অনুভূতির তীব্রতা যতই হোক তাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। একজন সামাজিকভাবে স্বীকৃত সফল এবং একইসাথে ব্যক্তিগতভাবে হতাশ ও দুঃখিত ব্যক্তিকে অবশ্যই আড়ালে থাকা উচিত।
একটা চপবোর্ড কিনেছি আজকে, সাদা রংয়ের। সেইসাথে একটা ছোট্ট ছুরি। মুগ্ধ হয়ে ছুরিটার দিকে তাকিয়ে আছি। ব্যবহারের পূর্বে জীবাণুমুক্ত করার কথা দায়িত্ববান দোকানী বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি অক্ষরে অক্ষরে তার কথা পালন করেছি।
সম্ভাব্য সব উপায়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে।
আমি দেখতে চেয়েছি ক্লান্ত চোখের অশ্রুগ্রন্থি ঠিকমত কাজ করছে কি না। এবং এই পরীক্ষণের জন্য জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করাটা কি পরিমাণ জরুরি সেটা দোকানী বলে না দিলেও ঠিকই বুঝতে পারতাম।
চার বছরের কিছু বেশী সময়ের আগের ঘটনা। আমি এবং আমার স্ত্রী, অরণি। দুজনের ছোট্ট সাজানো গোছানো সংসার। তবুও কেন জানি ঠিক পূর্ণতা পাচ্ছিল না। একটা কিছুর অভাব ছিল চোখে পড়ার মত।
যেদিন জানতে পারলাম আমরা পূর্ণতা পেতে যাচ্ছি ঠিক সেদিনকার অনুভূতি বর্ণনাতীত।
কিছু অনুভূতি সবার কাছেই একই রকম। অপরিবর্তিত এবং স্বর্গীয়। প্রথমবারের মত বাবা হতে যাচ্ছি।
সময়ে কেটে যাচ্ছে বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
আমার স্ত্রীর ব্যস্ততায় মুগ্ধ সময় কাটাতে থাকলাম।
একসময় অফিস থেকে ছুটিও নিলাম। বেশ লম্বা ছুটি। সময় যত কেটে যাচ্ছে আমি ততই ভীত এবং অহংকারীও হয়ে উঠেছিলাম। সৃষ্টির অহংকার।
সারাদিন ঘরে শুয়েবসে থাকি। নানান কিছু করে আমাদের অদ্ভূত একটা সময় কেটে যাচ্ছিলো।
চার বছরের একটা পিচ্চি মেয়ে। বড় বড় চুল নিয়ে সারা ঘরে দৌড়ে বেড়ায়। নীল রংয়ের দুইটা ক্লিপ থাকার কথা তার চুলে। দুষ্টামী করতে করতে একটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। সে এখন ক্লিপটা খুজে বেড়াচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না। ক্লিপটা খুজে না পেয়ে মেয়েটার চোখে রাজ্যের হতাশা!
একটা নাম অবশ্য এখনি সিলেক্ট করে ফেলেছি দুজন মিলে।
অংশু!
নামটা অবশ্য আমার মাথা থেকে আসে নি। নামটা সিলেক্ট করেছে আমার স্ত্রী।
-এইটা আবার কেমন নাম?
-মানে?
-মানুষের নাম এমন হয় নাকি?
রেগে গিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেয় সে। আমার অবশ্য নামটা অনেক পছন্দ হয়েছে। এর অর্থ আলো। কি চমৎকার একটা নাম। সারাঘর আলোকিত করে রেখেছে আমাদের অংশু। ভাবতেই কেমন যেন একটা অদ্ভূত অনুভুতি হয় আমার। খুবই পুরাতন পরিচিত একটা অনুভূতি।
অনেক পুরনো একটা স্মৃতিতে ফিরে যাই আমি। সবেমাত্র এইচ এস সি পরীক্ষায় গোল্লা মেরেছি। গোল্লা মানে ফলাফল আশানুরুপ হয় নাই।
দুঃখ দুঃখ চেহারা করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। একেবারে অকাট বাউন্ডুলের ভেক ধরে আছি। এরমধ্যে দুঃখের মাত্রা যাতে সবাই সন্দেহাতীতভাবে বুঝতে পারে তার জন্য বিড়ি সিগারেটও পুড়াচ্ছি নিয়ম করে। এমনি একটা অস্বস্তিকর মাতাল সময়ের দুপুরবেলা।
একটা বড় পুকুরের পাড়ে বসে আছি। বিকালবেলা অবশ্য এই জায়গাটাতে বসার কোন পরিবেশ থাকে না। প্রচুর লোকজন আসে একটু হাওয়া পরিবর্তনের জন্য। তখন আর এখানে থাকা যায় না।
কয়েকটা দোলনা আছে এক পাশে। বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য একেবারে আদর্শ জায়গা। আমি যে জায়গাটাতে বসে অলস সময় পাড় করছি ঠিক তার সামনেই দোলনা। দোলনার কাছে একটা মেয়ে দাড়ানো। বয়স তিন কি সাড়ে তিন হবে। পিচ্চিটা হঠাত কি কারণে যেন ভয় পেল। চিত্কার দিয়ে তার বাবার দিকে ছুটে গেল।
মেয়েটার বাবা কাছেই ছিল। দৌড়ে গিয়ে মেয়েটা বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখল।
এই দৃশ্যটা কেন জানি আমার ভিতরে গেথে গেল। আর তখনি আমার মনে হয়েছিল ইশশ আমার যদি এরকম একটা পিচ্চি থাকত। এভাবে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরত।
অবশেষে আমার অনুভুতিটা বাস্তবরুপ পেতে যাচ্ছে।
আমার স্ত্রীকে অবশ্য ছোট্ট এই ঘটনাটার কথা কখনো বলা হয় নি। কিছু কথা কাউকে বলা যায় না। এমনকি নিজের কাছেও বলা বারণ। তবে সব নিষেধ আমি মানতে পারি না। একা একা কিছুক্ষণ থাকলেই আজকাল সেই স্মৃতিটা মাথায় এসে বাড়ি দিচ্ছে।
এরইমধ্যে একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। অরণির মা একদিন আমাদের বাসায় এসে হাজির। একথা সেকথা বলে আমাকে বুঝাতে লাগলেন অরণির এখন ঠিক কি রকম সেবা শুশ্রুষার প্রয়োজন। এখানে না থেকে যদি অরণি তার মায়ের সাথে গিয়ে থাকে তাহলে অনাকাঙ্খিত বিপদসমূহ থেকে মুক্ত থাকার একটা সম্ভাবনাও দেখালেন। ভবিষ্যত নবজাতকের কথাও বারবার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। ভবিষ্যত আগন্তুকের জন্য তিনি কিরকম চিন্তিত এবং কোন সমস্যা হলে তার দায়দায়িত্ব বন্টন নিয়েও সবরকমেই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন।
রাশভারী ভদ্রমহিলার উদ্বিগ্নতা দেখে কিছুই আর বলতে পারলাম না।
তিনি সেদিনই অরণিকে নিয়ে চলে গেলেন।
হঠাত করেই কেন জানি মনে হলো অরণির সাথে বোধহয় আর দেখা হবে না। অফিস থেকেও ছুটি নিয়ে রেখেছি। অলস সময় পাড় করছি শুয়ে বসে। এলোমেলো অগোছালো হয়ে গেল নিত্যদিনকার রুটিন। অরণি অবশ্য খোজখবর রাখছে নিয়মিতই।
অস্থিরতার সময় কাটতে চায় না কিছুতেই। আমাদের অংশুকে দেখি আমি ঘরময় ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। অর্থহীন বুলিতে মাতিয়ে রাখছে সারাঘর। সব কিছুর প্রতিই অসীম কৌতূহল। শুধু টিকটিকি দেখলেই ভয় পেয়ে ছুটে আসে আমার কাছে। দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়ে মুখ লুকিয়ে রাখে। এরপর আস্তে আস্তে পিটপিট করে তাকায়।
আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি।
বেশকিছুদিন ধরে অরণির কোন খোজখবর পাওয়া গেল না। হঠাত একদিন সন্ধ্যায় অরণির মা ফোন করে হসপিটালে আসতে বলল।
ঠিক এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম এতগুলো দিন।
হাসপাতালে পৌছেই অরণির পিতার সাথে চোখাচোখি হলো। এই লোকটার জন্যই অরণিকে শেষ কয়েকটা দিন দেখতে যেতেও পারিনি। অবশ্য আমি আজ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এমন একটা দিনে ক্ষমা করতে কৃপণ হলে চলবে না।
ভদ্রলোকের পাথরের মত ভয়ংকর চোখ উপেক্ষা করা আমার মত ভীরু ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব।
আমাকে দেখেই ভদ্রলোক বসতে বললেন। খুবই নিরাবেগ গলায় ভালমন্দ কিছু আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা হল আমাদের মাঝে।
ততক্ষণে আমি প্রায় অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ভদ্রলোক আমাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বহীন বিষয় বুঝিয়ে যাচ্ছেন।
দুনিয়া মানেই মায়া মোহ এই টাইপের সস্তা দার্শনিকতার কপচাকপচি অন্য কোন সময় হয়তোবা মানিয়ে নেওয়া যেত কিন্তু এই মুহূর্তে আমি যথেষ্টই বিরক্ত হলাম। এবং প্রকাশও করে ফেললাম।
আমার রাজকন্যাকে একবার দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি।
আমাকে বিষ্মিত করে দিয়ে পাথর চোখ থেকে কয়েকফোটা তরল গড়িয়ে পড়লো। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। তবে অদ্ভুত পাথর চোখের ব্যক্তির সাথে নিজের একটা মিল খুজে পেলাম।
আমরা দুজনই আজ একে অন্যের ব্যথায় সমমর্মী।
একই দিনে আমরা আমাদের রাজকন্যাকে হারিয়েছি।
সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা দেখতে পেলাম।
চপবোর্ড আর ছুরিটা টেবিলের উপর রাখা আছে।
আজ আমাদের পিচ্চিটার ৩য় জন্মবার্ষিকী। চারদিকে কেউ নেই। নিস্তব্ধ রাতকে একটু জীবন্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফ্যানটা।
খুব সম্ভবত এখনই আমি ঘুমিয়ে পড়ব!
পাদটীকা ননসেন্স রাইম থাকতে পারলে ননসেন্স স্টোরী থাকতে পারবে না কেন?
ছাব্বিশ তারিখ সকালে লিখেছিলাম। পাবলিশ বাটনে ক্লিক দেয়ার পর পরই মোবাইলটা গেল বন্ধ হয়ে। ব্যস তিনঘন্টা গুতাগুতি করে লিখাটা হাওয়া। আজকে এখন আবার রিরাইট করলাম। আগের লেখাটা অনেক বেশী ভালো হৈসিল কিন্তু আজকে লিখতে গিয়ে দেখি আগেরটার বেশীরভাগ অংশই পুরোপুরি ভুলে গেসি। আর এই ভুলে যাওয়ার কারণেই এখন ননসেন্স স্টোরী শব্দটা আসতাসে। তবুও রিরাইট যে করতে পারসি তাতেই আমি খুশী।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:২৭