লাঠিয়াল। আমি জানি আপনাদের অনেকই এই বাংলা শব্দটির সাথে পরিচিত থাকলেও লাঠিয়াল কাকে বলে? এদের কাজ কি ছিল এ গূলো সন্মন্ধ্যে কিছুই জানেন না। জানবেন কি ভাবে আজ থেকে প্রায় ২০/২৫ বছর আগেই লাঠিয়ালদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। আমার কৈশোরে লাঠিয়ালদের বীরত্ব গাথা শুনতাম কখনো হতাম আতংকিত কখনো হতাম পুলকিত। আমি জানি আধুনিক কালে আপনাদের ধারনায় লাঠি শুধু খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
চলুন দেখি লাঠিয়াল কারা ছিল। আগের কালে ছিল জমিদারী প্রথা। সেকালে ছিল না এত বন্ধুক, বোমা আর পিস্তলের ঝনঝনানি। বিভিন্ন সময়ে জমিদারদের মধ্যে বিভিন্ন বিভেদ গায়ের জোরে মিমাংসা করা হত এক্ষেত্র যার যত লাঠিয়াল ছিল তার তত বিজয়ী হবার সম্ভাবনা ছিল। আগের কালের জমিদার, জোতদাররা বংশ পরম্পরায় লাঠিয়াল পুষত। মানে লাঠিয়ালের ছেলে লাঠিয়াল হবে এই আর কি।
সত্যিকারের লাঠিয়াল কিন্তু চাইলেই হওয়া যেত না এর জন্য নিতে হত অনেক দিনের নিগূঢ় প্রস্তুতি। কোন এক ওস্তাদ লাঠিয়ালের অধীনে বছরের পর বছর অনুশীলনের মাধ্যমে একজন লাঠিয়াল তৈরী হত। তারপরই পেত হাতে সত্যিকার লাঠি। সে লাঠি ও যেন তেন লাঠি না। বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাকানো বাশ অনেক দিন ধরে রোদ, পানিতে ভিজিয়ে লোহার মত শক্ত করা হত, এরপর এর গাট গুলো লোহার নাল দিয়ে পাকানী হত। এর পর বেশ কিছুদিন সেই লাঠিকে তেল দিয়ে চকচকে করা হত। ব্যাস তৈরী হয়ে গেল লাঠিয়ালের লাঠি।
একজন সত্যিকারের ওস্তাদ লাঠিয়ালের সামনে পাচ ছয়জন মুসকো জোয়ান কিছুই না। লাঠিয়াল যখন মুখে হুয়াংকার তুলে চোখে বিজলীর বান হেনে রক্ত লাল আখি গোল করে কারো দিকে বিদ্যুত বেগে ছুটে যেত কালবৈশাখীর মত পাচ সাত জন মানূষ ঝরো পাতার মত সেখান দিয়ে উড়ে যেত। আর কোনমতে লাঠিয়াল যদি কোন আক্রমনের মাজ়ে পড়ে যেত তা হলে আর দেখতে হত না ওখানে ঘূর্নি ঝড় বয়ে যেত।
যে কোন যুদ্ধে সবার আগে কথা থাকে কোন মতেই শত্রুর কেন্দ্রে নিজেকে নেয়া যাবে না। সেখানে লাঠিয়ালদের ছিল ভিন্ন মোরাল। প্রথমেই টার্গেট থাকত কি ভাবে শত্রু বূহ্যের মাঝে নিজেকে নিয়ে যাওয়া যায়। এরপর শুরু হত ঘূর্নি ঝড়ের মত আক্রমন। আপনারা আজকের নিনজাদের দেখে খুব উৎফুল্ল হন গ্যারান্টি সে আমালের একজন ওস্তাদ লাঠিয়ালের পাল্লায় পড়লে ওই ধরনের ২/৪ টা নিনজা পালানোর পথ খুজে পেত না।
আমার জীবনে আমি প্রথম লাঠিয়াল দেখি যখন আমি ক্লাশ ৫এ পড়ি। বাবা কর্ম উপলক্ষ্যে তখন ভোলা। আর জানেন তো ভোলা হল দ্বীপ ভুমি। সেকালে কালাবদর, মেঘনায় বিশাল বিশাল ‘চর’ উঠত। ‘চর’ কাকে বলে জানেন নিশ্চয়ই? নদীতে পলি জমলে নদীর মধ্যে ভূখন্ড জেগে ওঠে একে স্থানীয় ভাষায় চর বলে। তো এই চর দখল করার জন্য আগেকার কালের ভোলার দুই একটি পরিবার লাঠিয়াল পুষত।
তো সেবার ওই রকম একটি চর জেগে ওঠে মেঘনায়। ভোলার অতি পুরানো একটি বিখ্যাত পরিবার যাদের পরিবার থেকে মন্ত্রী ও হয়েছে সংগত কারনেই আমি নাম বলব না। তাদের ছিল কয়েক শ লাঠিয়াল। ওই চর প্রথমে স্থানীয় আর এক মহাজন দখল করে, তাদের হটিয়ে দিতে ওই পরিবারের কর্তা কয়েক শ লাঠিয়ালের এক বাহিনী পাঠায়, তখন আমি সেই ছোট কালে দেখছিলাম তাদের অল্প কিছুকে। এখনো যারা আমার স্বপ্নে হানা দেয়। মহিষের মত গায়ের রং অধিকাংশের মাথায় ঝাকড়া চুল কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে সড়কি। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চর দখলে যাচ্ছে। পরে শুন ছিলাম ওই চর দখল করতে যেয়ে প্রায় ৬০/৭০ টা লাশ পড়ছিলো। আধিকাংশ লাশ ই পেট কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হত যার কারনে পরে আর কোন লাশ খুজে পাওয়া যেত না।
আচ্ছা কিভাবে লাঠিয়াল রা চর দখলে আক্রমন করত? প্রথমে রাতের অন্ধকারে সুযোগ বুজে চরের কোন এক জায়গায় সমাবেশ হত। প্রতিপক্ষ হয়ত ইতিমধ্যে দখল নিয়ে চরের মধ্যে অবস্থান নিয়েছে। সাধারনতঃ শেষ রাতে বা ভোরের প্রথম আলো ফোটার সময় হা রে রে রে বলে বিকট চিৎকারে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ত। লাঠির বাড়ীতে প্রতি পক্ষের মাথা ফাটানোর আওয়াজে লাঠিয়াল সন্তুষ্টি নিয়ে পরের জনের ওপর আক্রমন শুরু করত। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জয় পরাজয় মিমাংসিত হয়ে যেত।
আর সে আমালে যে চরের দখল নিতে পারবে সেই চর তার হয়ে যেত বংশ পরাম্পরায়। এরপর সেই চরে চলত মহিষ পালন আর কিছু লাঠিয়াল ওখানে পরিবার নিয়ে স্থায়ী ভিত্তিতে থেকে যেত মালিকের হুকুম দাস হয়ে।
সেই যুগ আর নেই এখন আর লাঠিয়ালদের সেই সময় নেই। নেই সেই বীরত্ব গাথা। আমার দেখা শেষ লাঠিয়াল বেশ কয়েক বছর আগে বেশ কষ্ট পেয়ে ধুকে ধুকে মারা গেছে। নিজের স্কুল ভোলায় কাটানোর কারনে এই ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতা দেখেছিলাম তাই শেয়ার করলাম। হারিয়ে গেছে আমাদের লাঠিয়ালদের বীরত্বব্যঞ্জক গৌরব গাথা।
আজকে আপনাদের কেঊ কেঊ যারা লাঠি খেলা দেখে থাকেন তারা জানেন লাঠি খেলা কি। আর যারা জানেননা তাদের জন্য লাঠি খেলার বর্ননা দিলাম খানিক।
লাঠি খেলা এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ভ্রাম্যমাণ পরিবেশনা শিল্প। গ্রামের সাধারণ মানুষেরা তাদের নৈমিত্তিক জীবনের উৎসব-বাংলা বর্ষ বরণ, বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে লাঠি খেলার আয়োজন করে থাকেন। এক্ষেত্রে সাধারণত কোনো লাঠিয়াল দলকে ভাড়া করে আনা হয়। আর লাঠিয়াল দল তাদের দৈনন্দিন জীবনের পোশাকে বায়না পাওয়া গ্রামে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের ধ্বনি করে ডাক ভাঙতে থাকেন। তাদের সে ডাক ভাঙার শব্দ শুনে গ্রামের লোকজন তো বটেই আশে পাশের গ্রামগুলোতেও লাঠি খেলার সংবাদ প্রকাশ হয়ে যায়
নিয়মাবলী
গ্রামের বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষ ও শিশু, কিশোর ছুটে এসে জমায়েত হতে থাকেন লাঠি খেলার জন্য নির্ধারিত স্থানে। এই অবসরে লাঠিয়ালগণ আয়োজকদের দেওয়া খানা-খাদ্য গ্রহণ করেন এবং খাদ্য গ্রহণের পর নির্ধারিত স্থানে মুখোমুখি হয়ে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে মূল লাঠি খেলা শুরুর ডাক ভাঙেন। এ সময় তারা ডাক ভাঙতে যে সব ধ্বনি ও বাক্য ব্যবহার করেন, তা হচ্ছে-“ও ও ও/তুমি যে কেমন বীর/তা জানবো আমি রে/ও ও ও।” এমন ভাষায় ডাক ভেঙে সকলে মিলে এক সঙ্গে মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করে সাজ-পোশাক পরার জন্য একটি ঘরে ঢোকেন। এ সময় উঠানে পাটি বিছিয়ে একদল বাদ্যকার ঢোল, করতাল ও কাসার ঘড়া বা কলস বাজাতে শুরু করেন। এই সকল বাদ্য বাদনের মাঝখানে লাঠিয়ালগণ সাজ-পোশাকের মধ্যে বিভিন্ন রঙের হাতা-ওয়ালা ও স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে, সাদা রঙের ধুতি বা বর্ণিল ঘাঘরার মতো এক ধরনের বস্ত্র পরে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে, খালি পায়ে বিভিন্ন রঙের লাঠি হাতে খেলার মাঠে নেমে পড়েন। শুরুতে তারা সারি বেধে একটি বৃত্ত রচনা করে খেলার মাঠ প্রদক্ষিণ করেন। মাঠ প্রদক্ষিণ শেষে লাঠিয়ালরা একে একে তাদের হাতের লাঠি খেলার মাঠের কেন্দ্রবিন্দুর মাটিতে রেখে প্রণাম করেন এবং সে লাঠিকে পরক্ষণেই হাতে তুলে নিয়ে বাদ্যযন্ত্র ও বাদ্যযন্ত্রীদের প্রণাম করেন এবং খেলা শুরুর আগে আবার তারা উচ্চস্বরে ডাক ভাঙেন। তারপর বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে দেহে, পায়ে ও হাতে ছন্দ তুলে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করেন, যা অনেকটা দৈহিক কসরতমূলক নৃত্য। লাঠি খেলার মূল আসর শুরুর আগেই এই নৃত্য বেশ আকর্ষণীয়। এক এক এলাকার লাঠি খেলার এই নৃত্যভঙ্গিতে যেমন বেশ বৈচিত্র্য চোখে পড়ে- তেমনি একই এলাকায় প্রচলিত লাঠি খেলার নৃত্যভঙ্গিতেও কিছু বৈচিত্র্য চোখে পড়ে বৈকি।
লাঠি খেলার আসরে লাঠিয়ালদের নৃত্যাংশ শেষ হলে তারা পরস্পর কিছু সংক্ষিপ্ত ও কৌতুককর সংলাপে অংশ নেন। এরপর শুরু হয় লাঠি খেলার মূল পর্ব, যাকে আক্রমণাক্ত লাঠি খেলা বলা যেতে পারে। এ পর্বের শুরুতেই লাঠিয়ালরা সমান সদস্যে দুই দলে বিভক্ত হয়ে লাঠি খেলেন। এক্ষেত্রে বাদ্যের তালে তালে একদল আরেকদলকে লাঠির মাধ্যমে আক্রমণ করতে গিয়ে মুখে বলতে থাকেন-‘খবরদার’, প্রতিপক্ষের লাঠিয়ালরা একই ভাবে সে দলকে প্রতি আক্রমণ করতে গিয়েও বলেন-‘খবরদার’। এ ধরনের লাঠি খেলার একটি প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে খেলার মাঝে কোনো লাঠিয়ালের গায়ে লাঠির আঘাত লাগলে খেলা তাৎক্ষণিকভাবে থেমে যায়, থেমে যায় বাদ্য বাদন। আসলে, লাঠি খেলায় একপক্ষ তার প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে চাইবে ঠিকই কিন্তু অন্যপক্ষকে তা লাঠি দিয়েই ঠেকাতে হয়, না-ঠেকাতে পারলে সে খেলার নিয়ম অনুযায়ী আপনাতেই পরাস্ত হয়ে যায়। তাই লাঠি খেলতে খেলতে কোনো লাঠিয়ালের গায়ে লাঠির আঘাত লাগলে তা খেলা বন্ধ করে দর্শককে জানানোরও একটা রীতি এই খেলায় এভাবে বর্তমান রয়েছে।
গীতি
বাদ্যের তালে তালে যখন দুই দল লাঠিয়ালের লাঠি খেলা চলতে থাকে তখন কখনো কখনো কোনো বাদ্যকার হঠাৎ বাদ্য বাদন রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ভিন্ন প্রকারের লাঠি খেলা করার ইঙ্গিত প্রদান করেন। এক্ষেত্রে লাঠিয়ালদের একজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়া বাদ্যযন্ত্রীর কিছু সংলাপ বিনিময় হয়। মূলত সে সংলাপের ভেতর দিয়েই নতুনভাবে লাঠি খেলা শুরুর ইঙ্গিত ব্যক্ত হয়। দুই দলের বিচিত্র ভঙ্গির লাঠি খেলার মধ্যে হঠাৎ বাদ্যযন্ত্রীদের একজন উঠে বলেন-‘ও মিয়া সাব।’ সঙ্গে লাঠিয়াল সরদার বলেন-‘এই বেটা লাঠি খেলা চলছে...উঠলা কেন! বাজনা বাজাও।’ বাদ্যযন্ত্রী বলেন-‘আস্তে মিয়া সাব, একটা কথা শোনেন...আমি নিজ কানে শুনছি...এই পরিবারের লোক কি বলছে শুনছেন?’ লাঠিয়াল বলেন-‘আর কি বলছে?’ বাদ্যযন্ত্রী বলেন-‘আর দুঃখে মরি যাই...আমরা করি বইসা বইসা আর কিয়ের খাড়িয়ে খাড়িয়ে লড়তাছে...এই নারীরা বলছে এই কথা।’ লাঠিয়াল বলেন-‘ওহ বুঝছি, আপনি নারীদের কথা কানে তুলেছেন!’ বাদ্যযন্ত্রী বলেন-‘আরে আপনারা কানে কম দেখেন দেখছি।’ লাঠিয়াল বলেন-‘হ হ কানে কম শুনি। আরে জাতিই তো আমরা দুইটা, একটা মিয়ালোক আরেকটা পুরুষ।’ বাদ্যযন্ত্রী বলেন-‘তাই তো মিয়া সাব, এখন বইসা বইসা মিয়ালোকের মতো লাঠি দিয়া বাইটা দেখাইতে হইবো।’ লাঠিয়াল বলেন-‘যদি না পারি।’ বাদ্যযন্ত্রী বলেন-‘এক্ষুণি গলায় হাত দিয়া বাইর করে দেবে মিয়া সাব।’ লাঠিয়াল বলেন-‘কেডা ঘাড়ে হাত দিয়া বাইর কইরা দিবো?’ বাদ্যযন্ত্রী বলেন-‘আমিই দেবো।’ লাঠিয়াল বলেন-‘এতো ক্ষেমতা ক্যা! তুমার হাড়ির ভাত খাইয়া এখানে আইছি নাকি!’ বাদ্যযন্ত্রী এবার আয়োজকদের পক্ষ নিয়ে বলেন-‘ও মিয়া সাব, এরা দুই হাজার টাকা দেছে মাঙনা না!’ লাঠিয়াল বলেন-‘মাইনা দিয়া আনছে। খাইছি দাইছি খেলছি...এখন এমনে না ওমনে, ওমনে না এমনে। আমরা এমনেও পারবো না ওমনেও পারবো না। আমরা যেইডা পারি সেইডাই খেইলা যাবো।’ বাদ্যযন্ত্রী বলেন-‘ও মিয়া সাব তাইলে যে ওস্তাদের ওস্তাদি থাকে না।’ লাঠিয়াল এবার মহা বিরক্ত হয়ে বলেন-‘এই বেটা তুমি তো জবর অপমানের মানুষ। আচ্ছা, এই কথাডা ফাস্টেই কয়া দিলেই হতো যে, এখন বইসা বইসা বাইটা দেখাও। দেখাইয়া দিতাম খেলা শেষ...এখন কও ওস্তাদের ওস্তাদি থাকে না!’ বাদ্যযন্ত্রী বলেন-‘এইবার যখন বুঝছো তখন লাঠির মাঝখানে ধইরা বইসা বইসা সবাই মেইলা সুন্দর কইরা বাইটা দিতে হইবে।’ সাথে লাঠিয়াল বাদ্যযন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন-‘ও মিয়ারা দেখো তাইলে...এই বাজাও বাদ্য।’ শুরু হয় বসে বসে লাঠি খেলার একটি ছন্দময় উপস্থাপনা। বেশ কিছুক্ষণ সে খেলা চলতে চলতে আবার নতুন করে দর্শক, বাদ্যযন্ত্রী কিংবা লাঠিয়ালদের একে অপরের মধ্যে কৌতুককর কিছু সংলাপ বিনিময়ের পর আবার নতুনভাবে লাঠি খেলা চলে। দলগতভাবে লাঠি খেলা প্রদর্শন ছাড়াও দুইজন লাঠিয়াল আলাদা আলাদাভাবেও লাঠি খেলা উপস্থাপন করে থাকেন। একদিনের জন্য লাঠি খেলার জন্য দশ সদস্যের একটি লাঠিয়াল দল সাধারণত দুই হাজার টাকা থেকে পাঁচশত টাকা পর্যন্ত পরিবেশনার সম্মানী গ্রহণ করেন।
লাঠি খেলা মূলত কসরৎমূলক ভ্রাম্যমাণ নাট্যমূলক শিল্প। এক সময় বাংলাদেশের সর্বত্র এই লাঠি খেলা শিল্পের প্রচলন ছিল। বর্তমানে এই তা কেবল মানিকগঞ্জ, জয়পুরহাট, নড়াইল, শ্রীমঙ্গল, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে মানিকগঞ্জ অঞ্চলের লাঠি খেলার আসরে কখনো কখনো নৃত্যগীত পরিবেশন করা হয়। শুধু তা-ই নয়, কখনো কখনো উজ্জ্বলবর্ণের পোশাক পরে কিছু কৌতুককারী উক্ত অঞ্চলের লাঠি খেলার আসরে উপস্থিত হন এবং তারা সামাজিক রীতি-নীতির নানা রূপ বিষয় নিয়ে কৌতুক উপস্থাপন করে থাকেন। তাদের কৌতুক ও লাঠি খেলার ফাঁকে ফাঁকে লাঠিয়ালগণ বিভিন্ন ধরনের পৌরুষদীপ্ত নৃত্য পরিবেশন করেন। আসলে, লাঠি খেলার সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, লাঠি খেলায় দু’দল লাঠিয়াল পরস্পরকে কৃত্রিমভাবে আক্রমণ করে থাকেন। প্রতি আক্রমণে নতুন কৌশল প্রয়োগের আগে লাঠিয়ালগণ সুছন্দে নৃত্য প্রদর্শন করে পুনরায় খেলায় লিপ্ত হন। এ সময় লাঠিয়ালদের আক্রমণ নৃত্যের সঙ্গে নাট্যরস ঘনীভূত করতে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢাক-ঢোলক, মৃদঙ্গ-করতাল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এক সময় কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ অঞ্চলে কাহিনী ভিত্তিক লাঠি খেলা হতো, সেক্ষেত্রে কাহিনীর বিষয়গুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলো, যেমনডাকাত খেলা, যুদ্ধ খেলা ইত্যাদি। এখন কাহিনী ভিত্তিক লাঠি খেলার সে চল আর কোথাও দেখা যায় না। লাঠি খেলা সাধারণত বাঙালি মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত থাকলেও শ্রীমঙ্গল থানার বিভিন্ন চা-বাগানের শ্রমিকদের মাঝে ‘কাঠি নাচ’ নামে এক বিশেষ প্রকারের লাঠি খেলার প্রচলন রয়েছে। সাধারণত ফাল্গুন মাসের চাঁদ আকাশে দেখা দেবার প্রথম রাত থেকেই শ্রীমঙ্গল অঞ্চলের চা-শ্রমিকেরা তাদের পাড়ায় পাড়ায় ঢোল বাজিয়ে গান গেয়ে গেয়ে কাঠি নাচ বা লাঠি খেলার জন্য বিভিন্ন ধরনের লাঠি বা কাঠি চুরি করে থাকেন। চুরি করা সেই লাঠিগুলো নিয়ে তারা বাদ্যের তালে তালে গান গেয়ে বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে নানা রকমের দৈহিক কসরৎ ও নাচ করেন। শেষ রাতে তারা সে লাঠিগুলো চা-বাগানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পাহাড়ি ছরা বা গাঙের ধারে রেখে আসেন। পরদিন সন্ধ্যা থেকে আবার নতুন করে লাঠি চুরি ও সে লাঠি নিয়ে আগের মতোই খেলা, নাচ, গান করে একই স্থানে লাঠিগুলো রেখে আসা হয়। এভাবে একটি স্থানে তাদের চুরি করা লাঠি জমতে জমতে এক সময় একটি মিনারের আকার ধারণ করে। উল্লেখ্য, লাঠি বা লাকড়ি চুরির সময় গায়কেরা সাধারণত এমন সব আদিরসাত্মক গান করতে থাকেন যা শুনে ঘরের মেয়েরা বাইরে বেরোতে লজ্জা পান। যেমন, লাঠি বা লাকড়ি চুরির একটি গানে আছে-‘শমৎ বাবা শমৎ বাবা, লে লাকড়ি/চোদে কে দিহে এগো যোয়ান ছোকড়ি॥’ লাঠি চোরাদের এ রকম আদিরসাত্মক গান শুনে কোনো বাড়ির কোনো নারী যখন লজ্জায় ঘর থেকে বের হন না তখন সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লাঠি চোরা গায়কেরা অতি সহজেই সে বাড়ি থেকে লাঠি চুরি করে থাকেন। এভাবে ফাল্গুনের চাঁদ দেখা যাবার প্রথম রাত থেকে লাঠি চুরি করে করে ছরা বা গাঙের ধারে পূর্ণিমার আগের দিন পর্যন্ত জমানো হয়। জমানো সেই লাঠিগুলোকে চা-শ্রমিকেরা ‘শমৎ বাবা’ বলে থাকেন। পূর্ণিমার দিন সকালে সবাই মিলে øান করে এসে ‘শমৎ বাবা’কে জ্বালানো হয়। জ্বালানো লাঠির ছাই ও কাদা দিয়ে চা-শ্রমিকেরা খেলা করেন। রাতে নাচ-গান করেন আর পরদিন সকালে রং খেলেন। আর রং খেলা শুরুর দিন থেকে প্রায় ২/৩ দিন ধরে কাঠি নাচ বা লাঠি নাচ চলে।
চলচিত্র
১৯৭৫ সালে এ দেশে প্রবর্তিত হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রথম পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান হয় ১৯৭৬ সালের ৪ এপ্রিল। এতে 'লাঠিয়াল' ছবিটি ৬টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করে। দেশের প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ছবি এটি। ছবিটি সেরা প্রযোজক, পরিচালক, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, সহ-অভিনেতা, সহ-অভিনেত্রী, চিত্র সম্পাদকের পুরস্কার পায়। এ ছবিতে অভিনয় করে প্রথমবারের মতো জাতীয় স্বীকৃতি পান আনোয়ার হোসেন ও ফারুক। মিতা পরিচালিত ছবিটি নানা কারণে আলোচিত হয়। সমালোচকরা ছবিটি বাস্তবতাকে ছুঁয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা বলে মন্তব্য করেন। সমাজের সব পরিবারেই নানা মতের মানুষ থাকে। তারা ঘটনাক্রমে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এটাই 'লাঠিয়াল'-এর বিষয়বস্তু। ছবিটির নির্মাণশৈলী এখনও মানুষকে মুগ্ধ করে। এর একটি প্রিন্ট এখনও ফিল্ম আর্কাইভে জমা আছে। ছবিটিতে আরও আছেন ববিতা, রোজী প্রমুখ।
লাঠিয়াল ছবির লিঙ্ক দেখুন ব্লগার মেলবোর্ন এর সৌজন্যে
https://www.youtube.com/watch?v=iUiujtUebpA
গান
লাঠিয়ালদের নিয়ে জেমসের সেই গান শুনুন ব্লগার মেলবোর্ন এর সৌজন্যে
https://www.youtube.com/watch?v=7dqbgFB2RQg
কবিতা
লাঠিয়ালদের নিয়ে পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের নক্সী কাথার মাঠ এ চমৎকার কিছু ছত্র আছে
পাটার মত বুকখানিতে থাপড় মারে শাবল হাতে,
বুকের হাড়ে লাগল বাড়ি, আগুন বুঝি জ্বলবে তাতে!
লম্ফে রুপা আনলো পেড়ে চাং হতে তার সড়কি খানা,
ঢাল ঝুলায়ে মাজার সাথে থালে থালে মারল হানা।
কোথায় রল রহম চাচা, কলম শেখ আর ছমির মিঞা,
সাউদ পাড়ার খাঁরা কোথায়? কাজীর পোরে আন ডাকিয়া?
বন-গোঁয়োরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরে গফর-গাঁয়ে,
এই কথা আজ শোনার আগে মরিনি ক্যান্ গোরের ছায়ে?
'আলী-আলী' হাঁকল রুপাই, হুঙ্কারে তার গগন ফাটে,
হুঙ্কারে তার গর্জে বছির আগুন যেন ধরল কাঠে।
ঘুম হতে সব গাঁয়ের লোকে শুনল যেন রুপার বাড়ি;
আকাশ হতে ভাঙছে ঠাটা, মেঘে মেঘে লাগছে বাড়ি।
ডাক শুনে তার আস্ল ছুটে রহম চাচা, ছমির মিঞা,
আস্ল হেঁকে কাজেম খুনী নখে নখে আচঁড় দিয়া।
আস্ল হেঁকে গাঁয়ের মোড়ল মালকোছাতে কাপড় পরি,
এক নিমিষে গাঁয়ের লোকে রুপার বাড়ি ফেলল ভরি।
লম্ফে দাঁড়ায় ছমির লেঠেল, মমিনপুরের চর দখলে,
এক লাঠিতে একশ লোকের মাথা যে জন আস্ল দলে।
দাঁড়ায় গাঁয়ের ছমির বুড়ো, বয়স তাহার যদিও আশী,
গায়ে তাহার আজও আছে একশ লড়ার দাগের রাশি।
গর্জি উঠে গদাই ভুঁঞা, মোহন ভূঁঞার ভাজন* বেটা,
যার লাঠিতে মামুদপুরের নীল কুঠিতে লাগল লেঠা।
সব গাঁর লোক এক হল আজ রুপার ছোট উঠান পরে,
নাগ-নাগিনী আসল যেন সাপ খেলানো বাঁশীর স্বরে।
রুপা তখন বেড়িয়ে তাদের বলল, "শোন ভাই সকলে,
গাজনা চরের ধানের জমি আর আমাদের নাই দখলে।"
বছির মামু বলছে খবর - মোল্লারা সব কালকে নাকি;
আধেক জমির ধান কেটেছে, আধেক আজও রইছে বাকি।
"মোদের খেতে ধান কেটেছে, কালকে যারা কাঁচির খোঁচায়;
আজকে তাদের নাকের ডগা বাঁধতে হবে লাঠির আগায়।"
থামল রুপাই - ঠাটা যেমন মেঘের বুকে বাণ হানিয়া,
নাগ-নাগিনীর ফণায় যেমন তুবড়ী বাঁশীর সুর হাঁকিয়া।
গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাটিম হেন ঘোড়ার লাঠি,
রোহিত মাছের মতন চলে, লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি।
রুপাই তাদের বেড়িয়ে বলে, "থাল বাজারে থাল বাজারে,
থাল বাজারে সড়কি ঘুরা হান্রে লাঠি এক হাজারে।
হান্রে লাঠি-হান্রে কুঠার, গাছের ছ্যান* আর রাম-দা-ঘুরা,
হাতের মাথায় যা পাস যেথায় তাই লয়ে আজ আয়রে তোরা।"
"আলী! আলী! আলী!! আলী!!!" রুপার যেন কন্ঠ ফাটি,
ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজে কাঁপ্ছে আকাশ কাঁপছে মাটি।
তারি সুরে সব লেঠেলে লাঠির পরে হানল লাঠি,
"আলী-আলী" শব্দে তাদের আকাশ যেন ভাঙবে ফাটি।
আগে আগে ছুটল রুপা - বৌঁ বৌঁ বৌঁ সড়কি ঘোরে,
কাল সাপের ফণার মত বাবরী মাথায় চুল যে ওড়ে
চল্ল পাছে হাজার লেঠেল "আলী-আলী" শব্দ করি,
পায়ের ঘায়ে মাঠের ধুলো আকাশ বুঝি ফেলবে ভরি।
চল্ল তারা মাঠ পেরিয়ে চল্ল তারা বিল ডিঙিয়ে
কখন ছুটে কখন হেঁটে বুকে বুকে তাল ঠুকিয়ে।
চল্ল যেমন ঝড়ের দাপে ঘোলাট মেঘের দল ছুটে যায়,
বাও কুড়ানীর মতন তারা উড়িয়ে ধূলি পথ ভরি হায়।
দুপুর বেলা এল রুপাই গাজনা চরের মাঠের পরে,
সঙ্গে এল হাজার লেঠেল সড়কি লাঠি হস্তে ধরে।
লম্ফে রুপা শূন্যে উঠি পড়ল কুঁদে মাটির পরে,
থাক্ল খানিক মাঠের মাটি দন্ত দিয়ে কামড়ে ধরে।
মাটির সাথে মুখ লাগায়ে, মাটির সাথে বুক লাগায়ে,
"আলী! আলী!!" শব্দ করি মাটি বুঝি দ্যায় ফাটায়ে।
হাজার লেঠেল হুঙ্কারী কয় "আলী আলী হজরত আলী,"
সুর শুনে তার বন-গেঁয়োদের কর্ণে বুঝি লাগল তালি!
তারাও সবে আসল জুটে দলে দলে ভীম পালোয়ান,
"আলী আলী" শব্দে যেন পড়ল ভেঙে সকল গাঁখান!
সামনে চেয়ে দেখল রুপা সার বেঁধে সব আসছে তারা,
ওপার মাঠের কোল ঘেঁষে কে বাঁকা তীরে দিচ্ছে নাড়া।
রুপার দলে এগোয় যখন, তারা তখন পিছিয়ে চলে,
তারা আবার এগিয়ে এলে এরাও হটে নানান কলে।
এমনি করে সাত আটবারে এগোন পিছন হল যখন,
রুপা বলে, "এমন করে 'কাইজা' করা হয় না কখন।"
কৃতজ্ঞতাঃ উইকি
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:৫০