আমাদের লাল-নীল ছোট্ট সংসার-১
তোমার খুকি চাঁদ ধরতে চায়
একদিন আমাদের স্কুলের পিচ্চি পিচ্চি মেয়েরা ঠিক করল সবাই মিলে আইস্ক্রীম খাবে স্কুল গেইটের বাইরে থেকে। সেজন্য পরেরদিন সবাইকে একশ টাকা আনতে বলা হল। আমি বাসায় এসে রাতে আম্মুকে অনেক চেষ্টা করলাম বলতে একশ টাকা দিতে। কিন্তু বলতে পারলাম না। কারণ আম্মু সেদিন-ই আব্বুর সাথে টাকা-পয়সার ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করেছে। আমি টাকা না নিয়ে গেলে আইস্ক্রীম কেনা হবেনা,বন্ধুরা লজ্জা দিবে—এই ভয়ে আম্মু ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে চুপিচুপি আম্মুর ব্যাগ নিয়ে এসে টাকা বের করার চেষ্টা করলাম। সেই প্রথম এমন কাজটা করা,সেই শেষ। নাহ! আম্মুর ব্যাগে সেদিন কিছু ভাঙ্গতি দুই টাকা ছাড়া কিছু পাইনি। পরের দিন স্কুলে গেলাম টাকা ছাড়াই। ওরা যখন আইস্ক্রীম কিনতে গেল-আমি ক্লাসে বসে রইলাম চুপচাপ। মন অনেক বেশি খারাপ হল। আইস্ক্রীম খাওয়ার জন্য না-টাকা আনতে না পারার ব্যর্থতায়,ক্লাস টুতে পড়া ছোট মেয়েটা নিজের কাছেই কুঁকড়ে গেল। সেদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলেও আমি ঘুমাতে পারলাম না। বিছানায় শুয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা সাদা চাঁদটাকে দুধরঙ্গা আইস্ক্রীম মনে করে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম একদৃষ্টিতে! হাত বাড়ালেই সেই চাঁদ ছোয়া যায়না! অধরা!
চকোলেটের বাক্সে ভালোবাসা মিশে আছে
ক্লাস থ্রীতে ভিকারুননিসায় চান্স পাওয়ার পর আম্মু বলল,আমি যা চাইব তাই কিনে দেওয়া হবে। আমি চাইলাম,একটা মাকড়শা আঁকা ললিপপ। এই জিনিসটা আমার বেশ ভাল লাগত,কিন্তু মুখ ফুটে বলিনি কোনদিন। আম্মু আমার কথা শুনে খুব মিষ্টি করে হাসল তারপর আমাকে মোহাম্মদপুরের “হক” নামের দোকানটা থেকে সাড়ে তিনশ টাকা দিয়ে একটা ছোট্ট চকোলেটের বক্স কিনে দিল আর দোকানের সবাইকে বলল আমার জন্য দোয়া করতে।
আমি এখন আম্মুর থেকে অনেক দামী দামী গিফট পাই একটু ভাল রেজাল্ট করলেই,কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় সেই প্রথম পাওয়া উপহার সেদিনের চকোলেটের বাক্সে অনেক বেশি ভালবাসা বন্দী হয়ে আছে!
ভুল বুঝিস না বন্ধু
আমার প্রিয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। পেয়েছি অসম্ভব ভাল কিছু বন্ধু। তখন পর্যন্ত আমাদের বাসায় কখনো জন্মদিন উদযাপন করা হতনা। কিন্তু আমাদের স্কুলে কাছের কোন বন্ধুর জন্মদিন থাকলেই তাকে গিফট দেওয়া একটা রেওয়াজ ছিল। আমি গিফট নেওয়া বা দেওয়া দুটোই এড়িয়ে যেতাম তখন। কারণ আমাকে কেউ গিফট দিলে তাকেও দিতে হবে অবধারিত ভাবে—সেইরকম একটা ধারণা মনের মধ্যে ছিল। অথচ কাউকে বোঝানো সম্ভব ছিলনা আমাদের বাসায় বাড়তি খরচ করে আনন্দ কেনার সামর্থ্য নেই। কিংবা আমি-ই কাউকে বোঝাতে দিতাম না আমাদের অবস্থাটুকু—হেয় হওয়ার ভয়ে! কোন বন্ধুকে আমার বাসায় দাওয়াত দিতাম না,কারো বাসায় যেতাম না। কিন্তু একবার অঘটন ঘটেই গেল। তখন মনে হয় ক্লাস ফোরে পড়ি। আমার এক বন্ধু আমাকে “জারুল চৌধুরীর মানিকজোড়” বইটা গিফট দিল। আমি বইপাগল মেয়ে ছিলাম। যা পাই তাই পড়ি। কিন্তু সেদিন আমি ওই উপহারটুকু নিতে পারলাম না। মনে ভয়—উপহার নিলেই উপহার দিতে হবে! আমার সেই বন্ধুটি অনেক অনুনয়-বিনয় করেও উপহার দিতে না পেরে অন্য আরেকজনকে বইটা দিয়ে দেয়। বাসায় এসে ভাইয়াকে বলেছিলাম ব্যপারটা। ভাইয়া বলেছিল,"দূর বোকা! কেউ জন্মদিনের গিফট দিলে সেটা নিতে হয়!”
আমি জানি এই লেখাটা আমার সেই ছোট্টবেলার বন্ধুটা ঠিক পড়বে। তাই তার জন্য-ই এই কথাটুকু লেখা। সেদিন উপহারটুকু নিতে না পারার অন্যায় আজ ক্ষমা করিস!
টুকরো টুকরো আনন্দ
ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমরা আজিমপুর গভঃ কোয়ার্টারে চলে আসি। আম্মু তখন অনেক ব্যস্ত। আব্বুও। প্রচুর পরিশ্রম করতেন তাঁরা। আমাদের অভাব-অনটনগুলো কেটে যেতে শুরু করেছে। কষ্ট আর আনন্দ পাশাপাশি ছিল সেই জীবনে। বাসে ঝুলে ঝুলে আজিমপুর থেকে ধানমন্ডিতে স্কুল যাওয়া,বাড়ি ফেরা,বিকালে কোয়ার্টার মাঠে আম্মুর আর নানার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো। বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্র থেকে বই এনে বইয়ের শ্যাওলা গন্ধে ডুবে যাওয়া। পার্টিসন দিয়ে দুইভাগ করা একটা রুমে বসে অঙ্ক কষা। ভাইয়ার সাথে ঝগড়া-ঝাটি লাইট নেভানো নিয়ে। ভাললাগা-ভালবাসার জীবন ছিল তখন।
ক্লাস এইটে উঠে প্রথম ম্যাবসে কোচিং করা শুরু করলাম। তখন খেয়াল করলাম আমার ভাল কোন জামা নাই বাইরে পরার। আম্মু বললেন,"ঠিকাছে। আড়ং-এ চল। সেখানে ভাল জামা পাওয়া যাবে।" আড়ং-এ গিয়ে প্রাইস ট্যাগ দেখে দেখে জামা আর কোনটাই পছন্দ হয়না। কিংবা বলা যায় জামা পছন্দ হয়,প্রাইস ট্যাগ পছন্দ হয়না। আম্মুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল আমার জন্য জামা কিনতে না পেরে। আমি বুঝতে পারলাম। আম্মুকে হাত ধরে টান দিয়ে আড়ং থেকে বের করলাম। তারপর বললাম,"মা আমাকে এক প্যাকেট ঝালমুড়ি কিনে দাও।" আম্মু হেসে ফেলল। সেই নিষ্পাপ হাসি শত টাকা দিয়েও পাওয়া যাবেনা! ভাগ্যিস জামা কিনিনি! নাহলে এই হাসি দেখতে পেতাম না। অনেক টাকা দিয়ে জামা কিনলে নিশ্চয়-ই আম্মু এত নিষ্পাপ ভাবে হাসতে পারতনা! আড়ং থেকে এখন অনেক জামা কিনি। কিন্তু কেন জানি মনে হয় ঝালমুড়ি খাওয়াই আসলে ভাল!
আমাদের বাড়ি! স্বপ্ন আর সত্যি যেখানে এসে মিলে গেছে
ভাইয়ার এস.এস.সি পরীক্ষার কিছু আগে দিয়ে আব্বু-আম্মু খুব সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ততোদিনে আম্মু প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক হওয়ার পথে। আব্বু ও নিজ পেশায় অগ্রগন্য। আম্মু-আব্বু অনেক হিসাব-নিকেশ করে আর অনেক খুঁজে ধানমন্ডিতে একটা ফ্ল্যাট বুকিং দিয়ে দিল। তারপর আমাদের যুদ্ধ আবার নতুন করে শুরু হল। সেই বাড়ির প্রত্যেকটা ইটের গাঁথুনি আমাদের চেনা। প্রত্যেকটা টাইলস আমরা বসাতে দেখেছি। আমাদের স্বপ্নের বাড়ি! আমাদের নিজেদের বাড়ি! নিজেদের বাড়ি নিয়ে কত স্বপ্ন আমাদের। বারবার বাড়ির ডিজাইন চেঞ্জ করি আমরা,তাকে নিখুত করতে চাই। ভাঙ্গা ফ্রীজ বদলিয়ে নতুন ফ্রীজ কবে কিনব,নতুন টিভি কবে কিনব আমাদের চোখে তখন সেই স্বপ্ন। বাড়ি হওয়ার আগেই আমরা ছবি দেখে ইনটেরিয়র ডিজাইন করি,আম্মু কল্পনাতেই সব কিছুর উপর একটা করে ফুলদানি রেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে। মাঝে মাঝে আবার টাকার হিসাব মিলেনা,ডেভলপারকে টাকা তাড়াতাড়ি দেওয়ার চিন্তায় আমরা অস্থির হই। আম্মু-আব্বু অপেক্ষা করে ঘামে ভেজা বেতন পাওয়ার!
অবশেষে দুই বছর পর আমাদের স্বপ্ন সত্যিতে এসে মিলে যায়। আমরা নতুন বাড়িতে উঠি। বাড়ির সামনে লেক। আমার মনে হয় এটা আমাদের বাসা না। বাসার সব কিছু ছুঁতে আমার ভয় হয়। আমার কান্না পায়। কত কষ্ট,কত মন খারাপ করা দিন পার হয়ে এসে আমাদের নতুন বাড়ি! আমাদের বাড়ি! আমাদের নিজেদের!
অতঃপর আমাদের লাল-নীল সংসার
আমাদের লাল-নীল সংসারে আর কোন অপ্রাপ্তি নেই। ভাইয়া নটরডেম থেকে পাশ করে বুয়েটে থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার হয়ে বের হয়ে যাবে। আমার অপ্রাপ্তি ছিল সরকারি মেডিকেলে পড়তে না পারা। বারডেম সেই কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে অনেকাংশেই। আমাদের লাল-নীল সংসারে এখন শুধু আনন্দ খেলা করে। আমরা ফাঁক ফেলেই সবাই মিলে দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াই,বাংলাদেশকে দেখি। আমি মাঝে মাঝে ছাদে উঠি। ছয় তলা ছাঁদ থেকে আমি খোলা আকাশের দিকে তাকাই। নিজেকে নিজের মাঝে খুঁজে ফিরি। বিলাসিতা আমার এখনো ভাল লাগেনা। বন্ধুরা যখন কে.এফ.সি যায়,আডডা দেয়,আমাকে ফোন করে আসতে বলে আমি তখন ছোট্ট আমি হয়ে যাই। যে আমি একদিন একশ টাকার জন্য আইস্ক্রীম খেতে পারিনি-সেই আমি কিছুতেই আজ অকারণ হল্লা করতে পারিনা নিজের অজান্তেই। পহেলা ফাল্গুন বা বৈশাখে বন্ধুদের সাথে ঘুরার চেয়ে প্রিয় মমতাময়ী মায়ের সাথে রিকশায় ঘুরে বেড়ানোতে আমি সর্বসুখ খুঁজে পাই! অথবা ফেইসবুকে চ্যাট করার চেয়ে নানীর পিঠে লোশন দিয়ে দিতেই আমার ভাল লাগে। খুব ভোর বেলা আব্বুর ডাকে ঘুম ভাঙ্গাতেই আমার আনন্দ। আমার পরিধিটা অনেক ছোট,আমার খুব বেশি কাছের কয়েকজনকে নিয়ে। তবু আমি ভাল আছি।
আমি অনেক ভাল আছি আমার,আমাদের লাল-নীল ছোট্ট সংসারে!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩৫