১৬২০ সাল। টেমসের পানি তখন ও দূষনের মিশ্রনে এখান কার মত কালো হয়ে ওঠেনি। সৌখিন নৌভ্রমন কারীরা সন্ধ্যার আবছা আলোয় দেখতে পেল পানির নীচে একটা শুষক। টেমসের পানিতে শুষক? কিন্ত ওটা নড়েচড়ে নাতো। পানির প্রায় ৯/১০ ফুট নীচে নিশ্চল বসে আছে। সবাই প্রমোদ্ ভ্রমন বাদ দিয়ে কৌতুহলী হয়ে জায়গাটা ঘিরে ধরল। রহস্য পরিস্কার হল, শুষুক টুষূক না ওটা একটা সাবমার্সিবল বোট। কর্ণেলিয়াস জ্যাকবসজুন ড্রেবেল নামীয় একজন ডাচ এই সাবমেরিন আবিস্কার করেন বলে জানা যায়।
একটা লম্বাটে চেহারার নৌকাকে আগা পাশতলা লোহার পাত দিয়ে মূড়ে চামড়া দিয়ে ঢেকে তৈরী হয়েছিল আজকের ডুবোজাহাজের পূর্বপুরুষ।বেশ কয়েক ঘন্টা পানির নীচে থাকার ব্যাবস্থা ছিল তাতে এবং আজ পর্যন্ত যত ডুবোজাহাজ তৈরী হচ্ছে সবই একই প্রিন্সিপালের ওপর ভিত্তি করে তৈরী। আর সেই প্রিন্সিপাল হল আর্কিমিডিসের “ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক থিওরী”।
ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক থিওরী হল কোন অদ্রব্য বস্তুকে পানিতে ডোবালে তা নিজের আয়তনের সমপরিমান পানি অপসারিত করবে। সোজা কথায় অপসারিত পানির ভরের থেকে পানিতে ডোবানো জিনিস্ টি যদি হালকা হয় তবে তা ভেসে থাকতে পারে।
থিওরী একই থাকলেও ভেতরের বাহিরের খোল নলচা কিন্তু আদ্যোপান্ত পরিবর্ত্ন এসেছে, এই ডুবো নৌকা কিন্তু যুদ্ব কাজে ব্যাবহৃত হতে শুরু করে আমেরিকার বিপ্লবের সময়। আজকের সাবমেরিনের আদ্যিকালের সেই পূর্বশুরীর নাম ছিল ‘টার্টল’। পানির ছয় ফিট নীচে দিয়ে তিন নটিক্যাল মাইল বেগে চলত সেই সাবমেরিন।এক টানা পানির নীচে প্রায় আধা ঘন্টা থাকতে পারত। আটষট্টি কেজি ওজ নের গোলা বারুদ বইতে পারত এটি। সেকালের হিসাবে মোটেই কম কথা না কিন্তু। ১৭৭৬ সালে টার্টল ব্রিটিশ ফ্লাগশীপের নীচে বিস্ফোরন ঘটিয়ে নৌ যুদ্বের ইতিহাস অমর হয়ে আছে
আধুনিক সাবমেরিন উদ্ভাবন হতে হতে এসে যায় ১৯ শতক। ১৮০১ সালে রবার্ট ফাল্টন নামে এক মার্কিন প্রযুক্তিবিদ তৈরী করেন “নটিলাস”। নিশ্চয়ই আপনাদের মনে পড়ে গেছে জুলভার্নের অন্যতম সেরা লেখা “টুয়েন্টি থাউজেন্ট লীগস আন্ডার দ্য সি” তে নটিলাস নামে অমিত ক্ষমতাধর সাবমেরিনের কথা। ক্যাপ্টেন নিমোর সেই সাবমেরিনে ছিল মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র। বাস্তবের নটিলাস কিন্ত কল্পবিজ্ঞানের নটিলাসের ধারে কাছেও ছিল না। আকৃতিতে সেটি ছিল মাছের মত। চলার সময় পানির বিপরীত মুখী ধাক্কা ও ঘর্ষনজনিত অভিগত এড়ানোর জন্য এই আকৃতি সুবিধাজনক
১৮৫৬ সালে ব্যাভেরিয়ার উইলহেলম তৈরী করেন ৫২ ফুট লম্বা এক বিশাল ডুবোজাহাজ, নাম দেন “সী ডেভিল”। সি ডেভিলের গৌরবের স্থায়িত্ব অবশ্য বেশি দিন ছিল না, ১৮৬৩ সালে শার্ল ব্রুন নামে এক ফরাসী ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করেন ১৪৬ ফুট লম্বা “লে প্লাগোয়া” ডুবোজাহাজ। এতেই ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক থেকে পানি বের করে দেয়ার ঊচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বাতাস ব্যাবহার করেন। এরপর সাবমেরিনের উন্নতি হয় দ্রূতগতিতে। ইংল্যান্ডের ‘নর্দেনফেলড’ স্পেনের ‘পেরাল’ ১৯ শতকের শেষে খুব নাম করে। এই শতকের শুরুতে অবশ্য চলে আসে বিখ্যাত মার্কিন ডুবোজাহাজ “ইউ এস এস হল্যান্ড”।এখানেই প্রথম “ইন্টারন্যাল কমবাশ্চাশন” প্রযুক্তি কাজে লাগানো হয়। পানির ওপরে নীচে চলার জন্য এখানে ইঞ্জিন এবং ব্যাটারি চালিত মোটর ব্যাবহার শুরু হয়।
এর পাশাপাশি সাইমন লেক নামে এক ইঞ্জিনিয়ার প্রায় একই ধরনের সাবমেরিন তৈরী করে। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্বে যে সব সাবমেরিন নাম করেছিল তার প্রায় সবই ছিল হল্যান্ড ও লেক সাবমেরিনের বৈশিষ্টর সমন্বয়। এরপর আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ব, যেখানে নৌ যুদ্বে সাবমেরিন প্রায় অজেয় ভুমিকা নিয়েছিল। যুদ্বের শূরুতে অক্ষশক্তির ইউ বোটগুলো মিত্রশক্তির ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। জার্মানির ইউ বোটগুলো সাধারনত দুইজন নাবিক দ্বারা চালিত হত। দুটি বিশ্বযুদ্ব পর ১৯৫৮ সালে আসে পুরোপুরি ষ্টীমলাইনড চেহারার “স্কিপজ্যাক” সাবমেরিন।
এই স্কিপজ্যাক দূর থেকে দেখতে অবিকল তিমির মত মনে হয়। ১৯৫৯ সালে তৈরী হয় “ইউ এস এস জর্জ ওয়াশিনটন”। এই সাবমেরিন পুরোটাই একটা যুদ্বাস্ত্র। ১৬টি “পোলারিস থার্মোনিউক্লিয়ার ব্যালাস্টিক মিসাইল” পেটে নিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাগরের বুকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরী টাইফুন ক্লাশের “শার্ক’ সাবমেরিন এযাবৎ কালের সর্ববৃহৎ ডুবোজাহাজ। এটি ৫১৫ ফিট লম্বা আর ৭০ ফিট চ ওড়া। project 941 এর অধীনে টাইফুন ক্লাশের সাবমেরিন বানানো হয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে এর অস্তিত্ব জানানো হয় ১৯৮১ সালে। এই মুহুর্তে ১৩ টি টাইফুন ক্লাশের সাবমেরিনের অস্তিত্ব জানা যায়।
আমেরিকার নৌবাহিনীতে চার ধরনের সাবমেরিন আছে, “ওহিও” ক্লাশের ১৮টি যারা ১৬টি করে গাইডেড মিসাইল বহন করতে পারে। “ভার্জিনিয়া” ক্লাশের ৭ টি আরো ৪টি নতুন করে অর্ডার দিয়েছে। “সী উলফ” ক্লাশের আছে ৩টি। এটি অ্যাটাক সাবমেরিন হিসাবে ব্যাবহৃত হয়। “লস এ্যাঞ্জেলস” ক্লাশের আছে ৪৩টি। রাশিয়ান নৌবাহিনীতে ব্যালাস্টিক মিসাইল সাবমেরিন আছে ১১টি, ক্রুজ মিসাইল সাবমেরিন আছে ৫টি নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন ১৪টি এবং কনভেনশনাল এ্যাটাক সাবমেরিন আছে ১৮টি।
এত বড় মাহাসাগরেও কিন্ত সাবমেরিনে মুখোমুখি সংগর্স হয়। ২০০৯ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে HMV Vanguard এবং Le Triomphant এর মুখোমুখি সংগর্স হয়, কিন্ত বিস্ময়কর ভাবে খুব বড় কোন ক্ষতি হয়নি। ১২ আগস্ট ২০০০ সালে Oscar class submarine K-141 Kursk ব্যারেন্ট সাগরে দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়। ১১৮ জন নাবিকের সবাই মারা যায়।
দুঘটনার কারন সম্ভবত একটি ত্রুটিপূর্ণ টর্পেডোর বিস্ফোরন। এবং এতে পাশের অন্য টর্পেডোও বিস্ফোরিত হয়। এই সাবমেরিন থেকে পরবর্তীতে ২০০১ সালে সাবমেরিনের অংশসহ নিউক্লিয়ার রিএকটর ও সকল P-700 ক্রজ মিজাইল উদ্ধার করা হয়। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, জার্মানি, চীন, ফ্রান্স, ভারতে নৌবাহিনীতে পরমানু চালিত সাবমেরিন আছে সাবমেরিন আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ৭:১৭