চলুন কিছু প্রাচীন সভ্যতার খোজ নিয়ে আসি। এগুলো সব হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা। হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা যখন পড়ি আমি তখন হারিয়ে যাই ইতিহাসের স্বর্নালী দিন গুলোতে ওই সব জাতির সাথে। যদিও এই স্বর্নালী সময় বা জাতির সাথে রক্তপাতের এক ওত প্রোত সম্পর্ক আছে, তবে রক্তপাতের সাথে কাদের ই বা সম্পর্ক নাই। যে আধুনিক সভ্যতা নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করি সেই আধুনিক কালে রক্তপাত অতীতের যে কোন সময়ের থেকে বেশী যে কোন জাতির ইতিহাসের তুলনায়, কিন্তু আমরাই সভ্যতার গর্বে বলীয়ান হয়ে তাদের অসভ্য নাম দেই। চলুন ঘুরে আসি কিছু প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া জাতির সাথে।
ওলমেক সভ্যতা
Olmec Civilization map
প্রাক কলাম্বিয়ান আমেরিকার আদিসভ্যতা হচ্ছে ওলমেক সংস্কৃতি। মেক্সিকোর ক্যারিবিয়ান অঞ্চল জুড়ে ছিল এই সভ্যতা। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ – ৪০০ সাল আব্দি এই সভ্যতা বিরাজ ছিল। ১৮৬২ সালে মেক্সিকোর এক স্যাতস্যাতে অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য খোড়াখুড়ি করতে গিয়ে বেড়িয়ে এল বিরাট এক পাথরের টুকরা। চাষীরা ভাবল এখানে বোধ হয় গুপ্তধন পাওয়া যেতে পারে, তাদের মনোবাঞ্চা পুরন হল না কিন্তু প্রত্নতাত্বিকরা পেয়ে গেল তাদের কাংখিত গুপ্তধন। প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার প্রথম নিদর্শন পাওয়া গেল।
a seated person resembling an infant are unique to Olmec art
“ওলমেক” শব্দটি এসেছে এ্যাজটেক সভ্যতার “নাহুতাল” ভাষা থেকে। শব্দটির মানে “রাবার পিপল”। তাদের আদি নিবাস ধরা হয় আফ্রিকাতে, সেখানে থেকে বহু পথ পেরিয়ে কিভাবে ওলমেকরা কিভাবে আমেরিকায় এসে পৌছেচে তা আজো নির্নয় করা সম্ভব হয়নি।
তাদের সূক্ষ্ম খোদাইয়ের কাজ, বিরাট ভাস্কর্য্য, ভাষার ব্যাবহার, গনিত শাস্ত্রে পান্ডিত্য আর বর্ষপঞ্জী প্রত্নতাত্বিকদের অবাক করে দেয়। পশ্চিমা সভ্যতায় ওলমেকরাই সম্ভবতঃ প্রথম জাতি যারা লিখন পদ্ধতি আবিস্কার করেছিল। ওলমেকরা পিরামিডও বানাতে জানত (এটা আমার কাছে এক অদ্ভুত ব্যাপারই মনে হয় যে আদি সভ্যতার প্রায় সবাই পিরামিড বানাতে পারত)। মায়া সভ্যতার বর্নমালা ওলমেক সভ্যতার প্রভাবেই গড়ে উঠছে বলে মনে করা হয়।
A pyramid from the Ancient Olmec civilization
প্রত্নতাত্বিকরা চারটি স্থানে মায়া সভ্যতার নিদর্শন খুজে পেয়েছে। স্থানগুলো হল লেগুনা ডি সরোস, সান লরেঞ্চো, ট্রেস জপোটেস আর লা ভেনতা। এই লা ভেনতায় সিড়িযুক্ত একটি পিরামিড পাওয়া গেছে খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ থেকে ৫০০ বছর পূর্বে এই ওলমেক সভ্যতার এই শহর উন্নতির চরমে উঠেছিল। প্রত্নতাত্বিকরা মনে করেন আকাশের গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে যথেষ্ট ধারনা ছিল, নতুন ধরনের ফসল আবাদ করতে চাইত, তাদের ছিল শিল্প বোধ, সম্ভবতঃ ওলমেকরাই আমেরিকার প্রথম সভ্য জাতি। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে হঠাৎ করে তারা হারিয়ে গেছে, তাদের কিভাবে বিলুপ্তি ঘটেছে তা নিয়ে প্রত্নতাত্বিকরা এখনো ধারনা করতে পারেনি।
মায়া সভ্যতা
মায়া সভ্যতা প্রায় ৪০০০/ ৫০০০ বছর পুরানো, গুয়াতেমালা এবং উকাটানের জঙ্গলে গড়ে উঠেছে এই সভ্যতা। আমেরিকার জঙ্গলের নীচে হারিয়ে যাওয়া মায়া সভ্যতার বিশাল এক শহর আবিস্কৃত হয়েছে। সেখানে পাওয়া যায় ২৩০ ফুট উচু পিরামিড। মায়া সভ্যতা এখনো বিস্মের এক বিস্ময়। মায়ারা এমন এক নির্ভুল পঞ্জিকা আবিস্কার করেছিল যা চার কোটি বছরেও পরিবর্তনের প্রয়োজন হবেনা।
তাদের কারিগররা আগ্নেয়শিলা দ্ধারা বড় বড় বাড়ী করতে পারত। মিশরীয়দের মত মায়া জাতির লোকেরাও জীবনের অমরত্বে বিশ্বাস করত। সে জন্য তারা পিরামিড তৈরী করত। গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে তাদের জ্ঞান ছিল অবিশ্বাস্য। তারা ইউরেনাস এবং নেপচুনের কথাও জানত অথচ আধুনিক মানুষ এই ইউরেনাস এবং নেপচুনের কথা জানে ১৭৮১ সালে এবং ১৮৪৬ সালে।
আবিষ্কৃত মায়ান পান্ডুলিপি থেকে যতদূর জানা যায়, তাতে বোঝা যায় ভাষার লৈখিক রূপ হিসেবে তাদের কোনো বর্ণমালা ছিল না। তবে কি তাদের ভাষা ছিল না? না। এমনটি নয়। তাদের ভাষা অবশ্যই ছিল, যেটা দিয়ে তারা ভাবের আদান-প্রদান করত। তবে বর্ণের পরিবর্তে তারা ব্যবহার কত কিছু সাংকেতিক ছবি বা চিহ্ন। এইসব সাংকেতিক ছবি পাশাপাশি এঁকে তারা তাদের ভাব বোঝাত। যেহেতু কলম আবিষ্কার হয়নি তখনও। তাই লিখত তারা তুলি দিয়ে। আর লেখার জন্য ব্যবহৃত বিশেষ এই তুলি বানাত তারা পশুর লোম কিংবা লেজ দিয়ে। বই বানাত তারা গাছের বাকল দিয়ে। এই বইগুলোকে কোডেক্স বলা হয়। গবেষণায় জানা যায়, তাদের ভাষায় ব্যবহৃত এসব ছবির সংখ্যা হিসেব করলে আট শ’ কিংবা তারও বেশি পাওয়া যায়। আর কোডেক্স তথা বই উদ্ধার করা গেছে মোট চারটি।
এবার একটু তাদের দেবতাদের পরিচয় দিই। প্রধানতম দেবতা ইতজামনা। তাদের মতে ইনি ছিলেন মহান শক্তির আধার। তিনি আকাশচারী দেবতা। মায়ান ধর্মীয় নেতা বা যাজকগণ এই দেবতার নামে নরবলি করত। আর এটাই নাকি ছিল এই দেবতাকে খুশি করার উপায়। নরবলির জন্য তারা বেছে নিত বিশেষ সময়। সময়ানুযায়ী পিরামিডের উপর গিয়ে করা হত নরবলি। আর এক্ষেত্রে তারা তাদের নিজেদের ক্যালেন্ডারও অনুসরন করত। বলিদানের সময় অনুসরণ করা হত এজটেক রীতি। এই রীতিমত বলিকৃত মানুষটার বুক চিরে ফেলা হত, বের করে আনা হত হৃদপিণ্ড এরপর দেবতার সামনে বিসর্জন দেয়া হত। আর সেই মৃত মানুষের অন্যান্য অঙ্গ যেমন হাত, পা রেখে দিত তারা নিজেদের কাছে। আরো বিস্ময়কর এবং ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, এই বলির শিকার যারা হত, তারা কেউই তাদের নিজেদের জাতির কেউ ছিল না। ভুলক্রমে বা কোনোভাবে যদি অন্য কোনো সমাজ বা জাতির কোনো লোক তাদের রাজ্যে এসে পড়ত তাদেরকেই হতে হত ভয়ঙ্কর এই নরবলির শিকার।
মায়া পতনের পরিবেশদূষণহীন তত্ত্ব বেশ কয়েকটি উপবিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যেমন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, বিদেশী আক্রমণ, চাষি বিদ্রোহ, এবং বিশেষ বাণিজ্য পথের পতন। পরিবেশগত অনুমানের মধ্যে পরিবেশগত দুর্যোগ, মহামারী রোগ, এবং জলবায়ু পরিবর্তন রয়েছে। মায়া জনগোষ্ঠীরা কৃষি সম্ভাবনাময় অবসাদ ও অতিরিক্ত প্রাণী শিকারের মাধ্যমে পরিবেশের বহন ক্ষমতা অতিক্রম করে ছিল বলে প্রমাণ রয়েছে। কিছু পণ্ডিত সম্প্রতি অনুমান করছে যে ২০০ বছরের একটি তীব্র খরা মায়া সভ্যতার পতনের কারণ। খরা তত্ত্বটি ভৌত বিজ্ঞানীরা লেক তলদেশ, প্রাচীন পরাগরেণু এবং অন্যান্য তথ্য গবেষনা করে পেয়েছেন।
এ্যাজটেক সভ্যতা
ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ জাঁক সুস্তেল সন্ধান দিয়েছেন মেক্সিকোর প্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতার। ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এই সভ্যতার নিদর্শন। ১৬ শতকের দ্বিতীয় দশকে নৃশংস স্পেনীয় বাহিনীর আক্রমণের ফলে অ্যাজটেক সভ্যতার অকাল মৃত্যু ঘটেছিল। পুরাতাত্ত্বিক অভিযানের দরুন জানা গেছে এই বিচিত্র ও উজ্জ্বল সভ্যতার কথা।
৩০০ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে অ্যাজটেক সভ্যতায় দেবরাজ কুয়েটজালকোটল এর পূজা হতো। এই দেবতা ছিল পালকঅলা সাপ। এই সাপ মানুষকে রুপার নানারকম শৈল্পিক জিনিস তৈরি করতে শিখিয়েছে। অলঙ্কারে দামি পাথর বসানোর কাজ শিখিয়েছে। বর্ণমালা সাজিয়ে বই লেখার কাজও শিখিয়েছে। কৃষিকাজে মানুষকে ভুট্টা চাষ শিখিয়েছে। গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে সময়ের হিসাব রাখতে শিখিয়েছে। মানুষ এক সময় শুধু গাছগাছড়ার শিকড় খেত। এক পাহাড়ি গর্তে ভুট্টা লুকানো ছিল। কুয়েটজালকোটল তখন একটি কালো পিঁপড়ে হয়ে সেই গর্তে ঢুকে পড়ে।
Chichen Itza - Ancient History Encyclopedia
মেক্সিকোর ইউক্যাটন স্টেটের রাজধানী মিরিডা থেকে ৭৫ মাইল দূরে পবিত্র নগরী ইতজা অবস্থিত। মায়া ভাষায় এটা চিচেন ইতজা নামে পরিচিত। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো চিচেন ইতজার ধ্বংসাবশেষকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা দিয়েছে। একসময় এখানে পাথর ও কাদার তৈরি শত শত দালানকোঠা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। আজো গোটা ত্রিশেক ভবন টিকে আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে মেক্সিকোর প্রাচীন মায়া নগরী চিচেন ইতজার এক ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর প্রথার কথা জানা গেছে। অনাবৃষ্টির সময় আকাশের দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য কুকুলকান নামের বেদিতে নরবলি দেয়া হতো।
el dorado
অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের গহিন জঙ্গলের মাঝে রয়েছে এক রহস্যময় নগরী। দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মাঝে সেই নগরী হারিয়ে গেছে। সেই বিচিত্র শহরের পথঘাট, ঘরবাড়ি সবকিছু নাকি সোনার তৈরি। রূপকথার মতো শোনা যায় সেই নগরীর কাহিনী। এই শহরকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা কিংবদন্তি। স্প্যানিশ ভাষায় সেই স্বর্ণনগরীর নাম হচ্ছে ‘এল ডোরাডো’। দীর্ঘদিন থেকে সেই সোনায় মোড়া শহরের খোঁজে অভিযান চলছে। দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা পেরুর দুর্ভেদ্য গহিন অরণ্যে অভিযান করেছে। তবে আজ পর্যন্ত কেউই অবশ্য খুঁজে পায়নি সেই সোনার শহরকে। হারিয়ে যাওয়া এই শহরটি বহুকাল ধরে অভিযাত্রীদের হাতছানি দিয়ে আসছে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সেই রহস্যময় শহরের সন্ধানে গিয়েছে পর্যটকরা। কিংবদন্তিতে বর্ণিত দুর্গম পথের অনুসন্ধান করেছে নকশা দেখে। সোনার শহর এল ডোরাডোকে নিয়ে বহু আকর্ষণীয় উপাখ্যান রচিত হতে থাকে। সতের শতকের কোনো কোনো মানচিত্রে এর অবস্থান দেখানো হতো।
মুচে সভ্যতা
Moche Civilization Maps
গত শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রত্নতাত্বিক ম্যাক্স উলেহ এই মুচে সভ্যতার খোজ পান ১৯৯৭ সালে পেরুর একদল গবেষক পেরুর উত্তর উপকুল রহস্যময় মুচে সভ্যতার খোজে পুরাতাত্ত্বিক অভিযানে নামে। এর ব্যাপ্তিকাল ধরা হয় খ্রিঃপূর্ব ৮০০ থেকে ১০০ খ্রিঃপূর্ব পর্যন্ত। মুচেরা ছিল যোদ্ধা জাতি যার প্রমান পাওয়া যায় সিরামিক এবং ম্যুরাল চিত্রে। এছাড়া মুচেদের বিভিন্ন কবরে প্রাপ্ত অস্ত্র শস্ত্র দ্ধারাও এটা প্রমানিত।
Archaeologists discovered graves containing the remains of four elite members of the mysterious Moche civilisation
হুয়াকা দে লা লুনায়, কিছু মরদেহ পাওয়া গেছে, গবেষনায় দেখা গেছে তারা ছিল মুচেদের শত্রু যাদের কাউকে কাউকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হয়েছে। জ্যাকুইটেপিক উপত্যাকায় ডজ ক্যারোজ নামক স্থানে মুচেদের যে সমাধি পাওয়া গেছে তাতে যে মৃতদেহ পাওয়া গেছে তা ছিল এক অভিজাত মুচের। কবরে প্রাপ্ত বিভিন্ন বস্তু দ্ধারা আর্কিওলজিষ্টরা এ সিদ্ধান্তে পৌছেচেন যে মুচেরা কৃষিজীবি এবং মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। মুচে সভ্যতার এখনো অনেক কিছুই উন্মোচিত হয়নি, যেটুকু পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায় মুচেরা খাল ও জলাধার নির্মান করতে শিখেছিল।
Ancient Temples of the Gods - Huacas del Sol and de la Luna
হুয়াকাস নামে এক বিশাল আর্কিটেকচারের সন্ধান মুচে সভ্যতায় দেখা যায়, যা ছিল একাধারে তাদের মন্দির, প্রসাদ, প্রশাসনিক ভবন এবং প্রাসাদ। হুয়াকাস গুলো বিশাল প্লাটফর্ম আকারের ছিল যা পোড়ামাটির ইট দ্ধারা তৈরী ছিল, এগুলো কয়েকশত ফুট বিস্তৃত আর উপত্যাকা দশ বিশ তলার সমান উচু। সব চেয়ে উচু স্থানে ছিল শাসকের বসার জন্য আসন, থাকার জন্য কড়িডোর এবং উচু রুম ছিল।
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী আই পেচ ছিল তাদের সৃষ্টি কর্তা। এবং সাই ছিল চাদের দেবী। সিয়েরা ব্লাঙ্কো পাহাড়ের পাদ দেশে মুচে সভ্যতার রাজধানী মুচে অবস্থিত ছিল। কোন এক অজানা কারনে ৫৫০ খ্রিঃপূর্বে মুচেরা তাদের রাজধানী পরিত্যাগ করে। বিভিন্ন স্থাপনা খাল দেখে অনুমান করা হয় রাজধানী মুচে তে ২৫০০০ মানুষ বাস করত। এখনো মুচে সভ্যতার সব রহস্য উন্মোচিত হয়নি।
ইনকা সভ্যতা
দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার এই পার্বত্য ভূভাগে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত যে কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল তার মধ্যে এই ইনকারাই আধুনিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়েছিলো। যদিও সম্মিলিতভাবে এসব সভ্যতাকেই মূলত আন্দিজ সভ্যতা বলা হয়ে থাকে তবুও ইনকারাই হলো আধিপত্য বিস্তারকারী। এমন কি এরা সোনার পাত্রে খাবার খেতো। এরা যে বিলাসিতার জন্য এটা করত ব্যপারটা তা না। এটা করত কারণ সোনা ছিলো খুব সস্তা। ইনকা শব্দের অর্থ সূর্যের সন্তান।তারা যুদ্ধবাজ জাতি ছিলো।সাধারণত কুজকো অঞ্চলের শাসকদের ইনকা বলা হতো। কখনো কখনো সমুদয় জনগোষ্ঠীকেও ইনকা বলা হতো। ইনকার রাষ্ট্রীয় ভাষার নাম কুয়েচাওয়া। এর বাইরেও সাম্রাজ্য জুড়ে অন্তত ২০ টি স্থানীয় ভাষার অস্তিত্ব ছিল।
মাচুপিচু হচ্ছে ইনকাদের সবচেয়ে বিস্ময় নগরীর নাম। মাচুপিচু শব্দটি নেটিভ আমেরিকান কেচুয়া জাতির ব্যবহৃত শব্দ। আর এর অর্থ প্রাচীন পর্বত। মাচুপিচুর অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,৫০০ ফুট উচ্চতায়। অধিকাংশ সময় মাচুপিচু নগরী মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকে বলে একে মেঘের দেশের নগরী বলে। এমনকি উপর দিয়ে চলাচল করা বৈমানিকদেরও এটি চোখে পড়ে না। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন ২০০৭ সালের ৭ জুলাই মাচুপিচুকে আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে ঘোষণা দেয়। মাচুপিচু নগরীটি কোনো ধ্বংসাবশেষ নয় বরং একেবারে অব্যয় ও অক্ষত অবস্থায় কী এক অজ্ঞাত কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। বর্তমান বিশ্বের কাছে ইনকা সভ্যতা বলতে মাচুপিচুর পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। তাই প্রতিবছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পর্যটক মাচুপিচু দেখতে ছুটে যায় পেরুর রাজধানী লিমা থেকে ৩৫৭ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কুসকো শহরে।
আগ্নেয়গিরিকে কিংবা অন্য দেবদেবীকে শিশু উৎসর্গ করা ইনকা সভ্যতার একটি বর্বরতম দিক। দেবদেবীদের উৎসর্গের আগে ইনকারা তাদের সন্তানদের মোটাতাজা করে নিত। আর এই কাজটি তারা কিভাবে সম্পাদন করত, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ক’দিন আগেই। প্রাচীন ইনকা সভ্যতার নিকটবর্তী লুলাইলাকো নামের একটি আগ্নেয়গিরির চূড়ায় সংরক্ষিত ৫০০ বছরের পুরনো মমির চুল পরীক্ষার মাধ্যমে এ সম্পর্কিত বিস্তারিত জানা গেছে। সেখানে ‘লুলাইলাকোর কুমারী’ নামে পরিচিত ১৫ বছর বয়সী এক বালিকা এবং ‘লুলাইলাকোর বালক’ নামে সাত বছর বয়সী এক বালকের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। মমিকৃত দুটি দেহের সঙ্গে ছয় বছর বয়সী আরেকটি ছোট মেয়ের মমির সন্ধান পাওয়া যায়।
Francisco Pizarro
১৫২৭ সালে ইনকা সাম্রাজ্যে এক মহামারী দেখা দেয়। সেই মহামারিতে ইনকা রাজা ও তার উত্তরসূরি ছেলে মারা যান। রাজার অন্য দুই ছেলের মধ্যে সিংহাসনের লড়াইয়ে দেশজুড়ে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এদের একজন অ্যাটাহুয়ালপা জিতে গেলেও খুব বেশি দিন টিকতে পারেননি। ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ যোদ্ধা ফ্রান্সিস পিজারো তাকে হারিয়ে দেন। পিজারো নামমাত্র রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসান অ্যাটাহুয়ালপার শত্রু মানকোকে। নতুন রাজা অবশ্য কখনোই রাজার সম্মান পাননি। তাই প্রতিহিংসায় মেতে উঠে মানকো। ইনকা রাজার সোনার মূর্তি এনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ভিলকাবাম্বা শহরের পাহাড়ে হারিয়ে যান মানকো ও তার শক্তিশালী সেনারা। এরপর বহু বছর ধরে মানকো ও তার ছেলেদের সঙ্গে ইনকা সভ্যতার সিংহাসন জয় নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে স্প্যানিশ যোদ্ধাদের। এভাবেই এক সময় ধ্বংস হয়ে যায় ইনকা সভ্যতা। ( ইনকাদের নিয়ে জানতে রহস্যময় “ইনকা সভ্যতা” ও তাদের বিস্তারিত ইতিহাস ক্লিক করুন)
মহেঞ্জোদারো সভ্যতা
MOHENJO-DARO CIVILIZATION
মহেঞ্জোদারো ছিল প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নগর-বসতিগুলির মধ্যে অন্যতম। এটি অধুনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় অবস্থিত। ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ নির্মিত এই শহরটি ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির অন্যতম এবং প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া ও ক্রিটের সভ্যতার সমসাময়িক। এই শহরের পুরাতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। এটিকে "একটি প্রাচীন সিন্ধু মহানগর" নামেও অভিহিত করা হয়।
মহেঞ্জোদারো শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘মৃতের পাহাড় ’। তবে প্রকৃত পক্ষে শহরটির নাম কি ছিল তা এখনও যানা যায়নি সঠিক ভাবে। তবে মহেঞ্জোদারো হতে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সমগ্রে একটি নাম এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তা হল ‘কুক্কুতার্মা’ (Kukkutarma) আনুমানিক ভাবে ধরা হয় এটি খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সাল এ গড়ে উঠে এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে এর পতন ঘটে।
The Lost Civilization of Mohenjodaro and Harappa
মহেঞ্জোদারোতে বসবাসকারি মানুষদের থাকার পদ্ধতি আমাদের সবচেয়ে বেশি অবাক করে দেয়। মহেঞ্জোদারো তখনকার সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকেও বেশি বিকশিত এবং উন্নত ছিলো। এই শহর ৬০০ একর জমির উপর বিস্তৃত ছিল যেটা তখনকার সময়ে বেশ বড় আকারের । এখানকার ধবংস্তুপ থেকে জানা যায় এই শহরে প্রবেশের জন্য সামনে একটি বড় দরজা ছিলো। এখানে এমন কয়েকটি বাড়ির নিদর্শন পাওয়া গেছে যা তিনতলা পর্যন্ত উচু ছিলো। এখানকার দালানকোঠা বানানোর জন্য যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে তা কোন সাধারণ ইট ছিলো না এটা ওয়াটার প্রুফ ইট ছিলো। মনে করা হয় পৃথিবিতে প্রথম পাতকুয়া স্থাপন করেছিলো হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা। এখানে ৭০০ এরও বেশি পাতকুয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে।এখানকার খননকার্য শেষ করার পর এখানে পাওয়া কংকালগুলো ল্যাবে পরিক্ষা করা হয়। পরিক্ষা করার পর কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসে। ওই সময়কার মানুষেরা আজকের দিনের মতই নকল দাত ব্যবহার করত। এ থেকে বোঝা যায় তারা আসলেই চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নত ছিলো।
মহেঞ্জদারো ধবংস হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে কারো জানা নেই। তবে অনেকের ধারণা হঠাৎ ভূমিকম্পের কারনে এই শহরের পতন হয়েছিল। আবার অনেকে মনে করেন সিন্ধু নদের হঠাৎ গতিপথ পরিবর্তনের জন্য এখানে পানিসল্পতা দেখা দেয় যা একসময় মহামারীর আকার ধারন করে এর জন্য এই শহর ছেড়ে সবাই চলে যায়। আবার অনেকেই মনে করেন আবহাওয়া বিপর্যয়ের জন্য মুলত এই শহরের পতন। ঠিক কি কারনে মহেঞ্জোদারো পতন ঘটেছিলো তা ঠিক জানা যায়নি।
প্রাচীন সভ্যতা ইতিহাসের ওপর টান আমার সব সময়ই। কয়েক দিন ধরে শ্রদ্ধেয় লেখক আলী ইমামের “প্রাচীন নগরীর খোজে” বইখানি শেষ করলাম। ইতিহাস ভিত্তিক এই অসাধারন বইটি পড়ে ভীষন ভালো লাগছে, সেখান থেকেই এই লেখার অধিকাংশ তথ্য সূত্র গৃহীত। এর সাথে অন্তর্জালের বিভিন্ন সাইট থেকে কিছু যোগ করে এই লেখা খানি। বিশেষ কৃতজ্ঞতা শ্রদ্ধেয় আলী ইমামের প্রতি। আমি আসলে এই সব সভ্যতা সন্মন্ধ্যে ধারনা দেবার চেষ্টা করছি মাত্র। এগুলো নিয়ে অনেক জায়গায় অনেক বিস্তারিত লেখা আছে উৎসাহিত বোধ করলে সেখান থেকে আরো কিছু জানতে পারবেন।
হারিয়ে যাওয়া নাবাতিয়ানদের নিয়ে লেখা দারুন একটা লেখা লিখছে স্বপ্নবাজ সৌরভ লেখাটা দেখার জন্য নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন নাবাতিয়ান লাল পাথর
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:২৬