আলকেমী এক রহস্যময় আধ্যায়। আলকেমী বলতে আমারা বুজি অপরসায়ন, মানে যে বিদ্যার দ্বারা অন্য কোন ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করা। আলকেমী শব্দটি আরবী ‘আল-কিমিয়া’ থেকে এসেছে। আল কেমী নিয়া যারা গবেষনা করতেন তাদের বলা হয় আল কেমিষ্ট। এদের গবেষনার মুলত দুটি ধারা আছে, এক পরমায়ু লাভ করা। দ্বিতীয়ত সস্তা ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করা। অলিয়াস বারকিয়াসের মতে টুবাল কেইনের সময় থেকে আলকেমীর চর্চা শুরু হয়। বাইজান্টেনিয়াম পুরোহিতদের আলকেমির পিতৃপুরুষ ধরা হয়।
তাদের মতে মিশরে সর্বপ্রথম আলকেমির চর্চা শুরু করে পুরোহিতরা। খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ট্রিস ম্যাগিষ্টাস নামে এক পুরোহিতের কথা জানা যায় যিনি বিভিন্ন বিদ্যার আবিস্কারক হিসাবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। এই খ্যাতি তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যা তাকে ঈশ্বরের সমকক্ষ তুল্য করে। তার নাম অনুসারে ই পরবর্তীতে আল কেমী একটি “হামেটিক আর্ট” বা গোপন বিদ্যা রূপে পরিচিতি লাভ করে। আল কেমী নিয়ে রচিত বই পত্র গোপন সাংকেতিক ভাষায় লিখিত হত বিধায় এর রহস্যময়তা আরো বিস্তার লাভ করে।
আল কেমীর ইতিহাস নিয়ে ঘাটলে দেখা যায় তিন জাতি আলাদা আলাদা ভাবে এই পরশ পাথরের খোজে আত্মনিয়োগ করে এরা হল চীনা জাতি, ইন্ডিয়ান জাতি আর গ্রেকো-রোমান জাতি যেখান থেকে পরে আরাবীয়দের হাতে আসে। আরাবীয়রা আলকেমী নিয়ে এত গবেষনা করে যে আলকেমী আর আরব জাতি প্রায় অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত হয়ে পরে।
আষ্টম শতাব্দীতে আরব রসায়নবিদ জাবের বিন হাইয়াম আল কেমীকে আবার পাদ প্রদীপের নীচে নিয়ে আসেন এ ব্যাপারে তিনি প্রচুর পরীক্ষা নিরিক্ষা চালান তার ল্যাবরেটরীতে। এই আলকেমী নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আরব রাসায়নবিদরা কিন্তু আবিস্কার করে ফেলে সালফিউরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড আর এ্যাকোয়া রেজিয়ার মত প্রয়োজনীয় পদার্থ। এই আবিস্কার সেই সময় আল কেমীদের সন্মানের চূড়ায় নিয়ে যায়। প্রসঙ্গত এ কথা বলে যাই, বলা হয়ে থাকে আলকেমীর সাথে অ্যান্তনীয় ল্যাভয়সিয়ে আর চার্লস বয়েলের মত নামী রসায়নবিদের নাম ও জড়িত। তারা নাকি গোপনে আলকেমীর চর্চা করত
আল কেমীর ইতিহাস থেকে জানা যায় দু ধরনের আলকেমী ছিল এক দল অত্যান্ত নিষ্ঠার সাথে সারা জীবন নিরলস ভাবে লোহাকে সোনায় রূপান্তরিত করার চেষ্ঠা করছে আর একদল ছিল এটাকে পুজি করে প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছে।
আলকেমীর প্রসার শুরু হয় আলেকজান্দ্রিয়া থেকে, এখন থেকেই আলকেমী রোমান সম্রাজ্য ও ইউরোপে প্রবেশ লাভ করে। রোমান সম্রাজ্যর পতনের সময় আলকেমী কনস্ট্যান্টিপোলে ছড়িয়ে পরে। এখান থেকেই রসায়ন বিষয়ক গ্রীক গ্রন্থাবলী বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পরে। নিষ্ঠার সাথে অনেক আল কেমিষ্ট আলকেমীর চর্চা করলেও অনেক প্রতারনা ও ঠগবাজীর উদাহরন বিরল নয়। বস্তুত পক্ষে প্রতারনার পরিমান এত বেশী হয়ে গেছিল যে সম্রাট ডাইওক্লোটিন ( ২৮৪-৩০৫ খ্রীষ্টাব্দ) আলকেমীর সমস্ত মিশরীয় গ্রন্থাবলী পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন।
বিভিন্ন বিচিত্র প্রক্রিয়ায় এই প্রতারনা করা হত। যেমন ফাপা একটি লোহার দন্ডের ভেতর স্বর্ন ঢুকিয়ে দু পাশের ছিদ্র মোম দিয়ে গলিয়ে বন্ধ করে দেয়া হত। এরপর একটি পাতিলে কিছু সস্তা ধাতু আর কিছু আজেবাজে জিনিস মিশিয়ে ওই লোহার দন্ড দ্বারা আস্তে আস্তে নাড়াত। এতে দন্ডের মোম গলে যেত আর দন্ডের ভেতর তাল করা সোনা ওই পাতিলে জমা হত।
আর একটি প্রতারনা ছিল অর্ধেক সোনা ও অর্ধেক লোহা দিয়ে তৈরী একটি পেরেক নিয়ে তাতে কালো কালি দিয়ে প্রলেপ দেয়া হত, এরপর একটি গামলায় কিছু রাসায়নিক দ্রব্যাদি দিয়ে সোনার অর্ধেক দিয়ে ওই দ্রবন নাড়ানো হত, এতে কিছু সময় পরে কালো আবরন ঊঠে যেত আর বলত যে অংশ দ্রবনে ডুবানো হয়েছে সেই অংশ সোনায় পরিনত হয়েছে। এগুলো ছিল প্রতারনার সাধারন কিছু কৌশল।
কিন্তু একবার এক পার্শি আলকেমিষ্ট যে ঘটনা তা আজো ইতিহাস হয়ে আছে। ওই পার্শি আল কেমিষ্ট দামেস্কে পৌছে প্রথমে এক হাজার দিনার স্বর্নমুদ্রা যোগার করে টুকরো টুকরো করে তার সাথে আটা ময়দা কয়লা মিশিয়ে ছোট ছোট ট্যাবলেট তৈরী করেন। এরপর ট্যাবলেট গুলো শুকিয়ে গেলে তিনি দরবেশের বেশ ধরে ওই ট্যাবলেটের নাম দেন ‘খোরসানের তবারমাক’। আর তা এক ঔষধ বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেন।
এরপর বাসায় ফিরে দামী জোব্বা পরে মসজিদে যান নাময পড়তে ওখানে তার সাথে পরিচয় হয় বেশ কিছু গন্যমান্য ব্যাক্তির সাথে যাদের কে তিনি নিজে একজন আলকেমী পরিচয় দিয়ে বলেন যে একদিনে অনেক সোনা তৈরী করতে পারবেন। একথা গেল দামেস্কের উজিরের কানে তিনি একদিন ওই পার্শিকে সম্রাটের দরবারে ডেকে সম্রাটের সামনে সোনা তৈরী করতে বলেন। পার্শি সম্রাটকে বিভিন্ন জিনিসের একটি লিষ্ট দেন যার মধ্যে খোরসানের তবারমাক’ ও ছিল।
সব জিনিস খুব সহযে পাওয়া যায় কিন্তু ‘খোরসানের তবারমাক’ আর পাওয়া যায় না। পরে সুলতানের লোকেরা অনেক কষ্ট করে ‘খোরসানের তবারমাক’ এর হদিস পায় এক ঔষধ বিক্রেতার কাছে। বলা বাহুল্য এই বিক্রেতা আর কেউ না সে হল ওই ভন্ড আল কেমিষ্টে নিয়োজিত ব্যাবসায়ী। যাই হোক পার্শী ওই তবারকাম মিশিয়ে সমস্ত জিনিস পত্র জ্বাল দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে সমস্ত কিছু গলে নিচে স্বর্ন জমা হয়। রাজা হন চমৎকৃত আর পার্শী হন পুরস্কৃত।
এরপর রাজা আরো গো ধরেন তার অনেক স্বর্ন চাই। সমস্যা নাই পার্শী তো আছেই কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায় ‘খোরশানের তবারকাম’ তো আর পাওয়া যায় না। অনেক পীড়াপীড়ির পর পার্শী স্বীকার করল সে এক পাহাড়ের গুহা চেনে সেটা ভীষন দূর্গম অঞ্চলে সেখানে খোরশানের তবারকাম পাওয়া যায়। সুলতান পার্শীকেই অনুরোধ করেন তবারকাম নিয়ে আসার জন্য। পার্শী তখন প্রচুর টাকা পয়সা আর উপহার সামগ্রী নিয়ে ওই তবারকাম আনার জন্য রওনা দেয়। এ কথা না বললেও চলে ওই রাজা আর ওই পার্শী আল কেমীর চেহারা জীবনে দেখে নাই।
সূত্রঃ http://en.wikipedia.org/wiki/Alchemy
এবং আসাদুজ্জামান এজি র একটি নিবন্ধ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ ভোর ৬:৪৮