যদিও ঢাকা শহরের পত্তন হয়েছিল সপ্তম শতাব্দীর দিকে, কিন্তু শাহবাগে শহুরে স্থাপনার প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু স্মৃতিস্তম্ভ থেকে, সেগুলো ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের পরের। সেসময় মুঘল সম্রাট ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং শাহবাগের বাগান গড়ে তোলেন। এসকল স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে রয়েছে ঢাকা গেট, যা বর্তমানে শাহবাগে বাংলা একাডেমীর কাছে অবস্থিত। স্তম্ভটি বাংলার মুঘল সুবাদার মীর জুমলা তৈরি করেছিলেন, যিনি ১৬৬০ সাল থেকে ১৬৬৩ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মরিয়ম সালেহা মসজিদ', নীলক্ষেত-বাবুপুরা তে অবস্থিত একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মুঘল ধাঁচের মসজিদ, যা নির্মাণ করা হয়েছিল ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশের মুসা খানের মসজিদ, যা ১৭ শতকে তৈরি বলে মনে করা হয়। এবং খাজা শাহবাজের মসজিদ-মাজার, যা ঢাকা হাই কোর্টের পিছনে অবস্থিত এবং ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে খাজা শাহবাজ কতৃক নির্মিত। খাজা শাহবাজ ছিলেন রাজ প্রতিনিধি এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মুহাম্মদ আজমের সময়কালীন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বা সওদাগর।
নবাব সলিমুল্লাহর সাথে এক অজানা ইংলিশ দম্পত্তি
মুঘল শাসনের পতনের সাথে সাথে শাহবাগের বাগানগুলো অযত্ন ও অবহেলার শিকার হয়। ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে যখন প্রাদেশিক রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয় তখন এ সম্পত্তির মালিক হন নায়েব নাযিম, যিনি মুর্শিদাবাদের নবাবের প্রতিনিধি এবং পূর্ব বাংলার প্রদেশিক ডেপুটি-গভর্নর ছিলেন। ১৭৫৭ সাল থেকে ঢাকায় বৃটিশ শাসন শুরু হলেও, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জেলা প্রশাসক গ্রিফিথ কুকের পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগের বাগান গুলো ১৯ শতকের শুরু পর্যন্ত টিকে ছিল।। ঢাকার আর্মেনি সম্প্রদায়ের নেতা পি. আরাতুন এই কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ১৮৩০ সালে জেলা কালেক্টর হেনরি ওয়াল্টারের ঢাকা শহর উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত ঢাকা কমিটির বিচক্ষণতায় শাহবাগ সহ রমনা এলাকাকে ঢাকা শহরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রায় এক যুগ পরে, ঢাকার নবাব পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা এবং নবাব খাজা আব্দুল গনির পিতা নবাব আলিমুল্লাহ, শাহবাগের জমিদারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে কিনে নেন। ১৮৬৮ সালে তার মৃত্যুর পর এ সম্পত্তি তার দৌহিত্র স্যার নবাব খাজা আহসানুল্লাহর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০ শতকের শুরুর দিকে আহসানুল্লাহর পুত্র, স্যার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ শাহবাগের বাগানকে ছোট দুই ভাগে ভাগ করে বাগানগুলোর হারানো সৌন্দর্য্যের কিছু অংশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। বর্তমানে যা শাহবাগ এবং পরিবাগ নামে রয়েছে। আহসানুল্লাহর এক কন্যা পরিবানুর নামে এ নামকরণ করা হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা পূর্ব বাংলার নতুন প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ায়, পুরো ঢাকা, বিশেষ করে নবনির্মিত ফুলার রোডের (পূর্ব বাংলার প্রথম প্রতিনিধি গভর্নর স্যার মাম্পফিল্ড ফুলার এর নামে নামাঙ্কৃত) পাশ দিয়ে দ্রুত ইউরোপীয় ধাঁচের দালান কোঠা তৈরি হতে থাকে। এ সময়েই ঢাকার শাহবাগে প্রথম চিড়িয়াখানা চালু হয়।
হযরত শাহবাজের সমাধি
১৯৪৭ সালে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের পত্তনের পর, ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হয়। এসময় অনেক নতুন নতুন ইমারত তৈরি হতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৬০ সালের বাংলাদেশ বেতার অফিস (তৎকালীন পাকিস্তান রেডিও), জাতীয় বেতার কেন্দ্র, ঢাকা রেস-কোর্স (বর্তমানে অপ্রচলিত) সহ পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র অন্যতম। মার্চ ৭, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান শাহবাগের কাছে এই রমনা রেসকোর্সের ময়দান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এর পাকিস্তান ব্যুরো প্রধান আর্নল্ড জেইটলিন ও ওয়াশিংটন পোষ্ট এর রিপোর্টার ডেভিড গ্রীনওয়ে সহ অনেক বিদেশী সাংবাদিক শাহবাগ মোড়ের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে হোটেল শেরাটন) অবস্থান নেন। হোটেলটিকে নিরপেক্ষ এলাকা ঘোষণা করা সত্ত্বেও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং মুক্তি বাহিনী দুই পক্ষের হামলারই শিকার হয়। যুদ্ধের শেষে, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের স্থান হিসেবে প্রথমে পছন্দ করা হলেও পরবর্তীতে আত্মসমর্পনের জন্য রমনা পার্কের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জায়গায় স্থান নির্বাচন করা হয়।
উনিশ শতকে ঢাকার নবাব পরিবারের তৈরি বেশ কিছু দালান কোঠা শাহবাগে বিদ্যমান। এ সকল দানাল কোঠার কথা শুধু মাত্র ঢাকার ইতিহাসেই নয়, গুরুত্বের সাথে বঙ্গ এবং বৃটিশ ভারতের ইতিহাসেও লেখা রয়েছে।
শাহবাগ বাগান
নবাব পরিবারের জনপ্রিয় দালানগুলোর মধ্যে ছিল ইসরাত মঞ্জিল। মূলত, বাইজিদের (বাইজিদের মধ্যে পিয়ারী বাই, ওয়ামু বাই, আবেদী বাই খুবই জনপ্রিয় ছিল) নাচার জন্য নাচঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত, পরবর্তীতে ১৯০৬ সালে এ দালানটি নিখীল ভারত মুসমান শিক্ষা সম্মেলনের স্থান হিসেবে পরিণত হয়, যাতে প্রায় ৪,০০০ অংশগ্রহণকারী অংশ নেয়। ১৯১২ সালে সংগঠনটি খাজা সলিমুল্লাহের নেতৃত্বে আবার সভা ডাকেন এবং তারা ভিক্টোরি অফ ইন্ডিয়া চার্লস হারডিঞ্জ এর সাথে দেখা করেন। ইসরাত মঞ্জিল পুনঃনির্মান করে হোটেল শাহবাগ (ইংরেজ স্থপতি এডোয়ার্ড হাইক্স এবং রোনাল্ড ম্যাক্কোনেলের নকশায়) করা হয়, যা ঢাকার প্রথম প্রধান আন্তর্জাতিক হোটেল। ১৯৬৫ সালে ভবনটি ইনন্সটিটিউট অফ পোষ্ট-গ্রাজুয়েটে মেডিসিন এন্ড রিসার্চ (IPGMR) অধিগ্রহণ করে এবং পরর্তীতে ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (BSMMU) দ্বারা অধিগৃহীত হয়।
শাহবাগ বাগানের এক অংশ
আরেকটি নবাব দালান হল জলসাঘর। তৈরি হয়েছিল নবাবদের স্ক্যাটিং এবং বলনাচের স্থান হিসেবে, পরবর্তীতে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষকদের খাওয়া এবং আড্ডার স্থান হিসেবে পরিণত হয় এবং নামকরণ করা হয় মধুর ক্যান্টিন বলে। ১৯৬০ এর শেষের দিকে মধুর ক্যান্টিন পরিণত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্রদের একটি মিলনস্থান হিসেবে, যার একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ এবং অন্যদিকে আইবিএ রয়েছে। মধুর ক্যান্টিন শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে এখনো বিদ্যমান।
১৯০৪ সালে নবাব সলিমুল্লাহ লর্ড কার্জনের সাথে।
নিশাত মঞ্জিল তৈরি করা হয়েছিল নবাবদের আস্তাবল এবং ক্লাব হাউস হিসেবে, এবং তৎকালীন কুটনৈতিক ব্যক্তিবর্গের আপ্যায়নস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। উল্লখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে লর্ড ডাফরিন, লর্ড কারমাইক্যাল (বাংলার গভর্নর), স্যার স্টুয়ার্ট ব্যালে (বাংলার লে. গভর্নর), স্যার চার্লস ইলিওট (বাংলার লে. গভর্নর) এবং জন উডবার্ন (বাংলার লে. গভর্নর) অন্যতম।
নবাব জাদী পরীবানু (নবাব সলিমুল্লাহর বোন)
খাজা সলিমুল্লাহ তাঁর বোন পরি বানুর স্মরণে তৈরি করে ছিলেন নবাবদের পরিবাগ হাউস। পরবর্তীতে পরিবারের খারাপ সময় তাঁর পুত্র নবাব খাজা হাবিবুল্লাহ এখানে অনেক বছর বসবাস করেছিলেন। এখানকার হাম্মাম (গোসল) এবং হাওয়াখানা (সবুজ ঘর) বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর কৃর্তি হিসেবে মনে করা হয়।
অত্র এলাকায় নবাবদের সবচেয়ে পুরাতন ভবন ছিল সুজাতপুর প্যালেস, যা পাকিস্তান শাসনামলে পুর্ব-বাংলার গভর্ণরের বাসভবনেপ রূপান্তর করা হয়। আরও পরে এটি বাংলাদেশে, বাংলা ভাষা বিষয়ক সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বাংলাএকাডেমীতে পরিবর্তিত হয়। প্যালেসের বেশ কিছু এলাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলন কেন্দ্রের জন্য হস্তান্তর করা হয়। ১৯৭০ সালে এটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সূত্রঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ৭:৫৭