যক্ষরা যে ধন সম্পত্তি রক্ষা করে, সেই বিশ্বাসের এক মর্মান্তিক কাহিনী শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার “সম্পত্তি সমর্পন” গল্পে। ভুল করে নিজের নাতিকেই মন্দিরের পাতালে একা ফেলে রেখে পাথর চাপা দিয়েছিলেন এই গল্পের যজ্ঞনাথ। এইভাবে যক্ষের হাতে ধন সম্পদ হস্তান্তর করে পাথরের ওপর মাটিচাপা দেন। তার ওপর স্তুপ করলেন ইট বালি। মনে হল মাটির গভীর থেকে একটা কান্না উঠে আসছে। যক্ষ হয়ে গেল কিশর গোকুল ওরফে নিতাই
হেমেন্দ্র কুমারের যখের ধন, আবার যক্ষের ধন – এসব গল্পের কথা তো এখনও মনে আছে। হেমেন্দ্র কুমারের “যক্ষপতির রত্নপুরি” র গল্পে আছে এক দল সান্যাসী হিউয়েন সাং কে জানালেন আফগানিস্থানের কশিপা মাঠে যক্ষরাজ কুবের এর একটা প্রকান্ড মূর্তি আছে। তারই পায়ের তলায় চিনা রাজপূত্রদের অগাধ ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে। ভয়াবহ যকেরা ওই ধন পাহাড়া দেয় দিন রাত, একবার এক রাজ়া গুপ্তধন অধিকার করতে যায়, কিন্ত যকেরা এমন ঊৎপাত সুরু করে যে রাজা পালিয়ে বাচলেন। আপনি সাধু মানুষ আপনার উপর যকেরা অত্যাচার করবে না। হিউয়েন সাং ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে উপাসনা করে যকদের উদ্দ্যেশ্য বললেন, হে যক্ষ হে গুপ্তধনের রক্ষক আমার ওপর প্রসন্ন হও আমি ধর্মস্থান মেরামতির জন্য যেটুকু অর্থ প্রয়োজন সেইটুকু নিয়ে আমি বাকীটুকু রেখে যাব। যক্ষ রা হিঊয়েন সাং কে বাধা দেয় নাই।
নানা ধর্মে এই যক্ষদের দেখা যায়, কালিদাস তো কবিতা করে শুনিয়া গেছেন এক নির্বাসিত যকের কান্না তার “মেঘদূতে”। কিন্ত যক্ষ বলতে কাদের বুজায়, কোন অপদেবতা না স্বার্থপর দানব, উপকারী মানবহৈতেষী না রহস্যময়ী মানবী নাকি কোন প্রানী?
হিন্দুপুরানে সৃষ্টিতত্ত্বের গোড়ার কথায় আছে সৃষ্টিকর্তা ব্রক্ষা দেবতা, দানব মানুষ তৈরী করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেন। প্রচন্ড খিদেয় তার সর্বশরীর জ্বলছে, হঠাৎ তারই গড়া একদল প্রানী অন্য এক দলকে খুবলিয়ে খুবলিয়ে খাচ্ছে এরা হল যক্ষ, রক্ষঃ বা রাক্ষস। ব্রক্ষা ভীষন অসন্তষ্ট হন রাগে তার মাথার চুল খসে পরে। সেগুলো ক্রমে রূপ নিল সাপের। জঘন্য সেই সাপগুলো কে দেখে খেপে গেলেন সৃষ্টিকর্তা। সেই ক্রোধ থেকে জন্ম নিল মাংস খেকো পিচাশ, এ ভাবেই ব্র ক্ষা সৃষ্টিকর্তা তৈরী করলেন এক ধরনের নির্মম প্রানী এ গুলোর নাম ই যক্ষ। রামায়নেও আছে অন্য এক কাহিনী। সেও প্রজাপতি ব্রক্ষ্মা কে নিয়ে। দুনিয়া জুড়ে তিনি সৃষ্টি করলেন আদি সমুদ্র আর কিছু জলজ প্রানীকূল। জন্মের পরই কেবল পানি দেখে তাদের চিত্ত বিকল হবার জোগার। তারা সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞেস করল, "আমরা এখন কি করব"? প্রজাপতি হেসে বললেন তোমরা "এই জলভাগকে লালন পালন কর।" সংস্কৃতি ভাষায় একদল বলল, রক্ষামঃ, অর্থ্যাৎ নিশ্চয় রক্ষা করব। অন্যদল জানাল যক্ষামঃ মানে এই জল কে পূজো করব। যারা রক্ষাম বলছিল তারা হল রাক্ষস আর যারা যক্ষাম বলছিল তারা হল যক্ষ। সেই থেকেই বোধ হয় যক্ষদের বাস পুকুরে। যক্ষদের রাজার নাম কুবের। ধনদৌলতের অধীশ্বর।যক্ষরা ভীষন রাগী।
পুর্নভদ্র যক্ষের ছেলের নাম হরিকেশ যক্ষ। জন্মের পর থেকেই সে শিবের অনুরাগী হরিকেশ কাশি গিয়ে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন ভুতনাথ শিবের। দেখতে দেখতে তার শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।শুধু হাড় কখানা চকচক করতে লাগল প্রখর রোধে জোৎস্না রাতে। দেবাদিদেব সে সব দেখে বললেন, "যক্ষ! দীর্ঘ জীবন লাভ কর। রোগ শোক জ্বরা কোন দিন তোমাকে ছুতে পারবেনা। আর্শীবাদ করছি তুমি হবে গনদের রাজা।সবার ধন সম্পত্তি তুমি রক্ষা করবে। যুদ্বে কেউ তোমাকে হারাতে পারবেনা, লোকপাল ক্ষেত্রপাল হবে তুমি"। সেই থেকে মানূষ কুল যক্ষদের মেনে চলতে শূরু করল। উত্তরের দিক পাল যক্ষরাজ কুবের দক্ষিনের দিকপাল বিরূদ্বক যক্ষ, সুপারস যক্ষ মূষল ধারায় বৃষ্টী আনার জন্য বিখ্যাত, ছাগল চরানো রাখালদের প্রিয় যক্ষ অজকালক , সুন্দরি যক্ষী সুদর্শনা আর চন্দ্রা স্থান করে নিলেন বৌদ্বদের স্তুপে।
একবার এক যক্ষের বাড়ীতে বিশ্রাম নিয়েছিলেন বুদ্বদেব। বৈশালীর যক্ষ সারন্দদের সেই বাড়ী পরে পরিনত হয়েছিল বৌদ্ববিহারে, বুদ্ব সেখানে বসে লিচ্ছবীদের নানা উপদেশ দিয়েছিলেন আর নিজেই বলেছিলেন সারন্দদেব যক্ষের কথা।
যক্ষরা কখনও কখনও এক একটা শহরের প্রধান হয়ে উঠছিল। মানুষের ভয় থেকে এল ভক্তি। বুদ্বদেবের পিতৃভূমির যক্ষের নাম ছিল শাক্যবর্ধন, কালীর শহর যেমন কলকাতা তেমনি পুরগা যক্ষীর নগর ছিল পাটালিপুত্র। সুচী লোম যক্ষী গয়ার আর উজ্জয়নী নগরীর অভিবাবিকা ছিলেন অবন্তীসুন্দরী। প্রায় একই রকম দেখতে মগদ রাজ্যের যময যক্ষী নন্দী ও বর্ধন বাস করত নন্দীবর্ধন নগরে। বর্ধ্মানের অস্তিক গ্রামে বাস করত এক যক্ষ। মনিভদ্র আর পূর্ণভদ্র ছিল যক্ষ রাজের দুই প্রিয় অনুচর। বৈশালী নগরের নাম করন হয়ে ছিল বিশাল নামক এক যক্ষের নামে।
অযোধ্যার এক যক্ষ সুরপ্রিয়র মূর্তিতে প্রতিবছর রং করাতে হত, এক বছর কোন কারনে তা না হলে ভক্তদের ভয় দেখিয়ে মৃত প্রায় করে দিত। জাতকের গল্পে দেখা যায় এক যক্ষ কিভাবে বুদ্বদেবের বুদ্বির কাছে হেরে সন্যাসী হয়ে গিয়েছিল। যক্ষরা দেখতে যে সবাই ভয়ংকর এমন কথা নেই কিন্ত। পুরুষরা দেখতে খুব একটা ভালনা, চামড়া খসখসে, লোমশ শরীর, এবড়ো থেবড়ো দাত।তাদের কারো নাম কূঁজো গাছ। রাজা কুবেরের নাম থেকে এরকম নাম করন হয়েছে। অবশ্য স্তুতি করে কেউ কেউ বলেছেন কু(পৃথিবীর) বীর তিনি। হাতীমুখো এক যক্ষ আছে অমরাবতী স্তুপে। তিনমূখো এক যক্ষের নাম ত্রিমুখী। চোখ তার তিনটা, তিন জনের আছে ভূড়ি। কুবেরের হাতে থাকে টাকার থলি তার বাহন হল নর। অন্য যক্ষ যক্ষীরা চামড় ধরে থাকে ডান হাতে। কুবেরের দুই স্ত্রী ভাগ্যদায়িনী ভদ্রা আর সাফল্যদায়িনী ঋদ্বি, যক্ষিনীরা দেখতে যক্ষদের চেয়ে সুন্দর, অনেকেই রুপবতী, সৌন্দর্য্যর ছলনায় মানুষদের ভুলিয়ে দূরে নিয়ে মেরে ফেলে।
কথাসরিৎসাগরের গল্পে বলে এক যক্ষিনী নাকি এক মানূষ কে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যক্ষরা কেউ কেউ নাকি ভার বহন করতেও ওস্তাদ। সিদ্বার্থ সংসার ত্যাগ করে চলছে তার ঘোড়া বৈকুন্ঠকে নিয়ে। পথশ্রমে ক্লান্ত সেই ঘোড়ার চারটি পা মাথায় করে নিয়ে গেল যক্ষরা।গ্রিক উপকথায় আটলান্টিসের মত যক্ষরা বাড়ী ঘর মাথায় করে রাখত।যক্ষিনীরা ঝুড়ি মাথায় করে দাড়িয়ে থাকত পথের পাশে। হিউয়েন সাং বলছিলেন পাটালিপূত্র প্রাসাদ ও মনে হয় কোন যক্ষের তৈরী করা।
পান্ডবেরা তখন বনবাসে দিন কাটাচ্ছিল। ক্লান্ত পাচঁভাই তখন এক বটগাছের নীচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সকলেই খুব তৃষ্ণার্ত একে একে চার ভাই গেলেন জল আনতে সরোবরে। কিন্ত কেউ ফিরলেন না। তখন যূধিষ্ঠির সেই সরোবরের কাছে এসে দেখেন এক বিরাট তাল গাছের মত লম্বা, আগুনের গোলার মত চোখ এক যক্ষ দাঁড়িয়ে আছে, সে বলল জাল খাওয়ার আগে আমে কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তোমাকে নইলে তোমার ওই চার ভাইয়ের মতদশা হবে তোমার, যূধিষ্ঠির তাকিয়ে দেখেন, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব প্রত্যেকের মৃত্যুদেহ মাটিতে পরে আছে।যুধিষ্ঠির সবকটি প্রশ্নের ঠিকঠাক মত উত্তর দিলেন আর ভাইদের বাচিয়ে তুললেন। আসলে ধর্ম যক্ষের রূপ ধরে ওই প্রশ্নগুলো করছিল। যা বেদ ধর্মকথা নামে সুপরিচিত।
যক্ষদের নিয়ে গান বাধা হয় মহারাষ্টে, দক্ষিন ভারতে। শাস্ত্র বলে যক্ষ নাকি অমর কিন্তু পাহাড়, জঙ্গল, নদীনালা তোলপাড় করেও এখন আর যক্ষদের দেখা যায় না গেল কোথায় সব?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:৫১