ভিঞ্চিকে নিয়ে ড্যান ব্রাউন “দ্য দ্য ভিঞ্চি কোড” লিখে যে নাটকীয়তা তৈরী করছে, বাস্তবে ভিঞ্চি তার থেকে অনেক বেশী রহস্যময় বলেই আমার মনে হয়েছে তার জীবনের টুকরা টাকরা ঘটনা পড়ে। কৈশোরে ভিঞ্চি বীনায় নাকি ঐশ্বরিক সুর তুলতে পারতেন কারো কাছ থেকে শিখে নয় সহজাত গুনের কারনে। পিতা সের পিয়েরো, কিন্তু তার মা ক্যাটারিনাকে বিয়ে করেন নি, মানে বাবা মার অবৈধ সন্তান ছিলেন। লিওনার্দোর জন্ম ১৪৫২ সালের ১৫ ই এপ্রিল। পিতার তত্ত্বাবধানেই বড় হচ্ছিলেন লিওনার্দো তার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে আইন বা অন্য কোন ভদ্র পেশায় মানুষ করবেন, কিন্তু ছেলের আঁকায় সহজাত দক্ষতা আর আগ্রহ তাকে সে কালের ফ্লোরেন্সের শ্রেষ্ঠ শিল্পীর এন্ড্রিয়া ডেল ভেরোচিয়ার কাছে পাঠিয়ে দেন।
লিওনার্দোর বয়স তখন ষোল। খুব অল্প সময়ে গুরু ভেরোচিয়া বুজতে পারলেন ঈশ্বর প্রদত্ত গুনের কারনে লিওনার্দোকে তার শিখানোর কিছু নেই। শিষ্য লিওনার্দোর আঁকা আঁকির গুন দেখে ভেরোচিয়া জীবনে আর কোন দিন তুলি হাতে তুলে নেন নি, বাকী জীবনটা ছেনি বাটালি নিয়ে পাথরের মুর্তি বানানোর কাজ করে গেছেন। কিন্তু লিওনার্দোর সাথে তার গুরু শিষ্যর সম্পর্কটা আজীবন অটুট ছিল।
বিশ বছর বয়সে আঁকা আঁকির সার্টিফিকেট পান লিওনার্দো। পচিশ বছর বয়স পর্যন্ত থেকে যান ভেরোচিয়ার ষ্টুডিওতে এখানেই নিজ ইচ্ছায় শিখেন গ্রীক আর ল্যাটিন ভাষা, চিকিৎসা বিদ্যা থেকে সেই সময়ের বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখাতেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা লাভ করেন একান্ত নিজের ইচ্ছায়। (লিওনার্দো কে নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে আমি দু এক জায়গায় দেখছি লেখক তার গুনে বিস্মিত হয়ে কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলে বসেছে সে নাকি ফিউচার দিয়ে অতীতে গিয়েছিল, এটা আসলে তার গুনের প্রকাশ করতে গিয়ে ভাষা না পেয়ে বলছে।)
ফ্লোরেন্সে কোনও সম্ভাবনা না দেখে ১৪৮১ সালে মিলানে যান লিওনার্দো। সেকালে ফ্লোরেন্স, মিলান আলাদা আলাদা রাজ্য ছিল, লিওনার্দো যখন মিলান আসলেন তখন মিলানের রাজা ছিলেন জিয়ান গ্যালিয়াজো স্ফোরজা। কিন্তু অপ্রাপ্ত বয়স্ক হবার কারনে তার পক্ষে রাজত্ব চালাতেন তার কাকা লডোভিকো স্ফোরজা। এর গায়ের রং শ্যামলা দেখে ইতিহাসে তাকে “ইল মুর” নামে চেনে। মিলানে পৌছানোর পর সেসিলিয়া গ্যালেরিনো নামে এক মহিলার ছবি আঁকে। এই মহিলাই পরবর্তীতে লডোভিকের প্রধান রক্ষিতা হন।
সেসিলিয়া গ্যালেরিনো
আকিয়ে হিসাবে মিলানে লিওনার্দোর খুব একটা পাত্তা হলনা। অস্ত্র নির্মাতা হিসাবে বা মুর্তি গড়িয়ে হিসাবে একটা সুযোগ নেবার জন্য তিনি চিঠি লিখলেন, কেনেথ ক্লার্ক যার সম্বোধনটি ইংরেজীতে অনুবাদ করছিলেন “Most illustrious Lord” বলে। দরখাস্তের মুল বয়ানটি ছিল অনেকটা নিম্নরূপঃ
মহানুভব সম্রাট
যথাসম্ভব প্রত্যক্ষভাবে দেখে যাচাই করে এবং প্রমান পেয়ে, সেইসব ব্যাক্তিদের আবিস্কার, যারা যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তত করার ব্যাপারে নিজেদের আবিস্কারক এবং পারদর্শী বলে ধাপ্পা দেন, যদিও সেই সব আবিস্কার গুলো অতি সাধারন ব্যাবহারযোগ্য ব্যাতীত কিছুই না, একথা মাথায় রেখেই সম্পূর্ন পক্ষপাতশুন্য হয়ে আমার কিছু কৃত কর্মের নমুনা এবং গোপন কলাকৌশল আপনার কাছে পেশ করছি এবং একই সঙ্গে আপনার কাছে চাকুরীর জন্য আবেদন পেশ করছি
১। আমি সেতুর পরিকল্পনা এবং নকশা করছি যা হাল্কা, শক্তপোক্ত এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খুব সহজে বহনযোগ্য ফলে যুদ্ধে আক্রমন বা পশ্চাদপসরনের সময় সাহায্য করবে, আবার এমন সেতুও নির্মান করতে পারি যা আগুনে দাহ্য না। আবার শত্রুপক্ষের সেতু আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করার দেবার কৌশল ও আমার করায়াত্ত।
২।সেনারা কোন অঞ্চল অবরোধ করলে সেখানে পরিখা থাকলে পরিখা দিয়ে পানি বের করে দেবার কৌশল আমার জানা আছে। আবার পরিখা পারাপারের অসংখ্য ছোট সেতু নির্মান, মই এবং ওই ধরনের যন্ত্র তৈরীর উচ্চ প্রযুক্তি আমার করায়াত্ত।
৩। উচ্চতা বা দুর্গমতার কারনে কোন নির্দিষ্ট নিশানায় বোমা ফেলতে অসুবিধা হলে, সেই সব দূর্গ বা প্রাচীর কিভাবে বোমা মেরে ধ্বংস করা যায় আমার জানা আছে।
৪।আমি সুবিধাজনক এবং সহজে বহনযোগ্য কামান তৈরী করতে যা শত্রু পক্ষের ওপর বৃষ্টির মত পাথর নিক্ষেপ করবে একই সাথে ধোয়ার তৈরী করবে যা শত্রুদের দিশেহারা করে দেবে।
৫। যুদ্ধ যদি সমুদ্রে সংঘটিত হয় তবে তবে আমার পরিকল্পনায় এমন অনেক যন্ত্র আছে যা একই সাথে আক্রমন এবং প্রতিরোধ করতে পারবে। একই সাথে আগুন, গোলা এবং যে কোন ধোয়ার আক্রমন প্রতিহত করার মত নৌযান তৈরী করতে সক্ষম।
৬। আবার একটুও শব্দ না করে যে কোন নির্দিষ্ট স্থানে পৌছানোর জন্য সুড়ঙ্গ, গোপন পথ তৈরী করে দিতে সক্ষম এমন কি নদী বা পরিখার তলা দিয়ে হলেও।
৭। আমি শত্রুর যে কোন আক্রমন প্রতিহত করার মত সাজোয়া যান তৈরী করতে সক্ষম যা যে কোন শত্রু শিবিরে খুব দ্রুত ঢুকে যেতে পারে এবং এর পেছন পেছন আপনার সৈন্যরা ঢুকে শত্রুদের আক্রমন করতে পারবে।
৮। সাধারনতঃ যে সব যুদ্ধাস্ত্র তৈরী ব্যবহৃত হয় তার বাইরে অতীব কার্যক্ষম যুদ্ধাস্ত্র এবং হাল্কা বা ভারী কামান তৈরী করে দিতে পারব প্রয়োজন সাপেক্ষে।
৯। যখন প্রচলিত বোমায় কাজ হবে না আমি তখন বড় গুলতি, ম্যাঙ্গোনেলাস, ট্রিবুচেট তৈরী করে দিতে পারব। সংক্ষেপে বলা যায় পরিবেশ সাপেক্ষে আমি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র তৈরীতে পারদর্শী।
১০। শান্তিকালীন অবস্থায় আমি আপনাদের যথাযথ সন্তুষ্ট করতে পারব, স্থাপত্য, অট্টলিকা, পানি নিস্কাশন ব্যাবস্থায় আমি যে কোন প্রকৌশলীর থেকে ভালো কাজ করতে পারব।
এছাড়াও আমি পাথর, ব্রোঞ্জ, মার্বেল বা মাটির ভাষ্কর্য করতে পারি, এবং যে কোন পদ্ধতিতে ছবি আকায় পারঙ্গম। আমার ছবির ব্যাপারে বিশ্বের যে কোন আকিয়ের সাথেই আপনি তুলনা করতে পারবেন। এছাড়া আমি ব্রোঞ্জের অশ্ব নির্মান করতে পারি যা আপনার পিতা বা স্ফোরজা পরিবারের গৌরবান্বিত মধুর স্মৃতিকে সব সময় উজ্জ্বল রাখবে।
উপরোক্ত কোন বিষয়ে যদি অবাস্তব অসম্ভব মনে হয় তবে মহান সম্রাটের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোন খোলা জায়গায় অথবা রাজ উদ্যানে পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত। মহামান্য সম্রাটের কাছে পরম বিনয় সহকারে নিজেকে নিবেদন করলাম।
এই দরখাস্তটির কথা প্রথম জানা যায় ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত লিওনার্দোর নোটবই এর একাংশ “কোডেক্স অ্যাটলানটিকাস, এ্যাট দ্য এ্যাম্বাসিয়ানো এ্যাট মিলান।” এ লেখাটি লিওনার্দোর নিজের না কারন লেখার অনেক জায়গায়ই কেটে সংশোধন করা হয়েছে, সম্ভবতঃ লিওনার্দোর কোন ছাত্র তার মুখে মুখে শুনে এটার খসড়া করছিলো পরে লিওনার্দো এটাকে সংশোধন করে। লিওনার্দোর জীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায় তার দরখাস্থ অবশ্যই মঞ্জুর হয়েছিল এবং একটানা ষোল বছর সেখানে চাকুরী করে।
আপনারা যদি লিওনার্দোর দরখাস্তের দিকে তাকান যে পরিচয়ে সে এখন বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত মানে চিত্রশিল্পী সেটা সে দরখাস্থের শেষে অতি সাধারনভাবে উল্লেখ্য করছে।
শেষ পর্বের জন্য নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন
কোডেক্স অ্যাটলানটিকাস, এ্যাট দ্য এ্যাম্বাসিয়ানো এ্যাট মিলানোঃ লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চি – শেষ পর্ব
সুত্রঃ বিভিন্ন বই, পত্রিকা এবং জার্নাল
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ২:৫০