somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চির উন্নত মম শির, পার্ট২- লর্ড অফ দ্যা রিং।

২০ শে নভেম্বর, ২০০৮ ভোর ৫:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(ছবিতে বোঝা যাচ্ছেনা, কিন্তু আমার নাকের হাড়টা একটু আগেই ভাংছে, বাম চোখ থেতলে গেছে আর প্রতিপক্ষের ডান হাতের শোল্ডার ব্লেড আলগা।)

প্রথম রাতের মিলিটারী একাডেমীতে প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা ব্লগ দিছিলাম ভয়ে ভয়ে। ওটার সাহসে আরো কিছু শেয়ার করলাম।

সেকেন্ড টার্মকে বলা হয় সবচাইতে কঠিন শারীরিক পরীক্ষার সময়। ফ্রেস ছেলে মেয়েদের আস্তে আস্তে শারীরিক ভাবে সক্ষম করতে ফার্স্ট টার্মে প্রতিদিন মাইলটেস্ট আর দুনিয়ের পিটির পাশা পাশি কয়েকটা এক্সের সাইজ করতে হয়। ওগুলোতে ট্যাক্টিক্যাল জিনিস পত্র খুব কম। শুভযাত্রা, পদক্ষেপ ১ আর ২। আমরা বলতাম পদ-আক্ষেপ। এগুলো সবই পরের টার্ম গুলোতে সামরিক প্রশিক্ষনে উপযোগি ফিটনেস তৈরিতে লাগে।

সেকেন্ড টার্মে প্রথমে রেইড (অপারেশন পুর্বকোন) পরে এম্বুশ (অপারেশন ধুমকেতু) এর পরে বক্সিং করে মেজর অপস ডিফেন্স (অপারেশন লৌহকপাট), এছাড়া প্রথম বারের মত জুনিয়র ক্যাডেটরা পুরো কোম্পানীর সাথে ইন্টার কোম্পানী ক্রস কান্ট্রি,ইন্টার কোম্পানী এসল্ট, বিভিন্ন গেমস, ফায়ারিং কম্পিটিশন ইত্যাদিতে জয়েন করে। সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করা কোম্পানীটা প্রেসিডেন্ট প্যারেডের সময় প্রধানমন্ত্রির হাত থেকে সম্মানসুচক কোম্পানী ফ্ল্যাগ পায়। এর মাঝে বক্সিং শুধু সেকেন্ড টার্ম করে। একজন ক্যাডেটের পার্সোন্যাল রেকর্ডসের অনেক কিছু বলে এটা। বক্সিং থেকে দেখা যায় তার সাহস, কৌশল, সহিষনুতা এবং রণ পরিকল্পনা। যেটা তার ভবিষ্যত ক্যারিয়ারের কথা বলে। ফার্স্ট টার্মের শেষ থেকেই স্পেশাল বক্সিং পিটি শুরু। সারাদিন গার্ড নেয়া কিংবা হুক-কাট-পাঞ্চের মধ্যে দিয়ে। সিনিয়ররা দেখলেই একটাই পাঙ্গা গিভ হান্ড্রেড পুশ-আপ। দৈনিক প্রায় হাজার পুশ-আপ দিয়ে স্বাভাবিক হাবেই হাতের মাসল গুলো প্রচন্ড শক্ত হয়ে যায়।

টার্ম এন্ড ছুটিতে বাসায় যাবার পরে সবাই স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে নাকল গার্ড আর টুথ গার্ড কিনলাম। প্রতিপক্ষের ঘুষিতে দাত ভাঙ্গা থেকে বাঁচতে। সেকেন্ড টার্মের শুরু থেকেই খাবার দাবারে কড়া নজরদারী শুরু। সিনিয়রদের অত্যাচারে একদিনও ব্রেকফাস্টে ব্রেডের সাথে বাটার কিংবা জেলী খেতে পারি না। ডিম বেশী বেশী খেতে হয়। আসলে বক্সিং এ ওজনটা ফ্যাক্টর। কম ওজন হলে দুর্বল প্রতিপক্ষ। এমনিতে আমার ওজন কম ছিল তাই ভাবতাম না। সকালে পিটির পরে, দুপুরে ক্লাশের পরে আর বিকালে গেমস এর পরে প্রতিদিন গোসলের আগে নাকল গার্ড লাগিয়ে দেয়ালে ঘুসি মারা চলতো। শুধু আমি না সবাই, দেয়ালের একটা অংশ ডিসকালার এবং সুরকী খুলে আসলো। এখন পুশআপের (বুক-ডন) নিয়ম পালটে গেছে। আগে হাতের তালুতে ভর দিতাম, এখন হাত মুঠি করে শক্ত মেঝেতে। কিছুদিনের মধ্যে নিজের হাতে হাত দিলে মনে হত অন্যকারো গায়ে হাত দিছি।
পিটি এবং অন্যান্য শারীরিক কাজে আমি বরাবরি দুর্বল। আমার রুম-মেট শাহরিয়ার নর্থসাউথ থেকে পড়তে পড়তে চলে আসছে। সে আমার উল্টা।প্রচন্ড শক্তি রাখে। তারউপর থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট। ওর সাথেই ঘুসাঘুসি প্রাকটিস করতাম আর মার খেয়ে ভুত হতাম, আরেকজন ছিল ইস্রাফিল। সে বিকেএসপির বক্সিং এর ছাত্র। সাফ গেমস এ বক্সিং এ সিলভার মেডে জেতা। আমরা ডাকতাম আজরাইল বলে। কারন ওর সাথে প্রাকটিস মানেই রক্তাক্ত হয়ে হসপিটাল। ড্রাই প্রাকটিসের সময় হেড গার্ড কিংবা অন্য কিছু থাকতো না। প্রতিদিন রক্ত মাখা শার্ট নিয়ে ফিরতাম। ইমরান (এখন বিডিআরএ আছে) তো হাতই ভেঙ্গে ফেললো। পিটিএসও স্যার ছিলেন কমান্ডো করা একজন অমানুষিক শারীরিক দক্ষতার লোক। একদিন কি মনে করে উৎসাহ দিতে গ্লাভস লাগিয়ে আমার সাথে ফাইট করতে আসলেন। ৪০+একজন লোক, হোকনা হেল কমান্ডো কিংবা বিএম এর প্রধান পিটি প্রশিক্ষক, ১৯-২০ বছর বয়সটাই অন্যরকম। স্যার গার্ড নিতেই দমাদম ঘুসি মারলাম। রক্ত ভরা নাক নিয়ে নেমে আসলেন রিং থেকে। আমাকে বকতে শুরু করলেন, মাই বয়, ইউ হ্যাভ স্ট্রেংথ হোয়াই ইউ ডোন্ট ইউজ ইট।
বক্সিং এর কয়েকদিন আগে কোম্পানী লাইনে সভা বসলো। ফাইনাল টার্মের সিএসইউও ( কোম্পানী সিনিয়র আন্ডার অফিসার) আমাদের সার্জেন্ট আর কর্পোরালের মধ্যে। কারা কারা নিশ্চিত জিতবে, কারা কারা জিততে পারে এটা নিয়ে। প্রচন্ড কষ্ট পেলাম যখন দেখলাম আমার নাম নাই এর মধ্যে, আমাকে আন্ডার এস্টমেট। গেলাম কর্পোরালের কাছে। সে মালদ্বীপের ছেলে। ভালো বাংলা জানলেও বাথরুমে বাংলা সিনেমার গাওয়া ছাড়া আর কোনদিন বাংলা বলতে শুনিনি। তাকে বললাম, স্যার আপনাদের আচরনে আমার মেজাজ খারাপ হইছে, দেইখা নিয়েন আমি ফাটায়া আসবো। কর্পোরাল আমাকে প্রতি রাতে পাঞ্চিং প্যাডে (বালুর বস্তা) এক দমে ১০০ ঘুসি মারার কৌশল শেখালো। ঘুসিতে শক্তি কম কিন্তু খিপ্রতার সাথে একটানা ১০০ ঘুসি খেলে অপরপক্ষকে দেখা লাগবে না।
ফাইন্যাল রাউন্ডের আগে একদিন গেমসএর পরে স্টাডি হাওয়ারে যাচ্ছি। রাস্তায় ক্যান্টিনের সামনে দেখি হামিদ কোম্পানীর হামিম দাঁড়িয়ে আছে। হামিম আমাদের ব্যাচে টাফেস্ট ছেলেদের একজন। প্রচন্ড সুগঠিত বাইসেপ দেখলেই ভয় লাগে। সে সবাইকে মিস্টি খাওয়াচ্ছে। আমাকেও খাওয়ালো এবং খাইয়ে জানিয়ে দিল আমি তার প্রতিপক্ষ। এটা হবার কথাই না। আমি ওজনে ওর অর্ধেক। আমি ফেদার ওয়েট হলে ও লাইট ওয়েট কিংবা ব্যান্টাম ওয়েটে পরবে। আমি কি ভাবে ওর অপনেন্ট হই। পরে জানলাম ঘটনা সত্যি। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার যারা ছিল সবাই হেভী ওয়েটে পরে গেছে। হামিম ব্যান্টাম ওয়েট আর আমি ফেদার ওয়েট। আমরা ২ অড নাম্বারকে লাগিয়ে দিয়েছে। হামিমের মত দৈত্য রিং এ আমাকে পিষে ফেলবে এটা জানা কথা, সেই খুশিতে সে সবাইকে এমনকি আমাকেও মিস্টি খাওয়ালো।
সেইদিন রাতে ঘোরের মধ্যেই ডিনারের পর নামলাম। একটানা কয়েকঘন্টা পাঞ্চিং প্যাডে বক্স করলাম পাগলের মত। রাগের চোটে বস্তাটাকে হামিমের হাসিখুশি মুখ মনে হলো। আমার ফাইট থার্ড ডে তে। প্রথম দিন রউফ এগিয়ে গেল। জাহাঙ্গিরের জুনিয়রদের আতঙ্ক আব্দুল্লাহ রউফের সিরাজকে নক আউট করে দিল অবিশাস্য ভাবে। মেয়েদের বাউট (জুডো) গুলোতে ফেরদৌসী, মাটি সব্বাই হারলো। সেকেন্ড ডে তে আরো ভয়াবহ। রউফ একনাম্বারেই থাকলো। মোস্তাফিয়ান ছেলেদের টপকে হামিদিয়ানরা চলে এল দুই নম্বরে। ঐদিন আমাদের ভরসা ছিল যারা, দৈত্যের মত আসিফ, থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট শাহরিয়ার, প্যারা কমান্ডো করা রেজোয়ান সবাই হেরে বসলো। আমরা চলে গেলাম লাস্ট পজিশন এ। কোম্পানী কমান্ডার এসে আমাদের গালা গালির এক করে গেল। সিনিয়রেরা মটিভেশন করতে লাগলো। জুনিয়রেরা রিং এ রক্ত ঝরানো সিনিয়রদের নামে উতসাহ ধ্বনি দিয়ে গলা দিয়ে রক্ত বের করার অবস্থা করলো। কাজের কাজ হলো না।
**********পরের দিনটা অন্যরকম। রাতের বেলা নিজেকে স্পার্টাকাস মুভীর গ্ল্যাডিয়েটরের মত লাগছিলো। আর কয়েকটা ঘন্টা। এর পরে আমি রিং এ। চারপাশে রোমান এম্ফিথিয়েটারের মত সিনিয়র জুনিয়র, একাডেমীর সব অফিসার কর্মচারীর দল, আমি মারলে আমার নামে চিয়ার আপ করলে হারলে দুয়োধ্বনী দেবে। আমাকে রক্ত ঝরাতে হবে। সাদা শার্ট লাল করে আসতে হবে। এক্সিডেন্ট হয়। মোটামুটি সবারই নাকের হার ভাঙ্গে। শোল্ডার ডিসলোকেশান দাত ভাঙ্গা, চোখ থেতলানো বন্ধুদের ছবি ভাসতে লাগে। মোবাশ্বিরের ঘুসিতে আসিফের রক্ত বমি করা কিংবা আব্দুল্লাহর বিশাল পাঞ্চ গলায় লেগে কাটা গলা গাছের মত পড়ে গিয়ে নক আউটের আগ মুহুর্ত রক্তাক্ত ছবিটা ভাসতে থাকে।
পড়ের দিন ফিজিক্স ক্লাশে ক্লাস টেস্টের খাতায় গোল্লা পাওয়াতেও মেজর মাসুদ আমাকে কিছু বললেন না। কেমেস্ট্রি ল্যাবে প্র্যাকটিক্যাল খাতা আনতে ভুলে গিয়েও ক্যাপ্টেন আকবর কিছু বললেননা। রুমে ফিরেই খুব লাঞ্চ করলাম। ঠান্ডা শাওয়ার নিলাম অনেকক্ষন। আজকে কোম্পানী ফলইনে আমি না থাকলেও সিনিয়রেরা কিছু বলবেনা। নির্ধারিত টাইমের অনেক অনেক আগে আমি চলে এলাম বেলম্যান হ্যাঙ্গারে। কারুকাজ করা রিংটা ঝক মক করছে। গতরাতের রক্ত গুলো সুন্দর করে মুছে ঘসে তুলে ফেলা হয়েছে।
অনেক আগে এসেছি। বক্সিং এর স্পেশালাইজড পিটি স্টাফকে ধরলাম। খুব মনোযোগ দিয়ে ওয়ার্মিং আপ করলাম। সে যা বলে তাই করি। ঐদিন আমাদের ছেলেদের ২টা বাউট। আমি সেকেন্ডে নামবো। আমার আগে আলী খেলবেন মোহাম্মদের বিরুদ্ধে। আর মেয়েদের জুডোর ৪টা বাউট। জাহাঙ্গির কোম্পানী স্বগর্বে পয়েন্ট টেবিলে লাস্ট পজিশনে। ওয়ার্মিং আর স্ট্রেচিং এর পরে শুরু হবে মালিশ। সিনিয়রেরা পর্দা টাঙ্গানো গ্রীন রুমে আমাকে নিয়ে গেল। একটা কাপড়ের পট্টি দিয়ে আমার চোখ বেধে দিল। আর কয়েকজন মিলে শক্ত করে হাত পা চেপে ধরলো কোরবানীর গরুর মত। একটা বালতিতে নিক্স, মুভ দুনিয়ার ব্যাথা নাশক ক্রিম গুলিয়ে একধরনের পেস্ট করে। এটা মাখলে তাতক্ষনিক ব্যাথা অনুভব হয়না কিন্তু চামড়া জ্বলতে থাকে। চোখে যাতে না যায় এজন্যে চোখ বেধে দেয়া হয়। কিছুটা ট্র্যাডিশান। আর ক্রিমের জ্বলুনিতে ছেলেটা লাফা ঝাপা করতে না পারে এজন্যে সিনিয়রদের মধ্যে শক্তিশালী কয়েকজন হাত পা চেপে রাখে। আমার মালিশ শেষে কিছুক্ষনের জন্যে ছেড়ে দেয়া হলো। গায়ে যেন আগুন লেগে গেছে। মাথা কাজ করছেনা। শুধু একটাই চিন্তা আমি আমার প্রতিপক্ষককে আজকে খুন করবো। রিং এ এক্সিডেন্টলি মারা গেলে কোন সমস্যা নাই, সবাই বন্ড সাইন করে তবেই একাডেমীতে আসছি। মারা যেতেই পারে। আমার মাথায় হেড গার্ড, হাতে গ্লাভস শক্ত করে পড়িয়ে একটা সুতলী দিয়ে গিঠ দিয়ে দিল। যাতে কোন অবস্থাতেই খুলে না যায়। পর্দার ফাক দিয়ে দেখছি আলী আর মোহাম্মদ ফাইট করছে। আমরা মজা করে নাম দিছলাম মোহাম্মদ আলীর ফাইট। আলী আর মোস্তফা ক্যাডেট কলেজে রুমমেট ছিল। খুব ভালো বন্ধুত্ব। কিন্তু রিং এ তা দেখা গেলনা। দুজনেই পাগলের মত মারপিট করছে। আলী অনেক রক্ত ঝরিয়ে ধরাশায়ী হলো। জাহাঙ্গির কোম্পানী আরো পয়েন্ট হারালো। আমরা ধরে রেখেছিলাম আজকে আলী জিতবেই।
একটা লাল আলখেল্লা পড়িয়ে আমাকে রিং এ নেয়া হলো। আলিম স্যার এবং আরেকজন থার্ড টার্মার ছিল পাশে। আলিম স্যার (এখন বেঙ্গলে) আমার খুব পছন্দের একজন সিনিয়র। কি জানি দোয়া পড়ে কানে ফু দিচ্ছিলেন বার বার। রিং থেকে আমার ডাক আসলো। এবার আমার পালা। আলখেল্লা লাগিয়েই রিং এ উঠলাম। জাহাঙ্গির কোম্পানীর জুনিয়র সিনিয়রেরা আমার নামে জয়ধ্বনী দিচ্ছে। সিএসইউও ঘোষনা করলো, অন মাই লেফট সাইড রেড কর্নার জিসি সাঈদ ফ্রম জাহাঙ্গির কোম্পানী। আমি ঝটকা দিয়ে ঘুরে একটা বিকট হুঙ্কার দিলাম (এটাও ট্র্যাডিশান, ইচ্ছা ছিল হামিমের পিলে চমকায় দেব)। স্টাফ আমার গাউনটা ধরে ছিল ঘুরতেই হাতের টান দিল, দেখে মনে হয় আমি এত তীব্র গতিতে ঘুরছি যে গা থেকে আলখেল্লা উড়ে গেছে। হামিমকেও একই ভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো ওর বেল্ট গ্রীন ও গ্রীন কর্নারে। তবে ওর হুঙ্কারটা আরো ভয়ানক শুনালো। দুই প্রতিপক্ষ হ্যান্ড শেক করলাম। জাজ আমাদের গ্লাভসে টিপে দেখে নিয়ম বলে দিলেন আর বললেন আমরা সবাই একটা ক্লিন আর ফেয়ার লড়াই দেখবো। প্রতিপক্ষকে সম্মান দেখাতে হবে এবং কোন অবস্থায় পিঠ দেখানো যাবে না। সাহস করে মার খেতে হবে। পিঠ দেখানো কিংবা মার খেতে না পারা চারিত্রিক দুর্বলতা এবং একাডেমীতে অযোগ্যতা। আমাদের হ্যান্ড শেক এর পরে নিজ নিজ কর্নারে পাঠিয়ে দেয়া হলো। স্টাফের হাতের গামলা থেকে ডাবল পাটির সাইজ মতো একটা টুথ গার্ড বেছে নিলাম। ডাকাত ডাকাত লুক দিয়ে নিজের মাথার হেড গার্ডে দুইটা ঘুসি দিলাম সবাইকে ভয় দেখানোর ভঙ্গি করে।
জাজ ডিক্লেয়ার করলো। 'ওকে বক্সারস অন গার্ড। এন্ড বক্স অন।'
শুরু হয়ে গেল আমাদের ফাইট। প্রথমেই হামিম আমাকে ডান হাতে বেশ জোরে একটা বক্স করলো। আমার কপালে লাগলো। মাথাটা ঝিমিয়ে উঠলো। ব্যাকফুটে ভর দিয়ে চুপচাপ ধাক্কাটা হজম করলাম। পেছানো যাবে না। দ্রুত ফ্রন্ট ফুটে এসে হামিমের বডির কাছা কাছি থাকার ইচ্ছা। ঘুসি মারার মত দুরত্ব দেয়া যাবে না। যাই হোক ওর গায়ে জোর অনেক বেশি, আমার শক্তি আমি ওর চেয়ে ক্ষিপ্র। হামিমকে আমি হালকা একটা ঘুসি মারলাম। ও সুন্দর ভাবে ব্লক করলো। বিরতি না দিয়েই একটা হুক। এটা ওর কানের উপরে লাগানো থেকে আটকাতে পারলো না। ওর পায়ের দিকে কড়া নজর ছিল। ফ্রন্ট ফুট তেরছা ভাবে আসতেই টের পেলাম কি করবে, পা একটু সাইড করে পিছের পায়ে ভর দিল। শক্তিটা আসছে উরু থেকে কোমড় বেয়ে শোল্ডারে। ডান হাতে প্রচন্ড একটা রাইট কাট। বুঝতেই পারছিলাম প্রচন্ড শক্তিতে মারছে সে।
বুঝতে পেরেই শরীরটা কোনা কুনি করলাম, বুক পুরা আন প্রটেক্টেড, কিন্তু ও ঘুসি মারছিল মুখ লক্ষ্য করে। সরে গিয়ে ঘুসিটাকে কানের পাশ দিয়ে চলে যেতে দিলাম। পুরো শক্তির ঘুসিটা বাতাসে মেরেছে সে। কোথাও বাধা পেলে ব্যালেন্স থাকতো। হাতে প্রচন্ড টান খেয়েছে। আর পুরো উর্ধাংশ আন প্রটেক্টেড। আমি চান্সে ছিলাম। শুরু করলাম আমার একমাত্র অস্ত্র এক নিঃশ্বাসে দমাদম একটানা এলোপাথারি ঘুসি, খুব দ্রুত। একটাতেও জোর নেই। কিন্তু শরীরের একই পয়েন্টে এতগুলো ঘুসি অনেক বড় ব্যাপার। পড়ে শুনেছিলাম বাতাসে ঘুসি মেরে ব্যালেন্স হারানো এবং পড়ের সেকেন্ডে এত্তগুলি ঘুসি শোল্ডার ব্লেডে (মারার সময় দেখিনাই কই পড়তেছে) পড়ার সাথে সাথে ওর শোল্ডার ডিসলোকেট হয়ে গেছে। আমি দম নিয়ে আবার একটানা পেটালাম। ওর ডান হাত কাজ করছেনা। বাম হাতেই কয়েকটা মোক্ষম ঘুসি ছাড়লো। ততক্ষনে আমি বুঝে গেছি দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সবল একজন বিপদে পড়েছে। আমি ওর কোন ঘুসিকেই আমলে নিলাম না। একটানা পেটালাম। প্রথম মিনিটের পরে থেকে ক্রমান্বয়ে পেটালাম। হুস জ্ঞ্যান নেই। শুধুই মারছিলাম। একটা ঘুসিও ব্লক করছিলাম না। শুধুই এটাকিং মুডে। বেল পরে যখন ফাস্ট রাউন্ডের বিরতি আসলো, আমি অনেকটাই নিশ্চিন্ত। একটা টুল এগিয়ে এল। ক্লান্তিতে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছিলাম। আলিম স্যার ঝুকে আমার দুই পা ঘারের উপরে নিয়ে পায়ের মাসল গুলো মালিশ করে দিচ্ছিলেন। আরেকজন পানি ভেজা টাওয়েল দিয়ে রক্ত মুছে হাওয়া করছিলেন। টুথ গার্ড সরিয়ে কুলি করতে করতেই সেকেন্ড রাউন্ড।
রেস্টের পরে ও অনেকখানি গুছিয়ে নিয়েছে। প্রতিটা স্টেপ সাবধানে নিচ্ছে। কিন্তু আমি ওর চেয়ে ২ ইঞ্চি লম্বা। ওর গায়ে সেঁটে থাকলাম। আর পাগলের মত ঘুসি মারছি। ওর ঘুসি গুলো মুখ বুজে হজম করছি। ওর গায়ে জোর বেশি, একেকটা অনেক শক্তিশালী, একটা ঘুসিও উপেক্ষা করছিলাম না, পারলে ব্লক করি না পারলে হজম। কিন্তু নেক্সট রাউন্ডে একটা মুহুর্ত ওকে ঘুসি হজম করার সময় দিলাম না। হোক দুর্বল কিন্তু একের পরে এক ঘুসি বিরতীহীন ভাবে। এর মাঝেই ঘুসি মেরে সে আমার নাকের হার ভেঙ্গে দিল, বাম চোখে কিছু দেখছিনা। মনে হয় থেতলে গেছে। কিন্তু কিছুই টের পাচ্ছিলাম না।
রাউন্ড শেষে যখন জাজ উইনার হিসাবে আমার হাত তুলে দিল, পুরো হ্যাঙ্গারে হাত তালীর আওয়াজ। আমি রিং এর দড়ি উঠিয়ে ওকে এগিয়ে দিলাম। খুশিতে নাচতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। সব দমিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম উই হ্যাড আ গুড ফাইট, ক্লিন এন্ড ফেয়ার। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করলো। হামীম সোজা এম্বুলেন্সে, তারপরে চিটাগাং সিএমএইচ এ। আর আমার বাম চোখে রক্ত জমে আছে। এজন্যে কিছু দেখছিনা। নাকের হারটাও নরবরে ভাঙ্গছে কিনা শিউর না। রক্ত পড়ছেনা এটা খারাপ লক্ষন। সব প্ল্যাটুন কমান্ডারেরা এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিল। হামিদের কোম্পানী কমান্ডার আর্টিলারীর জনৈক মেজর আমাকে দু চোখে দেখতে পারতো না (এখন অবশ্য খুব ভালো সম্পর্ক) এসে আমাকে বাহবা দিলেন। আমাদের প্লাটুন কমান্ডার মেজর ইমতিয়াজকে আমরা ইশ্বরের মত দেখতাম, উনি যখন বাহবা দিলেন খুশি চেপে রাখা অসম্ভব।
ঐদিন ছেলেদের দুইটা বাউটে আমারটায় আমি জিতলাম, মেয়েদের জুডোতে সবগুলোতেই জাহাঙ্গেরিয়ান মেয়েরা জিতলো। পরেরদিন ছেলেরাও খুব ভালো করলো। পয়েন্ট তালীকায় নাটকীয় ওলট পালট হলো। রউফিয়ান্স রা একনাম্বারেই ছিল, মোস্তফাইয়ান আর হামিদিয়ানদের টপকে আমরা দুই নাম্বারে এলাম লাস্ট পজিশন থেকে।
রুম লক করে গিয়েছিলাম। ফিরে দেখি তেমনি লক আছে। রুমের ভিতর দুনিয়ার বার্গার, পেস্ট্রি, মিস্টি, নানারকম গিফট এবং সিগারেটের প্যাকেট, আমি খাইনা জেনেও। সিনিয়রেরা দিয়ে গেছে। রুমের চাবী পেল কিভাবে?? সবচেয়ে অবাক লাগলো মেজর ইমতিয়াজের তরফ থেকেও গিফট। খেলার পরে স্যার কোম্পানী লাইনে এসেছিলেন, তালা মারা রুম খুলে চুপিসারে গিফট রেখে চলে গেছেন, কেউ টেরও পায়নি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:১০
৩০টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×