১.
বারান্দায় কাপড় মেলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি আসবে কিনা বুঝার চেষ্টা করছি এমন সময় নিশাতের কাছ থেকে খবরটা জানতে পারলাম। নিশাত বই-খাতা সহ বারান্দায় এসে হাসিমুখে জানিয়ে গেল আয়শা আপা নাকি শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসেছে একেবারে। অবাক হলাম না খবরটা শুনে। আয়শা আপার বিয়ের আগে থেকেই রুবেল ভাইকে আমার পছন্দ ছিলনা। কিন্তু নিশাতের হাসি হাসি চেহারাটা দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার—
--অই বেয়াদব মেয়ে! মানুষের বিপদে তোমার হাসি আসে,না?
‘'কই হাসলাম বড়’বু?” বলেই নিশাত ফিক করে হেসে ফেলল। আমার মনে হল ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমি কখন-ই নিশাতের মত এত দুষ্টু ছিলাম না। ছোট মেয়ে দেখে আব্বা ওকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলছেন।
--নিশাত,তুই দিনে দিনে অনেক ফাজিল হচ্ছিস। আয়শা আপার কথা কার কাছ থেকে শুনলি?
--বুয়া ছাদে গেছিল আচার শুকানোর জন্য। তখন আয়শা আপাদের বুয়াও ছাদে ছিল। দুই বুয়া এক হইলে যা হয়। সব কাহিনী বলা শেষ!
--ভাল। বুয়াকে বলতে হবে যেন এইসব কথা আবার অন্যদের না বলে। পরে মানুষ ভাববে আমাদের বাসা থেকে এসব কথা রটে। এখন যাও,তুমি পড়তে বস।
--বড়’বু,তুমি কি আয়শা আপাদের বাড়ি যাবা আজকে?
--দেখি!
২.
আয়শা আপারা আমাদের বাড়ির দোতালায় থাকেন। ভাল প্রতিবেশী বলতে যা বোঝায়,আয়শা আপারা ঠিক সেটাই। অসম্ভব সজ্জন মানুষ আয়শা আপার আব্বা। পেশায় উকিল। আয়শা আপার মা আপার জন্মের পর-ই মারা যান। আপার বড়ভাই আমেরিকায় থাকেন। দেশে আসতে তেমন দেখিনা। আমি যখন নাইনে পড়ি তখন থেকেই রুবেল ভাইয়ের সাথে আয়শা আপার প্রেম। কঠিন প্রেম বলা যায়! প্রেম-ট্রেম আমাকে কখনই টানেনি। তাই আপার পুতুপুতু প্রেম কাহিনী শুনে খুব বিরক্ত হতাম। কিন্তু ফ্ল্যাটে আপার সমবয়সী কেউ ছিলনা,তাই আপার যাবতীয় প্রেম-কাহিনীর খুঁটিনাটি আপার চেয়ে তিন বছরের ছোট আমাকেই হজম করতে হত। বিনিময়ে মাঝে মাঝে মজাদার কিছু খাবার কপালে জুটত।
--জানিস নীতু? তোর রুবেল ভাই না আজকে আমাকে চারটা লাল গোলাপ কিনে দিয়েছে।
--ভাল করছে। গোলাপ জল বানায় ফেল। তারপর মুখে মাখ। তোমার মুখ আরো পরিষ্কার হবে।
--আমি কালো বলে তুই খোটা দিলি নীতু?
--আরে বাবা! তুমি কই কালো? তুমি তো শ্যামলা!
--জানিস নীতু,তোর রুবেল ভাই বলে আমি নাকি অনেক ফর্সা!
এটুকু বলেই অনেক লজ্জায় লাল হয়ে যান আয়শা আপা। কিন্তু গায়ের রঙ্গের কারণে লালের ছোপ চোখে পড়েনা আমার। আমি মনে মনে হাসি। হায়রে ভালবাসা! শ্যামলা মেয়েও ফর্সা হয়ে যায়!
রুবেল ভাইকে কেন জানি আমার কখনোই ভাল লাগত না। তার কথা বলা,চাউনি—কিছুই না। আমি বলতাম আয়শা আপাকে মনের কথাগুলো। আপা কখনো-ই পাত্তা দিতনা। আমার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলত—“একবার কারো প্রেমে পড়,তারপর বুঝবি কেন সেই মানুষের সব কিছু ভাল লাগে!” কি জানি! আমার ও ভুল হতে পারে। রুবেল ভাই হয়তো আপাকে আসলেই ভালবাসেন। গালে হাত দিয়ে উদাস হয়ে আমি ভাবতাম আমার কথা—আমি কেন কারো প্রেমে পড়িনা?
আমি যখন ম্যাট্রিক দিয়ে বাড়িতে বেকার বসে আছি, হুট করে এক দুপুরে শুনি চাচা মানে আয়শা আপার আব্বা আয়শা আপার সাথে রুবেল ভাইয়ের সম্পর্কের কথা জেনে ফেলেছেন। চাচা কিছুতেই রাজি না বেকার এক ছেলের সাথে আয়শা আপার বিয়ে দিতে। আপা তো আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করে অস্থির। আমার কেন জানি চাচার উপর খুব রাগ হয়ে গেল। আপার কান্না দেখেই কিনা জানিনা,আমি আমার আব্বাকে যেয়ে বলে দিলাম আয়শা আপা আর রুবেল ভাইয়ের কথা। বললাম,"আব্বা আয়শা আপা খুব কান্নাকাটি করছে। তুমি চাচাকে গিয়ে বুঝাও। তোমার কথা উনি শুনেন।"
আমার আব্বার সাথে চাচার কি কথা হয়েছিল জানিনা। কিন্তু পরেরদিন আয়শা আপা এসে বলল চাচা নাকি রুবেল ভাইয়ের সাথে আপার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। আয়শা আপার মুখ খুশিতে ঝলমল করছিল সেদিন। এরপর আর কোনদিন এত আনন্দ আয়শা আপার মুখে আর দেখেছি বলে আমার মনে পড়েনা। রুবেল ভাইকে চাচাই একটা ছোট-খাট চাকরি ঠিক করে দিলেন।
এর পরের বছর শ্রাবন মাসের কোন এক শুভ দিনে আয়শা আপার সাথে রুবেল ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের তিন মাস পরেই আয়শা আপা বুঝতে পারলেন রুবেল ভাই একজন পাঁড় মাতাল! এডিক্ট! চার বছরের অর্জিত বিশ্বাস ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল।
৩.
আমি আয়শা আপার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে ঢুকব কিনা বুঝতে পারছিনা। হাল্কা করে ভেজানো দরজাটাতে একটা টোকা দিলাম। ভেতর থেকে আপার কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর ভেসে এল—
--কে?
--আপা,আমি নীতু।
--ও নীতু। আয় ভিতরে আয়,বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
ভেতরে ঢুকে আমার বুকের ভেতরটা মোঁচড় দিয়ে উঠল। একী হাল হয়েছে আপার? সারা গায়ে ব্যান্ডেজ,রুগ্ন মুখ--আমার হাসিখুশি আয়শা আপা একটা শুভ্র চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছেন। আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল। আমি আপার কাছে গেলাম না।
--কি রে পাগলী? আমাকে দেখে মন খারাপ হল? আয়,আমার পাশে বস।
--আপা তোমাকে রুবেল ভাই এভাবে মেরেছে? মায়াদয়া নাই লোকটার?
--থাকরে,এভাবে বলিস না!
--এভাবে বলব না? বলব আমি একশবার বলব। বেটা একটা জল্লাদ।
--মদ খেতে দিইনি দেখে বেচারার মাথা গরম হয়ে গেছিল রে! তাই হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়ে মেরেছে। নেশা বড় কঠিন জিনিস।
--ভালোবাসার নেশাও মনে হয় কঠিন জিনিস। এত মার ধোরের পর ও তাকে নিয়ে একটা খারাপ কথা তোমার মুখ থেকে বের করা যায়না। আজব আপা!
--রেগে যাচ্ছিস নীতু? তুই আগের মত-ই কঠিন আছিস। প্রেমে পড়িসনি এখনো,নারে?
--নাহ! তোমাকে দেখে সেই ইচ্ছা মরে গেছে। যাই হোক,এখন তুমি কি করবে?
--একটু সুস্থ হয়ে আবার ওর কাছে ফিরে যাব। তাকে ঠিক করার চেষ্টা করব।
--আবার ও আয়শা আপা? এভাবে মাইর খাওয়ার পর ও তুমি যাবে ওই বাড়িতে?
--বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যে বাপের বাড়ি পর হয়ে যায় রে নীতু। ওইটাই তো আশ্রয়।
--চাচা তোমাকে যেতে দিবেন?
--দিবে দিবে। নাহলে যে তোর চাচাকে বিয়েভাঙ্গা মেয়ের অপবাদ সইতে হবে সারাজীবন।
--আপা,একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
--কর।
--কি লাভ ওই হিংস্র মানুষটাকে ভালোবেসে?
--লাভের জন্য তো ভালোবাসিনি রে। ভালোবাসব দেখেই ভালোবেসেছিলাম।
আয়শা আপার চোখ জলে টলমল করে। আমি আপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। আপার কান্না দেখে আমার কার উপর যেন খুব রাগ হয়। সব কিছু ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছা করে। আপা বলে আমি নাকি কঠিন মেয়ে! সত্যি আমি অনেক কঠিন আপা! তোমার মত এত নরম না!
৪.
আপা কিছুদিন পর আবার রুবেল ভাইয়ের কাছে ফিরে যান ভালোবাসার লাভ-ক্ষতি হিসেব না করে। এবং আবার ও আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়,আপাকে বাপের বাড়িতেই ফিরে আসতে হয়। তবে এবার আর একা না, পেটের মধ্যে আরো একটা ক্ষুদ্র প্রাণ সাথে করে নিয়ে আসেন আয়শা আপা। আপার খালা-খালুরা বলেন পেটের সন্তানকে নষ্ট করে ফেলতে,তারপর তাঁরা আবার আপার বিয়ে দিবেন ভালো ছেলে দেখে। এমনকি আপার উকিল সাহেব আব্বাও আইনের ধার না ধেরে সেই ভ্রূনটিকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আমার নরম আপা এবার নিজের সিদ্ধান্তে কঠোর হয়ে যান। শিশুটিকে আলো দেখানোর দৃপ্ত সংকল্পে আপার চোখ উজ্জ্বল হয়। আয়শা আপার সব দৃঢ়তার সাক্ষী হই আমি। বেচারা আপা! একের পর এক ঝড় তার জীবনটাকে যেন এলোমেলো করার লক্ষ্যে ছুটছিল। হঠাৎ করেই আপার আব্বা ব্রেইন ষ্ট্রোকে মারা যান। আপা একা হয়ে পড়েন। একদিন হুট করে আমাদেরকে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করে প্রেগন্যান্ট অবস্থাতেই আপা গ্রামের বাড়ি শিবগঞ্জে চলে যান। আপার সাথে আমাদের যোগাযোগের কোন উপায় ছিলনা। সেই তখন থেকেই আয়শা আপাকে আমি হারিয়ে ফেলি।
আমি সবসময় ভাবতাম আপা বোকা,আপা সহজ-সরল। কিন্তু কখনো ভাবিনি বোকা মেয়েরাই অনেক বেশি অভিমানী হয়!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
হারিয়ে যাওয়া আয়শা আপার সাথে আমার আবার দেখা হল। ঠিক বিশ বছর পর না। গুনে গুনে হিসাব করলে বাইশ বছর পর।
একদিন চেম্বারে বসে রোগী দেখছি,অনেক কাজের চাপ। এমন সময় আমার অ্যাসিস্টেন্ট এসে বলল আমাকে আমার এক আত্মীয় ফোন করেছেন। বলেছেন জরুরী ভিত্তিতে কথা বলা দরকার। আমার কুঞ্চিত ভ্রু আরো কুঞ্চিত হল। মানুষজনকে বাড়তি সময় দেওয়ার সময় আমার হাতে এখন আর নাই। তারপর ও আমি রিসিভার হাতে নিলাম-
--হ্যালো। স্লামালিকুম।
--ওয়াইকুম আসসালাম। নীতু,কেমন আছ?
আমি চরম পর্যায়ের বিরক্ত হলাম। কেমন আত্মীয়,কোথাকার আত্মীয় জানিনা। কিন্তু তিনি আমার ডাকনাম পর্যন্ত জানেন। আমি বিরক্ত গলাতেই বললাম—
--ভাল আছি। কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে পারছিনা। যদি নিজের নামটা বলেন প্লীজ..
--আমি তোমার আয়শা আপা নীতু। আয়শা আপাকে মনে নেই?
আমি অনেকক্ষণ ধরে আয়শা আপা ব্যক্তিটা কে সেটা মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে করার পরে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আয়শা আপাকে পেয়ে বিশ বছরের নীতু যেমন আবেগে উদ্বেলিত হ্ত,চল্লিশ বছরের নীতুর তেমন কিছুই হলনা। সময় আমাকে বদলে দিয়েছে! হয়ত আয়েশা আপাকেও!
--হ্যালো আপা। কেমন আছেন?
--যাক,তুমি চিনতে পেরেছ তাহলে। তোমাকে আমার খুব দরকার বোন।
আমি আবার ও বিরক্ত হলাম। মানুষজন দরকার ছাড়া ফোন করেনা। আমার যে এত বিপদ গেলো কয়জন তখন পাশে ছিল? কিংবা আয়শা আপা নিজে যখন একা একা গ্রামে চলে গেল বাইশ বছর আগে আমাকে তো একবার বলার প্রয়োজন ও বোধ করেনি! এখন নিজের দরকারের সময় ঠিক-ই হাজির! সেই বহুবছর আগের কথা মনে পড়ে আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে ক্রমাগত। অনেক পেসেন্ট বসে আছে। দেখতে হবে।
--আপা,আমি তো পেসেন্ট দেখছি। আপনি কি আমাকে রাত ন’টার দিকে আর একবার এই নাম্বারে ফোন করতে পারবেন?
--পারব নীতু।
আয়শা আপা আমাকে আবার ঠিক ন’টার সময়েই ফোন করলেন।
--হ্যালো নীতু।
--জ্বী আপা। বলেন। আপনার কি সমস্যা? শরীর অসুস্থ?
--নারে বোন। আমার ছেলেটাকে নিয়ে একটু সমস্যা।
--আপনার ছেলে?!
আমি অবাক হই। আয়শা আপার ভেতরের স্বত্তাটার কথা আমার একদম-ই মনে ছিলনা। কিছুটা লজ্জিত ও হই আমি। আপা চলে যাওয়ার পর আর কোন দিন আপাকে খুঁজিনি আমি। জানতে চাইনি তিনি কেমন আছেন,কোথায় আছেন?
--হ্যাঁ আমার ছেলে। তোমাদের বাড়ি থেকে যখন চলে আসি ও আমার পেটে ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। তুমি দেখলে অবাক হবে।
--আপনি কি এখন ঢাকায়?
--হ্যাঁ কিছুদিন আগে উত্তরাতে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি। পরে তোমাদের খোঁজ পেলাম আমার ছেলের বন্ধুর বাবার কাছ থেকে। তিনি তোমার পেসেন্ট। মিজানুল আলম নাম।
--ও আচ্ছা।
--আমার ছেলেটা বুয়েটে পড়ে ইলেক্ট্রিক্যালে। জাপান থেকে বৃত্তি পেয়েছে। পাঠিয়েই দিব এখন!
--বাহ!
আমি লজ্জিত হতে থাকি বারবার। আপার ছেলে ঢাকায় ছিল আমি কিছুই জানিনা। আপা আমাকে বিরক্ত করতে চাননি হয়তো!
--ইয়ে নীতু,ছেলেটা তো বাইরে চলেই যাবে। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। শুধু এক লাখ টাকা একটু শর্ট পড়ছে। টাকাটা যদি তোমার থেকে ধার পাওয়া যেত নীতু। আমি ধীরে ধীরে শোধ করে দেব।
--আপা এক সাথে এত টাকা! কিভাবে দেই?
--তুমি তো আমাকে চেন নীতু,আমি শোধ করে দেব কথা দিচ্ছি।
--আপা আমি একটা রাত চিন্তা করে কাল আপনাকে বলি?
--হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই!
আমি সারারাত আপার সাথে আমার স্মৃতিগুলো নিয়ে ভাবি। আমার হাসি পায় কত আনন্দ-বেদনার কথা মনে পড়ে! আপা আমাকে “তুই” বলত,আজ ফোনে “তুমি” বলেছে,আমিও আপাকে “তুমি” না বলে “আপনি” বলেছি। সময়! সব সময়ের খেল! আমি মন স্থির করি। পরেরদিন সকালে আমি আপাকে ফোন করে আপার বাসার ঠিকানা জেনে নেই,এক লাখ টাকার চেক রেডি করে আমার বাসার দিকে র্ওয়ানা দেই।
আয়শা আপার বাসায় যাওয়ার পর আপা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কত্তদিন পর দেখা! আপাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়। আপা কত বুড়িয়ে গেছেন। ফোনে কথা বলার সময় যে আবেগ আপার জন্য কাজ করেনি,সামনাসামনি দেখা হ্ওয়ার পর সেই আবেগ আছড়ে পড়ে আমার মধ্যে!
--আপা কত্ত বুড়ো হয়ে গেছ তুমি!
--তুই ও কম বুড়া হোসনি রে! বুড়ি নীতু! হাহা!
--কেমন আছ আপা এখন? সব শুনব আমি তোমার কাছে! সেদিন কেন চলে গেলে ওভাবে?
--সব বলব। তার আগে তোর কথা বল। জামাই কি করে?
--হাহাহা! আপা তুমি জাননা? আমি বিয়েই করিনি। তোমাকে দেখে অনেক শিক্ষা হয়েছে!
--বিয়ে করিস নি? কেন?
--তুমি তো চলে গেলে। আব্বা মারা গেল তার পরের বছর। আম্মা যে কয়দিন বেঁচে ছিল অসুস্থ হয়েই। তারপর নিশাত,নিগারের ভার আমার উপর এসে পড়ল। বড় বোনের দায়িত্ব পালন করতে করতে বিয়ের বয়স পার হয়ে গেল! নিশাত-নিগারের ভাল ঘরে বিয়ে দিলাম কিন্তু আমার আর বিয়ে করা হলনা! সবাই বলত করতে,কিন্তু বুড়া বয়সে বিয়ে করতে আমার আর মন সায় দিলনা। বাদ দাও। এখন তোমার কথা বল?
--আমার আর কি? ছেলেটাকে মানুষ করলাম। এখন তো সে চলেই যাবে!
--তাহলে কি লাভ হল আপা? কি পেলে জীবনে। তোমার ছেলে তো কয়েকদিন পর ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। আর কি ফিরবে?
--তুই আগের মত-ই আছিস রে? লাভ-ক্ষতির হিসেব করিস! লাভের জন্য তো কিছু করিনা। ভালবেসে করি। ফিরে এলে আসবে,না এলে বাপের মত হারিয়ে যাবে। তুই যে ছোট বোনদের জন্য এত কিছু করলি-লাভের আশায়?
--জানিনা আপা!
--আচ্ছা কঠিন মেয়ে,তোর কখনো কারো ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করেনা? বল নীতু? সত্যি করে বল?
আমার মুখটা খুব করুন হয়ে যায়। চোখ জলে ভরে যায়।আয়শা আপা ছেলেবেলার মত করে আমাকে বুকে টেনে নেয়। আমি আপার বুকে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফূঁপিয়ে কাঁদি।
কখনো কারো ভালোবাসা না পাওয়া মধ্যবয়সী দু’জন নারী পরস্পরকে পরম মায়া আর ভালোবাসার আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে পৃথিবীর সব ভালোবাসা একদিনে পেয়ে যেতে চায়!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪০