আমার এ লেখা বাংলার বর্তমান আন্দোলনে যারা শাহাবাগে গান গেয়ে আর গান শুনে বাংলার অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করছে তাদের করকমলে
আমি এ লেখা শুরু করেছিলাম চর্যাপদ থেকে, যারা প্রথম পর্ব পড়েননি তাদের জন্য নিবেদন প্রথম পর্ব
রবীন্দ্র যুগের শুরুতেই আমি নাম করব-
জোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
বলা হয় তার প্রতিভা ছিল রবীন্দ্রনাথের থেকেও বেশী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাকোর বাড়ীতে সঙ্গীত চর্চা আর প্রশিক্ষনের যে উচ্চ আবহ বিরাজ করছিলো সেখানেই জোতিরিন্দ্রনাথ তার সঙ্গীত জীবন গঠন করেন (১৮৪৯-১৯২৫)। রাগ সঙ্গীতের মত পাশ্চাত্য সঙ্গীতেও তার যথেষ্ঠ অধিকার ছিল। সেই জন্যই বাংলা গানের বিকাশে তিনি বিভিন্ন উদ্যেগ নিতে পারেন। আসলে তারই প্রেরনায় ও তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রনাথের সংগীত্ জীবন বিকশিত হয়। এক্ষেত্রে তার জীবনসঙ্গী কাদম্বরী দেবীর কথা উল্লেখ্য করাও অপ্রাসাঙ্গিক হবে না। আকার মাত্রিক স্বরলিপির উদ্ভাবন ও প্রচলন জোতিরিন্দ্রনাথের অক্ষয় কীর্তি। আগে গান শুনে শুনে শিখে গাইতে হত। বীনাবাদিনী নামক এক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে তিনি স্বরলিপি পদ্ধতি জনপ্রিয় করেন। বাংলাগানের ইতিহাসে তার অবদান এক নবযুগের সূচনা করল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাংলার সর্বশ্রেষ্ট সঙ্গীত রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। যে বইটির জন্য তিনি নোবেল পান (১৯১৩) তাও তার গানের সঙ্কলন গীতাঞ্জলী। রবীন্দ্রনাথ যার হাত ধরে গান শেখেন তিনি হলেন তার মেজদা জোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়া তিনি বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদুভট্টদেব এর কাছেও কিছু তালিম নিয়েছেন।মাওলা বখশের কাছ থেকে তিনি ধ্রুপদের তালিম নেন। ১৮৭৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম গান রচনা করেন। সেছিল হিন্দু মেলের জন্য তার দেশাত্মবোধক গান। গীতবিতান রবীন্দ্রনাথের স্মস্ত গানের সংকলন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত স্বল্প পরিসরে কিছু বলা মূর্খতার নামান্তর। তাকে নিয়ে অজস্র বই রচিত হয়েছে। বাংলা গানের ধারায় রবীন্দ্রনাথের বিচরন নাই এমন কোন ধারা নেই।বাংলা গানকে তিনি যেখান থেকে যে পর্যয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তারপর কিন্তু খুব বেশী কিছু করার নাই।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১১)। সঙ্গীতে বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তবে রবীন্দ্র যুগে জন্মানোর জন্যা যথার্থ সুবিচার পাননি কৃষ্ণনগরে জন্ম এই মানুষটি। ইংল্যান্ডে পড়ূয়া এই ব্যাক্তি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে এক সময় কাজ করছেন। ১৮৮৭ সালে বিবাহ করেন ১৯০৩ সালে পত্নী বিয়োগ হয়। ১৯০৩ সাল পর্যন্ত দ্বিজেন্দ্রলাল এর জীবনের আনন্দের সময়। তার মত এত মজার হাসির গান কেউ আজ অব্দি রচনা করতে পারেনি। হাসির গানের সুর রচনার ঢঙটি তিনি গ্রহন করেছিলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীত থেকে। কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের পর তার রচনায় আসে দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক গান এর প্রাধান্য। যারা তার জীবনী নিয়ে কাজ করেছিলেন তাদের ধারনা তিনি ছিলেন পরিপূর্ন কম্পোজার। বাংলা গান কে পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে মিলিত করার ক্ষেত্রে কেউ তাকে অতিক্রম করতে পারেনি। এমন কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। এখানেই দ্বিজেন্দ্রলালের স্বার্থকতা।
রজনীকান্ত সেন
বাংলা নাগরিক গানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ন অবধানের জন্য রজনীকান্ত সেন(১৮৬৫-১৯১০) কে শ্রদ্বার সাথে স্বরন করা হয়। তার রচিত গানের সংখ্যা প্রায় ৩০০। তিনি স্বদেশী ও ভক্তিগীতির জন্য স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। সিরাজগঞ্জ জেলার ভাঙ্গাবাড়ী রজনীকান্তের জন্ম। পিতা গুরুপ্রাসাধ সেন কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। কলকাতা থেকে তিনি ওকালতি পাশ করে কিছুদিন মুন্সেফ হিসাবে কাজ করেন। ১৮৯৪ সালে তিনি রাজশাহীতে এসে হাসির গান গেয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সবাই কে মাতিয়ে তোলেন। এক্ষেত্রে রজনীকান্তও তাকে অনুসরন করেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পর তার গানে ভক্তিগীতির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। তার অধিকাংশ গান খেয়াল ও টপ্পার অনুকরনে।
অতুল প্রসাদ সেন
বাংলা নাগরিক গানের প্রবাহে ঠুংরি মিহি মধুর শৈলীকে মিশ্রিত করাই অতুল প্রাসাদের প্রধান কৃর্তী। বাংলার প্রথম গজল কিন্তু তার হাত ধরেই রচিত। ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর তাঁর জন্ম। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ বিক্রমপুরের মগর গ্রামে। বাল্য কালে পিতৃহীন হয়ে অতুল প্রসাদ ভগবদ্ভক্ত, সুকন্ঠ গায়ক ও ভক্তিগীতিরচয়িতা মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন। পরবর্তীকালে মাতামহের এসব গুণ তাঁর মাঝেও সঞ্চালিত হয়। তাঁর সর্বমোট গানের সংখ্যা মাত্র ২০৬টি এবং সে সবের মধ্যে মাত্র ৫০-৬০টি গান গীত হিসেবে প্রাধান্য পায়। অতুল প্রসাদের মামাতো বোন সাহানা দেবীর সম্পাদনায় ৭১টি গান স্বরলিপিসহ কাকালি (১৯৩০) নামে দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়। তাঁর অপর গানগুলিও গীতিপুঞ্জ এবং কয়েকটি গান নামে দুটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ১৯২২-২৩ সালের দিকে কলকাতা থেকে প্রথম অতুল প্রসাদের গানের রেকর্ড বের হয় সাহানা দেবী ও হরেন চট্রোপাধ্যায়ের কন্ঠে। “মোদের গরব মোদের আশা আমরি বাংলা ভাষা” গান টি কিন্তু বাংলা ভাষার ওপর সর্বশ্রেষ্ট গান।
এই গানটির মাধ্যমেই অতুল প্রসাদ বাঙ্গালীর হৃদয়ে চির জাগরুক থাকবেন
কাজী নজরুল ইসলাম
বাংলা নাগরিক গানের ধারাকে বহুভাবে সমৃদ্ব করেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই "বিদ্রোহী কবি"। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।তাঁর সীমিত কর্মজীবনে তিনি ৩,০০০-এরও বেশি গান রচনা করেছেন। পৃথিবীর কোনো ভাষায় একক হাতে এত বেশি সংখ্যক গান রচনার উদাহরণ নেই। এসকল গানের বড় একটি অংশ তাঁরই সুরারোপিত। তাঁর রচিত চল্ চল্ চল্, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল বাংলাদেশের রণসংগীত। তাঁর কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুল বাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরো গান সংগ্রন্থিত হয়েছে। তবে তিনি প্রায়শ তাৎক্ষণিকভাবে লিখতেন; একারণে অনুমান করা হয় প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে।
সকল নজরুলগীতি ১০টি ভাগে বিভাজ্য। এগুলো হলোঃ ভক্তিমূলক গান, প্রণয়গীতি, প্রকৃতি বন্দনা, দেশাত্মবোধক গান, রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যাঙ্গাত্মক গান, সমবেত সঙ্গীত, রণ সঙ্গীত এবং, বিদেশীসুরাশ্রিত গান।
নজরুলগীতির বিষয় ও সুরগত বৈচিত্র্য বর্ণনা করতে গিয়ে নজরুল-বিশেষজ্ঞ আবদুল আজীজ আল্-আমান লিখেছেন, "...গানগুলি এক গোত্রের নয়, বিভিন্ন শ্রেণীর। তিনি একাধারে রচনা করেছেন গজল গান, কাব্য সংগীত বা প্রেমগীতি, ঋতু-সংগীত, খেয়াল, রাগপ্রধান, হাসির গান, কোরাস গান, দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত–শ্রমিক-কৃষকের গান, ধীবরের গান, ছাদপেটার গান, তরুণ বা ছাত্রদলের গান, মার্চ-সংগীত বা কুচকাওয়াজের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান, নারী জাগরণের গান, মুসলিম জাতির জাগরণের গান, শ্যামাসংগীত, কীর্তন, বৈষ্ণবপদাবলী, অন্যান্য ভক্তিগীতি, ইসলামী সংগীত, শিশু সংগীত, নৃত্য-সংগীত, লোকগীতি – ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, সাম্পানের গান, ঝুমুর, সাঁওতালী, লাউনী, কাজরী, বাউল, মুর্শেদী এবং আরও নানা বর্ণের গান। বিভিন্ন বিদেশী সুরের আদলে রচিত গানের সংখ্যাও কম নয়। এ ছাড়া লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীকে অবলম্বন করে 'হারামণি' পর্যায়ের গান এবং নতুন সৃষ্ট রাগ-রাগিণীর উপর ভিত্তি করে লেখা 'নবরাগ' পর্যায়ের গানগুলি নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে।" (চলবে)
কৃতজ্ঞতাঃ করুনাময় গোস্বামী, উইকি, আরো অনেকে
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ২:০২