শীতবস্ত্র বিতরণ: আমাদের উদ্যোগ- অভিজ্ঞতা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, ভুল-ব্যর্থতা, সফলতার কারণ, ভাস্বর অনুপম এবং আগামী উদ্যোক্তাদের করণীয়।
সকল ব্লগার ভাই ও বোনদের অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, সামহোয়্যার ইন ব্লগারদের উদ্যোগে উত্তরবঙ্গে"শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম'১০"। আপনাদের সকলের ঐকান্তিক সাহায্য সহযোগিতা, শুভকামনা, ভালোবাসা ও দোয়ায় এই কার্যক্রম সফল হয়েছে। আমরা লালমনিরহাট এর রাজাপুর ও সদরে প্রায় ৫০০ দুঃস্থ পরিবারকে শীত বস্ত্র বিতরন করেছি।
আপনারা জানেন যে, এই বিষয়ে ব্লগার হুপফুলফরইভার একটি পোস্ট দেয় যা স্টিকী হয়েছিল। তারপর আমরা এতে অভাবনীয় সাড়া পাই। প্রচুর সঙ্খ্যক পুরাতন পোষাক ও প্রায় ৮৫০০০/= টাকা আমরা সংগ্রহ করতে সমর্থ হই।
এই টাকায় আমরা নতুন ২৫০ কম্বল ও ২৫০ চাদর ক্রয় করি।
একজন মহৎ হৃদয় ব্যক্তি আরো ১০০ নতুন কম্বল দান করেন।
এসকল কম্বল, চাদর ও প্রায় ৩০ বস্তা বাছাইকৃত পুরাতন পোষাক নিয়ে আমরা ৬ জন গত ১৮/১২/২০১০ ইং তারিখে রাত ১০ টায় পিক আপ যোগে লালমনিরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেই।
ব্লগার পাহাড়ের কান্না ও মৈত্রি পরিক্ষার কারনে আমাদের সঙ্গি হতে পারে নাই তবে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। আমাদের একজন ড্রাইভারের সাথে এবং বাকী ৫ জন খোলা পিক আপের ছাদে অবস্থান করি। যতই গন্তব্যের দিকে যেতে থাকি শীতের প্রকোপ ততই বাড়তে থাকে।
মজার বিষয়, আমরা সহযাত্রীরা কেউ কারো পূর্বপরিচিত ছিলাম না। পারস্পরিক আন্তরিকতায় আমরা খুব দ্রুতই আপন হয়ে যাই। গল্প গুজব করতে করতে আমরা শীতকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে থাকি।
সকাল ৭ টার দিকে আমরা রংপুর মডার্ন মোড়ে পৌছাই। ওখান থেকে আমার এক ভাগ্নে ও তার ২ বন্ধুকে তুলে নেই। তখনো প্রায় ২ ঘন্টার পথ বাকী।
তিস্তা ব্রিজ পার হয়ে বামে লালমনির হাট ও ডানে কুড়িগ্রাম। এই ব্রিজটি খুব অদ্ভুত। সম্পূর্ণ কাঠের পাটাতন বসানো এবং এর ঠিক মাঝামাঝি রেল লাইন। গাড়িও চলে আবার ট্রেনও চলে।
পৌনে দশটায় আমরা পৌছাই লালমনির হাট শহরে আমাদের প্রিয় সুলতানা শিরিন সাজি আপুর বাবার বাড়ি।
এই আলিশান বাড়ির ৩য় ও ৫ম তলা গেস্ট হাউজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সাজি আপুর বড় ভাই বিশিস্ট কবি ডাঃ জাকিউল ইসলাম ফারুকি ,তার মা ও বড় বোন আমাদের স্বাগত জানায়। আমরা তার বাড়ির ৩য় তলা দখল করি। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে আমরা কাজে নেমে পড়ি। একটি কম্বল+একটি টি শার্ট+একটি চাদর এভাবে ২৫০টি প্যাকেট বানাই।
ইতোপূর্বে জাকি ভাই নির্দিস্ট এলাকায় ২৫০ জন লোকের নিকট স্লিপ বিতরণ করেছেন।
আমরা ২৫০ টি প্যাকেট নিয়ে রাজপুরের দিকে যাই যা সদর থেকে প্রায় ২০ কিঃমিঃ দূরে প্রত্যন্ত এলাকা। আমাদের বহরে যুক্ত হয় একটি মাইক্রোবাস এবং একটি প্রাইভেট কার। জাকি ভাইয়ের নিজস্ব ২ জন লোকও আমাদের সঙ্গী হয়।
যথাস্থানে পৌছে আমাদের আমাদের মাথা নস্ট- এত্ত লোক!!!
কিভাবে কি করব ভাবছি। এলাকাটা হিন্দু অধ্যুষিত।
একটি মন্দির সংলগ্ন দেয়াল ঘেরা জায়গায় স্লিপ প্রাপ্ত লোকজনকে লাইন ধরে বসানো হল।
বাইরে তখন প্রচুর লোক। তারা চিতকার করছে। আমরা খুব দ্রুত স্লিপ জমা নিয়ে কম্বল বিতরণ করি।
এখানকার লোকজন অতি দরিদ্র এবং ৬/৭ বার নদী ভাঙ্গনের শিকার। যারা স্লিপ পেয়েছে তাদের অধিকাংশ বৃদ্ধ বিধবা।
বিতরণের প্রায় শেষের দিকে বাইরে অবস্থানরত বঞ্চিত লোকজন পিটিয়ে বাউন্ডারীর মূল ফটক ভেঙ্গে ফেলে।তারা আমাদের উত্তম-মধ্যম দেয়ার জন্য হুংকার দেয়- কেন আমরা আরো বেশি কম্বল আনি নাই!!!??
কিন্তু এলাকার চেয়ারম্যানের ছেলে বিশ্বজিত ও কয়েক জন ভলান্টিয়ারের সহায়তায় কোনরূপ তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়াই আমাদের কাজ শেষ করি এবং লালমনির হাট শহরে ফিরে আসি।
এখানে আমরা আর,ডি,আর,এস ( রংপুর দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস) নামক একটি সংস্থা পরিদর্শন করি যারা বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের উন্নয়নে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে।
শহরে অবস্থিত ডায়বেটিস সমিতি হাসপাতাল প্রাঙ্গনে আমাদের সংগৃহিত পুরাতন পোষাক ও বাকী ১০০ কম্বল বিতরণ করি । পূর্বেই স্লিপ প্রাপ্ত প্রায় দুই শতাধিক নারী-পুরুষের মাঝে এসব দেয়া হয়। মাঠ প্রাঙ্গনে আমরা বস্তার কাপড় ঢেলে দেই বিভিন্ন গ্রুপে- শার্ট+গেঞ্জি, মহিলাদের পোষাক, শীতের পোষাক, বাচ্চাদের পোষাক এভাবে। একসাথে ৫ জন স্লিপধারীকে ভিতরে ধোকানো হয়- তারা ইচ্ছামত বেছে তাদের প্রয়োজনীয় পোষাক সংগ্রহ করে ।
এভাবে প্রায় ৫০০ পরিবার সরাসরি আমাদের বিতরণকৃত শীতবস্ত্র পায়। ডাঃ জাকিউল ইসলাম ফারুকী ভাইয়ের আন্তরিক সহায়তা ছাড়া আমাদের এই কার্যক্রম এতটা নির্বিঘ্ন ভাবে শেষ করতে পারতাম না।
রাতে আমরা জাকি ভাইয়ের গেস্ট হাউজে খাওয়া-দাওয়া করি এবং সেখানেই ঘুমাই।
পরদিন সকালে সাজি আপুর বড় বোনের তৈরি নাস্তা খেয়ে রংপুর শহরে আসি এবং দুপুর ৩ টার বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রাত ১১টায় ঢাকা পৌছাই।
যারা এই মহতি কার্যক্রমে অর্থ, বস্ত্র,শ্রম, বুদ্ধি-পরামর্শ ও শুভকামনা জানিয়েছেন সকলের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা রইল। আমরা ব্লগারদের নিয়ে আগামীতেও এধরনের সেবামূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যাক্ত করছি।
শীঘ্রই এই কার্যক্রমের শ্বেতপত্র প্রকাশিত হবে।