ইসলামের দৃষ্টিতে কেয়ামতের আলামত প্রথম পর্ব (ইমাম মাহদী আঃ)
ইসলামের দৃষ্টিতে কেয়ামতের আলামত দ্বিতীয় পর্ব (দাজ্জাল ও দাব্বাতুল আরদ)
হযরত ঈসা (আঃ)
ইমাম মাহদীর সাথে দাজ্জাল যুদ্ধ যখন আসন্ন হবে ঠিক এমনি সময়ে হযরত ঈসা (আঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসে আসরের সময় অবতীর্ন হবেন। এ প্রসঙ্গে মাওলানা শাহ রফী উদ্দীন (রঃ) লিখেন একদিন আসরের নামযের আযান হলে লোকজন আসরের নামাযের প্রস্তুতি নিতে থাকবে। এমন সময় হযরত ঈসা (অঃ) দুজন ফেরেশতার কাধে ভর দিয়ে আকাশ থেকে অবতরন করবেন এবং জামি মসজিদের পূর্ব মিনারে দাঁড়িয়ে সিড়ি দেবার জন্য ডাকতে থাকবেন। তখন সিড়ির ব্যাবস্থা হবে তিনি সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসবেন।
তিনি নীচে নেমে এসে ইমাম মাহদী (আঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করবেন। ইমাম মাহদী (আঃ) অত্যান্ত আদবের সাথে তাকে আসরের নামাযের ইমামত করতে অনুরোধ করবেন। তখন হযরত ঈসা (আঃ) বলবেন, না ইমামত আপনাকেই করতে হবে। আল্লাহতালা এই সন্মান শুধু এই উন্মতকেই দান করেছেন। তারপর ইমাম মাহদী (আঃ) নামায পড়াবেন আর হযরত ঈসা (আঃ) একজন মুক্তাদী হিসাবে তার পিছনে নামায পড়বেন। লক্ষ্যনীয় ঈসা (আঃ) একজন নবী হয়েও আখেরী জামানার নবীর একজন উন্মতের পেছনে নামায পড়ছেন। সুবাহানাল্লাহ।
নামায শেষে ইমাম মাহদী (আঃ) হযরত ঈসা (আঃ) বলবেন, হে আল্লাহর নবী, সৈন্য পরিচালনার ভার আপনার ওপর অর্পিত থাকল। আপনি নিজে ইচ্ছে মত সমাধা করুন। তিনি বলবেন, সেনাবাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব আপনাকেই পালন করতে হবে। আমি শুধু দাজ্জাল কে নিপাত করতে এসেছি। কারন তার মৃত্যু আমার হাতেই নির্ধারিত (আলামাতে কিয়ামত)। লক্ষনীয় ইমাম মাহাদী (আঃ) এর বিনয় হযরত ঈসা (আঃ) প্রতি।
ওদিকে দাজ্জাল তার বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্বে যুদ্ধ যাত্রা করবে। মুসলমানগন ও এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তারা দাজ্জালের মোকাবেলায় অগ্রসর হবে। শুরু হবে ঘোরতর যুদ্ধ । দাজ্জাল ও হযরত ঈসা (আঃ) ‘লুদ্দা’ নামক স্থানে উভয়ের মুখোমুখি হবেন। যুদ্ধে দাজ্জাল হযরত ঈসা (আঃ) এর হাতে নিহত হয়ে মুসলমানদের বিজয় সূচিত হবে।
দাজ্জালের সমর্থকরা তখন মুসলিম বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সকল চেষ্টা করেও ব্যার্থ হ বে। এমন কি ইয়াহুদীরা রাতে কোন গাছ বা পাথরের আড়ালে লুকানোর চেষ্ট করলেও সেই জ়ড় বস্তু উচ্চস্বরে আওয়াজ দিয়ে ওই পলাতক ইয়াহুদীকে ধরিয়ে দেবে।
এরপর ঈমাম মাহদী অল্প কিছুদিন জীবিত থাকবে। তার মৃত্যুর পর হযরত ঈসা (আঃ) মুসলিম সাম্রাজ্যর অধিপতি হবেন। অনেক বছর তিনি শান্তি শৃঙ্খলার সাথে দেশ শাষন করবেন।হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্নিত নবী করিম (সাঃ) ইশরাদ করেছেন হযরত ঈসা (অঃ) অবতরনের পর চল্লিশ বছর পৃথিবীতে অবস্থান করবেন। ঈসা (আঃ) এর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে লোকজন আবার অসৎ পথ অবলম্বন করবে। দেশে পাপের বন্যা প্রবাহিত হবে।
মুসনাতে আহমদ গ্রন্থে হযরত ঈসা (আঃ) কে চেনার কিছু উপায় বর্নিত আছে। তিনি মধ্যম আকৃতির ও গৌড় বর্নের হবেন। শরীরে লালচে দুটি চাদর জড়ানো থাকবে। দেখতে তাকে এমন দেখাবে তিনি যেন এই মাত্র গোসল সেরে আসলেন।
ইয়াজুজ ও মাযুয
কিয়ামত নিকটবর্তী হবার পর অপর একটি বড় আলামত হল পৃথিবীতে ইয়াজুজ-মাযুয নামে দুটি চরম অত্যাচারী গোত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। হযরত ঈসা (আঃ) অবতরনের পর এই জাতি দুটির প্রকাশ ঘটবে। ফাতাহুল বারী র ৬ষ্ঠ খন্ডে হযরত কাতাদা (রাঃ) বলেন এরা মানুষের আকৃতি হবে এবং হযরত নুহ (আঃ) এর পুত্র ইয়াকা এর বংশধর থেকে হবে। তাফসীরে তাবারী গ্রন্থ মতে তারা পৃথিবীর উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দা হবে, বর্তমানের আরমেনিয়া ও আযারবাইযানের পাশাতবাগ তাদের আবাসস্থল উল্লেখ্য করা হয়।
ইয়াজুজ-মাযুয দেখতে মানুষের মত কিন্তু তাদের স্বভাব হবে চতুস্পদ জন্তুর ন্যায়। দেহের সন্মুখ ভাগ মানূষের ন্যায় কিন্তু পিছনের ও নিম্নভাগ চতুস্পদ জন্তুর ন্যায়। দুনিয়ের এক সীমান্তে এরা বাস করে। এরা মানুষ বৃক্ষলতা সব ভক্ষন করে। এক সময় মানুষ জাতির ওপর এরা ভীষন অত্যাচার চালাত। হযরত শাহ সেকান্দার সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মান করে মানব এলাকায় আসার পথ বন্ধ করে দেয়।
ওরা উক্ত প্রাচীরটি জিহ্বা দ্বারা প্রতিদিন চাটতে থাকে আবার সন্ধ্যার সময় উক্ত প্রাচীর আবার পূর্বের অবস্থায় ফেরত যায় মানে পূর্নাঙ্গ অবস্থা লাভ করে। এভাবে কিয়ামতের আগ পর্যন্ত চলতে থাকবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন এ দেয়াল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখনই ইয়াজুজ-মাযুযের দল স্রোতের ন্যায় মানুষের এলাকায় ডুকে পড়বে। তারা সব কিছু খেয়ে ফেলবে। পানির পিপাসায় তারা দুনিয়ার সব সাগর মহাসাগরের সব পানি খেয়ে ফেলবে। তাদের দৌরাত্মে দুনিয়া তছনছ হয়ে যাবে। এমত অবস্থায় হযরত ঈসা (আঃ) মুসলমানদের নিয়ে দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। দেখা দেবে মহামারী সে মহামারীতে এই অত্যাচারী সম্প্রদায় ধ্বংশ হয়ে যাবে।
পবিত্র কোরানে সুরা কাহফে ৯৪-৯৯ আয়াতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা আছে।
قَالُوا يَا ذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَى أَن تَجْعَلَ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ سَدًّا 94
তারা বললঃ হে যুলকারনাইন, ইয়াজুজ ও মাজুজ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। আপনি বললে আমরা আপনার জন্যে কিছু কর ধার্য করব এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দেবেন।
قَالَ مَا مَكَّنِّي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا 95
তিনি বললেনঃ আমার পালনকর্তা আমাকে যে সামর্থø দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেব।
آتُونِي زُبَرَ الْحَدِيدِ حَتَّى إِذَا سَاوَى بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ انفُخُوا حَتَّى إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ آتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ قِطْرًا 96
তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেল, তখন তিনি বললেনঃ তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক। অবশেষে যখন তা আগুনে পরিণত হল, তখন তিনি বললেনঃ তোমরা গলিত তামা নিয়ে এস, আমি তা এর উপরে ঢেলে দেই।
فَمَا اسْطَاعُوا أَن يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ نَقْبًا 97
অতঃপর ইয়াজুজ ও মাজুজ তার উপরে আরোহণ করতে পারল না এবং তা ভেদ করতে ও সক্ষম হল না।
قَالَ هَذَا رَحْمَةٌ مِّن رَّبِّي فَإِذَا جَاء وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاء وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا 98
যুলকারনাইন বললেনঃ এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ। যখন আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত সময় আসবে, তখন তিনি একে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন এবং আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুতি সত্য।
وَتَرَكْنَا بَعْضَهُمْ يَوْمَئِذٍ يَمُوجُ فِي بَعْضٍ وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَجَمَعْنَاهُمْ جَمْعًا 99
আমি সেদিন তাদেরকে দলে দলে তরঙ্গের আকারে ছেড়ে দেব এবং শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে। অতঃপর আমি তাদের সবাইকে একত্রিত করে আনব।
সুরা আম্বিয়া ৯৬ নং আয়াত।
حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُم مِّن كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ 96
যে পর্যন্ত না ইয়াজুজ ও মাজুজকে বন্ধন মুক্ত করে দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যেক উচ্চভুমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে।
তিনটি ভয়াবহ ভূমিকম্প ও পৃথিবী ধোয়ায় আচ্ছন্ন
হযরত ঈসা (আঃ) ওফাতের পর সমগ্র পৃথিবীতে তিনটি ভয়ানক ভূমিকম্প হবে। এক হাদীসে বলা হয়েছে একটি মক্কা মদীনার মধ্যবর্তী বায়দা মরু আঞ্চলে ঘটবে। ইতিমধ্যে ধোয়া সমস্ত পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। ফলে মুসলমানরা স্নায়ু দূর্বলতা ও সর্দিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে আর কাফেররা সংজ্ঞাহীন হবে এ অবস্থা চল্লিশ দিন অব্যাহত থাকবে। এরপর পৃথিবী ধোয়ামুক্ত হবে। ( আলামতে কিয়ামত)
পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় ও তওবার দরজা বন্ধ
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে বুজা যায় দাব্বাতুল আরদের প্রকাশের কিছু পূর্বে কিংবা তার কিছু পরই সিঙ্গায় ফুৎকারের আগে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয়ের ঘটনা ঘটবে। এ অস্বাভাবিক ঘটনার পর থেকে কোন কাফিরের ঈমান কিংবা ফাসিকের তওবা কবুল হবে না। এই ঘটনায় ঈমানদারগন রাতভর আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করবে। এই রাতের পর সূর্য পশ্চীম দিক থেকে উদিত হয়ে আবার পশ্চিম দিকে অস্ত যাবে। পরের দিন সূর্য আবার পূর্ব দিক থেকে উদিত হয়ে পশ্চিম দিকে অস্ত যাবে। এর কিছুদিন পরেই কিয়ামত সংগঠিত হবে।
কুরানের অক্ষর বি্লোপ
পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের পর আতংকগ্রস্থ মানূষ দেখতে পাবে পবিত্র কোরানে কোন অক্ষর নেই। শুধুই সাদা কাগজ অবশিষ্ট আছে।
দক্ষিনের বায়ূ
দাব্বাতুল আরদ অদৃশ্য হবার পর দক্ষিন দিক থেকে এক প্রকার বায়ু প্রবাহিত হবে। এই বায়ুর প্রভাবে মুমিনগন কিছুটা অসুস্থ্য হয়ে পড়বে আর দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। এরপর পর পৃথবীতে এক ধরনের কালো মানূষের আধিপত্য হবে আর কাবা ঘর ধ্বংস সাধন করবে। বন্ধ হবে হজ্জ পালন।
মহা অগ্নিশিখা
কিয়ামতের সর্বশেষ আলামত হবে দক্ষিন দিক থেকে একটি মহা অগ্নিশিখা প্রকাশিত হয়ে মানুষকে উত্তর দিকে ধাওয়া করা শুরু করবে। লোকজন ক্রমশ উত্তর দিক সরে যাবে। কিয়ামত অতি নিকটবর্তী।
শিঙ্গায় ফুৎকার
অবশেষে একদা একটি আওয়াজ শোনা যাবে এই আওয়াজ ক্রমে মৃদু থেকে ধীরে ধীরে প্রচন্ডতর হতে থাকবে এবং সর্বত্র একই রকম শোনা যাবে এটিই সেই মহা ফুৎকার কিয়ামতের শুরু।
আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন
শেষ
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৯