লস আলমাস যেখানে প্রথম এ্যাটম বোমার ডিজাইন করা হয়েছিল
যুদ্ধ শেষ। লস আলমাসে যেখানে এই এ্যাটম বোমা তৈরীর ডিজাইন করা হয়েছিল এবং বোমা বানানো হয়েছিল ( রবার্ট ওপেনহাইমার এই লস আলমাস ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর ছিলেন) সে জায়গার কি হবে? ওপেনহাইমার জানালেন “যাদের জায়গা তাদের ফিরিয়ে দেয়া হোক” মুল জায়গা ছিল রেড ইন্ডিয়ানদের। অর্থ্যাৎ ভেঙে ফেলা হোক কারখানা। বলা বাহুল্য এটাই ওপেনহাইমারের জীবনে প্রথম কাল হয়ে দেখা দিল। প্রশাসন তো অবশ্যই সেই সাথে নিজের কিছু সতীর্থও তার বিরুদ্ধে লেগে গেল। নিজের সতীর্থদের মাঝে যে মানুষটি সব থেকে কঠোর ভাবে ওপেন হাইমারের পেছনে লাগলেন তিনি হলেন এডওয়ার্ড টেলর। যিনি কিনা আইনষ্টাইনকে বোমা তৈরির তাল দিয়েছিলেন।
টেলর ওপেনহাইমারকে দেখতে পারতেন না, না দেখতে পারার কারন হল যখন এ্যাটম বোমা তৈরী হচ্ছিল তখন একটা ইউনিটের প্রধান হবার দাবীদার ছিল টেলর, কিন্তু তার দাবী অগ্রাহ্য করে ওপেনহাইমার আর একজনকে ওই ইউনিটের প্রধান করেন। প্রতিবাদে টেলর পারমানবিক বোমার থেকে আরো ভয়ংকর হাইড্রোজেন বোমা বানানোর গবেষনায় মন দেন। হাইড্রোজেন বোমা সে আবার কি জিনিস যা কিনা এ্যাটম বোমার থেকে মারাত্মক?
হাইড্রোজেন বোমার মুল উপাদান হাইড্রোজেন মৌল। এ্যাটম বোমা বানানোর মুল থিওরী হল পরমানুকে বিভাজন করে তা থেকে শক্তি পাওয়া যাকে ফিশন প্রক্রিয়া বলা হয়, অন্য দিকে হাইড্রোজেন বোমা তৈরীর মুল থিওরী হল চারটা হাইড্রোজেন পরমানুর সংযোজনে একটা হিলিয়াম উৎপাদন। যে প্রক্রিয়ায় এটা ঘটে মানে সংযোজন এটাকে বলে ফিউশন। এখানেও কিছুটা ভর হারিয়ে যাবার ব্যাপার আছে, আসলে এটা হারিয়ে না গিয়ে আইনষ্টাইনের থিওরী E=mc² মেনে শক্তি মানে এনার্জিতে (E) রূপান্তরিত হয়।
আমাদের চোখের সামনে সূর্য কিংবা অন্যান্য নক্ষত্রে কিন্তু এরকম ফিউশন চলছে সব সময়। সেক্ষেত্রে সেখানে কেন বোমা ফাটছে না? আসলে সুর্য বা নক্ষত্রে ফিউশন প্রক্রিয়া চলছে তিলে তিলে একটু একটু করে, তাই ওখানে এনার্জি প্রকাশিত হচ্ছে আলো এবং তাপের মাধ্যমে। কিন্তু হাইড্রোজেন বোমায় এনার্জি পাওয়া যায় মুহুর্তের মধ্যে প্রচন্ড তাপ এবং আলোর সাথে উপরি পাওনা ধাক্কার মাধ্যমে। হাইড্রোজেন বোমার ধ্বংস ক্ষমতা এ্যাটম বোমার থেকে হাজার গুন। লস এ্যালমাসে যখন এ্যাটম বোমার তৈরীর কাজ চলছে তখন বস ওপেনহাইমারকে হাইড্রোজেন বোমা তৈরীর অনুরোধ করে টেলর। ওপেনহাইমার তা খারিজ করে দেন। সে রাগও ছিল টেলরের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাইড্রোজেন বোমা তৈরী হয়।
এডোয়ার্ড টেলর
সে সাফল্য আসল কিছুটা বিচিত্র পন্থায়। যুদ্ধের পর টেলর এবং তার সমমনা বিজ্ঞানীরা উঠে পড়ে লাগলেন সরকারকে বুজাতে যে তাদের হাইড্রোজেন বোমা তৈরীর দিকে এগোন উচিত। কিন্তু ওপেনহাইমার তখন এ্যাটম বোমার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অনুতপ্ত। তিনি চাচ্ছিলেন না, আর কোন নতুন কিছু তৈরী হোক। উপরন্ত এ্যাটম বোমা সংক্রান্ত সমস্ত গোপনীয়তা উঠে যাক যুদ্ধকালীন মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর থেকে। আসলে তা গোপন থাকেনি, ঠিকই গুপ্তচর মারফতে ষ্ট্যালিন সব খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে অন্য গল্প অন্য কোন দিন শোনাব। ওপেনহাইমারের ইচ্ছা ছিল যদি এ্যাটম বোমা তৈরীর কৌশল সবাই জানে সে ক্ষেত্রে এর ওপর একটা আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রন থাকবে, এবং ভবিষ্যতে কেউ আর এই মারনাস্ত্র তৈরীতে সাহস পাবে না।
ওপেনহাইমারের এই মত গুরুত্বপূর্ন হয়ে দাড়াল আর একটা জায়গায় সেটা হল আমেরিকার এ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের বিশেষ শাখা জেনারেল এ্যাডভাইসারি কমিটিতে। ওপেনহাইমার নিজে এই কমিটির চেয়ারম্যান এবং এর সদস্য হল সেকালের সব বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল এ্যাটম বোমার পর আমেরিকা কি হাইড্রোজেন বোমা বানানোর দিক অগ্রসর হবে কিনা, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে সরকার কে। অনেক দীর্ঘ আলোচনার পর ওপেনহাইমারের নেতৃত্বাধীন কমিটি রিপোর্ট দিল না উচিত হবে না। এক্ষেত্রে ধ্বংস বিরোধী হিসাবে তার একটা ইমেজ তৈরী হল কিন্তু একই সাথে কট্টর জাতীয়তাবাদীদের বিরোধিতার মুখেও পড়লেন।
ওপেনহাইমারের কমিটি তার রিপোর্ট দিল ১৯৪৯ সালের নভেম্ভরের গোড়ার দিকে, তার কিছুটা আগেই শুরু হয়ে গেছে বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ন পট পরিবর্তন। ১৯৪৮ সালে চেকোশ্লাভাকিয়ার ক্ষমতা দখল করে নেয় কম্যুনিষ্টরা। তৈরী হয়েছে রাশিয়ার তাবেদার সরকার। একই বছর “বার্লিন ব্লকেড” ( কোল্ড ওয়ারের সময় প্রথম মেজর ক্রাইসিস) । রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বকে বুজিয়ে দিয়েছে তাদের সে মোটেই কেয়ার করে না। ওদিকে ১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকে বেইজিং সরকারকে হঠিয়ে মাও জে দং এর কম্যুনিষ্ট সরকার ক্ষমতা দখল করছে। পুজিবাদী আমেরিকার জন্য সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে ঘটে আর এক ঘটনা, আমেরিকার হিসাব ছিল সব মিলিয়ে ৫২-৫৩ র আগে রাশিয়া এ্যাটম বোমা ফাটাতে পারবে না, কিন্তু ১৯৪৯ সালের শরতে রাশিয়া পরীক্ষামুলক এ্যাটম বোমার বিস্ফোরন ঘটায়। রুশ বিজ্ঞানীদের এমন সাফল্যে ঘুম হারাম হয়ে গেল আমেরিকার। কিভাবে ষ্ট্যালিন এত তাড়াতাড়ি এ্যাটম বোমা বানানোর প্রযুক্তি পেয়ে গেল? এই প্রশ্নের জবাব জানার জন্য আমেরিকা হন্যে হয়ে ঘুরছে।
জার্মান গুপ্তচর ক্লস ফুকস
জবাব জানা গেল ১৯৫০ সালের ২৭শে জানুয়ারি। লন্ডনের ওয়ার অফিসে গিয়ে জার্মান গুপ্তচর ক্লস ফুকস স্বীকারোক্তি দিলেন ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত গবেষক হিসাবে ব্রিটিশ মার্কিন বোমা প্রকল্পের সাথে যুক্ত থাকার সময় সব তথ্য রাশিয়ায় পাচার করেছে। কতখানি তথ্য? এ্যাটম বোমা থেকে শুরু করে টেলরের হাইড্রোজেন বোমা সংক্রান্ত যত গবেষনা হয়েছে তার সবটাই রাশিয়ায় পাচার হয়েছে। এযেন বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ততক্ষনে রেগে মেগে কাই। ১৯৫০ সালের ৩০শে জানুয়ারি বিশেষ নির্দেশে সই করলেন এক্ষুনি হাইড্রোজেন বোমা তৈরীর কাজ পুরোদমে শুরু হোক।
ফুকসের স্বীকারোক্তির পর বিপদে পরে গেলেন আমেরিকার অনেক বড় বড় মহারথীরা। সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থি চিৎকার জুড়ে দিলেন হলিউড থেকে শ্রমিক ইউনিয়ন সব জায়গায় নাকি ছেয়ে গেছে রাশিয়ান চরে। খুজে দেখা হোক সব ভি আই পির অতীত রেকর্ড। এ্যাটম বোমার জনক হিসাবে বাদ গেলেন না ওপেনহাইমার এই তল্লাশির শিকার হতে বাধ্য। ১৯৫৩ সালের নভেম্ভরে কংগ্রেসে জয়েন্ট এ্যাটমিক এনার্জির একজন সদস্য ওপেনহাইমারের রেকর্ড ঘেটে রায় দেনঃ “মোর প্রোবাললি দ্যান নট রবার্ট ওপেনহাইমার ইজ এ্যান এজেন্ট অব দ্যা সোভিয়েট ইউনিয়ন।” নতুন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার তুলে নিলেন ওপেনহাইমারের সব সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স। অর্থ্যাৎ পরমানু বোমার জনক হিসাবে তার ওপর সাধারন নাগরিকদের জন্য এ সংক্রান্ত যে বিধি নিষেধ ছিল তা থেকে এত দিন মুক্ত ছিলেন, সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স তুলে নেয়ায় অন্য সবার সঙ্গে তিনিও এক কাতারে এসে দাড়ালেন।
এইবার প্রশাসন তৈরী করল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, যার মধ্যে অন্যতম ছিল আমেরিকাকে হাইড্রোজেন বোমা তৈরী থেকে পিছু হঠতে বলে, পক্ষান্তরে ষ্ট্যালিনকে মদদ দেয়া। ওপেনহেইমার ঘোষনা দিলেন এ অপবাদ মিথ্যা। তিনি দাড়াবেন কমিশনের পার্সোনাল সিকিউরিটি বোর্ডের সামনে। এতো তদন্ত না এ যে বিচার! আমেরিকার সাধারন মানুষের মনে তখন তিনি এ্যাটম বোমার জনক হিসাবে হিরো, সেই ওপেনহাইমার কিনা ষ্ট্যালিনের গুপ্তচর?
শুরু হল ওপেনহাইমারের বিচার। সহজ হল না সে বিচার। কয়েক দিন আগে এ্যাটম বোমা তৈরীর সর্বেসর্বা হিসাবে যিনি ছিলেন প্রায় অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী তিনিই এখন বিচারের মুখোমুখি। যিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম নিয়ন্ত্রা তিনিই কিনা আজকে সওয়াল জবাবের মুখোমুখি যে তিনি দেশোদ্রোহী কিনা? ফ্রিডম অভ ইনফরমেশান এ্যাক্ট অনুযায়ী তত দিনে প্রকাশ হয়ে গেছে বেশ কিছু নথিপত্র। ওপেনহাইমারের টেলিফোনে আড়িপেতে তার বন্ধু বান্ধবের সাথে যে কথা বলা হয়েছে, তাও প্রকাশিত।
এফ বি আই র প্রথম প্রধান জন এডগার হুভার
ক্ষমতার চুড়ান্তে যারা থাকে তাদের যখন পতন হয় তখন তাদের শত্রুও থাকে ক্ষমতার চুড়ান্তে, এটা প্রকৃতির নিয়ম। এ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান লুইস ষ্ট্রস, জয়েন্ট কমিটি অভ এ্যাটমিক এনার্জির ডিরেক্টর উইলিয়াম বোরডেন, এফ বি আই র প্রধান জন এডগার হুভার (ইনি কিন্তু এফ বি আই এর প্রথম ডিরেক্টর আন অফিশিয়ালি তাকে এফ বি আই এর প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয়), সেনেটর ম্যাকার্থি। তবে সব থেকে বড় শত্রু হয়ে দেখা দেয় সেই বিজ্ঞানী টেলর। বিচারে তাকে সাক্ষ্য দিতে ডাকলে প্রশ্ন করা হয়, “আপনি কি মনে করেন ওপেনহাইমার দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।”
টেলর জবাব দিলেন, “আমি ওকে অনেকবার এমন আচরন করতে দেখছি, যার মানে বোজা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য….. তাই আমি বলব এই ধরনের কাজের ভার এমনকারো ওপর ন্যাস্ত করা হোক যাকে আর একটু ভালোভাবে বুজতে পারি এবং ভরসা করতে পারি”
আবারো টেলর কে প্রশ্ন করা হল, “ওপেনহাইমার কে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ছাড়পত্র দিলে, দেশের নিরাপত্তা কি বিঘ্নিত হবে?”
টেলরের উত্তর “ না দেয়াই বিচক্ষনতার লক্ষন হবে।”
সমস্ত সাক্ষ্য প্রমান বিচার করে ১৯৫৪ সালের ২৭শে মে পার্সোনাল সিকিউরিটি বোর্ড রায় দিল, “ওপেনহাইমার দেশোদ্রোহী না, তবে তার নিরাপত্তা ছাড়পত্রও আর দেয়া হবে না।” বোর্ডের জুড়িদের ২-১ ভোটে রায় দেয়া হয়। ২৯শে জুন এ্যাটমিক এনার্জি কমিশান একই রায় দেয় ৪-১ ভোটে। মানে হল যে লোকটা একটা বিশ্বের সব থেকে গোপন প্রজেক্ট চালিয়েছে (ম্যানহাটান প্রজেক্ট) সেই লোকটার আর কোন অধিকার রইল না আমেরিকার কোন সাধারন গোপন কিছু দেখার। মানে আর দশটা সাধারন মানুষের মাঝে তার কোন পার্থক্য রইল না।
আমেরিকা হাইড্রোজেন বোমা ফাটায় ১৯৫২ সালের ১ লা নভেম্ভর। সে পরীক্ষায় প্রশান্ত মহাসাগরের একটা আস্ত দ্বীপ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। হিরোশিমা নাগাসাকির এ্যাটম বোমার ক্ষত তখনো শুকায় নি এর মাঝে এ্যাটম বোমার থেকে হাজার গুন শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরনে অনেকেই নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে, সে সময় ওপেনহাইমারের এই বিচার তাকে নায়ক থেকে একজন খলনায়কে পরিনত করা প্রশাসনের জন্যও প্রয়োজন ছিল। শেষ জীবনে যারা তাকে কাছ থেকে দেখছে তারা বর্ননা করছেন তাকে একজন “ব্রোকেন ম্যান” হিসাবে। ১৯৬৭ সালের ১৮ই জানুয়ারী গলার ক্যান্সারে তার মৃত্যু হয়।
ওপেনহাইমার নায়ক না খলনায়ক? এ প্রশ্ন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। ঐতিহাসিকরা ডিক্লাসিফায়েড হওয়া বিভিন্ন নথিপত্র ঘেটে চলছেন এখনো, এতে আস্তে আস্তে উন্মোচিত হচ্ছে এক অন্য ওপেনহাইমার। যেমন ধরা যাক একটা চিঠি যেটা ১৯৪৩ সালের ২৫শে লিখছিলেন তার সতীর্থ (পরে নোবেলজয়ী) বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মিকে। এ্যাটম বোমা আবিস্কার তখনো অনেক দেরী। সেখানে ফার্মি প্রস্তাব দিয়েছিলেন শত্রু দেশের নাগরিকদের ধ্বংস করার জন্য তাদের খাবার বা পানিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ষ্ট্রনশিয়াম মেশানো। প্রস্তাবে আপত্তি করেন নি ওপেনহাইমার। বলছিলেন একটু সবুর কর অন্তত পাচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করতে না পারলে এ কাজে নামা ঠিক হবে না।
এ্যাটম বোমা বানানোর শেষ পর্যায়ে, এখন এর প্রয়োগ কোথায় করা হবে? কাদের লক্ষ্য করে? কোন বিবেচনায় কোন দেশে? এসব প্রশ্নের জবাব জানার জন্য যুদ্ধ সচিব হেনরি ষ্টিমসন সাত সদস্যের এক কমিটি বানান যাদের কাজ হবে এই সব প্রশ্নের জবাব ঠিক করে সরকারকে সাজেশান দেয়া কোথায় বোমা ফালানো যায়? ওপেনহাইমারের সহকর্মী বিজ্ঞানী আর্নেষ্ট লরেন্স (ইনিও নোবেলজয়ী) সাজেশান দিলেন, আগে ভাগে ঘোষনা দিয়ে কোন ফাঁকা জায়গায় বোমা ফাটানো যাক। জাপানীরা দেখুক এই বোমার দাপট, তাহলে ভয় পেয়ে আত্মসমর্পন করবে। এর বিপরীতে ওপেনহাইমারের বক্তব্য ছিলঃ মরুভুমিতে বাজির প্রদর্শনী দেখিয়ে ভয় পাওয়ানো যাবে না জাপানীদের। যুদ্ধ সচিব ষ্টিমসনের পছন্দ হল ওপেনহাইমারের বুদ্ধি। হিরোশিমার বুকে সফল বিস্ফোরনের পর জেনারেল গ্রোভস কনগ্রাচুলেট করে ওপেনহাইমারকে ফোন দিলেন –
গ্রোভসঃ আপনি ও আপনার সহকর্মীদের জন্য আমি দারুন গর্বিত
ওপেনহাইমারঃ সব কিছু ঠিক ঠাক ছিল?
গ্রোভারঃ বিস্ফোরন মনে হচ্ছে বিশালই ছিল।
ওপেনহাইমারঃ ঠিক। সবাই এ ব্যাপারে খুশী। আমার তরফ থেকে সবাইকে অভিনন্দন। অনেক দিনের কাজ আমাদের।
যে অভিযোগে ওপেনহাইমারকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল মানে কম্যুনিজমের সাথে সম্পর্কের কারনে যা আসলে এখনো প্রমানিত হয়নি, তবে ওপেনহাইমার যাকে বিয়ে করছিলো নাম ক্যাথেরিন। ক্যাথেরিনের আগের স্বামীর নাম ছিল জো ড্যালেট, স্পেনের কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতা ছিল। ১৯৪৩ সালের জুন মাসে ওপেনহাইমার গোপনে এক রাত কাটান জিন তাতলকের সাথে। জিন ছিল কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্য। ওপেনহাইমারের ভাই ও তার স্ত্রী ছিল ওই কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্য।
রাশিয়ান গুপ্তচরেরা যে তার ভাই ফ্রাংকের সাথে যোগাযোগ করছিলো ওপেনহাইমার সে কথা জেনারেল গ্রোভসকে জানিয়ে দেয়, এবং কথা আদায় করে যে সে যেন এটা কারো কাছে না প্রকাশ করে, কিন্তু এ কথা চলে যায় এফ বি আই য়ের প্রধান হুভারের কাছে। ওপেনহাইমারের বিচারের সময় এফ বি আই প্রধান হুভার জেনারেল গ্রোভস কে শাসায় যদি সে বিচারের সাক্ষ্য প্রমানের সময় একথা চেপে যায় তবে তাকেও শাস্তি পেতে হবে। সাক্ষী দেবার সময় গ্রোভার বলে দেন যে ওপেনহাইমারের ভাইর সাথে সোভিয়েত গুপ্তচররা যোগাযোগ করছিলো। এই ঘটনা বিচারে ওপেনহাইমারের বিপক্ষে চলে যায়।
ওপেনহাইমার কি নিজে কম্যুনিষ্ট ছিল? এ প্রশ্নের জবাব পাবার জন্য লেখা হয়েছে লেখক গ্রেগ হারকেন লিখছেন “ব্রাদারহুড অভ দ্য বম্ব”। গ্রেগ হারকেন নিজে ইয়েল এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইনিষ্টিটিউট অভ টেকনোলজির প্রাক্তন অধ্যাপক। ওয়াশিংটনে স্মিথসোনিয়ান ইনিষ্টিটিউটের এয়ার এ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের কিউরেটর এই মানুষটি কাগজপত্র ঘেটে যা বের করেছেন ওপেনহাইমারের বিচারের সময় এফ বি আই ও তা পারে নি। ওই বইতেই হারকেন দেখিয়েছেন সরাসরি কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্য না হলেও ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত কম্যুনিষ্ট পার্টির একটা গোপন শাখার সদস্য ছিলেন ওপেনহাইমার। এছাড়া কম্যুনিষ্ট পার্টি অভ ক্যালিফোর্নিয়ার কলেজ ফ্যাকাল্টিজের প্রতিবেদনগুলো নাকি গোপনে ওপেনহাইমার নিজে লিখে দিয়েছেন। এর মানে কি তিনি সোভিয়েত চর ছিলেন? তার কোন সরাসরি প্রমান বইতে পাওয়া যায় না।
লাখ মানুষের হন্তারক এ্যাটম বোমার জনক ওপেনহাইমার আবার তার থেকেও ভয়ংকর হাইড্রোজেন বোমা বানানোর বিরোধিতা করে হিরো থেকে জিরো হয়েছেন, হয়েছেন বিচারের মুখোমুখি, রাষ্ট্রদ্রোহিতার (সে সময় কম্যুনিজমের সাথে গোপনে যোগাযোগ থাকা মানেই ছিল এক রকম রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগ) অভিযোগে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে হয় সব রকম সিক্যুরিটি ক্লিয়ারেন্স (এটা কিন্তু তার অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মারাত্মক অপমান ছিল), কম্যুনিজমের সাথে পরোক্ষ যোগাযোগ (কম্যুনিজম ভালো কি মন্দ সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর, তখন তার অবস্থানের প্রেক্ষিতে তা মারাত্মক অন্যায় বলে বিবেচিত হত) আমেরিকান সমাজে তাকে করেছে অপমানিত। যার কারনে শেষ জীবন কাটিয়েছে “ব্রোকেন ম্যান” হিসাবেই। একেই কি প্রকৃতির অভিশাপ বলে?
এর প্রথম পর্ব বিজ্ঞান যখন চলে যায় রাজনীতির অধীনেঃ একজন ওপেনহাইমারের উত্থানের গল্প, পতনের গল্প অন্যদিন
মুল লেখাঃ এ্যাটম ফর পীস এ্যান্ড ওয়ার বইটির লিঙ্ক (Atoms for Peace and War) এর সাথে আরো অনেক অন্তর্জাল প্রবন্ধ। ছবিঃ অন্তর্জাল।
প্রথম হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরন দেখুন
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২০ রাত ১২:৫১