একে স্কুলের পড়া তার ওপর আছে স্কুলের ম্যাগাজিনের কাজ। বেলাও হয়ে গেছে বেশ। ছোট্ট স্কুল পড়ুয়া লি বেশ দৌড়ে আসছিল।সেন্ট লুই স্কুলের কাছাকাছি আসতেই ছোট্ট লি শুনতে পেল এক বৃদ্বের আর্তচিৎকার। নিজেকে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখল চার জন ষন্ডা মার্কা লোক এক বুড়ো লোকের সব কিছু কেড়ে নিচ্ছে। লি ফক হতবাক হয়ে গেল। চোয়াল গেল শক্ত হয়ে। ভোরবেলা ছোট্ট লি র স্বপ্নে দেখা দিল এক প্রবল পরাক্রম বীর। মা এসে ডেকে তুলল কিন্ত ছোট্ট লি র চোখে সেই স্বপ্ন লেগে রইল। পরবর্তীকালে ছোট্ট লির সেই স্বপ্ন দেখা বীরই জন্ম নিল লি ফকের কলম থেকে ‘ফ্যান্টম’ যা বাঙ্গালী পাঠকদের কাছে "অরন্যদেব" নামে পরিচিত। এভাবেই কমিকসের ইতিহাসে জন্ম নিল ফ্যান্টম ১৯৩৬ সালে।
কিশোর ব্রুস ওয়েন বাবা মার সঙ্গে একটি সিনেমা দেখে বাড়ী ফিরছিল। রাত্রিবেলা পথ হারিয়ে ফেলল তারা। আর সেই অন্ধকারে খুনে গুণ্ডারা ঝাপিয়ে পরে তাদের ওপর। বাধা দিতে গিয়ে ব্রুসের বাবা নিহত হন গুন্ডাদের হাতে। ঘটনাটি কিশোর ব্রুসের মনে ভীষন দাগ কাটে। প্র্তিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। শরীর চর্চার পাশাপাশি বহু কৌশল আয়ত্তে আনেন ব্রুস। নিজেকে নানা বিষয় পারদর্শী করার পাশাপাশি নিজেকে অতি মানবীয় ভাব ধারায় কল্পনা করতে ভাল লাগত ব্রুসের। এরপর একদিন সন্ধ্যা বেলায় আলো জ্বলতে গিয়ে জানলার বাইরে কিছু বাদুড় দেখতে পান। তখনই নিজের দ্বিতীয় সত্ত্বার অস্তিত্ব পেয়ে যান। গথাম সিটির বাসিন্ধারা এরপর এক নতুন হিরোর প্রশংসায় পঞ্চমূখ। কালো চাদর, আধা মুখশ, কালো পোষাক পরা এই মহাশক্তিমান ব্রুসই হয়ে ওঠেন “ব্যাটম্যান”। আমেরিকার বাসিন্দা বব কেন ১৯৩৯ সালের মে মাসে তৈরী করেন এই ব্যাটম্যান চরিত্র। বব নিজের সৃষ্ট চরিত্রকে মানবদরদী, রোমান্টিক ছন্দে বাধতে চেয়েছিলেন।
এ্যাকশন কমিকসের প্রথম সংখ্যার নায়ক হল বিধবস্ত ক্রিপ্টন গ্রহ থেকে ছিটকে আসা এক বিস্ময় বালক। তার বিজ্ঞানী বাবা তাকে মহাকাশযানে করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। স্মলভিল শহরের জোনাথন এবং মার্থা কেন্ট তাকে উদ্বার করে। নাম দেয় “ক্লার্ক কেন্ট”। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে কেন্ট পরিবার আবিস্কার করে ক্লার্কের অতিমানবিক ক্ষমতা। ক্লার্ক ঠিক করে তার এই অতিমানবীয় ক্ষমতা মাণূষের কল্যানে ব্যাবহার করবে। বড় হয়ে ক্লার্ক কেন্ট সাধারন মানূষের মত একটি পত্রিকা অফিসে চাকুরী নেয়। কিন্ত অন্যায়ের বিরুদ্বে এই ক্লার্কই হয়ে ওঠে “সুপারম্যান”। ১৯৩৮ সালের জুন মাসে আমেরিকা শহরের মাত্র ১৭ বছরের বালক জেরোম সীগাল লেখেন “সুপারম্যান” বন্ধু জো শাসটার ছবি আঁকেন। বাস্তবে একজন সাংবাদিক আবার কল্পনায় এক অতিমানব এই দ্বৈত সত্ত্বার সংমিশ্রনই সুপারম্যান কে সুপার হিরোতে পরিনত করে।
কমিকসে শুধুমাত্র বিনোদনই নয় শিক্ষামূলক দিকও থাকে। সাম্প্রতিক কালে বিশ্বব্যপী শান্তি ও মৈত্রী প্রচার করতে "অ্যান্টি ডিফেমেশন লিগ" থেকেও একটি কমিকস বই বের হচ্ছে।সিনেমা, টিভি, রেডিও এই সব গনমাধ্যমে কমিকসই বোধ হয় সব চেয়ে নবীন। মাত্র সোয়াশ বছর আগেও কেঊ কমিকসের কথা চিন্তাও করতে পারত না। কিন্ত কমিকসের আদি রূপ কার্টুন তত দিনে আত্মপ্রকাশ করে গেছে। কার্টুন থেকে কমিকস এই পর্ব পার হতে প্রায় ১০০ বছর লেগে গেল। কার্টুন কথাটি এসেছে ইতালির “কার্তোন” কথাটি থেকে।যার মানে হল “পেষ্ট বোর্ড”। খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ সালে প্যাপিরাসে আকা একটি ক্যরিকেচার ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। এটাকেই পৃথিবীর প্রথম কার্টুন হিসাবে ধরা হয়। ১৮৪৩ সালে লন্ডনের “পাঞ্চ” পত্রিকায় ১০৫ নম্বর সংখ্যায় জন লিঞ্চ এর আকা একটি হাস্য রসাত্নক ছবিকে সর্বপ্রথম কার্টুন আখ্যা দেয়া হয়। ১৮৬০ সালে এক জার্মান ভদ্রলোক নাম উইলহেলম বুশ সর্বপ্রথম প্রকাশ করেন সংলাপ বিহীন একটি ছবি গল্প। একেই ধরা হয় আদি কমিকস। এর ঠিক পাচ বছর পর ১৮৬৫ সালে উইলহেলম বুশের প্রকাশিত “ম্যাক্স অ্যান্ড মরিস” সে দেশে দারুন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর এখানেই বুশ প্রথম “ওনোম্যাটোপিয়া” ব্যাবহার করে। ওনোম্যাটোপিয়া মানে হল ধুপধাপ, ফিটফাট এই জাতীয় অব্যয়। এখান থেকেই বুশ হয়ে রইলেন আধুনিক কমিক ষ্ট্রিপের জনক।
“নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড” কাগজের সম্পাদক জোসেফ পুলিৎজার সংবাদ পত্রের সম্পাদক হিসাবে কমিকসের তাৎপর্য প্রথম উপলদ্বি করেন। কমিকসের ইতিহাসে পুলিৎজারের পাশাপাশি আর এক মার্কিন সাংবাদিকের নাম ও এসে যায়। “মর্নিং জার্নাল” পত্রিকার সম্পাদক উইলিয়াম র্যান্ডলফ হার্ষ্ট সে ছিল আবার পুলিতজারের প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৮৯৫ সালে ৫ই মে নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ডে রবিবাসরীয় তে ছাপা হয় একটি রঙ্গিন ষ্ট্রিপ নাম “ক্যাট দ্য সাকাম ইন সুগান্স অ্যালে” এর মূল চরিতে একটি ছ সাত বছরের ছেলে গায়ে হলুদ জামা। পৃথিবীর এই প্রথম কমিকস হিরোর কোন নাম ছিল না। পাঠক রাই ভালবেসে এর নাম দিয়েছিল “দ্য ইয়েলো কিড”। এই কমিকসটিতেই আমরা প্রথম দেখতে পাই “বেলুন” এর ব্যবহার। বেলুন মানে একটি ছবির সাদা ফ্রেমের মধ্যে চরিত্রের যে সব কথা বার্তা লেখা থাকে। বেলুন দু’প্রকার একটি “স্পিচ বেলুন” আর “থট বেলুন”। হার্ষ্টের “ইয়েলো কিড” এদিকে বেশ মার্কেট পেয়ে গেল ওদিকে পুলিৎজার ও কিন্তু বসে নেই, “হুগান্স অ্যালে” নাম দিয়ে তিনি জর্জ লুকসকে দিয়ে তিনি আকাতে লাগলেন কার্টুন চরিত্র। পুলিৎজার ও হার্ষ্ট দুজনেই পাল্লা দিয়ে কাগজ বিক্রির জন্য ছাপাতে লাগলেন বড় বড় ছবি, দিলেন বড় বড় হেডিং। পাঠকরা মজা করে এর নাম দিলেন “ইয়েলো প্রেস”। আর পরবর্তিকালে পৃথিবীর প্রথম কার্টুন ষ্ট্রীপ এর নায়কের নাম থেকে এই যুদ্ব সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে “ইয়েলো জার্নালিজম” হিসাবে বিখ্যাত হয়ে রইল।
১৯১৪ সালে এডগার রাইস বারোজের কলম থেকে প্রকাশিত হয় কিশোর দুনিয়ায় সাড়া জাগানো উপন্যাস “টারজান অব দ্য এপস”। ১৯১৮ সালে এটি চলচিত্রায়ন হয়। ১৯২৯ সালে হ্যারল্ড ফষ্টার একে নিয়ে এলেন কমিকসে। শুরু হল কমিকসের নতুন পথ চলা। ১৯২৯ সালে কমিকস দুনিয়ায় স্মরনীয় হয়ে রইল আর এক টি কারনে। ১৯২৯ সালে কমিক স দুনিয়ায় আত্নপ্রকাশ করল বেলজিয়াম নামে একটি ছোট দেশ। যে মানুষ টি বেলজিয়ামকে কমিকস দুনিয়ায় অমর করে রাখলেন তার নাম রেমি জর্জ। বেলজিয়ামের সংবাদ পত্র “লা ভিঞ্জতিয়েম সিয়েক ল” তিনি যে চরিত্রটি সৃষ্ট করলেন তার নাম “টিনটিন”।
১৯৩১ সালে চেষ্টার গোল্ড সৃষ্ট করলেন কমিকসের প্রথম পুলিশ চরিত্র “ডিক ট্রেসি”, একই সময় লি ফক তৈরি করলেন “ম্যন্ড্রেক”। যাদুকর ম্যানড্রেক সবার মন হরন করে নিয়ে গেল। ১৯৩১ সালে প্রথম এল “মিকি মাউস”।১৯৩৬ সালে “ডোনাল্ড ডাক”। ১৯৩০ সালে চিক ইয়ং তৈরি করেন তার অসাধারন চরিত্র “ব্লন্ডি”। আলেক্স রেমন্ড ১৯৩৪ সালে তৈরী করেন “ফ্লাশ গর্ডন”। ১৯৩৮ সালে “সুপারম্যান”। ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে গার্ডনার ফকস ও বার্ট ক্রিস্টমযান তৈরি করেন “স্যান্ডম্যান” সেপ্টেম্ভরে বিল এভারেটের হাতে বের হয় “অ্যামেজিং ম্যান” নভেম্ভরে মেয়ার শেল্ডনের হাতে বের হয় “আল্ট্রাম্যান” ১৯৩৯ সালে আত্নপ্রকাস করে উইল উইস্নারের “ডলম্যান”। ১৯৪০ সালে মে মাসে প্রকাশিত হয় স্মল এর “বুলেটম্যান” ও গার্ডনার ফকস ও ডেনিস নেভিল এর “হকম্যান”। ১৯৪১ সালে আর প্রকাশিত হয় আরো তিনটি অতিমানবের “অ্যাকুয়াম্যান”, হ্যাংম্যান” ও প্লাষ্টিকম্যান”। ১৯৫১ ব্রিটেনের মিক অ্যাংলো বের করেন “মারভেলম্যান”। ১৯৬১ সালে মার্কিন মুল্লুক জয় করে নেয় “স্পাই্ডারম্যান”, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের মধ্যেই জন্ম নেয় “আর্চি”। এতদিন কমিকসের নায়করা ছিল খুদে শিশু বা যুবক এই প্রথম এল কিশোর নায়ক। টাইম ম্যাগজিনের হিসাবে কোন বই সপ্তাহে ৩ লক্ষ বের হলে তা বেষ্ট সেলার। কিন্তু দেখা গেল আর্চি এক মাসে বিক্রি ১৬৮ লক্ষ কপি।
যত দিন যাচ্ছে কমিকসের আবেদন ছেলে বুড়ো সবার কাছে দিন কে দিন বেড়ে যাচ্ছে। আমরা ও আমাদের হিরোদের হাত ধরে ফিরে যাই ছেলে বেলার সেই স্বপ্নের জগতে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:৫৭