ভাওয়ালের মেজোকুমার সন্ন্যাসী অবস্থায়
অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলায় আলোড়ন তুলছিল ভাওয়ালের মেজোকুমারের মৃত্যু রহস্য। ১৯০৯ সালে নাকি দার্জিলিং ভ্রমন গিয়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় ঢাকার জয়দেবপুরের মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ন রায়ের। অন্তত মেজো রানী বিভাবতীর বয়ান তাই বলে। এক যুগ পরে মেজোকুমারের মত দেখতে নাগা সাধুর দেখা মেলে সদর ঘাটের বাকল্যান্ড বাধে। তিনিই কি ভাওয়াল কুমার নরেন্দ্র নারায়ন রায়? প্রজা পরিবারের মধ্যে বিতর্ক বাড়ে। ঘটনা গড়ায় আদালতে। রাজকীয় মামলায় বিচারের রীতি ভেঙ্গে ব্রিটিশ আদালত ওঠে ভাওয়াল রাজ দরবারে। মেজোকুমারের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে।
মেজোকুমার গাড়ীতে
১৫ বছর আইনি টানাপোড়নের পর রায় হয় সন্ন্যাসীই মেজোকুমার। রায়ের বিরুদ্বে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন মেজোরানী। যুগান্তকারী ঘটনার রেশ গড়ায় লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে। ১০ বছর পর রায় হয় মেজো কুমার সম্পত্তির দখল নেবেন। খবর পৌছানোর দিনই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ভাওয়াল রাজা মেজোকুমার। নিম্নে চেষ্টা করব ভাওয়াল রাজের ইতিহাস ও বিচারের উল্লেখ্য যোগ্য ঘটনা তুলে আনতে।
ইতিহাস
ইতিহাস থেকে জানা যায় ভাওয়াল এলাকার জমিদারদের পূর্বপুরুষ বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। এই গ্রামেরই বাসিন্দা বলরাম রায় ১৮ শতকের চল্লিশ দশকে গাজীপুরের ভাওয়াল পরগনার জমিদার দৌলত গাজীর দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন। দৌলত গাজীর অনুপস্থিতিতে দীর্ঘদিন খাজনা প্রদান বাকি পড়ে যাওয়ায় ভাওয়াল জমিদারি নিলামে ওঠে। মুর্শিদকুলী খানের সঙ্গে সখ্য থাকায় বলরাম রায় কৌশলে এই জমিদারি হস্তগত করে ফেলতে সক্ষম হন। রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে মুর্শিদকুলী খান মুসলমান জমিদারদের স্থলে পূর্ববঙ্গে হিন্দু জমিদারদের নিযুক্ত করতেন। বলরাম রায়ের মৃত্যুর (১৭৪৩) পর তার সুযোগ্য পুত্র কৃষ্ণরায় জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পান। তিনি ভাওয়াল জমিদারিকে স্থায়ীরূপ দেন। কৃষ্ণ রায়ের মৃত্যুর (১৭৫০) পর তার পুত্র জয়দেব রায় ভাওয়াল জমিদারির উত্তরাধিকার নির্বাচিত হন এবং দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন। এ সময় তার নামানুসারে ভাওয়াল এলাকার নামকরণ হয় জয়দেবপুর।
জমিদার বাড়ীর বর্তমান হাল
জয়দেব রায় ১৭৫৬ সালে মারা যান। পরবর্তীতে ভাওয়াল জমিদারি এস্টেট পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন তার ছেলে ইন্দ্রনারায়ণ রায় । ইন্দ্রনারায়ণ রায়ের মৃত্যুর পর ধারাবাহিকভাবে তাদের উত্তরাধিকারীরা ভাওয়াল জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যান। ১৮৫৬ সালে উত্তরাধিকারীদের একজন গোলক নারায়ণের মৃত্যুর পর তার পুত্র কালী নারায়ণ রায় জমিদারি পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। বস্তুত তার সময়ই ভাওয়াল জমিদারির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। জমিদার নিজেই জমিদারি পরিচালনা করতেন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে কাচারিতে বসতেন। কৃতিত্বের সঙ্গে জমিদারি পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সরকার কালী নারায়ণ রায়কে বংশানুক্রমে ব্যবহারের জন্য রায় চৌধুরী এবং রাজা উপাধি প্রদান করেন। কালী নারায়ণের সময়ই ভাওয়াল রাজবাড়ী এবং ভাওয়াল রাজ শ্মশানেশ্বরী নির্মিত হয়। কথিত আছে ভারতের পুরী থেকে বিখ্যাত স্থপতি কামাক্ষ্যা রায়কে নিয়েআসা হয় শ্মশানেশ্বরী নির্মাণের জন্য
প্রথম মামলা
১৯৩০ সালের এপ্রিল ২৪ তারিখে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর আইনজীবীরা বিভাবতী দেবী ও অন্যান্য মালিকদের বিরুদ্ধে ভাওয়াল এস্টেটের সম্পত্তির অধিকার চেয়ে মামলা করেন। জেলা জজ অ্যালান হেন্ডারসন বিচারপতি পান্নাবল বসুকে এই মামলার বিচারে নিয়োগ করেন। বিজয় চন্দ্র চক্রবর্তী ভাওয়াল সন্ন্যাসীর প্রধান উকিল হিসাবে কাজ করেন। বিবাদীপক্ষের উকিল ছিলেন অমিয় নাথ চৌধুরী। বিচার শুরু হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বর ৩০ তারিখে।
বিবাদীপক্ষে আরো ছিলো কোর্ট অফ ওয়ার্ডস যা বিভাবতী দেবী ও অন্য দুই কুমারের বিধবা স্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব করছিলো। বিবাদীপক্ষের আইনজীবীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, এই নিরক্ষর সন্ন্যাসী কোনো অবস্থাতেই ব্রাহ্মণ বর্ণের হতে পারে না। কিন্তু বাদীপক্ষের আইনজীবীরা প্রমাণ করে দেখান যে, কুমার রমেন্দ্রনারায়ণও প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। বিবাদীপক্ষ থেকে আরো দাবী করা হয়, কুমারের রক্ষিতা এলোকেশীর কাহিনী পুরোই মিথ্যা। কিন্তু বাদীপক্ষ এলোকেশীকে হাজির করে। জেরার জবাবে এলোকেশী জানান, পুলিশ তাঁকে ঘুস দিয়ে সাক্ষ্য দেয়া হতে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে।
বিবাদীপক্ষ আরো দাবী করে, কুমারের সিফিলিস রোগ শেষ পর্যায়ে পৌছে যাওয়ায় তাঁর গায়ে দগদগে ঘা ও ক্ষত থাকার কথা, কিন্তু সন্ন্যাসীর গায়ে তা নেই। সন্ন্যাসী মূলত উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। তিনি দাবী করেন যে, ভ্রমণ করতে করতে তিনি বাংলা ভুলে গেছেন। কুমারের চোখের বর্ণ নিয়েও বিতর্ক উঠে। এটাও দাবী করা হয় যে, শ্মশানে কুমারের চিতায় অন্য কারো দেহ দাহ করা হয়েছে।
উভয় পক্ষ থেকে কয়েকশ সাক্ষী হাজির করা হয়। তাদের অনেকের সাক্ষ্য ছিলো পরস্পরবিরোধী। বিবাদী পক্ষ কুমারের বোন জ্যোতির্ময়ী দেবীকে জেরা করে। তিনি সন্ন্যাসীর পক্ষে ছিলেন, এবং দাবী করেন, সন্ন্যাসীই কুমার। তিনি আরো দাবী করেন, সন্ন্যাসীর চেহারায় তাঁদের বংশের ছাপ রয়েছে, এবং সন্ন্যাসী বাংলা বলতে পারেন। বাদীপক্ষ কুমারের স্ত্রী বিভাবতী দেবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিভাবতী দেবী কুমারের চেহারার সাথে সন্ন্যাসীর চেহারার কোনো মিল নেই বলে দাবী করেন। কুমারের অন্য ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী অন্নদা কুমারী দাবী করেন, কুমার রমেন্দ্রনারায়ন ইংরেজি বলতে পারতেন, এবং বাংলা বলতে ও লিখতে পারতেন। এর কোনোটাই সন্ন্যাসী পারতেন না। কিন্তু কুমারের ভাষাজ্ঞানের প্রমাণ হিসাবে পেশ করা চিঠি গুলো পরে জাল বলে প্রমাণিত হয়।
১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গুরু ধর্মদাশ নাগা সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত হন। দোভাষীর মাধ্যমে তিনি জানান যে, ভাওয়াল সন্ন্যাসী হলো তাঁরই পূর্বতন শিষ্য সুন্দরদাস। পূর্বে মাল সিং নামধারী এই ব্যক্তি জাতিগতভাবে পাঞ্জাবী এবং লাহোরের নিবাসী শিখ ধর্মাবলম্বী। সাক্ষ্য দেয়ার সময়ে গুরু অসুস্থ্য হয়ে পড়েন, এবং তাঁর জেরা আদালত কক্ষের বাইরে নিতে হয়েছিলো। সন্ন্যাসীর সমর্থকেরা গুরু ধর্মদাসকে ভন্ড অভিহিত করে। উভয় পক্ষের সমাপনী যুক্তিতর্ক চলে ছয় সপ্তাহ ধরে। মামলার রায় দেয়ার পূর্বে শুনানি মুলতুবী করা হয় ১৯৩৬ সালের মে ২০ তারিখে।
বিচারক পান্নাবল বসু তিন মাস ধরে চুড়ান্ত রায় নিয়ে কাজ করেন। ১৯৩৬ সালের আগস্ট ২৪ তারিখে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ রায় প্রদান করেন, এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় দেন। এসময় মামলার রায় জানতে বিশাল জনসমাগম হয়। মামলার রায় দেয়ার পরেই পান্নাবল বসু বিচারকের পদ থেকে অবসর নেন।
প্রিভি কাউন্সিল (দ্বিতীয় মামলা)
ভাওয়াল এস্টেটে রমেন্দ্রনারায়ণের সম্পত্তির ভাগ থেকে দাবিদার সন্ন্যাসীকে টাকা নিতে অনুমতি দেয়া হয়। তিনি অন্যান্য বিষয়ের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অর্থ গ্রহণ স্থগিত রাখেন, এবং এই সম্পত্তির কর্তৃত্ব কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের হাতেই রাখেন। একই সময়ে তিনি বিয়ে করেন।
রাজস্ব বোর্ড মামলা নিয়ে কার্যক্রম বন্ধ রাখে তখনকার মতো। এ এন চৌধুরী মামলা থেকে সরে দাঁড়ান। তবে বিভাবতী দেবী হাল ছাড়তে রাজি হননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে মামলার আপিল ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ঐ বছর বিভাবতী দেবীর আইনজীবীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করে। জার্মান বিমান হামলায় কাউন্সিলের কক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রিভি কাউন্সিলের অধিবেশন ঘটে হাউজ অফ লর্ডসে, ১৯৪৫ সালে সেখানেই শুনানি শুরু হয়। ডি এন প্রিট দাবিদারের পক্ষে এবং ডব্লিউ ডব্লিউ কে পেইজ, কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন।
প্রিভি কাউন্সিল আপিল শুনতে রাজি হয়। লর্ড থাঙ্কের্টন, লর্ড হার্বার্ট ডু পার্স্ক, এবং স্যার চেতুর মাধবন আপিলের বিচার করেন। ২৮ দিন ধরে শুনানি চলে। ১৯৪৬ সালের জুলাই ৩০ তারিখে বিচারকেরা দাবিদারের পক্ষে রায় দেন, এবং আপিল নাকচ করে দেন। পরের দিন কলকাতায় টেলিগ্রাফ মারফত মামলার রায় জানানো হয়।
ফরেনসিক তাৎপর্য
ফরেনসিক বিজ্ঞানের জন্য এই মামলাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলাতে মানুষের পরিচয় বের করার কলাকৌশলের যথেষ্ট প্রয়োগ ঘটেছে। কুমার নরেন্দ্রনারায়ণ এবং ভাওয়াল সন্ন্যাসীর দেহের নিম্নলিখিত সাদশ্য ছিলো।
S.No পরিচিতি চিহ্ন কুমার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় ভাওয়াল সন্ন্যাসী
1 বর্ণ গোলাপী ও শ্বেত গোলাপী ও শ্বেত
2 চুলের বর্ণ হালকা বাদামী হালকা বাদামী
3 চুলের ধরন ঢেউ খেলানো ঢেউ খেলানো
4 গোঁফ মাথার চুলের চাইতে পাতলা মাথার চুলের চাইতে পাতলা
5 চোখের বর্ণ বাদামী বাদামী
6 ঠোঁট নীচের ঠোট ডানদিকে কুঞ্চিত নীচের ঠোট ডানদিকে কুঞ্চিত
7 কান কিনারার দিকে চোখা কিনারার দিকে চোখা
8 কানের লতি গালের দিকে সংযুক্ত না, ছিদ্র যুক্ত গালের দিকে সংযুক্ত না, ছিদ্র যুক্ত
9 কণ্ঠমণি প্রকট প্রকট
10 উপরের বাম দিকের মাড়ির দাঁত ভাঙা ভাঙা
11 হাত ছোট ছোট
12 বাম হাতের তর্জনী ও মধ্যমা ডান হাতের চাইতে কম অসম আকারের ডান হাতের চাইতে কম অসম আকারের
13 ডান চোখের নীচের পাপড়ির আঁচিল বিদ্যমান বিদ্যমান
14 পা খসখসে, জুতার আকার ৬ নাম্বার খসখসে, জুতার আকার ৬ নাম্বার
15 বাম গোড়ালির উপরের দিকে ক্ষত বিদ্যমান বিদ্যমান
16 সিফিলিস বিদ্যমান বিদ্যমান (বিতর্কিত)
17 সিফিলিসের ক্ষত বিদ্যমান বিদ্যমান (বিতর্কিত)
18 মাথা ও পিঠে ফোঁড়ার দাগ বিদ্যমান বিদ্যমান
19 কুঁচকিতে অস্ত্রোপচারের দাগ বিদ্যমান বিদ্যমান
20 ডান বাহুতে বাঘের থাবার আঘাতের দাগ বিদ্যমান বিদ্যমান
21 শিশ্নের নিম্নভাগে আচিল বিদ্যমান বিদ্যমান
এ ছাড়াও এই দুই ব্যক্তির আলোকচিত্রে যথেষ্ট মিল আছে। হাঁটার ধরণ, গলার স্বর, এবং ভাবভঙ্গীতেও মিল রয়েছে। আঙুলের ছাপ নেয়ার পদ্ধতি এই মামলার সময়ে চালু ছিলো, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তা ব্যবহৃত হয়নি। ধারণা করা হয়, কুমার নরেন্দ্রনারায়ণ ১২ বছর আগে নিখোঁজ হওয়াতে তাঁর হাতের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা সম্ভব ছিলো না।
যৌবনে মেজোকুমার
ভাওয়াল পরিবারের সদস্য শ্রীমতি রত্না চ্যাটার্জীর ভাষ্য মতে জানা যায় মেজোরানী বিভাবতী ছিলেন স্বৈরীনি। পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ দাশগুপ্তের সাথে ছিল মেজোরানীর অবৈধ সম্পর্ক। আশু ডাক্তারের অবৈধ সন্তান যখন বিভাবতীর গর্ভে তখন মেজোকুমার শারিরীকভাবে অক্ষম সন্তান দানে কারন অসংযম যৌনাচারে কিছু দিন আগেই তিনি সিফিলিসে আক্রান্ত ছিলেন। মেজোকুমার যখন বড় রানী সরযুবালা ও ছোট রানী আনন্দকুমারীর প্ররোচনায় বিভাবতী কে শাস্তি দিতে উদ্যত তখনই মেজোরানী ও আশু ডাক্তারের ফাদে পড়ে দার্জিলিং যান চিকিৎসায়। কথিত যে দার্জিলিং চিকিৎসার জন্য মেজোরানী মেজোকুমারকে অসুস্থ্য করার জন্য স্বল্পমাত্রায় বিষ প্র্য়োগ করত।
এ ব্যাপারে আরো জানতে জয়নাল হোসেনের “রাজা ভাওয়াল সন্ন্যাস ও ভাওয়াল পরগনা” পড়ে দেখতে পারেন।
সূত্রঃ
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ৭:৫১