somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুতুল বউয়ের আত্মকথন

০২ রা জুন, ২০১১ রাত ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আজ আমার বিয়ে। গতকাল গায়ে হলুদ ছিল। আমি এখন সেনাকুঞ্জে বউ সেজে বসে আছি। আমাকে বউ সাজতে গিয়ে বিশাল ঝামেলা হয়েছে। ঠিক করা ছিল বিয়ের সাজগোজ করব পারসোনাতে। কিন্তু আমার ছোট মামী বললেন পারসোনার চেয়ে ফারজানা শাকিল’স-এ নাকি সুন্দর করে বউ সাজায়। ছোট মামী আবার শখের বিঊটিশিয়ান। আমি খেয়াল করে দেখেছি বেশির ভাগ রাধুনী এবং বিউটিশিয়ানরা মোটা হয়। আমার মামীও মোটা। মোটা দেখেই কিনা জানিনা সবাই উনাকে দেখে বেশ ভয় পায়। তাঁর কথার উপরে কেউ কথা বলেনা। আমার খুব ইচ্ছা পারসোনাতে সাজার,কিন্তু চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে সেই কথা আর ছোট মামীকে বলতে পারলাম না। ফারজানা শাকিল’স-এ বিশাল এক লটবহর নিয়ে র্‌ওয়ানা দিলাম।

ফারজানা শাকিল’স-এ আমার আগেই আমার খালাত-চাচাত-মামাত টিন-এজ কাজিনরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল সাজার জন্য। ছোট মামী একটা ধমক দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দিলেন। আমি একটু লাইট ভাবে সাজতে পছন্দ করি। কিন্তু বিউটি পার্লারের মেয়েগুলা বলল বিয়েতে নাকি ডার্ক ভাবে সাজতে হয়। তাদের কথাই মেনে নিলাম! কিন্তু সাজার পরে আমাকে কেমন সাদা ভুত,সাদা ভূত লাগতে লাগল। আমি একটু চঞ্চল টাইপ মেয়ে। বিয়ের দিনেও আমার চঞ্চলতা কমেনা। আমি হাতে কিল মেরে বললাম,এই সাজ ক্যানসেল,পছন্দ হয়নাই। আবার সাজতে চাই। কিন্তু আমার ছোট মামী বললেন আমাকে নাকি প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির মত লাগছে। আমি বড়-ই লজ্জায় পড়ে গেলাম। এই কথা শোনার পর সাজ বদলানোর প্রশ্ন ঊঠেনা। সাজগোজ করে সাদা ভূত হয়ে গাড়িতে করে র্‌ওয়ানা দিলাম সেনাকুঞ্জের দিকে। আমাদের গাড়িকেও বউ-এর মত সাজানো হয়েছে। গাড়িকে অবশ্য গরু গরু লাগছে। মনে হচ্ছে একটা গরুকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে।

সেনাকুঞ্জে পৌঁছে দেখি ভয়াবহ ব্যাপার। এই গরমের মধ্যেও কয়েক’শ লোক ঘেমে-নেয়ে কিলবিল করতে করতে আমার বিয়ে খেতে চলে এসেছে। এতদিন নিজে অনেক বিয়ের দাওয়াত খেয়েছি এখানে,কিন্তু আজ আমার বিয়ের খাওয়া-দাওয়াই সেনাকুঞ্জে। কেমন অন্যরকম লাগছে। তার চেয়ে বেশি লাগছে গরম। আমি গাড়ি থেকে নামা মাত্র কোথা থেকে যেন পাঁচ-ছয় জন ক্যামেরাম্যানসহ দুনিয়ার পিচ্চি-পাচ্চা,আমার বান্ধবীরা আর বুড়ো বুড়ো আন্টিরা ছুটে এলেন। আমি অবশ্য কাউকেই চিনতে পারছিনা। সবাইকে এক রকম মনে হচ্ছে।

ফটোসেশনের পর্ব শেষ হলে আমি যতটা ধীরে হাঁটি তার চেয়ে অনেক বেশি ধীরে ধীরে সেনাকুঞ্জের ভেতরে ঢুকলাম। ধীরে হাটতে হচ্ছে কারণ আমার হাঁটার ও ভিডিও করা হচ্ছে। এই জন্য ঢং করে হাঁটছি। নাহলে প্রায় দৌঁড়ে গিয়ে বউ-এর বসার জায়গায় বসে যেতাম। ভেতরে ঢুকে আরাম পেলাম। আহা! এসির ঠান্ডা হাওয়া ভেতরে! কিন্তু মানুষ প্রচুর। রং-বেরঙ্গের মানুষ!

বিয়ের দিনটা স্মরনীয় দিন। অথচ আমার সেরকম কোন অনুভুতি হচ্ছেনা। এতদিন শুধু অন্যদের বিয়ে খেয়েছি। খেয়ে-দেয়ে বাড়ি চলে গেছি। আর এখন আমাকে জবু-থবু হয়ে ভারী শাড়ি পরে বসে থাকতে হচ্ছে। আমার ইচ্ছা করছে এই গয়না আর ভারী শাড়ি খুলে শান্তিতে ঘরে গিয়ে ঘুমাই। খাওয়ার গন্ধে পুরো কমিউনিটি সেন্টার মৌ মৌ করছে। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। কাল থেকে হইচইয়ের মধ্যে ভালমত খাওয়া হয়নি। আজকে কখন খেতে পাব কে জানে? ভীড়ের মধ্যে থেকে মা একবার বের হয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে গেলেন,সব গয়না ঠিক মত আছে কিনা? আমি মাথা নাড়লাম। ছোট মামী সাথে থাকলে গয়না হারানোর ভয় নেই। মা’র শাড়ি দেখে বিরক্ত হলাম। মা’কে বলেছিলাম অফহোয়াইট রঙ্গের শাড়িটা পড়তে। মা ফিরোজা শাড়িটা পড়েছে। মাকে ফিরোজা রঙ মানায় না। বাবাকে আসে-পাশে কোথাও দেখছিনা। মনে হয় গেইটে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

এখন সাড়ে আটটা বাজে। আমার খুব টেনশন হচ্ছে। মানুষটা এখনো আসছেনা। অথচ চলে আসা উচিত। চেয়ারের পাশের অংশটুকু আমার কাছে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। যদিও পাশ ফাঁকা থাকছেনা। মাঝে মাঝে অনেকেই গ্রুপ করে ছবি তুলে যাচ্ছে। আমিও হাসি ঝুলিয়ে রেখে ছবি তুলছি। তিন্নি আবার ছবি তুলতে এসে টিটকারি মেরে গেল। আমি-ই নাকি বন্ধুদের মাঝে সবার প্রথম মুক্তার মালা গলায় ঝুলালাম। আমার বর হচ্ছে মুক্তার মালা। আর আমি বাঁদর।

চারপাশে ভীড় করে মানুষেরা আমাকে দেখছে। চিড়িয়াখানার জন্তু দেখার মত। বিয়েতে এভাবে হা করে বঊ দেখা আমার সব সময় অপছন্দ ছিল। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। আমার মা-ও এভাবে বিয়েতে বউ দেখে। তারপর বাসায় এসে বলে মেয়েটার নাক বোঁচা,জামাইটা কেমন হাইব্রীড টাইপ। আজকে বাড়ি গিয়ে আন্টিরাও নিশ্চয়-ই আমার কথা এভাবে বলবেন—মেয়েটাকে ভূতের মত লাগছিল। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই আমি আরো অপ্রস্তুত হলাম। মাইক্রোফোনে বলা হল কিছুক্ষনের মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া সার্ভ করা হবে। এটা শুনে কি হল জানিনা—আমাকে যারা জন্তু দেখার মত করে দেখছিল তাঁরা খুব চঞ্চল হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে আমাকে দেখা বাদ দিয়ে খাবার টেবিলের দিকে ছূটে গেল। ষ্টেজের সামনের দিক এখন প্রায় ফাঁকা। মানুষগুলো টেবিলে বসে আছে। আর যারা ফার্ষ্ট ট্রিপে বসতে পারেনি তারাও বসার জন্য হন্যে হয়ে আসন খুঁজছে। বাবর চাচুকেও দেখলাম টেবিল খুঁজতে। সাথে লামিয়া। বাহ! লামিয়া পিচ্চিটা অনেক বড় হয়ে গেছে তো! আদর করতে ইচ্ছা করছে পিচ্চিটাকে।

মানুষজনের গোগ্রাসে খাওয়া দেখছি আর চিন্তা করছি আমি যখন বিয়েতে হাপহুপ করে খাই নিশ্চয় আমাকেও এরকম বাজে লাগে। চিন্তা করতে করতেই সোরগোল,”বর এসেছে,বর চলে এসেছে!” বর আসলে এসেছে,এত চিল্লাচিল্লি করে ক্যান সবাই? এমনিতেই ধুমধারাক্কা “শিলা কি জাওয়ানি”-র তালে মাথা ধরে যাচ্ছে। আমি বারবার বলেছিলাম বাংলা গান দিতে। কিন্তু আমার বদ কাজিনগুলো রাজি হলনা। হিন্দিতে কি মজা পায় কে জানে?

মানুষটাকে সবাই গেটেই আটকে রেখে দিয়েছে। বদ কাজিনগুলা নিশ্চয় গেইট ধরেছে। আহারে মানুষটা গরমের মধ্যে সেজে-গুজে কষ্ট করে এসেছে—কোথায় একটু বসবে—তা না গেইট ধরাধরি শুরু হয়েছে। কত টাকায় ছাগলগুলো গেইট ছাড়ল জানিনা,একটু পর দেখি মানুষটা আসছে। সামনে ভীড় করা ক্যামেরাম্যানগুলোকে ছাপিয়ে দেখা যাচ্ছে লম্বা মানুষটার মুখ। মানুষটা ষ্টেজের একদম কাছে এসে থামল। কি সুন্দর মানিয়েছে মানুষটাকে পাঞ্জাবীতে! আমি অবশ্য বেশি তাকাচ্ছিনা,কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। অথচ এক সময় মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে চারুকলার বারান্দায় কেটে গেছে কত সুন্দর বিকাল!

মানুষটা খুব আস্তে করে আমার পাশে এসে বসল। মানুষটারও কি আমার মত অন্যরকম লাগছে? এত মানুষ আমাদের আশে-পাশে যে আমরা কোন কথাই বলতে পারছিনা। আমার শাশুড়ি আম্মা এসে আমাকে আদর করে গেলেন। শাশুড়ি আম্মা চলে যাওয়ার পর পর-ই মানুষটা মাথাটা আলতো করে আমার দিকে এনে ফিসফিস করে বলল,"ভালো আছ তুমি?” আমি লজ্জায় লাল হয়ে ঘাড় কাত করলাম শুধু।

ক্যামেরাম্যানরা সেই মুহুর্তটার ছবি তুলে যাচ্ছে অবিরত—ক্লিক! ক্লিক! ক্লিক!


হা হা হাঃ

গত পরশু আম্মুর সাথে একটা বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। নয়টা বেজে যাচ্ছে,কিন্তু খাওয়া সার্ভ করার কোন লক্ষণ নাই। আমি তো বিয়ের দাওয়াতে ভালমত পেট পুরে খাব দেখে সারাদিন কিছু খাইনি। বাঙ্গালি স্বভাব! কিন্তু প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ চোখ গেল ষ্টেজে বসা পুতুলের মত ব্‌উটার দিকে। হাসি হাসি মুখ করে সবার সাথে ছবি তুলছে পুতুলটা। বর তখনো আসেনি। হঠাৎ মনে হল,পুতুলটা ষ্টেজে বসে কি কি চিন্তা করতে পারে? বউকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই খাবার চলে এল। হুপহাপ করে খেয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম। কিন্তু পুতুল বউকে নিয়ে এলোমেলো চিন্তাগুলো থামল না। অবশেষে চিন্তাগুলো লিখেই ফেললাম—আজ,আধাঘন্টা আগে। আমি একটু পাগল আছি! কি সব চিন্তা যে মাথায় আসে মাঝে মাঝে!

পুনশ্চঃ এই গল্পটির নাম পূর্বে ছিল "আজ আমার বিয়ে"। কিন্তু কিছু ব্লগার যেহেতু গল্পটি না পড়েই কিছু রুচিহীন কমেন্ট করেছেন ,তাই আজ থেকে এই গল্পটির নাম "পুতল বউয়ের আত্মকথন"। আগে এখনকার শিরোনামটা মনে আসলে হয়ত শিরোনাম নিয়ে এত ঝামেলা হতনা।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫৪
৯১টি মন্তব্য ৮৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×