নিজেকে সুরভিত রাখার ইচ্ছে হাজার বছরের পুরানো, পৃথিবীর সব সমাজ ও কালচারে সুগন্ধির মর্যদাই অন্যরকম। এমন কি ইসলাম ধর্মে যেখানে জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে কৃচ্ছতাসাধন ও সাধারন জীবন যাপনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে, সেখানেও অ্যালকোহল বিহীন সুগন্ধ ব্যবহারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। অবশ্য সুগন্ধীকে এরকম বোতলবন্ধি হয়ে আসতে পেরুতে হয়েছে ইতিহাসের অনেক বাঁক।
সুগন্ধির যাত্রা কবে থেকে শুরু হয়েছিল?
ইতিহাসের পাতায় সঠিক দিনক্ষন না থাকলেও প্রমান পাওয়া যায় মিশরীয় রা বিভিন্ন সুগন্ধী ও উদ্ভিদের নির্যাস তেল কিংবা চর্বিতে মাখিয়ে এক ধরনের মলম তৈরী করত। বিভিন্ন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় এই মলম তারা গায়ে মাখত। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সুগন্ধ তৈরী হত সুগন্ধী লতা ও গুল্ম পুড়িয়ে। সুগন্ধির ইংরেজী “Perfume” এসেছে লাটিন শব্দ ‘par fum’ যার অর্থ “ধোঁয়ার মাধ্যমে”। ধারনা করা হয় রানী সেবা (মিশর ও ইথিওপিয়ার রানী) ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বাইরে প্রথম সুগন্ধি ব্যবহার শুরু করেন।
প্রাচীন পারস্যে সুগন্ধির ব্যবহার ছিল আভিজাত্য ও মর্যদার প্রতীক। প্রাচীন গ্রীসে সুগন্ধির ব্যবহার শূরু করেন বিশ্বজয়ী বীর আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডার সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসকে পরাজিত করে পারস্যে এলে সেখান থেকে তিনি সুগন্ধি তৈরীর কৌশল গ্রীসে নিয়ে যান। অবশ্য ইউরোপে খ্রীষ্ট জন্মের প্রথম যুগে সুগন্ধী ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। মধ্যযুগে সুগন্ধী শিল্পের পুরোটাই ছিল আরবদের হাতে। শেক্সপিয়রের বিখ্যাত নাটক লেডি ম্যাকবেথের কন্ঠে শুনতে পাই ‘The Perfume of Arabia’, এই পারফিউম আর কিছুই না আজকের প্রচলিত আতর। ধারনা করা হয় আরব্য চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী ইবনে সিনা সর্বপ্রথম গোলাপ ফুল পাতন করে সুগন্ধি বের করেন।
কৃত্রিম সুগন্ধির সুচনা হয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। রসায়ন বিজ্ঞানের ক্রমশ উন্নতির ফলে তৈরী হয় নানা রকম সৌরভযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ। যার কিছু কিছু সুগন্ধি হিসাবে ব্যাবহৃত হতে শূরু করে। ব্রিটিশ আমলে এদেশে প্রচলিত ‘বিলিতি এসেন্স’ আর কিছুইনা এক ধরনের কৃত্রিম সুগন্ধি। আধুনিক সুগন্ধি শিল্প পুরোটাই ফরাশিদের দখলে। ফ্রান্সের দক্ষিন প্রভিন্সে রয়েছে সুগন্ধি লতা গুল্মের বিশাল সমারোহ। দুশো বছর আগে সেখানে ছিল ট্যানারী শিল্প, চামড়ার র্দূগন্ধে সেখানে টেকাই দায় ছিল। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু। আজ সারা বিশ্বে সুগন্ধি মানেই ফরাসী পারফিউম।
সুগন্ধি শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে এক নতুন ধরনের পেশাদারের আর্ভিবাব হল, এদের নাম পারফিউমার। পারফিউমারদের কাজ হল সুগন্ধি তৈরীর ফর্মুলা ডিজাইন করা। অর্থ্যাৎ সুগন্ধি কি ভাবে তৈরী হবে, কোন উপাদান কত অনুপাতে মিশ্রিত হবে এসব বের করাই পারফিউমারদের কাজ। কেউ একজন পারফিউমার হতে হলে তার জীবনের অন্তত পনের বছর ব্যায় করতে হবে সৌরভ শেখার সাধনায়। প্রথমে তাকে যেতে হবে সুগন্ধি শেখার স্কুলে, ফ্রান্স ও আমেরিকায় এ ধরনের অল্প কিছু ইনিষ্টিটিঊট আছে, সুগন্ধি শেখার প্রথম বছর চলে যায় কাচামাল সন্মন্ধ্যে জ্ঞান আহোরন করতে করতে।যে কোন রকমের পারফিঊম তৈরী করতে গেলে কয়েক হাজার রকমের জিনিস নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। তারপর চার পাঁচ বছর কাটবে সুগন্ধি নির্যাসের মিশ্রন শেখার জন্য। এরপর প্রায় নয় বছর কাটাতে হবে কোন প্রতিষ্ঠিত পারফিউমারের সহ কারী হিসাবে। এতেই শেষ নয় একজন ভাল পারফিউমারের থাকতে হবে ভাল সূক্ষ্ম ঘ্রান শক্তি, বুজতে হবে গন্ধের রসায়ন। গন্ধের রসায়ন একটু জটিলই বটে। প্রসঙ্গক্রমে বলি, আমার একজন পরিচিত মানুষের প্রিয় ঘ্রান হল বৃষ্টির পর মাটির যে সোদা গন্ধ সেইটি, এইবার বুজুন সুগন্ধি তৈরী করা কতখানি কঠিন কাজ।
সুগন্ধি আমরা সবাই ব্যাবহার করি কিন্তু এর ব্যাকরন আমরা কজন মানি? কোন পারফিউমের মজা পুরোপুরি পেতে হলে এর গন্ধ নিতে হবে তিনটি পর্বে। প্রথমে আসবে টপ নোটঃ অর্থ্যাৎ শুরুতে যে গন্ধটি এসে মানুষকে মুগ্ব করবে, মিডল নোটঃ এসে আপনি বুজবেন সুগন্ধিটি কোন ধারার, এন্ড নোটঃ এসে আপনি বুজবেন কতক্ষন গন্ধটি থাকবে। সুগন্ধির মূল্য কিন্তু নির্ভর করে এর ‘ষ্টেয়িং পাওয়ারের’ ওপর। মানে সুগন্ধিটি কতক্ষন থাকবে আপনার কাপড়ে।
বাজারে কিনতে পাওয়া সব সুগন্ধিকেই আমরা পারফিউম বললেও ব্যাকরন অনুসারে তা কিন্তু পারফিউম না। যে কোন সুগন্ধির বেশিরভাগই (৭৮%-৯৫%) অ্যালকোহল বাকি সুগন্ধি নির্যাস। যেমন পারফিউম যেখানে সুগন্ধির নির্যাস সব চেয়ে বেশি ২২%। এরপর রয়েছে Eau de parfum যেখানে ১৫-২২% সুগন্ধি থাকে। এরপর Eau de Toilette যেখানে সুগন্ধি ৮-১৫%। সর্বনিম্ন Eau de cologene যেখানে মাত্র ৪% সুগন্ধি থাকে।
সুগন্ধির উপাদান নিয়ে অনেকেরই কৌতুহল আছে, ফুল ছাড়াও হরেক রকম উদ্ভিদজাত ও প্রানীজাত উপাদান লাগে পারফিউম তৈরী করতে। ফুলের মধ্যে গোলাপের পাশাপাশি লাইলাক, লিলি অভ ভ্যালি, ম্যাঙ্গোলিয়া প্রভৃতি। কস্তুরীর কথা অনেকেই শুনেছেন এ ছাড়া স্পার্ম তিমির অ্যাম্বার্গিস, বিভার ও সিভেটের ব্যাবহার আছে পারফিউম তোইরী করতে। বৃক্ষজাত পদার্থের মধ্যে আছে চ ন্দন, সিডার, ইউক্যালিপটাস প্রভৃতি। আমাদের পরিচিত কিছু মশলাও পারফিউম তৈরীতে ব্যাবহৃত হয়। ধনে, এলাচী, দারুচিনি, তেজপাতা এরাও পারফুমের উপাদান। ফলও কিন্তু বাদ যায়না, লেবু, কমলালেবুর খোসা, লেবু গাছের ছালও কিন্তু ব্যাবহার হয় সুগন্ধি তৈরীতে। পারফিউমাররা সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে সুগন্ধির খোজে।
একটি বিশ্ববিখ্যাত পারফিউমের কথা না বললেই না আর্নেষ্ট বো ১৯২১ সালে শ্যানেল নং-৫ তৈরী করেন, শুরুতেই বাজার মাত করে এই সৌরভ। মুলতঃ ফুলের নির্যাস থেকে তৈরী এই সুরভীর টপনোট হচ্ছে গোলাপ ও জেসমিনের মিশ্রন। আরো আছে চন্দন ও অন্যান্য কাঠের মিশ্রন। ১৯২১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই সুগন্ধির বাজার একই রকম আছে। বিশ্বে প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একটি শ্যানেল নং-৫ বিক্রি হচ্ছে।
মেরিলিন মনরোকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আপনি রাতে কি পড়ে ঘুমান? তার উত্তর ছিল শ্যানেল নং-৫।
সবশেষে আমার প্রিয় মুভিটির কথা না বললেই না আমার প্রিয় মুভিটির নাম কিন্তু “পারফিউম”। বেন ঊইশ অভিনীত পারফিউম অনেক ই দেখে ফেলছেন না দেখলে এখনি দেখে নিন। আমি খুব বেশি মুভি দেখি না কিন্তু এই সিরিয়াল কিলারের মুভিটি আমাকে আপ্লুত করেছিল
মুভিটির লিঙ্ক পারফিউম
সুত্রঃ Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Perfume
http://inventors.about.com/library/inventors/blperfume.htm
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১:২০