হাজার হাজার বছরের বৈজ্ঞানিক গবেষনা যে টাইম (সময়) আর স্পেস (মহাশুন্য) কে নিত্য এবং ধ্রুব বলে মেনে নিয়ে বিভিন্ন আবিস্কার হল, ১৯০৫ সালে আইনষ্টাইনের থিওরী অভ রিলেটিভিটি এক মুহুর্তে তা নসাৎ করে দিল। তিনি হিসাব কষে দেখালেন একটি ছুটন্ত ট্রেনের যাত্রীর কাছে প্লাটফর্মে দাঁড়ানো যাত্রীর তুলনায় টাইম অবশ্যই ধীরে চলে। মানে হল যে জিনিস যত জোরে ছুটবে সময় তত ধীরে বইবে। তবে সেটা বুজবে ট্রেনে চড়া আর প্লাটফর্মে দাঁড়ানো মানুষটির সাপেক্ষে যে স্থির আছে। সমস্যা হল বর্তমান যুগে যার সামান্যতম অক্ষরজ্ঞান আছে, সেও জানে এই বিশ্ব ব্রাক্ষ্মান্ডের কোন কিছুই স্থির না, গ্রহ বলেন আর গ্যালাক্সি বলেন বা নক্ষত্রপুঞ্জ যাই বলেন সবই নিয়ত নড়াচড়া করছে। তাই সময় ও স্থির না। সময় ও আপেক্ষিক।
আইনষ্টাইন একবার মজা করে বলছিলো “আপনি যদি একটা গরম কেটলিতে এক মিনিট হাত রাখেন তবে মনে হবে এক ঘন্টা আর এক জন সুন্দরী মহিলার পাশে এক ঘন্টা বসে থাকলে মনে হবে এক মিনিট, এটাই আপেক্ষিকতা।” শুধু মাত্র থিওরী দিয়েই বিখ্যাত হয়ে গেলেন ছাব্বিশ বছরের আইনষ্টাইন। সবাই ধন্য ধন্য করছে তাকে।
আর এই “থিওরী অভ রিলেটিভিটি” থিওরী হয়েই আছে এর প্রমান তখনো দেয়া সম্ভব হয় নি। সমস্যা সেখানেও না, সমস্যাটা তখনি তৈরী হল যখন এই থিওরী কে প্রমান করার প্রশ্ন চলে আসল। থিওরী অভ রিলেটিভিটি প্রমান করতে গিয়ে এমন এক আবিস্কারকে চ্যালেঞ্জ জানানো হল যিনি কিনা তখনো ছিলেন পদার্থবিদ্যার অঘোষিত ঈশ্বর। এখান থেকেই গল্প শুরু হল আমার।
১৬৬৬ সালে, ইংল্যান্ডে এক যুবক আপেল বাগানে বসে ছিল হঠাৎ তার সামনে টুপ করে গাছ থেকে আপেল পড়ল। এক লহমায় আবিস্কার হয়ে গেল সেই প্রশ্নের উত্তর যার সমাধান জানার জন্য জন্য বহুরাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে কোপারনিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও। কেন আমরা মাটিতে আটকে আছি? কেন গাছ থেকে ফল আকাশের দিকে না যেয়ে মাটিতে পরে?
আইজ্যাক নিউটন আবিস্কার করে বসলেন কেন আপেল মাটিতে পরে? তিনি আবিস্কার করলেন এই মহাবিশ্বের সব কিছু, সব কিছুকে আকর্ষন করে। সেই আকর্ষন নির্ভর করে বস্তু দুটোর ভর এবং দূরত্বের ওপর। সে ক্ষেত্রে আপেল পৃথিবীকে আকর্ষন করে আবার পৃথিবী আপেল কে আকর্ষন করে তবে আপেল মাটিতে কেন পরে? উত্তর খুবই সোজা পৃথিবীর ভর আপেলের তুলনায় বেশী।
নিউটনের এই মহাকর্ষ সুত্র পদার্থবিজ্ঞানে এক সাথে “সব পেয়েছির উত্তর” এর সুত্র হয়ে দাড়াল, ধনুক থেকে তীর ছুড়লে তার গতি কি হবে বা হ্যালির ধুমকেতুর গতিবেগ কত হবে সব কিছুর উত্তর এক নিমিষে নিউটনের মহাকর্ষ সুত্র দিয়ে নির্নয় করা সম্ভব হল। নিউটন হয়ে গেলেন পদার্থবিদ্যার ঈশ্বর তার জীবদ্দশাতেই।
এখানে এসেই বিপদে পড়ল আইনষ্টাইনের “থিওরী অভ রিলেটিভি”। আইনষ্টাইন স্পষ্ট বুজলেন, “মহাকর্ষ সুত্র” একটা সীমিত আকারের মাঝে ঠিকই আছে, কিন্তু মহাবিশ্বের হিসাব নিকাষে মারাত্মক গড়মিল আছে। আইনষ্টাইনের মতে টাইম এবং স্পেশ দুটো আলাদা সত্তা না বরং একই সত্তার আলাদা দুটো রূপ। যেমন পানি তরল অবস্থায় ও থাকতে পারে আবার উত্তপ্ত অবস্থায় জলীয় বাস্প হয়ে যায়। জিনিস একই পানি কিন্তু এক সময় তরল এক সময় বাস্প। একই সত্তার দুটো রূপ আর কি।
এই স্পেসটাইম টান টান করে ছড়ানো আছে সমগ্র মহাবিশ্ব বরাবর রাবারের চাদরের মত।
আবার কোন ভারী বস্তু ধরি সূর্য অথবা অন্য কোন গ্রহ নক্ষত্র সেই স্পেসটাইম চাদরের ওপর আসে সেই চাদরের ওপর একটা বড় সড় টোল ফেলে।
অপেক্ষাকৃত কম ভারী গ্রহ বা নক্ষত্র তখন টোল খাওয়া স্পেসটাইমের মাঝে পাক খেয়ে চলে।
নিউটনের মহাকর্ষ সুত্রে এই স্পেসটাইমের কোন বালাই নাই বিধায় সেখান টোল খাওয়া খাওয়ির হিসাব নিকাষ না থাকায় বিশাল মহাশুন্যের হিসাব নিকাষে অনেক গড়মিল হয়ে যাবে। আপেল পৃথিবীর পতনের হিসাব বা হ্যালির ধুমকেতুর গতির হিসাব মহাকর্ষ সুত্র দ্ধারা সম্ভব কিন্তু কোটি কোটি আলোকবর্ষ দুরের কোন কিছু হিসাব করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ন অচল ( বর্তমান স্পেস যুগে আলোকবর্ষ দূরত্বের গ্রহ নক্ষত্র বা স্পেসশীপের হিসাব খুবই সাধারন ব্যাপার)।
আইনষ্টাইন বললেন তিনি তার “থিওরী অভ রিলেটিভিটি” প্রমান করে দেবেন এবং মহাবিশ্বের বিশালতার ক্ষেত্রে “মহাকর্ষ” সুত্রের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দেবেন। “Matter tells space how to bend and space tells matter how to move”
এখানেই ক্যাচালটা লেগে গেল আইনষ্টাইন “থিওরী অভ রিলেটিভিটি” এবং নিউটনের “মহাকর্ষ” সুত্র। যারা আইনষ্টাইনকে থিওরী অভ রিলেটিভি সুত্র আবিস্কারের জন্য বাহাবা দিয়েছিল তারাই তখন তাকে বলতে লাগল পাগলামি ছাড়। ম্যাক্স প্লাংকের মত বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন কে বলল, “বড় ভাই হিসাবে বলছি একাজ করো না, হয় তুমি সাফল্য পাবে না হলে সাফল্য পেলেও মানুষ বিশ্বাস করবে না।”
আইনষ্টাইন তার সূত্রের বিভিন্ন প্রমান দিতে লাগলেন পৃথিবীর বিভিন্ন চেনা জানা জিনিসের সাপেক্ষে কিন্তু সেগুলো তো নিউটনের সুত্রেও প্রমান করে দেয়া যায় তবে তার সূত্রের বিশেষত্ব কি? আবার কেউ কেউ বললেন প্রমানিত জিনিস প্রমানের মাঝে বাহাদুরি কি? আবার কেউ বললেন তোমার থিওরীই বানিয়েছ মহাকর্ষ সুত্র কে সামনে রেখে তবে এত জ্ঞানী ভাব কেন? মোট কথা আইনষ্টাইনের “থিওরী অভ রিলেটিভি” ইজ্জত যায় যায় অবস্থা।
বিজ্ঞানে কোন থিওরীর প্রমান করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হল থিওরী দিয়ে কোন, না ঘটা ঘটনার ব্যাখ্যা আগে ভাগে দিয়ে দেয়া। তবেই সবার মুখ বন্ধ। আইনষ্টাইনের সমস্যা হল পার্থিব কোন বস্তু দ্ধারা তো স্পেসটাইমের টোল খাওয়া প্রমান করা যাবে না আবার পৃথিবীর ভর সমগ্র মহাবিশ্বের তুলনায় এত অল্প যে তাতে স্পেসটাইমের চাদরে যে টোল খায় তা দিয়ে আশপাশের উপগ্রহর হিসাব দেখানো যাবে না। ধরলেন বৃহস্পতি গ্রহ কিন্তু সে চেষ্টাও ফলপ্রসু হল না। এরপর দৃষ্টি দিলেন সূর্য নামক নক্ষত্রের দিকে।
সুর্যের ভর এত বিশাল যে তা নিশ্চিত ভাবে স্পেসটাইমের চাদরে টোল ফেলবেই এবং তার পেছনে যে তারারা আছে তাদের আলো পৃথিবীতে আসার সময় বক্ররেখা হয়ে আসবে।
কিন্তু সমস্যা হল সুর্যের আলোতে অন্য তারার আলো দেখা যাবে না, এর সমাধানও বের করে ফেললেন আইনষ্টাইন বললেন যখন সূর্য গ্রহন হবে তখন তিনি সূর্যের পেছনে যে তারা আছে তার আলোর পৃথিবীতে পৌছানোর ছবি তুলে দেখিয়ে দেবেন সে আলো সোজা পথে আসছে না আসছে বক্র পথে। যেটা প্রমান করবে স্পেসটাইমের ওপর ভর প্রভাব ফেলে এবং হিসাবেও ভিন্নতা আনে। হিসাব করে দেখা গেল ১৯১৪ সালের ২১ শে আগষ্ট ক্রিমিয়ায় সূর্য গ্রহন হবে। আইনষ্টাইন এর জোর্তিবিদ বন্ধু ফ্রেন্ডলীচ ক্রিমিয়ায় গেলেন। তত দিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ক্রিমিয়ায় ফ্রেন্ডলীচ কে গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় । অনেক দেন দরবার করে ২ রা সেপ্টেম্বর সে বার্লিনে ফেরত আসেন। “থিওরী অভ রিলেটিভিটি” প্রমান আবারো ব্যার্থতায় পর্যবসিত হল।
আইনষ্টাইনের থিওরী অভ রিলেটিভিটি প্রমান করেন বৃটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন। ১৯১৯ সালের ২৯শে মে পূর্ন সূর্যগ্রহন হবে যা দেখা যাবে মধ্য আফ্রিকা এবং দক্ষিন আমেরিকা থেকে, আরো বড় ব্যাপার সে সময় সূর্যের ঠিক পেছনে থাকবে হায়াডেস নক্ষত্রপুচ্ছ। সেখান থেকে আলোর বক্রতার পরিমাপ করে আইনষ্টাইনের থিওরী প্রমান করা যাবে।
সমস্যা হল অন্য জায়গায়, ব্রিটিশ রয়েল একাডেমীর কিছু সদস্য এবং সরকার কোন অবস্থাতেই চাচ্ছিল না এই সব প্রমান ট্রমান তাদের দেশ থেকে হোক কারন পদার্থবিদ্যার ঈশ্বর নিউটন যে তাদের দেশেরই। কিন্তু বিজ্ঞান সাহিত্য এইসব যে সীমানা মানে না তাই আইনষ্টাইনের গুনমুগ্ধ এডিংটন তার ওপরওলাদের বুজালেন উলটা, “এই জার্মানটা বড় বাড় বেড়েছে আমাকে সুযোগ দাও আমি ওর দেখানো পথেই ওকে প্রমান করে দেব যে তার থিওরী ভুল।” এই বার ব্রিটিশ সরকার এডিংটনকে সব রকমের সহায়তা দিলেন।
১৯১৯ সালের ৮ ই মার্চ HMS Anselm জাহাজে চেপে সে সময়ের সব থেকে শক্তিশালী দুরবীন এবং অনেক যন্ত্রপাতি সহ একদল বিজ্ঞানী সহকারে মাদিরা দ্বীপে গিয়ে দলটি দুভাগে বিভক্ত হয়ে একদল কে পাঠালেন ব্রাজিলের সোব্রাল জঙ্গলে আর নিজে গেলেন মধ্য আফ্রিকায় প্রিন্সেপ শহরে। এর দূরবীন টুরবীন সেট করে ২৯শে মের অপেক্ষায় থাকলেন।
Instruments used during the solar eclipse expedition in Sobral, Brazil.Credit...SSPL, via Getty Images
আইনষ্টাইন তার থিওরীর সাহায্যে হিসাব করে আগেই বলছিলেন সুর্যের পরিধি বরাবর আসার সময় হায়াডেস নক্ষত্রপুঞ্জের আলোক রশ্মি বাকাবে ০.০০০৫°, সহজ ভাষায় এক কিলোমিটার দুরের একটি মোমবাতির আলো ১ সে.মি বায়ে সরালে যা ঠিক ততটুকু। কিন্তু নিউটনের মহাকর্ষ সুত্র অনুযায়ী আলোর তো সরলরেখায় আসার কথা।
How the 1919 Solar Eclipse Made Einstein the World's Most Famous Scientist
প্রিন্সেপের দল মোট ষোলটি ছবি তুলল, তার মাঝে অনেক গুলোই নষ্ট হয়ে গেল, একটি মাত্র ছবি ঠিক ভাবে পাওয়া গেল, অতি সুক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দিয়ে হিসাব নিকাষ করে দেখা গেল, তারার আলো সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময় বাঁক নেয় আর তার পরিমান ০.০০০৫°!!!! ঠিক আইনষ্টাইন যেভাবে বলছেন। ব্রাজিল দলের ছবিতেও সেই একই রেজাল্ট।
১৯১৯ সালের ৬ ই নভেম্ভর লন্ডনের রয়েল এ্যাষ্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটির হলে তিল ধারনের জায়গা নেই। আস্তে আস্তে এডিংটন ষ্টেজে উঠলেন। ব্যাখ্যা করলেন গোটা অভিযান এবং প্রমান পেশ করলেন। পরদিন লন্ডনের “The Times” পত্রিকায় হেডিং আসল “Revolution of science – New theory of universe – Newtonian Ideas overthrown”
আইনষ্টাইন তখন নিজের অন্য একটা গবেষনা নিয়ে ব্যাস্ত তার এক ছাত্র ছুটতে ছুটতে এসে তাকে বলল, “স্যার আপনার থিওরী প্রমানিত”
আইনষ্টাইন শুধু বললেন “ও আচ্ছা।”
ছাত্র আবার জিজ্ঞাস করল, “কিন্তু স্যার আপনার থিওরী যদি ভুল প্রমানিত হত?”
আইনষ্টাইন তখন যে জবাব দিল তা বিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, “সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের প্রতি আমার করুনা হত কারন আমি জানি আমি নির্ভুল।” আইনষ্টাইন রাতারাতি পদার্থবিদ্যার ঈশ্বরের জায়গা করে নিলেন নিউটন কে সরিয়ে।
বিজ্ঞানের দুটি শর্তঃ তত্ত্ব এবং প্রমান। আইনষ্টাইন তত্ত্ব দিয়েছেন আর এডিংটন তা প্রমান করেন। এই এডিংটনকে একবার রিলেটিভিটি বিশেষজ্ঞ লুডভিগ সিলভারষ্টেইন বলছিলেন, “আপনিই তো এই জগতের তিনজনের একজন যিনি রিলেটিভিটি বোজেন।”
জবাবে এডিংটন অবাক বিস্ময়ে উত্তর দিয়েছিলেন, “ভাবছি আমি আর আইনষ্টাইন ছাড়া সেই তৃতীয় জন কে?”
আইনষ্টাইন এবং এডিংটন
আমি শুধু বিজ্ঞানের এক মহান আবিস্কারের এবং প্রমানের থ্রিলিং গল্পটা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। তবে এহেন আইনষ্টাইনের ভুলও কিন্তু শুধরে দিয়েছিলেন এক মহান বিজ্ঞানী এবং তিনি ছিলেন বাঙ্গালী যার নাম সত্যেন্দ্রনাথ বোস। বোস আইনষ্টাইন কনডেনসেট থিওরী নামে যা সারা দুনিয়ায় পরিচিত। ভালো লাগলে আর একদিন তার গল্প শোনাব।
আইনষ্টাইনের একটা উক্তি যা আমার ভীষন পছন্দঃ
যারা এই ধরনের লেখা পছন্দ করেন তারা বিড়ালটি বেচে আছে আবার মরে গেছেঃ শ্রোয়েডিংগারের সংকট লেখাটি দেখতে পারেন। আমার নিজের খুব পছন্দের ব্যাপার। কোয়ান্টম মেকানিক্সের সাথে জড়িত।। আর একটা লেখা বড় ভাইরে আকাশে পাঠালে ভাইয়ের বয়স কমে কেন? ভারী বস্তুর পাশ দিয়ে গেলে আলো বাঁকে কেন? এটাও দারুন একটা লেখা পড়ে দেখতে পারেন।।
কৃতজ্ঞতাঃ বিভিন্ন পত্রিকা এবং ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:৩৫