আপনি যদি কখনো বলেন আমি কিছুই জানি না, সেটাও কিন্তু একটা প্যারাডক্স। কারণ আপনি যে কিছু জানেন না, সেটাও তো একটা জানা। প্যারাডক্সের এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে!
এটাই হচ্ছে প্যারাডক্স। মানে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, বিষয় ইত্যাদি। আর এখনকার সময়ে প্যারাডক্সের সবচেয়ে বড় উদাহরণ নিঃসন্দেহে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ের লেখা। এবার মিগুয়েল ডি সারভান্তেসের 'ডন কুইক্সট' বইয়ের একটা গল্প শোনা যাক।একটা শহরে এক অদ্ভুত আইন আছে। সেখানে কেউ এলেই নগররক্ষী জানতে চায়, কেন সে শহরে এসেছে? জবাব ভুল হলে আর রেহাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসি।একবার এক আগন্তুক এলেন ওই শহরে। যথারীতি তাঁর এখানে আসার কারণ জানতে চাইলেন নগররক্ষী। আগন্তুক জবাব দিলেন তিনি ফাঁসিতে ঝুলতে এসেছেন।মহা সমস্যায় পড়ে গেলেন নগররক্ষী। যদি ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, তাহলে আগন্তুকের কথাই সত্যি হয়ে গেল। কিন্তু সত্যি কথা বললে কেউ ফাঁসিতে ঝুলতে পারে না। আবার যদি আগন্তুককে ফাঁসিতে ঝোলানো না হয়, তাহলে নগরের নিয়ম ভঙ্গ হয় আর লোকটার জবাবও মিথ্যা হয়েযায়।
গ্রিক দার্শনিক পিথগোরাসে শিক্ষক হিসেবে খুব নামডাক ছিল। একদিন এক গরিব ছেলে পিথগোরাসের স্কুলে এল ওকালতি শিখতে। বেতন দেওয়ার মতো অর্থ তার নেই। অতএব একটা চুক্তি হলো প্রোটাগোরাস ও ছেলেটির মধ্যে_উকিল হয়ে ছেলেটি প্রথম মামলায় জিতে যা পাবে সেটাই হবে গুরুদক্ষিণা বা স্কুলের বেতন। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করে ওকালতির ধারে-কাছেও ঘেঁষল না ছেলেটি। কিছুদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন পিথগোরাস। অপেক্ষারও তো শেষ আছে। একদিন রাস্তায় দেখা হতেই খপ করে ছেলেটিকে ধরে ফেললেন তিনি। খেপে গিয়ে বললেন, 'ব্যাটা প্রতারক! পয়সা ফাঁকি দেওয়ার জায়গা পাস না? আমি তোকে আদালতে তুলব।'
ছেলেটি তখন হেসে বলল, 'আপনি আদালতে মামলা দিলেই কী? আদালত যদি আমার পক্ষে রায় দেয়,তাহলে আপনাকে টাকা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। আর যদি আদালত আমার বিপক্ষে রায় দেয়, তাহলে তো আমার মামলা জেতা হলো না। সে ক্ষেত্রে আপনি কোনো পাওনাও দাবি করতে পারেন না। কাজেই আমি হারি বা জিতি আপনি কানাকড়িও পাচ্ছেন না।' পিথগোরাসে আর তাঁর ছাত্র দুজনের যুক্তিই জোরালো তবে পরস্পরবিরোধী। আর এটাই হলো প্যারাডক্স। প্রতিদিন আমরা এমন নানা প্যারাডক্সের মুখোমুখি হই।প্যারাডক্সের আসলে কোনো নির্দিষ্ট জনক নেই। পিথগোরাসের সময় জেনো নামে আরেকজন বিখ্যাত দার্শনিক চমৎকার একটি প্যারাডক্স সৃষ্টি করেছিলেন।
ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন যে প্রাচীন গ্রীসে শধুমাত্র সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যা্রিস্টটল না একের পর এক এসেছিলেন অসংখ্য পন্ডিত। আর জ্ঞান অন্বেষনে নেমে ওরা তুলে ধরেছিল অসংখ্য প্রশ্ন, মৌলিক আর ক্ষুরধার যত সব প্রতিপাদ্য। যেন যবর জিজ্ঞাসার এক ধারালো লড়াই। এই লড়াইয়ের প্রতি পদে পদে এসেছে তর্ক। জন্ম নিয়েছে অসংখ্য প্রশ্ন। এমনই এক লড়াইয়ের ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে জেনোর ধাধাঁ।
আনুমানিক ৪৪৫ খ্রীঃ পূঃ ইলিয়া থেকে এথেন্সে আসেন গুরু পারমিনিডিয়াস, সাথে প্রিয় শিষ্য জেনো। উদ্দ্যেশ্য এক তর্ক যুদ্বে গ্রীক পন্ডিত সক্রেটিস এর সাথে, ঊদ্দ্যেশ্য যাতে নস্যাৎ করে দেয়া যায় পিথাগোরাসীয় চিন্তা ভাবনা, আর পিথাগোরাসের মতবাদ তখন পুজিত হচ্ছে এথেন্সে। এথেন্সের সেই সাক্ষাৎকার এখন ও বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ট মেধার লড়াই হিসাবে চিহ্নিত। চলুন দেখি কি নিয়ে সেই লড়াই।
এক বার এক কচ্ছপ বীর একিলিস কে অনুরোধ করল এক দৌড় প্রতিযোগিতার, শুধু সামান্য একটা শর্ত, কচ্ছপকে সামান্য আগে থেকে শুরু করতে দিতে হবে, একিলিস তো হেসেই বাচে না। তথাস্তু। জীবনের শ্রেষ্ট ভুল করে বসল দৌড়বিদ একিলিস।
আগেই বলা হয়েছে, সামান্য আগে শুরু করবে কচ্ছপ, স্যান্ডেলের ফিতা বেধেঁ একিলিস ও শুরু করলেন, দৌড়ুচ্ছে কচ্ছপ, একিলিস খানিক দৌড়ে যদিও কচ্ছপের এগিয়ে থাকা কিছু দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলেন কিন্তু ওই সময় শ্লথ গতির কচ্ছপ ও খানিকটা এগিয়ে যায়, যেই সময় একিলিস যখন কচ্ছপের সাথে তার পিছিয়ে থাকা দূরত্ব মুছে ফেলেন কচ্ছপ ব্যাটাও ওই সময় কিছুটা এগিয়ে যায়, এই “কিছুটা” একিলিস যতক্ষনে কাভার করে ওই ব্যাটা কচ্ছপও তো "কিছুটা" এগিয়ে যায় তা যত কমই হোক না কেন? এভাবেই চলতে থাকে।কচ্ছপ এগিয়ে। আবার একিলিস সেই ব্যাবধান মুছে ফেলতেই কচ্ছপ আবার “কিছুটা” এগিয়ে থাকে।
প্রিয় পাঠক যদি বলেন এমন তো দেখা যায় না কখনো, পিছিয়ে যাবার দৌড়ে একজন আর একজান কে টপকে যাবার ঘটনা তো হরহামেশাই আমরা দেখি। সে ক্ষেত্রে একিলিস বা না কেন?
একটু ধীরে চলুন বন্ধু, নেহাত গল্প মেনে নিয়েই না হয় দেখি কেন জেনো বলেছেন, একিলিসের পক্ষে কখন ও সম্ভব নয় তুচ্ছ কচ্ছপকে ডিঙানো? গল্পে আমরা দেখি কচ্ছপ শুরু থেকেই সব সময় আগানো। সে ক্ষেত্রে একিলিস ফারাক ঘুচাতে না ঘুচাতে তৈরী হয় নতুন ফারাক। অন্তত হিসাব তো তাই বলে, কি তাই না? সে ক্ষেত্রে আপানার চোখ যাই দেখুক না কেন। আর এই গোলমালটাই তো গল্পের মূল কথা। অর্থ্যাৎ অঙ্কে যাই বলুক বাস্তবে তা ঘটে না। কেনো? এই কেনোতো আজকের না, পাক্কা ২৫০০ বছর আগের প্রশ্ন।
পিথাগোরাসিয় চিন্তায় আমরা “স্পেস” বা “শুন্যস্থান” বলতে যা বুঝি তা হল অগুনিত বিন্দুর সমষ্টি, আর “টাইম” বা “সময়” হল অগুনিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষনের সমাহার।আসল কথা হল স্থান বা কাল ছোট, আরো ছোট, আরো আরোও ছোট ভাগে ভাগ করা যায়। ধরা যাক একটি সরলরেখা, যা শুন্যস্থানে সব সময় কল্পনা করা যায়।
“ক - খ”
এখন পিইথাগোরাস বলবেন ক ও খ এই সরল রেখা অনেক বিন্দুর পাশাপাশি অবস্থান। সেটা কত? সমশ্যা এখানেই। যদি বলেন এক কোটি, তাহলে প্রশ্ন ২ কোটি নয় কেন, যদি বলেন ২ কোটি, তাহলে প্রশ্ন ৪ কোটি নয় কেন, এক কথায় বলা যায় অসীম সংখ্যক বিন্দুর সমষ্টি, সমস্যা কিন্তু মিটছে না, মানছি সেই বিন্দু গুলো ভীষন ভীষন ছোট, সেই দূটো বিন্দুর মধ্যে থাকতে পারে আরো একটি বিন্দু, আচ্ছা বাদ দিন, ১ ও ২ এর মধ্যে কত গূলো ভগ্নাংশ থাকতে পারে বলতে পারেন? না পারবেন না, কেন? ১.১, ১.২, ১.৩………১.৯ তেমনই আবার ১.১ থেকে ১.২ এর মধ্যে থাকতে পারে অসংখ্য ভগ্নাংশ ১.১১, ১.১২, ১.২৩………১.১৯ এভাবেই চলতে থাকবে। তাহলে শুন্য স্থানকে কেমন করে কল্পনা করব কয়েকটি বিন্দুর সমষ্টি হিসাবে? চিন্তাধারাটা কি ভূল না?
ভূলইযে সেটা প্রমান করতেই তো পারমিনিদিস আর জেনো এসেছিলেন এথেন্স এ। আর ওদের যুক্তির স্বপক্ষে তুলে ধরেন বেচারা একিলিস আর ফাযিল কচ্ছপের গল্প। নির্দিষ্ট একটা দৈঘ্যকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা গেলে গতির ব্যাপারটা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
ভাইরা জেনো আমার মাথায় গিট্টু লাগাইয়া দিছে? কেমন যেন আউলা আউলা :-< :-< লাগছে ব্যাপারটা ভাবতে যেয়ে, তবে আমি কোন ছাড়, সক্রেটিস ব্যাটা আউলাইছে আমি তো আমি। চেয়েছিলাম জেনোর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ধাধা গুলো নিয়ে একটু লিখবো, মাফ চাই আর একটু ভাবলেই পুরা আউলাইয়া আমার অবস্থা বরিশালের তপা পাগলা হতে হবে, চোখে যা দেখি তবে কি তা মিথ্যা? চোখের দেখা যদি মিথ্যা হয় সত্য কোনটা? ব্যাটা জেনো মনে হয় আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আপনার দিকেও কিন্ত। ও ব্যাটাকে আর সুযোগ দিয়েন না চলেন অন্য কোন লেখা পড়ি।
আর এক ব্যাটা "এশার" এর ছবির দিকে তাকাইয়া আমার মাথা আউলা করে দিছিল। ছবি দেখে মাথা আউলা? বিশ্বাস হয়না? দেখুন না লিঙ্ক ।
সুত্রঃ
http://skeptoid.com/episodes/4267
http://en.wikipedia.org/wiki/Zeno's_paradoxes
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ ভোর ৬:৩৯