গ্রীকরা যখন মগধ রাজ্যের উপকন্ঠে বিশ্বজয়ের অভিপ্রায়ে তখন তারা হাতি নামক এক বিশাল যোদ্ধা প্রানীর নাম শূনতে পায় যা মগধ রাজার সেনা বাহিনীতে এক বিশেষ ভুমিকা রাখে। ভয়ে গ্রীক সেনারা আর এগোতে সাহস পায় না। পাল ও সেন রাজাদের হাতির বহরের কথা তাদের সভাকবিরা বিভিন্ন উপমা দিয়ে লিখে গেছেন। পলাশির প্রান্তরে নবাব সিরাজের হাতির পাল ষড়যন্ত্রকারীদের কারনে নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকাকেও ইতিহাস বিদগন পরাজয় কে ত্বরান্বিত করে বলে দাবী করেন।
বাংলার বারো ভুইয়াদের ছিল দুর্দান্ত হস্তীবাহিনী। যে হস্তীবাহিনী ছিল মোগলদের কাছে মুর্তিমান আতংক। বারো ভুইয়ারা নিজেদের কোন ইতিহাস লিখে যাননি। মোগল সেনাপতি মির্জা নাথান যদি মোগল আর বারো ভুইয়াদের মধ্যকার যুদ্ধর ইতিহাস না লিখে যেত তবে বারো ভুইয়াদের ইতিহাস বা তাদের অপারেজয় যোদ্ধা হাতিগুলো সন্মন্ধ্যে কিছু জানা যেত না।
মির্জা নাথানের বইটির নাম “বাহারিস্তান-ই-গায়বী”। এটি এখন পর্যন্ত বারো ভুইয়াদের ওপর অন্যতম লিখিত দলিল হিসাবে স্বীকৃত। এই দলিল টি না থাকলে মোগল শক্তির বিরুদ্ধে বারো ভুইয়াদের প্রতিরোধ, বীরত্বগাথা, তাদের আত্মত্যাগ আর দেশের জন্য জীবন দানের যে অপরিসীম সাহস সেটা আমাদের জানা হোত না। আমি এই বই থেকে বারো ভুইয়াদের অপারেজেয় হস্তী বাহিনীর কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।
মোগলদের সাথে বাংলার বারো ভুইয়াদের যুদ্ধে হাতির ভুমিকার গুরুত্ব বুজাতে একটি মাপকাঠি উল্লেখ্য করি। মোগলরা বারো ভুইয়াদের আত্মসমর্পনের যে শর্ত দিয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য ছিল হাতি সম্পর্কিত – পরাজিত ভুইয়াদের হাতিসালার সব “ফিলান-ই-দান্দানদার” মানে সমস্ত দাতাল যোদ্ধা হাতি মোগলদের হাতে সমর্পন করতে হবে। সঙ্গে থাকবে আত্মসমর্পন কারী নেতার কোন ভাই বা ছেলে। হাতি আর নৌকা থাকলে বাংলার জলাজঙ্গলে ঘোড়া না হাতি ই মুল যুদ্ধাস্ত্র ছিল।
এই হাতি গুলো ছিল আধুনিক ট্যাংকের মত যা পদাতিক আর ঘোড়াসওয়ার বাহিনীকে নিমেষে ছত্রভঙ্গ করে দিত। মোগল সেনাপতি যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার সেনা দল সাজাতেন বারো ভুইয়াদের হাতি বাহিনীকে মাথায় রেখে। মোগল সেনাবাহিনীর একটা স্পেশালাইজড দল থাকত আধুনিক কমান্ডোদের মত যাদের কাজ ই ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে যোদ্ধা হাতি গুলোর পা কেটে অকেজো করে দেয়া।
ঐতিহাসিক আর সি মজুমদার বারো ভুইয়ার এক ভুইয়া খাজা ওসমানের প্রধান দুটি হাতির নাম উল্লেখ্যে করেছেন বাজ ও বখত। মির্জা নাথান খাজা ওসমানের আরো কয়টি যুদ্ধ হাতির নাম উল্লেখ্য করেছেন তার “বাহারিস্তান ই গায়বী” তে অনুপা, সিঙ্গালী, দাস্তা, শতরঞ্জী। মোগল হাতিগুলোর মধ্যে নামকরা ছিল বাঘদলন, বালসুন্দর, চঞ্চল, ফাতহা, গোপাল ও রনসিঙ্গার। সিলেটের ভুইয়া বায়জিদের প্রধান হাতির নাম ছিল “আবর”। মোগল সেনাপতি মির্জা নাথান দ্ব্যার্থ হীন ভাবে তার হাতি গুলোর তুলনায় যে বারো ভুইয়াদের হাতি অনেক উৎকৃষ্ট যোদ্ধা ছিল সেটা স্বীকার করে গেছেন।
মাতঙ্গের জমিদার পাহলোয়ান ছিলেন বিখ্যাত যোদ্ধা তিনি তার মোগল প্রতিপক্ষ শামসুদ্দীন কে পরাজিত ও হত্যা করে নিজেও যুদ্ধে জীবন দেন। মির্জা নাথানের বর্ননা থেকে পাহলোয়ানের বিখ্যাত যূদ্ধা হাতি “বাজে”র সাহসিকতার কথা জানতে পারি। বাজ অতি সহজেই শত্রু দূর্গের গেট ভেঙ্গে ফেলত তার অমিত শক্তি দিয়ে। বাজের পায়ে পায়ে ঘেষে পাহলোয়ানের সেনারা শত্রু দুর্গে ঢুকে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হত। মোগল সেনারা বাজের চারটি পাই কেটে টুকরো টুকরো ফেলে কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বাজ আমৃত্যু যুদ্ধ করে গেছে।
আমরা ঘোড়া কুকুরের প্রভুভক্তি বা যুদ্ধে সাহসিকতার অনেক নিদর্শন জানি কিন্তু অমিত বিক্রমশালী এইসব বাংলার যুদ্ধ হাতি সন্মন্ধ্যে প্রায় কিছুই জানি না।
নাথান মির্জা ওসমানের প্রধান হাতি “বাখতা”রের বীরত্বের বর্ননা দিয়েছেন তার লেখায়। বাখতা ছিল আকারে পাহাড়ের মত। দুর্গের পাথর ভেঙ্গে ফেলার মত শক্তি বাখতার ছিল। যুদ্ধের মাঠে মাহুতের হুকুম ছাড়া বাখতা কে এক পা ও নড়ানো যেত না এই বিশেষ গুনের জন্য বাখতা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাদশাহ জাহাঙ্গীর বাখতাকে তার জীবন স্মৃতিতে “গজপতি” উপাধিতে ভুষিত করেছেন।
এইসব যুদ্ধ হাতি যুদ্ধের ময়দানে ইস্পাত নির্মিত বর্মের মত আচ্ছাদান ব্যাবহার করত যাকে বলা হত “পাখার”। ইকবাল নামায় লেখা আছে খাজা ওসমান বাখতা কে সামনে রেখে মোগলদের আক্রমন করতেন। আবার কখনো কখনো বাখতা কে লুকিয়ে রেখে অন্য হাতি দিয়ে আক্রমন শানানো হত। বাখতাকে লুকিয়ে রাখা হত। যুদ্ধের বিশেষ মুহুর্তে সেই লুকানো বন জঙ্গল ভেদ করে চলমান দুর্গের মত যখন বাখতা যুদ্ধের ময়দানে ধেয়ে আসত শত্রু তখন পালানোর পথ পেত না।
মির্জা ওসমানের সাথে মির্জা নাথানের দৌলাম্বাপুরের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক যুদ্ধে হাতির যুদ্ধের বেশ ভালো একটা বর্ননা দেয়া আছে। সে যুদ্ধে মোগল হাতি “গোপাল” বাংলার হাতির পরাক্রমের সামনে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়, মির্জা নাথানের শক্তিশালী হাতি “বাঘদলন” কে ওসমানের আর একটি হাতি “অনুপা” নাজেহাল করে। নাথানের দূরন্ত হাতি “চঞ্চল” ওসমানের অমিত বিক্রমশালী “বাখতা”র দিকে তেড়ে যায় কিন্তু বাখতার এর সওয়ারী গোলন্দাজদের গুলির আঘাতে আহত হয়ে চঞ্চল পালিয়ে যায়।
ওদিকে ওসমানের “সিংহলি” দ্বৈরথে নামে মোগল হাতি “বালসুন্দরে”র সাথে। বালসুন্দর অনেক টা পরাজয়ের দ্বার প্রান্তে চলে যায় এই সময় আর একটি মোগল হাতি এগিয়ে যায় বালসুন্দরের সহায়তায় এ অবস্থায় দ্বৈত আক্রমনে সিংহলি পিছু হটে।
এই দৌলাম্বপুর যুদ্ধে মির্জা ওসমান নিহত হলে মির্জা ওসমানের ছেলে আর ভাইয়েরা বাখতা কে নিয়ে মির্জা নাথানের মোগলসেনাদের ওপর ঘুর্নিঝড়ের মত ঝাপিয়ে পড়েন। বাখতার আক্রমনে মোগল বাহিনী খড় কুটোর মত উড়তে থাকে। এক পর্যায়ে যুদ্ধ মদমত্ত বাখতা মির্জা নাথানের নাগাল পেয়ে তার ঘোড়া সহ শুড় দিয়ে তুলে ফেলে দূরে ছূড়ে ফেলে। ভাগ্য ভালো সে যাত্রা মির্জা নাথান আহত হলেও জানে বেচে যান।
মোগল সেনারা ঘিরে ফেলে বাখতা কে। ধারালো তলোয়ার দিয়ে বাখতার পা, শুড় আর দাত কেটে ফেলতে থাকে। এ অবস্থাতেও মরনপন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে বাখতা। এক পর্যায়ে প্রভু মির্জা ওসমানের বীরের মত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে। বন্দী হবার থেকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীরের মৃত্যুকেই বেছে নেন মির্জা ওসমান আর তার প্রান প্রিয় যুদ্ধ হাতি বাখতা। গোলামির থেকে সন্মান জনক মৃত্যু অনেক মহিমার।
এক পর্যায়ে মোগলদের আক্রমনে টিকতে না পেরে মির্জা ওসমানের ভাই ও ছেলেরা আত্ম সমর্পন করে। ওসমানের সব যুদ্ধ হাতি জাহাঙ্গীর নগর সুবেদার ইসলাম খানের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঢাকার পোলো খেলার মাঠে এসব যুদ্ধ হাতির প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা করা হয়। পরে এগুলো দিল্লী পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঢাকা থেকে দিল্লীর কঠিন পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক হাতিই পথে মারা যায়।
পোলো মাঠে ওসমানের হাতি “দাস্তা” একজন মোগল সেনাকে আক্রমন করে। হাতির স্মৃতি শক্তি দীর্ঘ আর প্রতিশোধ স্পৃহা তার থেকেও লম্বা। ধারনা করা হয় যুদ্ধ ক্ষেত্রে ওই সেনা দাস্তার মাহুত কে নিহত করে ছিল। তবে কি দাস্তা সুযোগ পেয়ে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও প্রতিশোধ নিয়ে নিল?
আমরা আসলে নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে পর ইতিহাস নিয়ে মাতামাতি করতে পছন্দ করি, তাইতো আমরা ঘোড়ার ব্যাপারে যা জানি তার ১০০ ভাগের এক ভাগ ও জানি না আমাদের গর্ব আমাদের ঐতিহ্য আমাদের যোদ্ধা হাতিগুলো সন্মন্ধ্যে। আমি শিওর এই সব যোদ্ধা হাতি গুলো আজকে ব্রিটিশ বা গ্রিক ঐতিহ্য র সাথে জড়িত থাকলে বিশ্ব ইতিহাসে এদের বীরত্ব অমর হয়ে থাকত।