
ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের অনেকের-ই অনেক প্রিয়। এর অনেকগুলো কারণ ও হয়ত আছে। প্রথমত এটা আমাদের গর্বের মাস,ভাষা আন্দোলনের মাস। ফেব্রুয়ারি মাসেই ফুলেল সৌরভে ফাল্গুন আসে ভালবাসার বার্তা নিয়ে। সারা মাস ধরে চলে প্রিয় বইমেলা। সবকিছু মিলিয়ে মাসটি একটা উৎসবের মাস-ই বলা যায়।

আমার এই লেখাটা কিন্তু শুধু ফেব্রুয়ারি মাস কে উপজীব্য করেই লেখা না। এই লেখাটা আমি লিখছি বহুদিনের জমানো কিছু ক্ষোভ থেকে,চাপা কষ্ট থেকে। মুখে প্রতিবাদ করে যখন বারবার অপমানিত হতে হয়,তখন প্রতিবাদের ভাষা কলম বা কীবোর্ড হওয়াটাই বোধ করি ভাল।

আমার মনে পড়ে আমি যখন খুব ছোট্ট ছিলাম,স্কুলে যাওয়াও শুরু করিনি তখন আব্বু অফিস থেকে ফিরে আমাকে পাশে বসিয়ে কাঠের টেবিলে তাল দিতে দিতে পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের কবিতা শুনাতেন--
"আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিম উদ্দীনের ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।"
আব্বুর কন্ঠে কি যে সুন্দর লাগত শুনতে! সেই তখন থেকেই আমার বাংলা প্রীতি। যখন স্কুলে ভর্তি হলাম,এক্টু এক্টু করে পড়তে শিখলাম দুই বছরের বড় ভাইয়ার স্কুলের বাংলা বই আনার সাথে সাথেই সব গল্প-কবিতা গুলো বানান করে করে পড়ে ফেলতাম। রবিঠাকুরের সাথে আমার পরিচিতি একদম ছেলেবেলাতে,যেদিন মা আমার হাতে 'গল্পগুচ্ছ' এনে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি,হঠাৎ করেই বাংলাদেশে হিন্দি সিরিয়াল গুলো খুব জনপ্রিয় হতে লাগল। সারাদিন ক্লাসে সবাই দেখি হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে আলোচনা করে,পরের পর্বে কি হবে সেটা নিয়ে গবেষণা করে। আমার খুব কাছের বন্ধুরাও মাঝে মাঝে আমার সাথে এসব নিয়ে কথা বলত।
-কালকে 'অমুক সিরিয়াল' টা দেখেছিস?
-না রে। আমি সিরিয়াল দেখি না। আমার ভাল লাগেনা।
-সিরিয়াল ভাল লাগেনা? বলিস কিরে?
-সিরিয়াল নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগছেনা রে। অন্য কিছু বল।
-তুই সারাজীবন বোরিং-ই থেকে গেলি।
আমি টেলিভিশন এমনিতেই একটু কম দেখি চিরকাল-ই। তারপর ও তখন ছোট ছিলাম দেখেই হয়ত আমাকে নিয়ে সবাই হাসা-হাসি করছে দেখে নিজেকে একটু তথাকথিত স্মার্ট বানানোর জন্য টিভি খুলে একটা হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসলাম। দেখতে দেখতে মনে হল কেন মানুষ এরকম বাসার মধ্যে সাজগোজ করে বসে থাকার মত অদ্ভুত জিনিশগুলো দেখতে পছন্দ করছে!

এরপর স্কুলের গন্ডি পার হতে হতে দেখেছি প্রিয় বন্ধুরা মাঝে মাঝে হিন্দিতে কথা বলত। খুব মন খারাপ হয়ে যেত তখন। মনে হত এরা কেউ কি জানেনা আমাদের ভাষাটা কত্ত সুন্দর! এই ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে মানুষ নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করেনি! বন্ধুদের হিন্দী না বলার জন্য নিষেধ করতে গেলে নিজেই হাসাহাসির পাত্র হয়ে যেতাম তখন। রাগ হত আমার কিছু আত্মীয়-স্বজনদের উপর যখন দেখতাম তাদের প্লে তে পড়ুয়া বাবুরা মহা আনন্দে 'you are my sonia' গান গাচ্ছে কিন্তু তাদের মুখের বোল তখনো আধো আধো। এই শিশুরা বাংলা ভাষার প্রতি কতটুকু মমত্ববোধ নিয়ে বেড়ে উঠবে?
ইদানীংকালে বাংলাদেশের আধুনিক কিছু ছেলেমেয়ের ভারতের মডেল,ভারতের নায়কদের হেয়ার স্টাইল,নায়িকাদের ড্রেস আপ সবকিছু নকল করার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে। শুধু তাইনা,যে কোন বিয়ে বা হলুদের অনুষ্ঠানে ধুম-ধারাক্কা হিন্দি গান বাজানো,তার তালে নাচা--এসব যেন এখনকার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। আর আছে ফেসবুকে ক্রমাগত হিন্দি স্ট্যাটাস দিয়ে যাওয়া,হিন্দিতে কমেন্ট আদান-প্রদান করা। ফেসবুকে অনেকের ল্যাঙ্গুয়েজের জায়গাতে বাংলার পাশাপাশি '2nd language' হিসেবেই কিনা জানিনা হিন্দি-ও দেওয়া আছে। এমনকি আমার এক পরিচিত জনের ফেসবুকে "জানা ল্যাঙ্গুয়েজ" এর তালিকায় 'উর্দু' দেওয়া আছে। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম "উর্দু কিভাবে শিখলি?" ও আমাকে বলেছিল তার এক পাকিস্তানি আত্নীয়ের কাছ থেকে। হয়ত উর্দু জানা দোষের কিছু নয়,বরং অতিরিক্ত একটি ভাষা জানা থাকা ভাল। তবে যে ভাষা আমরা চাইনি,যে ভাষায় কথা বলার প্রতিবাদেই একদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সৃষ্টি হয়েছিল--সেই ভাষা ফেসবুকে জানা ভাষার তালিকায় দিয়ে রাখা কতটূকু যুক্তিসংগত?
এখন আমরা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে,সংস্কৃতির বিস্তারের দোহাই দিয়ে শাহরুখ খানকে নিজের দেশে নিয়ে এসে নিজেরাই হিন্দি-তে কথা বলি-আমাদের বিন্দুমাত্র খারাপ লাগেনা। আমরা হিন্দি গানের তালে তালে নাচতে পছন্দ করি-রবীন্দ্র সংগীত,পুরোনো বাংলা গান আমাদের প্যানপ্যানে মনে হয়! সুকান্তের বা শামসুর রাহমানের কবিতা আধুনিক প্রজন্মের অনেকেই পড়েনা। ইন্ডিয়ান কালচার নকল করতে গিয়ে আমরা যে নিজেদের স্বকীয়তা ভুলে যাচ্ছি সেটা একবার ও ভেবে দেখছিনা! আজকাল হাটুর কাছে ছেঁড়া জিন্স পরা বা ওড়না গলায় পেঁচিয়ে চলাফেরা করাটাই আধুনিকতা! পরিচিত কাউকে দেখলে সালাম বা নমষ্কার দেওয়ার বা "কিরে কি খবর" বলার বদলে 'হাই-হ্যালো' বলাটাই আসলে আধুনিকতা!

আমার এই লেখাটা আসলে তাদের জন্য যারা বাংলাদেশে বসে হিন্দি তে কথা বলে,হিন্দিতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। এই লেখাটা তাদের জন্য যারা হিন্দিতে কথা বলাকে স্মার্টনেস মনে করে। এই লেখাটা আসলে তাদের জন্য যাদের হিন্দিতে কথা না বলতে অনুরোধ করলে তারা উলটো অনুরোধকারীকেই ''হাবলা'' বলে হাসাহাসি করে বা "ভাব মারছে" বা "দেশপ্রেম দেখাতে আসছে" বলে বিরক্ত হয়। আমি এই লেখাটা লিখছি কিছু কিছু মানুষের জন্য,কিছু রেডিও জকির জন্য যারা দুই লাইন বাংলা তারপর এক লাইন English বলে জগাখিচুরি করে 'বাংলিশ' ভাষায় কথা বলে। এই লেখাটা English medium এর বিশেষ কিছু ছেলেমেয়েদের জন্য যারা বাংলা রিডিং পড়তে পারেনা এবং এটা বলতে লজ্জাবোধ করেনা (আমি english medium এ পড়ুয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছিনা)। আসলে আমার অনেক দিনের জমানো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এই লেখাটা,কারো মূল্যবোধে আঘাত করার জন্য না-বরং নিজের মূল্যবোধেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে লেখাটা লিখছি। তবে যাদের জন্য লিখছি তারা হয়ত কখনই এটা পড়বেনা।
তবুও আশার কথা--এখনো আমাদের দেশটাকে ভালবাসে এরকম অনেক তরুণ-তরুণী দেশের জন্য কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ইন্টারনেট দিয়ে সারা বিশ্বকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এখনো আমরা স্কুল,কলেজ আর ভার্সিটিতে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি,স্বাধীনতা দিবস পালন করি,বিজয়ের গান এখনো আমরা গাই। আমরা পহেলা বৈশাখে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরি,পহেলা ফাল্গুনে বসন্তকে বরণ করে নিই আমাদের চিরাচরিত স্নিগ্ধতায়। আমরা এখনো শীতের রাতে দাঁড়িয়ে ভাপা পিঠা খাই,বাংলাদেশের বিজয়ে উৎসব করি। তাই আমি বিশ্বাস করি,আমি জানি-- আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি একদিন নিশ্চয় সারা বিশ্বের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশকে অন্ধভাবে ভালবাসতে জানা অসংখ্য মানুষের ভালবাসা নিয়ে।
