দ্রুত হাটতে গিয়ে ভেজা রাস্তায় পা পিছলে যায়। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে “... মা ...”। নিজেই একটু অবাক হয়ে যাই। এটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। আমি কখনই এটা করিনা। কিন্তু আজকে করলাম। কেন করলাম, নিজেও জানিনা। ছোটরা যে কোন সমস্যায় পড়লে মা’কে ডাকে, টিকটিকি মানে পান্না’কে এখনও বেশী খেপালে সে “আম্মা” বলে জোরে চিৎকার দেয়, কিন্তু আমি কখনওই দেইনা।
মা’কে আমি ছোটবেলা থেকেই খুব বেশী কাছে পাইনি। কিন্তু যেটুকু পেয়েছি, তা সবাই পায়না। আমি কখনওই খুব ভাল ছেলে ছিলামনা। মা’ই আমাকে আমার জীবনটা উপভোগ করার সাথে সাথে নিজেকে নিজে সামলে রাখার কায়দাটা শিখিয়েছেন। সে জন্যেই বোধ হয় সবসময় আমার সাথে একটা দুরত্ত্ব বজায় রাখতেন। বাবা আর আমার মদ্ধে মা ছিলেন একটা দেয়াল। যে দেয়াল গলে বাবা’র আদর আর শাসন টুকু আমার কাছে পৌছাতো, কিন্তু আমার করা অনেক অপরাধের কথা বাবার কান পর্যন্ত পৌছাত না।
মা আমার খুব ভাল গান করেন। আমি কোনদিন মা’কে সে কথা বলিনি। মা এখনও জানেন না যে আমি এখানে এসেও মা’র গান মিস করি। আর খুব বেশী মিস করি মা’র হাতের রান্না। আমার মা’র রান্না গরুর মাংশ আর খাশীর বিরিয়ানি – এক কথায় অসাধারন। মা অনেক পিঠে বানাতে পারেন। খুব ভালো পায়েশ রান্না করতে পারেন। মা’র আরেকটা জিনিশ আমার খুব ভালো লাগে। মা খুব দ্রুত রান্না করেন। ঘরে থাকা টুকটাক জিনিশ দিয়ে মা আমার টেবিল ভর্তি অসাধারন মেনু বানিয়ে দিতে পারেন প্রায় চোখের পলকে। সংসার সামলে বাজার করা থেকে শুরু করে সবকিছুই মা নিজ হাতে করতেন। এখনও করেন তাই। বাবাকে এক গ্লাস পানি নিজ হাতে ঢেলে খেতে দেখিনি আমি কোনদিন। তাই হয়তো মা চাইতেন যে আমি যেন বাবার মত না হই। আমি সত্যি আমার বাবার মত হইনি।
বাসায় থাকতে মা’র সাথে মাঝে মাঝে খুব খারাপ ব্যাবহার করতাম। কেন করতাম জানিনা। কিন্তু এখন সে কথা গুলো মনে করে খুব কষ্ট হয়। মা বলতেন, যখন বড় হবি, তখন বুঝবি অনেক কিছু। মা, আমি অনেক কিছু বুঝি এখন। বুঝি বলেই কষ্টটা অনেক বেশী হয়। এখন বুঝি, আমাদের দিকে দেখতে গিয়ে মা তার নিজের কোন শখ পূরন করতে পারেননি। কত কষ্ট করে সংসার চালিয়েছেন, কোনদিন আমাদের অভাব জিনিসটা বুঝতে দেননি। হলে থাকার সময় কত বার মিথ্যে বলে টাকা চেয়েছি, একবারের জন্য ভাবিনি যে মা কই পাবেন টাকা, কি ভাবে ম্যানেজ করে দেবেন। কখনো ভেবে দেখিনি কেন মা ঈদের সময় কিছু কিছু শাড়ীর দোকান এড়িয়ে যেতেন। এখন আমি মা’কে লক্ষ টাকা দিয়ে শাড়ী কিনে দিলেও মা আমার সেই শাড়ী পড়তে পারবেননা, কারন মা’র বয়স ৫০ ছাড়িয়েছে। আমি আছি, মা আছেন, বাবা আছেন – নেই শুধু সেই সময়টা।
আমার মা ইউরো হাট’এর চিকেন ফ্রাই খেতে পছন্দ করেন খুব। মা জেনেননা যে তার ছেলে সিডনীতে এসে যতবারই চিকেন ফ্রাই খেতে গেছে, প্রতিবারেই তার এই দুষ্ট ছেলেটার দুচোখ ভিজে গেছে সে কথা মনে করে।
মা, কখনও তোমাকে সামনাসামনি বলতে পারিনি, কোন দিন পারব কিনা, তাও জানিনা, অনেক ভালবাসি মা তোমাকে, অনেক অনেক ভালবাসি।