বিশাখা পত্তম / ভাইজাক
সকাল ৫ টায় ব্যাংগালোর এয়ার পোর্টে এলাম । ৬-৩০ এ প্লেন টেক অফ করল । ৫০ মিনিট পর আমরা মাদ্রাজ বা চেন্নাই এয়ারপোর্টে নামলাম । সুন্দর ও ব্যস্ত এয়ারপোর্ট । হালকা নাস্তা দিল প্লেনে । এরপর জেট লাইট এয়ার লাইন্স এ করে ভাইজাক এর পথে যাত্রা । ১০-৩০ মিনিট এ প্লেন এ বোর্ডিং এই সময়টুকু এয়ারপোর্টে বসে বসে কাটালাম । জেট লাইট এর ৪৫ সিটার এর ছোট বিমানে ১ ঘন্টার মধ্যে ভাইজাক পৌঁছালাম ।
ভাইজাক এয়ারপোর্ট
ভারতের ইষ্টার্ণ নেভাল কমান্ড এর হেডকোয়ার্টার এই বিশাখা পত্তম । এই শহরটা মূলত গড়ে উঠেছে এই নৌবাহিনীর ঘাটিকে কেন্দ্র করে । এখানে ড্রাইডক এবং ওয়েল রিফাইনারী আছে । একদিকে পাহাড় ও অন্যদিকে সাগর। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এখানে এসে এখন বসতি স্থাপন করছে মূলত এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান ও নৌবাহিনীর সাথে সম্পর্কীয় জীবিকার জন্য । শহরে হোটেল আছে । বেশ সুন্দর শহর, পর্যটকও আসে অনেক তবে এটা সামরিক বাহিনীর প্রভাব সমৃদ্ধ শহর। নৌঘাটিতে ভারতের অনেক সাবমেরিন দেখলাম । সামরিক প্রস্তুতিতে ভারত বেশ এগিয়ে গেছে । দুপুর ১ টার দিকে ডলফিন হোটেলে এসে পৌঁছালাম । দ্রুত লাঞ্চ করতে গেলাম ৭ তলায় । সুন্দর ভাবে সাজানো খাবার তবে দৌড়ের উপর ১৫ মিনিটে খেতে হলো । তারপর বিকেলে সাবমেরিন দেখতে গেলাম।
সাবমেরিন মিউজিয়াম
১৯৭১ সালে এটা ব্যবহার হয়েছিল এখন এটা একটা মিউজিয়াম । রাশিয়া থেকে আনা ব্যাটারী চালিত প্রথম জেনারেশনের সাবমেরিন । এই প্রথম সাবমেরিন দেখলাম । বঙ্গোপসাগর এখানে উত্তাল । বীচ পাথরের ,তেমন বালুবেলা নেই । দিনটা বেশ ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল । গতকাল রাত ৩ টা থেকেই বেশ ব্যস্ততায় কাটছে সময় ।
০৭ আগস্ট ২০০৮, বৃহস্পতি সকালে নাস্তা করে ৮-৩০ এ রেডি হলাম । এরপর পোতাশ্রয়ের পাশে নির্মিত ডক ইয়ার্ড এ গেলাম । ডক এর ইতিহাস বলার পর বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখালো । এরপর ২ টা জাহাজে বেড়াতে গেলাম । পাহাড়ের চুঁড়ায় স্থাপিত বে ওয়াচ মেস কমপ্লেক্স । বিশাখা পত্তম এ সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনা মনে হলো । এটা নৌবাহিনীর অফিসারদের স্থাপনা । অনেক উন্নয়ন মূলক নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে । পাহাড় বেয়ে চুঁড়ায় উঠার পথে পার্কের মত সাজানো বাগান, বসার ব্যবস্থা ইত্যাদি আছে । সেখান থেকে ভাইজাক পোর্ট এলাকার চমৎকার দৃশ্যাবলী দেখা যায় । পোর্টের ও পার্কের নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় তুলে নিলাম।
বেলাভুমির দৃশ্যাবলী, ভাইজাক
পাহাড় চুঁড়ায় বে ওয়াচ মেস অসম্ভব সুন্দর জায়গা। অনেক নীচে সাগরের ঢেউ বেলাভুমিতে আছড়ে পড়ছে । পুরো এলাকা এখান থেকে দেখা যায় । নীচে নারিকেল বাগান ও সাগর বেলার অদ্ভুত দৃশ্য ভোলা যায় না । ভবিষ্যতে এটা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে । লাঞ্চ এর পর সবকিছু গুছিয়ে বিমান বন্দর এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম ১ ঘন্টা ২০ মিনিট ফ্লাইট টাইম, জেট লাইট এর সেই ছোট বিমান তবে আরামদায়ক । বিশাখা পত্তম বিমান বন্দর ছোট এবং এর সুবিধাও বেশ কম ।
কলকাতা
আমাদের বিমান পশ্চিমবংগের কলকাতার নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু অভ্যন্তরীণ এয়ারপোর্টে ৭ টার দিকে অবতরণ করল । কলকাতা প্রথম অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর না । কেমন যেন ময়লা ঘিঞ্জি মনে হয় । সবকিছু টান টান, আমাদের হোটেল লিটল রাসেল ষ্ট্রীটে। হোটেল পস হলেও আশপাশ ভাল লাগলো না । ১ ঘন্টা পর হোটেল কেনিলওয়ার্থ এ এসে পৌঁছালাম । হোটেলে এসে গোসল ও নামাজ পড়লাম । হোটেল বেশ সুন্দর ৫ তারা হোটেল । রাত ১০-৩০ এ খেতে বের হলাম । সব খাবারের দোকান বন্ধ । অনেকক্ষণ হেঁটে ডোমিনো পিজার দোকান খোলা পেলাম ১৫০ রুপি দিয়ে পিজা খেলাম । ১১-৩০ এ রুমে এসে সবকিছু গুছিয়ে ঘুম ।
০৮ ই আগস্ট সকালে উঠে হোটেলের ডাইনিং রুমে নাস্তা করতে গেলাম । বেশ সুন্দর বসার ব্যবস্থা নাস্তা শেষে ৯-৩০ এ শহর দেখতে বের হলাম । ফোর্ট উইলিয়ামে গেলাম, এটা ইষ্টার্ণ আর্মি কমান্ড হেডকোয়ার্টার । এখন বাইরে তেমন রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না । ব্রিটিশদের বানানো বাড়ীঘর গুলোই আছে । পরদিন আমার পুরো পরিবার বেড়ানোর জন্য ঢাকা থেকে কলকাতায় আসবে তাই দুপুরে তাড়াতাড়ি রুমে এসে দ্রুত বের হলাম হোটেলের খোজে । সন্ধ্যা ৬-৩০ পর্যন্ত হেঁটে আশপাশ ঘুরে বৃষ্টিতে ভিজে নিউ মার্কেট এর পাশে ১ টা হোটেল বুকিং দিলাম । ২৩০০ রুপি এক রাত্রি, কলকাতা ভাল লাগছে না । বাজে অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা হলো,আজ একজনকে হোটেল কোথায় দেখাতে বলায় লোকটা উল্টো দিকে দেখিয়ে দিল এবং একটা টেক্সি ড্রাইভার হোটেলে ফেরার সময় পুরো টাকাটা নিয়ে ১ কিঃমিঃ দুরে রাস্তায় নামিয়ে দিল। বৃষ্টি হচ্ছিল তাই ভিজতে ভিজতে হোটেলে আসতে হলো ।
সন্ধ্যায় নিউমার্কেটে গেলাম । আজ হঠাৎ করে কেন যেন বিরিয়ানী খেতে ইচ্ছে হলো । নিউমার্কেট এর পাশে ভাল বিরিয়ানীর রেষ্টুরেন্ট আছে, ঢুকে পড়লাম, মোটামুটি ভাল খাবার তবে ঝাল একটু বেশী এবং পরিবেশটা কেমন যেন ময়লা মনে হলো । খাওয়ার পর কিছু কেনাকাটা করলাম নিউমার্কেট ও আশপাশের এলাকায় তারপর হোটেলে ফিরে এলাম । কাল ঢাকা থেকে সবাই আসবে বিমানে । সকাল ৯-৩০ এ হোটেল ছেড়ে দিয়ে মার্ক হোটেলে আসলাম । ২৬০ রুপি দিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে আমি এয়ারপোর্ট এ এলাম ।
প্লেন এর আগমন পিছিয়ে গেল ১০-৩০ এ আসার কথা ছিল। হোটেল রাধুনীতে লাঞ্চ করে আমরা সল্ট লেকের সিটি সেন্টারে গেলাম এটা কলকাতার মূল অংশ থেকে বাইরে । সুন্দর জায়গা, ১৪০ রুপি নিল ট্যাক্সিতে । বেশ খোলামেলা ও পরিস্কার এলাকা । রাতে হোটেলে এসে ৩০০ রুপি দিয়ে খাবার অর্ডার দিলাম । আমরা আবার নিউমার্কেটে গেলাম রাত ১১ টার দিকে রুমে ফিরে ফ্রেস হয়ে ঘুম । আমার ছেলের এটা প্রথম বিদেশ সফর, এবার ওর জন্য পছন্দের ব্যাগ ও জুতা কেনা হলো । আম্মুও খুশি আল্লার রহমতে ।
ভারতীয় হলুদ এমবেসেডর ট্যাক্সি নেতাজী সুবাসচন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ রুপি নেয় । এটাই এখানকার ভাড়া তবে এদেশের টেক্সিতে আমাদের দেশের টেক্সির মত এসি নেই । কলকাতাবাসীদের এই গরম ও আর্দ্রতা সহ্য হয়ে গেছে । ১১ তারিখ সকাল বেলা নাস্তা করে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখতে গেলাম । হোটেল থেকে মানুষে টানা রিক্সা করে যেতে ইচ্ছে হলো । বেশ খুশি রিক্সাওয়ালা আমাদেরকে বলল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এ নিয়ে যাবে । ছবি তুললাম কয়েকটা । পরে পার্ক ষ্ট্রীট এ নামিয়ে দিল । সেখান থেকে ২ কিঃ মিঃ এর মত হেঁটে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখতে এলাম, রিক্সাওয়ালা ২০০ রুপি চায় । শেষে ১৫০ রুপি দিয়ে মান রক্ষা হলো ।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা
১৯২১ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নামে এটি তৈরি করা হয় । গম্বুজ বিশিষ্ট এ অট্টালিকাটির উচ্চতা ২০০ ফুট। ভবনটি একটি যাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে । এর ভিতরে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার সংস্পর্শে আসা পদক,অস্ত্রসস্ত্র,পান্ডুলিপি, মুদ্রা, ছবি, ব্যক্তিগত স্মারক, মানচিত্র প্রভৃতি সহ প্রায় ৩,৫০০ ধরণের জিনিষ পত্র দেখার ব্যবস্থা আছে । সতেরো বছরে এ ভবনটি তৈরী করতে ব্যয় হয়েছিল এক কোটি টাকা । ভবনটির সামনে মহারাণীর একটি বিরাট প্রতিকৃতি আছে । বাহির থেকে দেখলাম এর সুন্দর ভবনটা পরে আশেপাশের এলাকা ঘুরে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম । দুপুরে লাঞ্চ করে রাজধানী একত্রেযে দিল্লীর পথে রওয়ানা হবার জন্য তৈরী হলাম । ২ টা স্যুটকেস হোটেলে রেখে দিলাম। দিল্লী থেকে ফেরার পর থাকার জন্য বুকিং দিলাম ২ টা রুম।
শেয়ালদা ষ্টেশন থেকে আমাদের রাজধানী এক্সপ্রেস ছেড়ে যাবে । ট্যাক্সিতে ৭০ রুপি দিয়ে ষ্টেশনে এলাম । এই ষ্টেশন আমাদের ষ্টেশনগুলোর চেয়ে নোংরা কিন্তু বিশাল । রাজধানী এক্সপ্রেস এর প্লাটফর্মে হেটে হেটে আসতে হলো । এরা হাটতে অভ্যস্থ । আমরা একটু হলেই রিক্সা নিয়ে নিই । ষ্টেশন থেকে বেশ দুরে নামতে হলো । হেঁটে যেতে হবে । কুলি নিলাম না । ট্রলিব্যাগ টেনে আস্তে আস্তে রওয়ানা হলাম । বিশাল ষ্টেশন তবে ময়লা কাদা পানি ইত্যাদি চিরাচরিত তৃতীয় বিশ্বের চেহারা । ভিতরে টিকেট কাউন্টারে বিশাল লাইন ও ভিড় । আর্চওয়ে লাগানো আছে নিরাপত্তার জন্য তার মধ্যদিয়ে ষ্টেশনের ভিতরে ঢুকলাম । অনেকগুলো প্লাটফর্ম । আমাদের ট্রেনের জন্য প্লাটফর্ম হলো ৯ বি । পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে হেঁটে হেঁটে রওয়ানা হলাম । প্লাটফর্মে তখনো গাড়ী আসেনি। অনেক মানুষ । ছাউনি পিলারকে ঘিরে বসার সামান্য ব্যবস্থা । মাঝে মাঝে ফ্যান লাগানো আছে । নোংরা প্লাটফর্ম । ব্রডগেজ লাইন । আধাঘন্টা বসে দাড়িয়ে সময় কাটালাম । ওয়েটিং রুমও আছে । আমরা সেখানে না গিয়ে সরাসরি প্লাটফর্মে এসেছিলাম ।
সময়মত ট্রেন এলো । ট্রেন আসার পর বগি খুজে উঠে পড়লাম । টিকেট অনুযায়ী সিট । ৩ টায়ারের বগি । সামনা সামনি ৩ টা করে ৬ টা বার্থ করিডোরে ২টা বার্থ । তেমন সমস্যা হবে বলে মনে হলো না । প্লাটফর্মে ধুমপান করার নিয়ম নাই । একজন সিগারেট খেতে গিয়ে ধরা পড়ল পুলিশ এর হাতে । ওকে ধরে নিয়ে যাবেই । পরে সিনিয়র একজন পুলিশের কাছে অনুরোধ করে বল্লাম ভুল করেছে। যেন সমস্যা সমাধান করে দেয় । ৩ টায়ার এসি কোচ । আমরা ৪ জন একসাথে । আরও দুই জন প্যাসেঞ্জার সাথে ছিল তারাও বেশ ভাল। একজন দিল্লী হাইকোর্টের এডভোকেট,আরেকজন অবসর প্রাপ্ত ইনকাম ট্যাক্স কমিশনার,বাংগালী । একটা ছেলে ছিল বেশ স্মার্ট অভিষেক নাগ । এম বি এ করা দিল্লী থেকে । এখন বিদেশী ফার্ম এ ইন্টার্নী করছে। বেশ চটপটে । ট্রেন সময় মতই ছেড়ে দিল । প্রথমে নাস্তা দিল । জুস ও পানির বোতল । তারপর চা দিল । এরপর রাতের ডিনার । ভেজ ও ননভেজদের জন্য অর্ডার নিয়ে সুন্দর ভাবে সরবরাহ করে । প্রত্যেক বার্থের জন্য ২টা চাদর ১ টা তোয়ালে,১টা কম্বল ও ১ টা বালিশ আছে প্যাকেট করা । রাতের খাবার খেয়ে ১০ টায় গল্প শেষে ঘুমাতে গেলাম । আমরা ছাড়া নীচে বার্থে বাইরের দুইজন লোক। এসি ট্রেন তাই তেমন কোন সমস্যা নেই । টয়লেটও মোটামুটি পরিষ্কার, পানির ব্যবস্থা আছে ।
ট্রেনটা পশ্চিমবঙ্গ,বিহার,ঝাড়খন্ড ও মধ্যপ্রদেশ হয়ে দিল্লী যায় । মধ্যখানে কয়েকটা স্টেশনে থামে । পশ্চিম বাংলার শেষ ষ্টেশন ধানাবাদ, এখানে ট্রেন থামে । এরপর বিহার প্রদেশের পাটনা ষ্টেশন । তার আগে নজরুলের জন্মস্থান আসানসোল ষ্টেশনও পার হয়ে এলাম । পাটনাতে নাকি লাগেজ চুরি হয় । পাটনা পার হয়ে ঘুম দিলাম আল্লার নামে। ভোরে উঠলাম । মুখ হাত ধুয়ে নিতেই নাস্তা দিয়ে গেল । ভালই নাস্তা চা ও ছিল। ১০-৩০ এ দিল্লী পৌঁছানোর কথা। প্রায় ১২ টা বেজে গেল । ষ্টেশনে নেমে খবর পেলাম আমাদের টুরিস্ট বাস বাইরের একটা হোটেলের সামনে আছে । হেঁটে হেঁটে বাসের কাছে এলাম। আমরা ৫ টা ফ্যামিলি বড় ৩০ সিটের বাস দিল আমাদেরকে আমাদের ট্যুর অপারেটর । বেশ আরাম করে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ক্যারল বাগ এর সিলভার প্যালেস ও আপাতত আমাদের আস্তানা। জিনিস পত্র রেখে চেক ইন করে খেতে বাইরে গেলাম। সাউথ ইন্ডিয়ান ভেজ খাবারের বেশ ভাল হোটেল আছে । মিষ্টি ও বিভিন্ন রকমের মজার খাবার দাম তুলনামুলক ভাবে কম । মানসুরা দোসা অর্ডার দিল । আমরাও বিভিন্ন রকম খাবার অর্ডার দিলাম । মজা করে খেলাম। তারপর ক্যারলবাগ মার্কেটে কেনাকাটা ও ঘুরতে বের হলাম । রাস্তার দুপাশে সারি সারি বাজার প্রথমে কিছুক্ষণ হেটে দেখলাম। তারপর শাড়ী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা হলো। হোটেল থেকে ডলার চেইঞ্জ করে নিয়েছিলাম। পরে শাড়ীর দোকানেও ডলার চেঞ্চ করতে হলো এবং তারা ভাল দামে ডলার কিনে নিল। আজ ক্যারলবাগ ছাড়া দিল্লীর আর কোন জায়গা দেখা হলো না। আমার প্লান ছিল মেট্রোতে করে কনট প্লেস ঘুরে আসার । সময় হলো না।
পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলাম। হোটেল থেকে বাসে করে দিল্লী রেল ষ্টেশনে যেতে হবে । ভূপাল গামী শতাব্দী এক্সপ্রেস এ করে আমরা আগ্রা যাব। দিল্লী স্টেশনে এসে এর বিশালতা দেখে সবাই হতবাক কোন প্লাটফর্মে কোন গাড়ী কেউ বলতে পারে না। ৬ টা বেজে যায় যায়। পরে প্লাটফর্ম পাওয়া গেল। সুন্দর ট্রেন চেয়ার কোচ এসি আছে দুই ঘন্টার জার্নি। ট্রেনে উঠার পর নাস্তা দিল, বেশ ভালই। দু’ধারের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলছিলাম। এটাও নতুন একটা অভিজ্ঞতা। আগ্রা স্টেশনে ট্রেন থামল। এটা ক্যান্টনমেন্ট ষ্টেশন। এখানে ভারতের প্যারা ব্রিগেড আছে । স্টেশন এ সকালের ফ্রেসআপ করলাম। গোসল ও বাথরুম এর ভাল ব্যবস্থা আছে টাকা দিয়ে ব্যবহার করতে হয়। তারপর দিল্লীর একই বাস আমাদেরকে তাজমহল এলাকায় নিয়ে এলো। তাজমহলের কাছে সাধারণ যানবাহন যায় না। ২০ থেকে ৪০ রুপি দিয়ে পরিবেশ বান্ধব ব্যাটারী চালিত গাড়ীতে মানুষ আসা যাওয়া করে। আমরাও এরকম একটাতে উঠলাম। তাজমহলের গেটে আমাদেরকে ৭৫০ রুপি দিয়ে টিকেট কিনতে হলো । গেইট থেকে তাজমহল বেশ দুর। কয়েকটা ছবি তোলা হলো। তাজমহলের অপূর্ব দৃশ্য দেখে মনটা ভরে গেল। এই ভ্রমনে তাজমহল আমার দ্বিতীয়বার দেখা হলো। মার্বেল পাথরের এই স্বপ্নের স্থাপত্য,সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম আকর্ষণ। সম্রাট শাহজাহান-পতœী মমতাজ মহলের (আর্জুমন্দ বানুর ) সমাধিটি এখানে । এর প্রধান তোরণটি লাল বেলে পাথরের তৈরী । প্রধান স্মৃতি সৌধটি দুটি উঁচু বেদীর উপর অবস্থিত । এই মর্মর বেদীর চারদিক থেকে ৪টি মিনার উঠেছে । মিনার গুলো বেদী থেকে ১৩৭ ফুট উঁচু । এর ৩টি তল ও মোট ১৫৪ টি ধাপ আছে । চারকোণে ১০৮ ফুট উঁচু চারটি গম্বুজের মাঝে বড় গম্বুজটির উচ্চতা ১৮৭ ফুট । সৌধের মাঝখানে একটি আট কোণা ঘরে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর সমাধিগৃহ। সমগ্র সৌধে কোরানের বাণী উৎকীর্ণ। রং-বেরং এর ৩৫ ধরণের পাথরে যেন জ্বলছে সৌধটি । শিল্পির এ অনবদ্য কারুকার্যগুলো স্বপ্নের মতই । না দেখলে বুঝানো যায় না । তাই বুঝি পৃথিবীর সেরা শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় মূল্যবান পাথর আর মণিমুক্তায় গড়া এ সৌধটি আজও সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম। ১ ঘন্টা সময় ছিল আমাদের হাতে ঘুরে ফিরে সবাই বাসের কাছে এলাম। তারপর আমরা আগ্রাফোর্ট দেখতে গেলাম । ৫০০ রুপী দিলাম আমাদের খাবার কেনার জন্য । ভারতে বেড়াতে এসেছে কিন্তু তাজমহল দেখেনি এ ধরণের কথা শোনা যায় না । বিদেশীরা তো বটেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অজস্র লোকজন প্রতিদিন তাজমহল দেখতে ভীড় করে আগ্রাতে ।
পর্যটকদের দেখার জন্য একটা অন্যতম প্রধান স্থান এই আগ্রার তাজমহল। দুইবার তাজমহল দেখার সুবাদে বেশ ভাল ভাবেই দেখতে পেরেছি । চোখ দুটো শীতল হয়ে গিয়েছিল তাজমহলের বিশালতা ও অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে প্রথমবার দিল্লী থেকে বাসে করে আগ্রা গিয়েছিলাম । সেবার খুব ভোরে রওয়ানা হলাম । এসি লাক্সারী বাস । ট্রাভেল এজেন্ট সব ব্যবস্থা করল । দিল্লীর সীমানা পার হয়ে হরিয়ানা তারপর উত্তর প্রদেশ । তাজমহলের কাছাকাছি আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেল । পরিবেশ রক্ষা করার জন্য তাজমহল এর কাছে এখন কোন জৈব জ্বালানীর গাড়ি চলে না । ব্যাটারী চালিত মিনি বাসে করে তাজমহলের সামনে যেতে হয় । ভারতীয়দের জন্য ২০ রুপির মত ভাড়া তাজমহলে ঢোকার জন্য ৩ টা দরজা আছে । তবে মূল দরজা হিসেবে পশ্চিম দরজাকে ধরা হয় । এখানে নিরাপত্তা রক্ষীরা পর্যটকদেরকে চেক করে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয় । তার আগে টিকেট কিনতে হয়। ভারতীয়দের জন্য বিশ রুপি বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের লাগে সাতশত পঞ্চাশ রুপী । কি বিশাল ব্যবধান । যাক পাসপোর্ট দেখিয়ে টিকেট কিনলাম । সবকিছু চেক করে ভেতরে ঢুকলাম গেইট গুলো বিশাল বিশাল লাল স্যান্ড ষ্টোন বা বেলে পাথরে তৈরী । ভেতরে ঢোকার পর বিশাল খোলা জায়গা বাগানের মত আছে এবং ফ্লোরগুলো বেলে পাথরে বানানো ও বেশ সুন্দর এই জায়গাতে বিভিন্ন গেইট দিয়ে প্রবেশ করা পর্যটকদের সবাইকে জড়ো হতে হয় তাজমহলের মূল এলাকায় ঢোকার জন্য । ঢোকার জন্য বিশাল গেইট । এক সময় এই গেইট অনেক মূল্যবান ধাতু দিয়ে বানানো ছিল । তা লুট হয়ে যায় । এখন বিশাল ব্রোঞ্জের গেইট আছে । এটা খোলা থাকে । ঢোকার তোরণ বেলে পাথরের । এখানে কোরানের আয়াত ও বিভিন্ন নক্সা করা আছে মূল্যবান পাথর দিয়ে । এই এলাকাটা ফাঁকা ও বেশ বড় । সব কিছুই বিশাল । মনের ক্ষুদ্রতা তাই তাজের সামনে এলে শূন্য হয়ে যায় । গেইট দিয়ে তাকালেই দুরে অপূর্ব সুন্দর তাজমহল দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় । সারা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ পর্যটক এই তাজমহল দেখার জন্য ভারত ভ্রমণ করে । এই তাজমহল অবিরত ভারতের জন্য সৌভাগ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিচ্ছে । বিশাল সাদা মার্বেলের তাজমহল দূর থেকে অপূর্ব লাগে । কেন যেন বাইরের প্রচন্ড উত্তাপেও সেই তাজমহল মনে হয় বেশ শীতল । বহু পর্যটক এখানে দাড়িয়ে তাজমহলের ছবি তুলছে । প্রেমিক প্রেমিকা প্রেমের সমাধির ছবির সাথে নিজেদের ছবি মিলিয়ে নিচ্ছে । সিড়ি দিয়ে নীচে নামলে বিশাল উদ্যান ।
তাজমহল এলাকায় প্রবেশের গেইট থেকে তাজমহল পর্যন্ত বেশ দুর । এই জায়গাতে বাগান, পানির ফোয়ারা একটা চাতালের মতো উঁচু জায়গা , চলাচলের জন্য রাস্তা এসব আছে । লাল ইটের সবকিছু । বসার জন্য কয়েকটা সুন্দর চেয়ারও আছে । পর্যটকরা এখানে বসে ছবি তুলছে । ছবি তোলার জন্য কিছু বিশেষ জায়গা আছে সেখান থেকে তাজমহলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছবি আসে । অনেক প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান ভিতরে পর্যটকদের ছবি তুলে দিচ্ছে । ফেরার পথে ছবি সংগ্রহ করে নেয়ার ব্যবস্থা আছে । নীচে নেমে ডান,বাম ও সোজা হেটে তাজমহলে যাওয়া যায় । ডান বাম থেকে আবার দুটো রাস্তা তাজমহলের পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্বে গিয়েছে ।
তাজমহলের পেছনে আরও উত্তরে যমুনা নদী বয়ে চলছে । এখন প্রমত্তা যমুনা প্রায় মৃত । তাজমহল থেকে বেশ নীচে পানির ধারা দেখা যায় । নদীর ওপারে কিসের যেন একটা কারখানা ছিল । সেই কারখানার নির্গত সালফারের ধোয়াতে তাজমহলের সাদা মার্বেল পাথরের রং হলুদ ও কালো হয়ে গিয়েছে । এখন কারখানা বন্ধ করে সেখানে বাগানের মত বানানো হয়েছে । পূর্ব ও পশ্চিমে পথের পাশে গাছপালা আছে ছায়া দেয়ার জন্য । মধ্যের পথ দিয়ে ফোয়ারার পাশ দিয়ে দল বেধে পর্যটকরা তাজমহলের মূল ভবনে যাওয়ার জন্য এগিয়ে চলছে । প্রায় অধিকাংশ মানুষের এটাই প্রথম তাজ দর্শন । এক কথায় বলা যায় তাজমহলে মানুষকে হতাশ করে না, প্রেরণা দেয় । তাজমহলের ভেতরে জুতা নিয়ে ঢোকার নিয়ম নেই । প্লাষ্টিকের প্যাকেট পরতে হয় জুতার উপর অথবা জুতা খুলে জমা দেয়ার ব্যবস্থা আছে কিছু লোক এ কাজে নিয়োজিত । ফেরার পথে ওদের কিছু টিপস দিলে তারা খুশী । বেশ অনেক গুলো সিড়ি বেয়ে উঠে তাজমহলের খোলা আঙ্গিনাতে আসলাম । বেশ গরম আবহাওয়া । নীচে মার্বেল পাথর চার কোনায় চারটা উচু মিনার মূল ভবন এই আঙ্গিনার ঠিক মাঝে । মার্বেলের সৌধের মধ্যে বড় মিনার ও চারখানে ছোট ছোট মার্বেল পাথরের মিনার। নীল আকাশের নীচে বিশালতা সবাইকে মোহিত করে । যে কোন একদিক দিয়ে হাঁটতে থাকলে উত্তর দিকে নীচে দেখা যায় যমুনা নদী বয়ে চলছে । দুরে পূর্ব দিকে তাকালে আগ্রা ফোর্ট দেখা যায় । মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে শাহজাহান আগ্রা ফোর্ট এর বন্দী কুঠুরী থেকে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন । পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্বে লাল ইটের সুন্দর ভবন এগুলো মসজিদ, মানুষ নামাজ পড়ে এখানে। সময়ের সল্পতার কারণে আমরা যেতে পারিনি এসব দেখতে ।
এখনো তো মূল তাজমহলে ঢোকাই হয়নি । সিড়ি দিয়ে আবার উঠা , মার্বেল পাথরের সিড়ি মার্বেল এর ফ্লোর । সমাধি কক্ষের ঢোকার দরজা এবং সমস্ত দেয়াল মার্বেলের উপর নানা রকম রং এর মূল্যবান পাথর দিয়ে নক্সা করা প্রতিটি নক্সাই সুক্ষ্ম আলাদা কিন্তু আকর্ষণীয় । সাদার উপর ফুটে উঠেছে বিভিন্ন রং । আরবীতে কোরানের আয়াত আছে। গেইট এর পিলার গুলোতে। ভেতরে একটু অন্ধকার । ছবি তুলতে দেয় না । এখানে একটা এলাকা মার্বেল পাথর দিয়ে ঘেরাও করা দুটো সামাধি দেখা যায় এর ভেতরে । একটা শাহজাহান ও অন্যটা নুরজাহান এর , তবে মূল সমাধি এর নীচে । বর্তমানে মানুষকে যেতে দেয় না । রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে । ভিতরে চক্কর দিলাম দোয়া করলাম মৃত ব্যক্তির জন্য । তাজমহল দেখার আজন্ম সখ আল্লাহ পুরণ করলেন । এশিয়ার মধ্যে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন আজ দেখা হলো । তাজমহল থেকে ভারত বহু টাকা উপার্জন করে কিন্তু এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তেমন খরচ করে বলে মনে হলো না । গাইডদের কথার সুরে মোগল বাদশাদের প্রতি কটাক্ষ ও প্রচ্ছন্ন ঘৃণা প্রকাশ পায় । একেতো মুসলমান তারপর ভারত দখল করে শাসন করেছে তাই তাদের এই ক্ষোভ। যাক এসব ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মনোযোগ দিতে ইচ্ছে করল না । তাজমহলের বিশালতা মানুষের মনের ক্ষুদ্রতাকে হারিয়ে দেয় । তাজ দেখে এখন ফেরার সময় হয়ে এসেছে । আস্তে আস্তে নীচে নেমে এলাম । তারপর ফেরার পথ আবার সেই প্রবেশ পথে এসে ফিরে তাকালাম তাজমহলের দিকে যুগ যুগ ধরে এই তাজমহলের বিশালতা ও সৌন্দর্য এভাবে মানুষকে কাছে টেনে এনে আবার বিদায় জানিয়েছে । আমরাও বিদায় নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। তাজমহল দেখে বাইরে এসে বাসে করে আগ্রাকোর্টের দিকে যাত্রা করলাম ।