প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
নিশাতের মুখ গম্ভীর। প্রফের রেজাল্ট এরকম হবে ভাবতেও পারেনি সে। একটু পর পর চায়ের খালি কাপ দিয়ে ক্যান্টিনের টেবিলে শব্দ করছে সাব্বির। সামনে বসে থাকা নিশাতের কোন খেয়াল-ই নেই সেদিকে। প্রফের রেজাল্ট তাকে বড় বেশি মুষড়ে দিয়েছে।
“নিশু,তুই মেডিসিনে পাশ করতে পারবিনা,এটা চিন্তাও করিনি। আমার-ই না ফেল করার কথা!”
“নাহ ঠিক আছে,আমি তো আনলাকি থার্টিন। ফেল-ই তো করব। তোর ইন্টার্নি শুরু কবে থেকে?”
“জানিনা। তুই পাশ-ফেল নিয়ে চিন্তা করিস না নিশাত। মেডিকেলে ফেল তো ডাল ভাত। ছয় মাস পর আবার পরীক্ষা দিবি।"
ক্লান্ত হেসে নিশাত বলল,“তোকে বলা হয়নি সাব্বির। আব্বা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। পড়াশোনা করা আর হবেনা রে একবার বিয়ে হয়ে গেলে।"
“ও। বিয়ের কথা আমাকে এত দেরিতে বললি? যাইহোক,কনগ্রাটস! জামাই কি করে?” সাব্বিরের গলায় স্পষ্ট ব্যঙ্গের ছোঁয়া।
“আব্বার পরিচিত এক ব্যবসায়ীর ছেলে। বুইড়্যা বেটা।" ফিক করে হেসে ফেলে নিশাত।
“জামাই বুইড়্যা দেখে খুব আনন্দে আছিস মনে হয়? বুড়াদের রসবোধ কিন্তু ভালই থাকে। তো তুই কি বিয়ে করে ফেলবি নাকি বুইড়্যাকে?”
“নাহলে কি করব? আমি তো ফেলটুস মেয়ে। অবলা নারী। বাপ-মা হাত পা বেন্ধে যেখানে বিয়ে দিবে সেখানেই করব।” কথাগুলো বলতে বলতে আচমকা গলা ধরে আসে নিশাতের।
“নিজেদেরকে মেয়েমানুষ,অবলা ভাবিস বলেই তোরা মেয়েমানুষ।"
“হ্যাঁ তাইতো! আমি নাহয় মেয়েমানুষ। কিন্তু তুই তো খুব সবল পুরুষ। তাহলে কেন মুখ ফুটে একবার ও বলতে পারলিনা—ভালবাসি?”
সাব্বির প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে নিশাতের দিকে তাকায়। এত প্যানপ্যান করতে পারে মেয়েটা! কড়া করে একটা ঝাড়ি দেওয়া দরকার। কিন্তু নিশাতের মায়া মায়া চোখে জলের আভাস দেখে হঠাৎ সাব্বিরের মত কঠোর ছেলের বুকের ভেতর কেমন যেন হুহু করে ওঠে। এই মেয়েটা না থাকলে জীবনেও সে পাশ করে ডাক্তার হয়ে বের হতে পারতনা। যখন-ই প্রয়োজন হয়েছে,ছায়ার মত সাব্বিরের পাশে ছিল নিশাত। নিশাতকে ছাড়া বাকি জীবন কাটানোর কথা চিন্তা করে নিজের অজান্তেই সাব্বির কেঁপে ঊঠে। হঠাৎ নিজের মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে নিশাতের চোখ থেকে টলমলে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ার আগেই খুব মৃদু স্বরে সাব্বির বলল,"আমি তোকে ভালবাসি,নিশাত। এখন দয়া করে কান্নাকাটি বন্ধ কর।"
---------
সাব্বিরের হাতে ছোট একটা চিরকুট। আক্কাস মিয়ার হাতে নিশাত পাঠিয়েছে। চিঠিতে বড় বড় করে লেখা—“সাব্বির,তোর মোবাইল বন্ধ। কখন খুলবি ঠিক নাই। তাই প্রাচীন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হল। আব্বা আজ রাতের ট্রেনে আমাকে নিতে আসবেন। আব্বার মতের বিরুদ্ধে ঢাকায় গিয়ে আমি কিছুই করতে পারবনা। বিয়ে করতেই হবে আব্বার পছন্দে। যদি সত্যি আমাকে ভালবেসে থাকিস,তাহলে আজকের মধ্যে আমাকে বিয়ে করতে হবে। আজ সন্ধ্যার মধ্যে। অন্ততঃ রেজিষ্ট্রিটা করে রাখি। আমি তোদের হোষ্টেলের সামনে আক্কাস ভাইয়ের দোকানের কাছে থাকব। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত তোর জন্য অপেক্ষা করব। আমি খোঁজ নিয়েছি জেনেছি নিউমার্কেটের পাশের কাজী অফিস আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সেখানেই রেজিষ্ট্রি করা যাবে। তুই ছয়টার পরে আক্কাস ভাইয়ের দোকানের কাছে আসিস। আর যদি মনে করিস,আবেগের বশে আমি এসব বলছি—তাহলে আসিস না। মনে রাখিস,সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত সময় আমাদের হাতে। আর শোন,কখনো বলা হয়নি—তুই একটু পাগল আছিস। কিন্তু এই পাগল ‘তুই”-টাকেই আমি ভালোবাসি। ইতি—নিশাত।"
সাব্বির পুরো হতভম্ব বোধ করে। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। নিশাত যেরকম মেয়ে,কখন কি কান্ড ঘটায় তার ঠিক নাই। মরার মোবাইলটাও নষ্ট হয়ে পড়ে থাকার সময় পায়নি। বুবুকে ফোন করলে একটা উপায় পাওয়া যেত। সাব্বির কাউকে কিছু না বলে হাসপাতালের ডিঊটি ফেলে দিয়ে বাইরে বের হয়।
“হ্যালো নিশাত! কি শুরু করলি এসব?"
“তুই ফোন করছিস কোথা থেকে?"
“আমার ফোন নষ্ট। বাইরে থেকে ফোন করছি। বেশিক্ষণ কথা বলা যাবেনা। পকেটে আট টাকা আছে।"
“চিঠিটা পেয়েছিস না? আক্কাস ভাইয়ের হাতে পাঠিয়েছি। উনি ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য কাউকে পেলাম না।"
‘’হ্যাঁ,চিঠি পেয়েছি। কিন্তু এসব কি?”
“চিঠিতে যা লিখেছি সেটাই। আমি তোকে ভালবাসি সাব্বির। আমি জানি,তুই-ও আমাকে পছন্দ করিস। আজ তোদের হোষ্টেলের কাছে থাকব আমি। সন্ধ্যায়। তুই না আসলে তোর ব্যাপার। নিশুকে হারাবি সারাজীবনের মত।“
“নিশাত,আমার কথাটা শোন ভাল করে। পাগলামি করিস না। এরকম খামখেয়ালী করা তোকে মানায় না। একটু ভেবে দ্যাখ নিশু!"
“মেডিকেল লাইফের সারাটা সময় আমি তোর খামখেয়ালীপনা সহ্য করেছি সাব্বির। আজকের দিনটাতে নাহয় আমার খামখেয়ালীপনা সহ্য কর! ভালো কথা,আজকে খিচুরী রান্না করছি। সন্ধ্যায় নিয়ে আসব। বিবাহ উপলক্ষ্যে খানাপিনা হবে। ভুনা খিচুরী আর গরুর মাংস।"
“নিশু প্লীজ বোঝার চেষ্টা...”
ফোনটা ওপাশ থেকে কেটে দিল নিশাত। তার দৃঢ় বিশ্বাস আজকে সাব্বির আসবেই তার কাছে। সাব্বিরকে ছুটে আসতেই হবে।
----------
“হ্যালো বুবু,শুনছ! সাব্বির বলছি।"
আয়শা বেগম এতদিন পর হঠাৎ সাব্বিরের গলা শুনে খুব খুশি হন। মা হারা ভাইটা কত্তদিন পর পর ফোন করে। খুব সাধ ছিল এই ভাইটাকে নিজের কাছে রাখে। তা আর হল কই? মেয়েমানুষের জীবন বড় কষ্টের।
“বল,সাব্বির। কেমন আছিস রে?”
“আমি ফোন করলেই তুমি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেল। যেন তোমার দিনদুনিয়া আমাকে ছাড়া অন্ধকার। আসলে তো ভাল-ই আছ। সুখে-শান্তিতে পরমপ্রিয় পতিমহাশয়ের জন্য ভাত রান্না করছ। আমার জন্য এসব ফালতু ফোঁসফোঁসানি বন্ধ কর বুবু। আমি ভাল আছি। মহা আনন্দে আছি।"
“আচ্ছা সাব্বির,ফোন করে কড়া কড়া কথাগুলো না বললে হয়না? কি বলতে ফোন করেছিস?”
“বুবু,জরুরী কথা বলতে ফোন করেছি। আমি আজকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবাকে তো বলা যাবেনা। গার্জেন তুমিই। তাই আমার জন্য দোয়া করো।"
আয়শা বেগমের মাথায় ব্জ্রাঘাত হয়। আর যাইহোক সাব্বির বিয়ের মত ব্যাপার নিয়ে মজা করার ছেলে না।
“কি? কাকে বিয়ে করবি?”
“বাবাকে এখন-ই এসব বলার দরকার নাই। দুলাভাইকে বললে বলতে পারো। বিয়ে করছি একটা মেয়েকে। মেয়ের নাম শানিত। কথার ধার ও সেইরকম শানিত।“
“মেয়ের নাম শানিত?”
“আরে না। মেয়ের নাম আসলে নিশাত। উল্টা-পাল্টা মেয়ে তো,তাই নাম উল্টা-পাল্টা করে বলেছি। আমার নিজের ও বিয়ের চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে গেছে বোধ হয়। মেয়ের অরিজিনাল বাড়ি ঢাকায়। আমাদের সাথে পড়ত। খাতির হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে বিয়ে করতে হচ্ছে। মেয়ের বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করেছে।"
“বউকে কি খাওয়াবি,কি পরাবি—নিজেই বা চলবি কিভাবে? ফাজলামি করছিস নাকি?"
“আরে তুমি কি আমার ইয়ার দোস্ত নাকি বুবু? ফাজলামি করছিনা। আসলেই বিয়ে করছি। আজ সন্ধ্যায় কাজী অফিসে বিয়ে করব। এখন রাখি,পকেটে পাঁচ টাকা আছে। বেশি কথা বললে ফোনের বিল দিতে পারবনা। বাইরে থেকে ফোন করেছি। বিয়ে করে বউ তোমার বাড়িতে রেখে আসতে পারি। আগেই বলে রাখলাম।"
বুবুর সাথে কথা শেষ করে সাব্বির এলোমেলো হাঁটতে থাকে। কিছুই ভাল লাগছে না। নিজেকে মেরুদন্ডহীন মনে হচ্ছে। নিশাতের মত একটা মায়াবতী মেয়েকে কিছুতেই হারাতে চায়না সাব্বির। কিন্তু যে ছেলে বৃদ্ধ বাবার জন্য কিছু করতে পারেনি,একমাত্র বোনের জন্য কিছু করতে পারেনি—এখনো ইন্টার্ণির প্রথম মাসের বেতন হাতে পায়নি,তার কাছে সব কিছু এই মুহূর্তে বাহুল্য মনে হয়,সব কিছু!
আক্কাস মিয়ার চায়ের দোকানে বসে এককাপ চা খেয়ে “নিশাত আসলে এটা দিয়েন” বলে আক্কাস ভাইয়ের হাতে একটা ছোট্ট কাগজ গুঁজে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে কোথায় যেন হারিয়ে যায় একগুঁয়ে,একাকী ছেলেটা!
-----------
সন্ধ্যার সময় রাজশাহী মেডিকেলের বয়েজ হোষ্টেলের সামনে বড় বেশি অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে। আক্কাস মিয়ার দোকানের সামনের যে জায়গাতে আজ সন্ধ্যাবেলা দু’টো ছায়ামূর্তির এক হয়ে নতুন জীবনের সূচনা করার কথা ছিল—সেই জায়গাটা ফাঁকা। নিশাত কিংবা সাব্বির—কাউকেই সেখানে দেখা গেলনা। দু’জনের কাউকে না!
----------
সেদিন রাতে মেঘলা আকাশ ভেঙ্গে ঝুম বৃষ্টি হল। শীতের দিনে সাধারণত বৃষ্টি হয়না। কিন্তু কিছু কিছু দিনে সব কিছুই স্বাভাবিক লাগে। সেদিনটাও যেন ছিল স্বাভাবিক বৃষ্টিদিন। প্রকৃতির অপার লীলা। মানুষের অশ্রুজল কখনো কখনো বৃষ্টির রূপ নেয়।
(চলবে)
শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:৫৬