১.
নীতুর আজকে ভয়াবহ ধরনের মন খারাপ। সে চেষ্টা করছে মন খারাপ ভাবটাকে ঢেকে রাখতে। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছেনা। তার চোখ জলে টলমল করছে। মনে হচ্ছে কেউ একটা টোকা দিলেই টুপ করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়বে। নীতু এখন বসে আছে আমগাছের নীচে। নীতুদের আজিমপুর কলোনীর বাসার এই আমগাছটা নীতুর খুব প্রিয়। বাড়ির পেছনের জংলামত জায়গায় একটা বিশাল আমগাছ। নীতুর শৈশবে আমগাছটা নিয়ে একটা রহস্যময় ব্যাপার হয়েছিল। শৈশবের সেই ঘটনার পর থেকে মন খারাপ হলে নীতু আমগাছের নীচে এসে বসে থাকে। নীতু চোখ ভর্তি জল নিয়ে ফিসফিস করে আমগাছকে বলল, “এ্যাই লবঙ্গ, এ্যাই! আমার মন ভাল করে দাও।" কোন এক বিচিত্র কারণে নীতু আমগাছের নাম দিয়েছে লবঙ্গ। নীতুর কথায় আমগাছের মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলনা। সেটাই স্বাভাবিক। বৃক্ষকে সৃষ্টিকর্তা মূক ও বধির করে তৈরী করেছেন।
মাগরিবের আযান দিচ্ছে। নীতু বুঝতে পারছে আমগাছের নীচে বসে না থেকে বাড়ি যাওয়া দরকার। কিন্তু নীতুর মোটেই বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছেনা। আজকে নীতুদের কলেজ থেকে চিঠি এসেছে নীতুর আব্বার কাছে। চিঠিতে লেখা নীতু পড়াশোনায় খুব অমনোযোগী। সে গত তিন সপ্তাহে ক্লাস করেছে ছয় দিন। নীতুর আব্বা জামসেদ চৌধুরী পেশায় সরকারী উকিল। বেশ কড়া মানুষ। উনি চিঠি দেখে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন। তারপর নীতুর আম্মাকে বলেছেন, “মেয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করি। নীতুর আর পড়াশোনা করার দরকার নাই। মেয়ের মা’ও যেমন মূর্খ, মেয়েও সেরকম মূর্খ হয়ে থাকুক।" আয়শা খাতুন স্বামীর কথা শুনে কিছুই বলেননি। কারণ কথা সত্য। তিনি নিজে ম্যাট্রিকের পরে আর পড়াশোনা করেননি। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া পড়াশোনা করতে তাঁর কোনকালেই ভালো লাগেনি। আয়শা খাতুন চেয়েছিলেন একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। কিন্তু সব ঝামেলাই তার উপর এসে পড়েছে। ছেলে পড়ালেখা শেষ করে বেকার হয়ে দিনরাত বাড়িতে বসে থাকে আর মেয়ের পড়ালেখায় মন নাই। মাঝে মাঝেই নীতু কলেজ ফাঁকি দিয়ে এখান-ওখান ঘুরে বেড়ায়। তার ওপর স্বামীর মেজাজের যন্ত্রনায় বাড়িতে টেকা দায়। আয়শা খাতুনের মাঝে মধ্যে সংসার ছেড়ে-ছুড়ে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সংসার একটা আশ্চর্য মায়ার জায়গা। চলে যাব বললেও কোথাও যাওয়া যায়না।
নীতু হঠাৎ শুনতে পেল খসখস শব্দ করে কে যেন তার কাছেই আসছে। আতঙ্কে একদম জমে গেল নীতু। সন্ধ্যা অবধি সে কখনোই বাড়ির পেছনে একা বসে থাকেনি। নানা ধরনের খারাপ চিন্তা ঘুরছে মাথার মধ্যে। সেদিন-ই তো সুপ্তি গল্প করছিল, তাদের প্রতিবেশীর কাজের মেয়েকে একটা লোক হাত পা বেঁধে...। নীতুর ইচ্ছা করছে গলা ছেড়ে চিৎকার করতে। অথচ গলা দিয়ে একফোঁটা শব্দ বের হচ্ছেনা।
“নীতু চল, বাড়ি চল। আমি জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম তুমি আমগাছের নীচে ভেউ ভেউ করে কাঁদছ। আরো আগেই তোমাকে নিতে আসতাম। কিন্তু একা একা কাঁদলে মন হালকা হবে দেখে আসিনি।"
নীতু শক খাওয়ার মত চমকে উঠল। তারপর ঝট করে উঠে তৃণার গলা জড়িয়ে আনন্দে প্রায় চিৎকার করে বলল, “তৃণা আপা! তুমি! তুমি কখন এলে?”
নীতুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আজকের রাতটা তার জন্য শুভ। তৃণা আপা বাড়িতে এসেছে মানে কোন না কোন ভাবে নীতু আব্বার হাতে মার খাওয়া থেকে বেঁচে যাবে। একটু আগে আব্বার কথা শুনে নীতুর ভয়াবহ কান্না পাচ্ছিল। সেই কান্না ছিল মন খারাপের। এখন তৃণা আপাকে দেখে নীতুর কান্না পাচ্ছে। এই কান্নাটা মনে হয় আনন্দের। কান্না কি অনেক রকমের হয়? দুঃখ কান্না, আনন্দ কান্না, নেঁকি কান্না। আর কি কি কান্না থাকতে পারে? হীরাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। হীরা নীতুদের ক্লাসের সাহিত্যিক। কবিতা-টবিতা লেখে। কাজেই সে এইসব বিষয় ভাল জানে।
২.
তৃণা পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজকে প্রায় আট মাস পর সে মামার বাড়িতে এসেছে। মামার বাড়িতে এসে তৃণার ভীষণ রকম ভাল লাগছে। ভাগ্যিস আজকে ভার্সিটিতে দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি হয়ে হল বন্ধ হয়ে গেছে। ভার্সিটিতে মারামারি হলে কোন এক বিচিত্র কারণে তৃণার মনে বড় আনন্দ হয়। তৃণা একটা খালি চায়ের কাপ নিয়ে জামসেদ চৌধুরীর সামনে বসে আছে। চা খাওয়া বহক্ষণ আগেই শেষ। কিন্তু সে উঠে যেতে পারছেনা। কারণ মামা বলেছেন তৃণার সাথে তাঁর কথা এখনো শেষ হয়নি। মামার সামনে বসে থাকতে তৃণার যে খারাপ লাগছে তা না। এই ভয়ানক রাগী মানুষটাকে তৃণা প্রচন্ড রকম ভালোবাসে। মানুষটা শামুকের মত। বাইরের আবরণটা শক্ত, কিন্তু ভেতরটা নরম। তৃণার দৃঢ় ধারণা, মামী ভেতরের আবরণটার খোঁজ পেয়েছে। তা নাহলে এই কঠোর মানুষটার সাথে ঘর করা রীতিমত অসম্ভব।
“তৃণা!”
“জ্বী মামা?”
“ভার্সিটিতে পড়ছ দেখে নিজেকে খুব লায়েক মনে করছ? কি মনে করে তুমি একা একা ঢাকা চলে আসলে? আমাকে একটা ফোন করে খবর দেওয়া যেতনা?”
“মামা, তুমি খামোখা রাগ করছ। এই তো, এইখান থেকে এইটুকু রাস্তা। ডাইরেক্ট বাস।"
“তাতে কি? মেয়েমানুষ একা একা এতদূর আসবে, এটা আমার একদম পছন্দ না। নাবিল তো সারাদিন বাড়িতেই থাকে। অকর্মণ্যের ঢেকি। ও গিয়ে নিয়ে আসত। "
“থাক না। দাদাকে তো বাড়ির টুকিটাকি কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। তাকে আবার কেন...?”
“অকর্মণ্যের ঢেঁকির জন্য দরদ দেখি উপচে পড়ছে!”
তৃণা ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর চট করে হাসিটা মুখ থেকে মুছে ফেলতে ফেলতে বলল, “মামা, শোন, নীতুটা খুব ভয়ে ভয়ে আছে। ওকে তুমি বেশি কিছু বলোনা।“
“ধিঙ্গি মেয়ে দেখে গায়ে হাত তুলতে পারলাম না। তাছাড়া আজকে তুই বাড়িতে আছিস। নাহলে ওর মা সুদ্ধ সব গুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলতাম।"
“মামা, তুমি কি জানো নীতু কেন এই মাসে মাত্র ছয় দিন কলেজ গেছে?”
“কলেজ ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরেছে দ্যাখ গিয়ে! মেয়ের মায়ের তো কোনদিকে হুঁশ নাই।"
“মামীর হুঁশ ঠিক-ই আছে। তুমিই শুধু শুধু মাথা গরম করেছ । ভয়ে তোমাকে কেউ কিছু বলতে পারেনি। নীতুর এই মাসে জন্ডিস হয়েছিল। তাই কলেজ যেতে পারেনি। তুমি এটা কেন ভুলে গেছ? এখনো নীতু কলেজে অসুখের অ্যাপ্লিকেশান জমা দেয়নি দেখে কলেজ থেকে চিঠি দিয়েছে। মামা, আমি এখন একটু মামীর কাছে যাই। মামী রাতের জন্য কি রান্না করছে দেখে আসি।"
“তৃণা! তুই যে ঢাকাতে এসেছিস জাহানারাকে জানাসনি?”
তৃণার মুখ আচমকা শক্ত হয়ে গেল। সে কঠিন গলায় মামাকে বলল, “মাকে জানাতে ইচ্ছা করছেনা মামা। তুমি বরং একটা ফোন করে দিও মাকে। আর তাছাড়া তোমাদের বাড়িতে দিন পনেরো থাকলে তো তোমাদের তেমন কোন ক্ষতি হবেনা মামা। আমার মত বাড়তি উপদ্রব সহ্য করে তোমাদের অভ্যাস আছে।"
তৃণা ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র জামসেদ চৌধুরীর মন খারাপ হয়ে গেল। তৃণার মায়ের কথাটা না তুললেও হত। মেয়েটা ক’টা দিনের জন্য মামা বাড়িতে এসেছে। হলে-হোষ্টেলেই তো জীবন কাটিয়ে দিল। নীতুর জন্ডিসের ব্যাপারটাও ভুলে যাওয়া ঠিক হয়নি। তিনি ভাল বাবা হতে পারেননি--ব্যাপারটা মাঝে মাঝে খুব পীড়া দেয় জামসেদ সাহেবকে। বাচ্চাদের সাথে বাবার সম্পর্কটা হওয়া দরকার ছিল বন্ধুর মত। অথচ উকিলগিরি করতে করতে তিনি কেমন যেন কর্কশ হয়ে গেছেন। মমতা দিয়ে দু-একটা কথাও বলতে পারেননা ছেলেমেয়েদেরকে। জামসেদ চৌধুরী একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
৩.
“নীতু, তুমি মোবাইল পেলে কিভাবে?”
নীতু মোবাইল দিয়ে ফেসবুকে ঢুকে বসে ছিল। তৃণার দিকে না তাকিয়েই বলল, “এটা আমার মোবাইল না তৃণা আপা, আম্মার ফোন। আম্মার আর ফোন দিয়ে কাজ কি? এটা আমার কাছেই থাকে।"
“মামা জানেন তুমি মোবাইল নিয়ে ঘু্র?”
“নাহ! জানলে আমি আস্ত থাকব নাকি? তুমি আব্বাকে কিছু বলবানা কিন্তু আপা, প্লীজ!”
“আচ্ছা বলবনা। এখন তুমি একটু পড়তে বস, নীতু। জন্ডিসের সময় যেসব পড়াগুলো হয়নি, ওগুলো জমে পাহাড় হয়ে গেছে না?”
“পাহাড়-পর্বত বুঝিনা তৃণা আপা। আমার একটুও পড়তে ভাল লাগেনা। পড়ালেখা একটা বাজে জিনিস। তুমি কয়দিনের জন্য এসেছ, এত গম্ভীর মুখে পড়াশোনার কথা বলোনাতো! ভাল্লাগেনা!”
“আচ্ছা ঠিক আছে। বলবনা পড়ার কথা। সারাক্ষণ মোবাইলে কি করছ? কারো প্রেমে-ট্রেমে পড়েছ নাকি?”
“ধুর আপা! কি যে বল!”
তৃণা নীতুর দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা দিনে দিনে অসম্ভব রূপবতী হয়ে যাচ্ছে। খোলা চুলে দেবীর মত লাগছে নীতুকে। প্রেমে পড়ার প্রশ্নটা শুনে নীতুর ফরসা গালে কি হালকা লালের ছোঁয়া? নীতুর বয়সটাই অন্যরকম। প্রেমে পড়ার বয়স। সুইট সিক্সটিন।
নীতুর মাথা নিচু। হাতের আঙ্গুলগুলো দ্রুত খেলে বেড়াচ্ছে ফোনের বাটনে। কিন্তু নীতু তখন ভাবছে আসলে অন্য কথা, “রাসেলের সাথে আমার সম্পর্কটাকে প্রেম-ই তো বলে?” নীতুর ভীষণ লজ্জা লাগছে। তৃণা আপা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? আপা কি সব বুঝে ফেলেছে?
৪.
তৃণার মামী আয়শা খাতুন চুপচাপ ধরনের মানুষ। কথাবার্তা খুব কম বলেন। তাঁকে মোটামুটি একজন ব্যর্থ মা বলা চলে। কারণ দুইজন ছেলেমেয়ের কাউকেই তিনি ঠিকভাবে মানুষ করতে পারেননি। নাবিল এবং নীতুর কাছে মা এবং একটা গাছের সাথে তেমন কোন পার্থক্য নাই। গাছের সাথে রাগ করে কথা বললেও যেমন গাছ কিছু বলবেনা, মায়ের সাথে রাগ করে কথা বললেও মা কিছু বলবেনা—এটা নাবিল, নীতু দুইজনের-ই ধারণা। তৃণার অবশ্য মামীকে বেশ পছন্দ। কারণটা সে নিজেও জানেনা। তবে একটা ব্যাখা হয়ত আছে। তৃণার বাবা মারা যাওয়ার পর তার নিজের মা তাকে মামাবাড়িতে ফেলে রেখে আরেকটা বিয়ে করেছিল, তখন মামীর নির্লিপ্ত স্নেহেই তৃনার শৈশব কেটেছে। মামী তাকে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় না দিলে হয়ত তৃনার জীবনটা অন্য রকম হত।
“মামী, বকুল বুবুর কোন খবর জান?”
“নাবিল জানে, মা।"
“আচ্ছা আমি দাদাকে জিজ্ঞেস করে আসি।“
“যাও।"
তৃণার একটু মন খারাপ হল। তার ইচ্ছা ছিল মামীর সাথে কিছুক্ষণ কুটকুট করে গল্প করার। কিন্তু আগ্রহে ভাটা পড়েছে। মামী খুব সুন্দর করে তাকে বলেছেন, “যাও"। মামীর যদি গল্প করার ইচ্ছা থাকত মামী বলতেন, “আমার কাছে আরেকটু বস মা।" তৃণা মামীর উপর মনে মনে একটু রাগ করল। কিন্তু সে একবার ও নিজে থেকে বললনা, “মামী, তোমার সাথে একটু গল্প করি?”
তৃণা এমন একজন মেয়ে যে নিজের দুঃখ, কষ্ট, রাগ এমনকি আনন্দ ও নিখুঁতভাবে চেপে রাখতে পারে। কিছু কিছু মেয়ে কোন কারণ ছাড়াই নিজেকে মহামানবী ভাবতে ভালবাসে! তৃণা সেইসব মেয়েদের একজন।
৫.
নাবিলের ঘর থেকে রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছে। রবীন্দ্রসংগীতের সাথে সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ ও আসছে। মামা কি আজকাল দাদাকে আর শাসন করেনা নাকি? তৃণার চোখেমুখে হতাশা ফুটে উঠছে। দাদা ছিল স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির গুডিবয়। সেই গুডিবয় এখন ঘরে বসে সিগারেট খায়। কেউ কিছু বলেনা তাকে। বকুল বুবুর বিয়ের পর থেকেই দাদা বদলাতে শুরু করেছে। প্রিয় মানুষের ভালোবাসা না পেলেই কি মানুষকে বদলে যেতে হয়? তৃণা নাবিলের ঘরের সামনে থেকে সরে আসল। রবীন্দ্রসংগীতটা শুনতে ভাল লাগছেনা। ..."কত রাত তাই তো জেগেছি, বলব কি তোরে?” কি বাজে ব্যাপার! রাত হচ্ছে ঘুমানোর জন্য। অকারণে রাত জাগার প্রয়োজনটা কি? খ্যাপাটে রবীন্দ্রনাথের মাথায় মনে হয় বড় ধরনের কোন সমস্যা ছিল।
বকুল বুবুর সাথে দাদার ছিল কঠিন প্রেম। নীতুদের কলোনীর বাসা নম্বর ছয়। আর বকুল বুবুদের বাসা ছিল সাত নম্বর। পাশাপাশি বাসা। নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বকুল বুবুর আম্মা পিঠা, পায়েস করলেই বকুল বুবুকে বলতেন, “যাতো মা, উকিল সাহেবদের বাসায় একটু দিয়ে আয়।" দুই পরিবারের সেই সুমধুর সম্পর্ক চট করে ভেঙ্গে গেল যখন বকুল বুবু আর দাদার প্রেমের সম্পর্কের কথা জানাজানি হল। বকুল বুবু মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছিল, নাবিলের সাথে তার বিয়ে না দিলে সে বিষ খেয়ে মরবে। বকুল বুবুর আম্মাও তেজী মহিলা। উনি বলেছিলেন, “মরে যা বিষ খেয়ে। দেখি তোর কত তেল হইসে!” খুব-ই স্বাভাবিক। বেকার ছেলের সাথে কোন বাবা-মা তরুনী মেয়ের বিয়ে দিতে চায়? দাদার সাথে বকুল বুবুর বিয়ে হলনা। বকুল বুবুর বিয়ে হল এক ডাক্তারের সাথে।
তৃণা ডাইনিং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ কুচকুচে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে এক ফালি চাঁদ। চাঁদ মাঝে মাঝে মেঘ দিয়ে ঢেকে যাচ্ছে। তৃনার মনে পড়ছে বকুল বুবুর কথা। বকুল বুবু ছিল তৃণার ছেলেবেলার আদর্শ মানবী। সে সারাদিন বকুল বুবুর পেছন পেছন ঘুরে বেড়াত। সেই আদর্শ মানবীকে এখন তৃণা দু’চোখে দেখতে পারেনা। তৃণা এর পেছনের কারণটাও ঠিক জানেনা। বকুল বুবু যদি ডাক্তারের সাথে ঘর-সংসার না করে বিষ খেয়ে মরে যেত--তাহলেই কি তৃণা খুশি হত?
৬.
সকালবেলা তৃণার ঘুম ভাঙ্গল বৃষ্টির শব্দে। কাল রাত্রে আকাশে একটুও মেঘ ছিলনা। অথচ এখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।
“তৃণা, চা খাবে?”
“হুঁ, খাব। আগে মুখ-হাত ধুয়ে আসি। ক’টা বাজে, মামী?”
“সাড়ে নয়টা।"
তৃণা প্রায় ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে বসে বলল, “সেকি! এত বেলা হয়ে গ্যাছে? আমাকে তো একটু বাইরে যেতে হবে! আরো আগে উঠালেনা কেন আমাকে?”
“কোথায় যাবে? বৃষ্টি হচ্ছে তো!”
“উহু! রিকশাতে যাব। ভিজব না। ঢাকা ভার্সিটির দিকে যাব একটু।"
ঘর থেকে বের হতে না হতেই তৃনার দেখা হল নাবিলের সাথে। নাবিলের চোখের নীচে কালি, চুল এলোমেলো। নাবিলকে দেখলে যে কোন মানুষের বাংলা সিনেমার ব্যর্থ নায়কের কথা মনে পড়বে। প্রায় এক বছর হতে চলল, অথচ এখনো দাদা বকুল বুবুর মোহ কাটিয়ে উঠতে পারলনা। কি অদ্ভুত হাস্যকর একটা ব্যাপার! বিরক্তিতে তৃণার ভ্রু কুঁচকে গেল।
“তুই নাকি কালকে বকুলের কথা জানতে চেয়েছিস আম্মার কাছে?”
“হু। কেমন আছ দাদা? আমি কালকে বিকালে বাড়িতে আসলাম। আর তোমার দেখা পেলাম আজকে সকালে।"
“তুই তো কালকে রাতে আমার ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলি। ঘরে ঢুকলেই পারতি। আচ্ছা শোন, বকুলের বাচ্চা হবে। এখন তার মায়ের বাড়িতে আছে। দেখা করে আসতে পারিস।"
তৃণা তীক্ষ্ণ চোখে দাদার দিকে তাকাল। প্রাক্তন প্রেমিকার সব খবর তাহলে দাদার জানা আছে। তৃণা দাদাকে কড়া গলায় কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। মানুষকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে তার ভাল লাগেনা।
৭.
ঢাকায় আসা মানেই তৃনার অফুরন্ত অবসর। তৃনা একটা রিকশা ভাড়া করেছে। রিকশাওয়ালাকে শুধু বলেছে, “চলেন।“ কোথায় যাওয়া যায় তৃনা নিজেও বুঝতে পারছেনা। ঢাকা ভার্সিটির দিকে যাওয়া যেতে পারে। ঢাকা ভার্সিটিতে গেলে সাজ্জাদের সাথে দেখা হওয়ার একটা ক্ষীণ সম্ভবনা আছে। আবার তার সৎ বাবার ধানমন্ডির বাসা থেকেও ঘুরে আসা যায়।
বৃষ্টি প্রায় ধরে এসেছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে এখন। বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ। প্রকৃতি এত সুন্দর! তৃণার মনে হল যদি রিকশায় কোন একজন মানুষ তার পাশে বসে থাকত তাহলে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দ্বিগুন হয়ে যেত। সেই একজনটা কে? সাজ্জাদ? আচ্ছা, কাল দাদার ঘরে যেন কোন গানটা বাজছিল? খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি, মনের মন্দিরে?
সাজ্জাদকে নিয়ে খেলাঘর বাঁধার স্বপ্নে রিকশাতে বসে কেঁপে উঠল তৃণা। বৃষ্টিস্নাত তৃণার কল্পনায় তখন সাজ্জাদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত!
(চলবে)
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
শেষ পর্ব