মুঠোফোনটা বেজেই চলেছে অবিরাম। ফোন ধরতে এক্টুকুও ইচ্ছে করছে না আনিলার। এই নিয়ে চারবার সায়ন ফোন করল আজকে। একবারও ধরেনি আনিলা। ফোন্টা হাতে নিয়ে বরং রিংটোন্ শুন্তেই ভাল লাগছে তার। অটোগ্রাফ সিনেমার সেই গান্টা বেজে চলেছে আনিলার মুঠোতে—
"আর আমি আমি জানি জানি চোরাবালি কতখানি গিলেছে আমাদের রোজ
আর আমি আমি জানি জানি প্রতি রাতে হয়রানি,হারানো শব্দের খোঁজ"।
নিরিবিলি এক্টা ছুটির দিনের দুপুর বেলা। কর্কশ স্বরে পাশের ফ্ল্যাটের কার্নিশে বসে একটা কাক ডেকে যাচ্ছে---“কা কা কা কা!” ফোনটা একদম বন্ধ করে এলোমেলো পড়ার টেবিল্টা গুছিয়ে উঠে দাড়ালো আনিলা। খুব মন খারাপ হয়ে গেল আনিলার হঠাৎ করে! মন খারাপ হ্ওয়ার কারণ কি রিঙটোনে দেওয়া গান্টা নাকি এই “কা কা কা কা!” ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা সে।
ফোন্টা ধরলেই পারতাম! বন্ধ মুঠোফোন খুলে সায়ন্কে ফোন করার চিন্তা করল আনিলা। পরক্ষণেই পরিকল্পনা বাতিল! কি দরকার! আজ কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সায়ন্টার পঁচানি শুনতে তো আরো না!
কি মনে করে যেন ড্রয়ারে রাখা ডায়্রিটা হাত বড়িয়ে টেনে নিল আনিলা। অনেক দিন পর ডায়্রিটা হাতে নেওয়া। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেল তবুও এই ডায়রিটা সে ফেলে দেয়নি। এক্টুও ধূলো জমতে দেয়নি। অথচ সেরকম ভাল কিছুই লেখা নেই এখানে। প্রথম কিছু পাতা ভরে উঠেছে তার কচি আর নিষ্পাপ হাতের লেখায়। ছোট-খাট কত স্মৃতি এই ডায়রিটাতে,সরলতায় মাখা সেসব দিন!
“আম্মু আমাকে আজকে বকা দিল আমি স্কুলের ম্যাথ এক্সামে ‘এ প্লাস’ পাইনি দেখে। তাও এক্টুর জন্য। বকা খেয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁদব না। কিছুদিন আগে সাতকাহন উপ্ন্যাসে পড়েছি দীপাবলিকে তার বাবা বলেছে,”তোর এক ফোঁটা চোখের জল এক এক ফোঁটা রক্তবিন্দুর সমান”। তাই আমিও কাঁদবনা। আমি দীপাব্লির মত শক্ত হতে চাই। আমার দীপাব্লি চরিত্রটা ভাল লাগে”।
হায়রে কোথায় হারিয়ে গেল শ্ক্ত হওয়া! আজ কোথায় হারিয়ে গেছে তার দীপাব্লি হতে চাওয়া! জীবন যে উপ্ন্যাস হয়না এটা এখন তার চেয়ে ভাল আর কে জানে! খুব দ্রুত ডায়রির পাতা উল্টায় আনিলা। খুঁজে বের কর্তে চেষ্টা করল বাংলা কোচিং ক্লাসের শেষ দিন্টা করে এসে লেখা সেই লেখাটা। যে লেখা লিখতে গিয়ে সে ভুলে গিয়েছিল দীপাব্লিদের কাঁদতে নেই!
০২/০৪/২০০৫(শনিবার)
“তোমার সাথে আর কোন্দিনও দেখা হবে কিনা জানিনা। হয়তো হবেনা। তবে আমার কেন জানি মনে হয় হবে। পৃথিবীটা আসলে বেশি বড় না। গোল তো! ঘুরতে ঘুরতে দেখা যাবে ঠিক দেখা হয়ে যাবে তোমার সাথে। ভাললাগা,কাউকে পচ্ছন্দ করা এসব ব্যপার তখনো ভালমত বুঝিওনি,ভাবতাম এইসব হয়ত পাপ,ছেলেদের সাথে কোন মেয়ের কথা বলাও পাপ। ক্লাস টেনে পড়ছি অথচ ছেলেদের নিয়ে কোন আগ্রহ নাই,গার্লস স্কুলে পড়ি দেখেই হয়ত! এমনকি সবাই যখন সুন্দর করে সাজগোজ করে কোচিং-এ আসত আমি তখন কোনভাবে ক্লাসে এসে সামনে বস্তে পারলেই খুশি। পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভাল লাগে আমার,এখনো। সেদিন স্যার এর বাসায় তুমি ঢোকার সাথে সাথে তামান্না যখন বল্ল,''এই ছেলেটাকে দেখিস। এক্টু আলাদা।'' সেই প্রথম চোখ তুলে তাকিয়েছিলাম তোমার দিকে। আলাদা বা তেমন বিশেষ কিছু মনে হয়নি। অন্যদের মতই লেগেছিল আর তারপর সেদিনের মত ভুলেই গেলাম তোমার কথা। একদিন ক্লাসে তুমি “স্বাধীন্তা তুমি” কবিতাটা আবৃত্তি করলে। বিকেল বেলার ক্লাস্টাতে জানালা দিয়ে বাতাস এসে তোমার চুল্গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছিল আর তুমি হাত দিয়ে বারবার চুল ঠিক করছিলে! অন্যরকম সুন্দর এক্টা দৃশ্য! সেদিন বাসায় যেয়ে কেন জানি সেই ছবিটাই বারবার মনে পড়ছিল। তারপর কি যে হল জানিনা। আমি জানতাম পুরোটাই এক্তরফা পছন্দ। তুমি এস্বের কিছুই জানোনা। আর এই বয়সে কাউকে ভাল লাগতেও পারে। কয়েকদিন পরে নিশ্চয়ই সব ভুলে যাব। সব আবার আগের মত হয়ে যাবে। তবুও যে কয়দিন বাংলা কোচিং হল তোমাকে দেখার জন্য্ই মনে হ্য় অনেক আগে ক্লাসে যেতাম। তোমার ব্যক্তিত্বটুকু এত ভাল লাগে!
আজকে কোচিং-এর শেষ ক্লাস ছিল। মডেল টেষ্টে ফার্ষ্ট হ্ওয়া আর প্রত্যেকদিন ক্লাসে আসার জন্য স্যার সুকান্তের একটা কবিতার বই উপ্হার দিলেন। অন্যকোন সময় হলে হয়ত আমি বই পাওয়ার আন্ন্দেই আত্মহারা হতাম,কিন্তু আজকে আত্মহারা হলাম কারণ স্যার আমাকে স্বার সাম্নে ডেকে আমার নাম বলে তারপর বইটা দিলেন। সবাই তখন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। হাত্তালি দিল। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তাদের মধ্যে তুমিও ছিলে। ওহ! অন্তত একবার তো তুমি আমার দিকে তাকালে তাহলে। আমার নামটা তো জানলে! আমি জানি এতদিন অনেক অনেক সুন্দর মেয়ের ভীড়ে অসুন্দর এবং অতি সাধারণ আমাকে তোমার চোখেই পড়েনি! যদি চোখে পড়ত তাহলে দেখতে তোমাকে দেখা মাত্র কেন এক্টা মেয়ের মুখের রং বদলে ফ্যাকাশে হয়ে যায়,কেন সে কাঁপতে থাকে ভীত হরিণীর মত তিরতির করে! যদি চোখে পড়তই তাহলে তুমি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় অন্তত একবার ফিরে তাকিয়ে দেখতে তোমার সাথে আর দেখা হবেনা দেখে কোন একজনের চোখ ভরে গেছে জলে।
তোমাকে আমি পছন্দ করি এটা আমার কোন বন্ধুকেই বলিনি। বল্লে তারা পঁচাবে এই ভয়ে। কাজেই ঈশ্বর ছাড়া কেউ-ই জানবেনা যে আমি তোমাকে পছন্দ করতাম কোন্ একদিন। ঈশ্বর ছাড়া কেউ-ই জানবে না এই কয়টা মাস আমি ক্তটা কষ্ট পেয়েছি! কি জানি আমি নিজেই হয়ত তোমাকে ভুলে যাব। প্রথম এক্তরফা প্রেম মানুষ আর কয়দিন মনে রাখে? আচ্ছা তোমার সাথে কি আর কোনদিনই দেখা হবেনা? এ জীবনে আর একবার যে তোমাকে দেখতে চাই আমি!”
আনিলার চোখ ভিজে ঊঠছে জলে। এখনো এই লেখাটুকু পড়লে ক্ষ্ট হয় তার ভীষণ। কেন হয় কে জানে? এই লেখা পড়লে তো এখন হাসি আসা উচিত। “কি ন্যাকা ন্যাকা ভাবে লেখাটা লেখা-পুরাই এক্টা বাংলা সিনেমা বানায় ফেলসিলাম। সেই ক্লাস টেনে পড়ার সময় পছন্দ করা এক ছেলের প্রতি সস্তা আবেগ কি এখনো থাকা উচিত?”—মনে মনে ভাবে আনিলা। ডায়রিতে লেখা শেষ কথাগুলো আবার পড়ে। তারপর মন্স্থির করেই ফেলে সায়্ন্কে আজকে ফোন করবে সে। বেচারা নিশ্চয়ই রেগে আছে খুব! চোখ মুছে বন্ধ মুঠোফোন্টা খুলে টেবিলে রাখতেই দেখে এসএমএস,
ওই ভুটকি! ফোন বন্ধ করে ভাব মারিস,না? নাকি পরশু পরীক্ষা আছে দেখে পড়ার ডির্স্টাব হবে দেখে ফোন অফ করে রাখসিস? আরে তুই তো এমনিতেও পাস করবি না পড়েই। তোরে নকল সাপ্লাই করার জন্য মামারা আছে না?”
নাহ! গরুটার উপর মনে হয় রাগ করা যাবেনা! এখন আবার এতবার রিং হচ্ছে তাও ফোন ধরেনা ক্যান? ফোন না ধরার এক্টাই অর্থ—বন্ধুদের সাথে মাঠে আড্ডা মারতে চলে গেছে নিশ্চয়ই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনিলা,
"আর কত রে সায়ন,আর কত এরকম এলোমেলো থাকবি তুই?”
(চল্বে)
দ্বিতীয় প্র্ব
তৃতীয় প্র্ব
শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৪৫