পা পিছলে আলুর দম
-আজব কথা! পা পিছলে আলুর দম কেমনে হয়? ছোট বেলায় রাস্তার মোড়ের আলুর দম বেশ পছন্দ করতাম। কলার পাতায় করে খেজুরের কাটা দিয়ে দারুন মজা করে আলুর দম খেতাম।পরে কত কিসিমের মসলা দিয়ে আলুর দম করেছি- কিন্তু সেই আলুর দমের স্বাদ আজ আর কোন দমেই পাইনা!একবারতো দুবাই থেকে আলু দিয়ে হাজার পদের রেসিপির বই-ই কিনে ফেললাম! কিন্তু সেই স্বাদ আর পেলামনা!
আমার বাড়ি থেকে শ দেড়েক মিটার দুরেই ছিল রেল লাইন। দিন রাতে বেশ কয়েকখানা ট্রেন চলাচল করত সেই পথ দিয়ে।
দেশ ভাগের আগে একটা ট্রেন সেখান থেকে সোজা শিলিগুড়ি যেত বলে একটা ট্রেনের নাম তখনো শিলিগুড়ি ছিল। খুব ভোর বেলায় সেই ট্রেন ছেড়ে যেত। কখনো ঘুম ভেঙ্গে গেলে বালিশে কান পেতে আধো ঘুম চোখে সেই ট্রেনের চলে যাওয়ার শব্দের তালে তালে দুই লাইনের সেই ছড়াটা আউড়ে যেতাম।‘সপ্নের মাঝেই পিছল খেয়ে পড়ে আলুর দম হাতড়ে খুজে বেড়াতাম।'
সেই ট্রেনে আর ট্রেন লাইনের সাথে জড়িয়ে আছে শৈশব কৈশরের অনেক স্মৃতি!
'পাভেলেস্কি বোখজাল’-বোখজাল অর্থ ট্রেন স্টেশন। পাভেলেস্কি স্টেশন মস্কোর অন্যতম ট্রেন স্টেশন। ট্রেন স্টেশন যে এত বড় এত সুদৃশ্য কারুকার্যময় হতে পারে তা আমার ধারনার মধ্যে ছিল না। আমার দেখা নোংড়া ময়লা বিবর্ন রেল স্টেশনগুলোর সাথে কোনভাবেই মিলাতে পারছিলাম না। রুশীয়রা যেন ওদের সব শিল্প মেধা আর অর্থ উদার ভাবে ঢেলে দিয়েছে এই রেল স্টেশনগুলো তৈরি করতে। রাশিয়াতে যাবার প্রথমদিনেই অভিজ্ঞতা হল দুর পাল্লার ট্রেনে চড়ার। চরম ভয়ঙ্কর ঠান্ডা ছিল ছিল সেদিন!
ট্রেনের অপেক্ষায় প্লাটফর্মে যে কয়মিনিটমাত্র দাড়িয়ে ছিলাম তা কয়েক যুগের সমতুল্য। সেদিন দেশে ফিরে আসার সুযোগ থাকলে তখুনি ফিরে আসতাম। ভাগ্যিস সে সুযোগ ছিলনা!
তখনকার সময়টাতে আমরা বেশ দুর্ভাগ্যবান ছিলাম বলতে হয়। মানুষ ইন্টারনেট যুগে প্রবেশ না করায়-অন্য দেশ জাতি ভাষা সংস্কৃতি আবহাওয়া সন্ন্ধে কখনোই সত্যিকার চিত্রটা পেতনা। আমি বহু চেষ্টা করেও জানতে পারিনি রাশিয়ার শীত আর গ্রীস্মকালটা কখন। শীতে তাপমাত্রা সর্বনিন্ম কত থাকে। ওটা যে শীতের দেশ আর শীতকালে বরফ পড়ে এটুকুই শুধু জানতাম।পোষাক-আশাক শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কতটুকু কার্যকর তা না ভেবে কতটা স্টাইলিস সেই ব্যাপারটা হয়েছিল মুখ্য।
ব্যাগ হাতড়ে যত গরম কাপড় ছিল সবগুলো গায়ে চড়িয়ে কিম্ভূত চেহারার একটা গরম কাপড়ের পুটলি হওয়া সত্বেও ঠান্ডা থেকে রক্ষে পেলাম না।এমনিতেই শোকে মুহ্যমান তখন, তার উপরে অজানা আশংকায় দিশে হারা আর উপরি পাওনা ছিলে ঠান্ডার তীব্রতা!কে দেখবে ট্রেন স্টেশনের সৌন্দর্য?
আমি এখনো চোখ বুজলে দিব্যি দেখতে পাই ‘পাভেলাস্কাইয়া বোখজালের’(পাভেলাস্কাইয়া ষ্টেশন) প্লাট ফর্মে জোব্বা জাব্বা গায়ে একুশ বাইশ বছরের এক তরুন চোখে রাজ্যের হতাশা ক্লান্তি শঙ্কা ভয় নিয়ে দাড়িয়ে আছে আর তার মুখাবয় শীতের তীব্রতা আর ছেড়ে আসা আত্মীয় পরিজনের বন্ধু সাথে চিরচেনা পরিবেশের শোকে নীল হয়ে আছে।
তার মনের মধ্যে একটাই শঙ্কা’আমি কি ভুল করে ফেললাম?’
ইলেকট্রিক ট্রেন জীবনের প্রথম দেখা।তবে ঘাড় উচু করে তাকাইনি বলে প্রথমবার বুঝিনি এটা ফুয়েল চালিত না ইলেকট্রিক? দারুন পরিচ্ছন্ন পরিপাটি বিছানা পাতা গরম কামরা পেয়ে শান্তি পেলাম! দেশে প্রথম শেনীর কামরাতে ভ্রমনের অবিজ্ঞতা ছিল আমার বহুবার –সেই কামরাগুলো(ব্রড গেজ) পরিসরে অনেক বড় হলেও এমন পরিপাটি নয়।প্রতিটা রুমে একটা করে বেসিন আছে যেখানে গরম আর ঠান্ডা পানি দুটোরই ব্যাবস্থা আছেতার উপরে ছোট্ট একটা বক্সের মত যার পাল্লা খুলে অন্যান্য জিনিসের সাথে অবাক হয়ে দেখলাম একটা ইলেকট্রিক রেজর’ও আছে! আমাদের দেশে ভাবা যায়?
রুমের সব’চে যে জিনিসটা আমাকে বেশী মোহিত করল সেটা হল ছোট্ট চিনে মাটির ফুলদানিতে একটা টিউলিপ ফুল।সামান্য কিন্তু অসামান্য সেই উপহারটা প্রথমদিনেই রুশ জাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিল অনেকটা।
ছোট্ট সেই কামরাটাতে মোট আমরা চারজন যাত্রী। তিনজন ঠিক আমারই মত বাঙলাদেশ থেকে আসা ছাত্র আর বাকিজন রাশান গাইড।
ওর নাম ‘শাশা’।গুনে গুনে ইংরেজী শব্দ জানে খান দশেক! ইংরেজীতে এমন দারুন দক্ষতা নিয়ে কি করে সে একজন দোভাষী কাম গাইডের চাকরি পেল তা আমার মাথায়-ই আসছিল না। এই দেশের হাল হকিকত সন্মন্ধে জিজ্ঞেস করব কি? সে ও আমার কথা কিস্যু বোঝেনা,আর আমি তথৈবচ! ওদিকে বাকি বাঙ্গালী দুজন পূর্ব পরিচিত নয় বলে –কথা একখানে এসে থেমে গেছে।
এক ফাঁকে কামরা থেকে বেরুলাম বগিটা ঘুরে দেখব বলে-সেই সুযোগে যদি একটা সিগারেট খাওয়া যায় তবে মন্দ নয়। সেই প্রথম ট্রেনে ধুমপানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান সাথে ভাজ করা টুল আর এসট্রে দেখলাম।আমাদের দেশে তখনো পর্যন্ত এমন কোন ব্যাবস্থাই চালু হয়নি। এ ছাড়া ট্রেনের এক বগি থেকে অন্য বগিতে চলাচলের ব্যাবস্থাও তখন ছিলনা- সেই অভিজ্ঞতাটাও আমার প্রথম!
কড়িডোরে কার্পেট পাতা জানালায় সূদৃশ্য পর্দার এত ছিমছাম গোছানো ট্রেন আর পরিচ্ছন্ন পোশাকের দারুন বিনয়ী এটেনডেন্সদের দেখে আমি অভিভুত! রুশীয় বিমান 'এরোফ্লোতের' থেকে দেখি এদের সেবার মান অনেক উন্নত।
নিজের কামরায় ফিরে এসে ফের আচ্ছন্ন হলাম অনাগত ভবিষ্যত চিন্তায় সাথে বন্ধু স্বজনদের ছেড়ে আসার কষ্টও গ্রাস করল আষ্টেপৃষ্টে।
শাশা'র ডাকে সম্বিৎ ফিরল। ইশারায় বোঝাল, এখন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।ব্যাগের মধ্যে ঠান্ডা ম্যাগডোনাল্ডের বার্গার আর ফ্রেঞ্জফ্রাই।
নভেম্বর ১১,১৯৯০ সালে রাশিয়াতে প্রথমবার ম্যাগডোনাল্ডস চেইন রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতি দেয়া হয় তাও শুধু মস্কোতে একখানা মাত্র।(সেই ম্যাগডোনাল্ডের গল্প গুজব অন্য কোনদিন হবেখন।)
আমাদের গাইড মশাই বিদেশী বলে অন্য কোন খাবার দেয়ার ঝুকি নেয়নি-সারা বিশ্বের আম-জনতার খাবার দিয়েছে। সেই দিনই প্রথম খেলেও প্রথমদিনই আমি ম্যাগডোনাল্ডের বার্গারের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। অতি মোলায়েম রুটি,লবনে চুবানো শসার টুকরো লেটুসপাতা মসৃন পনির আর অতি উপাদেয় মাংসের মন্ড দিয়ে তৈরি বার্গার-এর ঘ্রানটা নাকে গেথে গিয়েছিল। আজো বিদেশে গেলে ম্যাকডোনাল্ড খুজে ‘বিগম্যাক’খাই আর চোখ বন্ধু করে -রুশীয় ঘ্রান পাই।
যারা আশির দশক আর নব্বুইয়ের শুরুর ঢাকার ফাস্ট ফুডের কথা স্মরণ করতে পারেন তারা জানেন সেই খাবারগুলো কি অখাদ্য ছিল।
যেনতেন ভাবে বানান গোল পাউরুটির মাঝখানে আলু,পিয়াজ,ডাল, মরিচ আর মনে চাইলে একটু মাংসের কিমা দিয়ে একটা মন্ড বানিয়ে ভেজে সেটা তার মধ্যে সেধিয়ে সস টম্যাটো আর শসা দিয়ে তৈরি হত বার্গার। আর লম্বা বন এর মাঝামাঝি কেটে সেই বস্তুটা দিয়েই একটা সসেজ করে টম্যাটো সস আর বনেদী সপের মালিকেরা একটু মাস্টার্ড সস দিয়ে ঝটপট হটডগ করে ফেলত।
সেই জিভে ম্যাগডোনাল্ডের ঠান্ডা বার্গার বহুগুন মজার!
খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়া ছাড়া কি-ইবা করার আছে। মসৃন রেলপথে দুলুনি নেই তেমন। মোটামুটি এয়ারটাইড তার উপরে দুই পরতের জানালার কাচ বাইরের শব্দ ভিতরে ঢোকার পথ প্রায় রুদ্ধ করে দিয়েছে।
রেলগাড়ি ঝমঝম
পা পিছলে আলুর দম
এই সুর রুশীয় সেই ট্রেনে শুয়ে শোনার উপায় নেই। আমরও বয়স বেড়েছে-সেই সুর আর আগের মত মোহাবিষ্ট করেনা।এখন সপ্নে আর ‘পা পিছলে আলুর দম’আর খুজিনা। ততদিনে জেনে গেছি - রাগ সঙ্গীতে যেমন অর্থহীন শব্দ থাকে আর তাই শুনে বড় বড় শিশুরা মোহিত হয়- ঠিক তেমনি আমি বিমোহিত হতাম অথর্হীন সেই ছড়ার বাণীবদ্ধ ছন্দে।
ভোরে আমার সহযাত্রীরা ঘুম ভাঙ্গাল। ঘড়ি দেখে চমকে উঠলাম-আরেব্বাস!এখানকার সময় আটটা বেজে গেছে? জানালার পর্দা সরিয়ে দিন রাত কিছু ঠাহর হলনা-শুধু ঘোলাটে পাতলা একটা আলোর আভাস। একি জানালার ভিতরের দিকেও দেখি বরফের আস্তর!
বুঝলাম সেই কারনেই,বাইরের দৃশ্য কিছু দেখা যায়না সবকিছু ঘোলাটে আর ঘষা ঘষা!হাত দিয়ে ঘষে পরিস্কার হাত ঠান্ডায় কুকড়ে গেল কিন্তু পাতলা শক্ত জমাট বাধা সেই বরফের আস্তর পরিস্কার হলনা। সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল শাশা সে তার চামড়ার গ্লভসখানা পরে-হাত মুঠো করে ঘষে ঘষে সেই বরফ গলিয়ে ফেলল। এখন সল্প আলোয় বাইরে কিছুটা দেখা যায়। সেইদিন উপলব্দি হলো,পরিমিত আলোর অভাবে এখন থেকে বছরে ছয়থেকে নয়মাস পৃথিবীর সত্যিকারের রুপ দর্শন থেকে বঞ্চিত হব। আদি দিগন্ত বরফের চাদরে মোড়া দেশটা –বাড়িঘর রাস্তাঘাট কিছুই দেখা যায়না-শুধু হলদেটে বিবর্ন কিছু বিজলী বাতির আলো ছাড়া।কখনো ময়লাটে কখনো অতি শুভ্র তুষার যে গিলে খেয়েছে পৃথিবীর সব রুপ আর রঙ। শুধু কিছু ক্রিসমাস ট্রির কাটার মত পাতাগুলো বিদ্রোহ করে গায়ে লেগে থাকা পেজা বরফের পিন্ড ভেদ করে সবুজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তাকে ছাড়া অন্য কোন বৃক্ষ দেখে মালুম হয়না আদিকাল থেকে এদের দেহে কোন প্রানের অস্তিত্ব ছিল। চির হরিৎ দেশের মানুষের জন্য এইটে একটা বড় ধাক্কা।
‘তাম্বুভাস্কাইয়া ওবলাস্ত’বা তাম্বুভ শহরে যখন পৌছুলাম ঘড়ির কাটা দশটা ছুই ছুই,তবু তখনো বাইরের আলো তেমন করে ফোটেনি-রাস্তা ঘাটের সব আলো জ্বালানো। দুটো ঢাউস ব্যাগ টেনে হিচড়ে নিয়ে ট্রেন থেকে নামতেই তীব্র হিম শীতল বাতাসের ঝাপটা এসে লাগল চোখে মুখে। মস্কোতে ঠান্ডার এই তীব্রতা এমনভাবে টের পাইনাই। তীব্র শীতের সাথে ঝড়ো বাতাস অতি ভয়ঙ্কর-ঠান্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবকিছু আনলেও-মনে করে মাথার টুপিটা আনা হয়নি আর হাতের মোজাটা পাতলা উলের। সেই মোজা ভেদ করে তুষারের কামড় মুহুর্তেই আঙ্গুলগুলোকে অসাড় করে দিল। কান আর নাক যেন কেটে ছিড়ে যেতে চাইছে। সাহায্যের আশায় কোন মতে তাকালাম শাশা'র দিকে। শাশার এসব দেখার সময় নেই সে উল্টোদিকে একটু দুরের আরেকটা প্লাটফরম দেখিয়ে ইশারায় বলল, আমাদের এই চার জোড়া লাইন পেরিয়ে ওখানে যেতে হবে!
ওভার ব্রিজ নেই কেন সেটা কেন জিজ্ঞেস করলাম না আর শাশা’ই বা কেন ওভার পাস বাদ দিয়ে রেল লাইন হেটে পার হতে বলল, সেটা আজো বোধগম্য নয়।
তাম্বুভ স্টেশন‘পাভেলেতস্কি স্টেশনে’র তুলনায় নেহায়েৎ সাদামাটা তবুও আমাদের দশখানা জংশন স্টেশন এর মধ্যে অনায়াসে এটে যাবে।এমনিতেই ঠান্ডায় কাহিল আমি-তারপরে এই বোঝা নিয়ে কেমনে হেটে যাব ওপারে? কারো কাছে যে সাহায্য চাইব তার উপায় নেই। এতক্ষন ভাবতে ভাবতে আমার সহযাত্রী আর গাইড শাশা ততক্ষনে অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে গেছে। ওদের বোঝা অনেক হালকা। আর এদিকে আচার পছন্দ দেখে আমার মা-আচার-ই দিয়েছেন কয়েক বয়াম!
কি কপাল আমার!সেদিন নাকি তাম্বুভের জানুয়ারির সব’চে বেশী ঠান্ডা পরেছিল।হিস্ট্রিক্যাল ওয়েদার রিপোর্টে রেকর্ড সেদিন তাম্বুভের তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ২৪.৩! যাদের সৌভাগ্য হয়েছে ঠান্ডার দিনে জোর বাতাসে কাছে ধারে ভারতের কারগিলের পাদদেশে কিংবা চীনের প্রাচীরের উপর হাটার- তারা উপলব্দি করবেন শীতের দেশে বাতাস কি ভয়ঙ্কর!
উচু প্লাটফরম থেকে নেমে ভারি ব্যাগ দুটো হাতে নিয়ে প্রথম পদক্ষেপেই আমার মনে হল আমি আর কোনদিন এই পথটুকু পেরুতে পারবনা...
আপাতত গল্পের এখানেই সমাপ্তি এবার আসি আসল কথায়। রুস্কাইয়া ব্লুদার পাঠকদের সনির্বদ্ধ অনুরোধ কষ্টকরে বাকিটুকু পড়বেন;
একটা অদ্ভুদ ব্যাপার আমি বহুদিন বাদে জেনেছি; সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সুবাদে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে রেল যোগাযোগ খাতে ‘সোভিয়েত রেলওয়ে’পরিচালনার দায়িত্ব শেষ করে। জানুয়ারির ২০, ১৯৯২ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘রাশিয়ান রেলওয়ে’। তার মানে ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারীর বিশ তারিখ পর্যন্ত নতুন এই রেলওয়ে সংস্থা বেনামে অভিভাবকহীনভাবে চলছিল। আমার প্রথম ট্রেন ভ্রমন ছিল ১৯৯১ সালের ১৪ই জানুয়ারি!
রাশিয়ান রেল লাইন দৈর্ঘ্যে বিশ্বের দ্বীতিয় দীর্ঘতম- যা সর্বমোট ৮৫০০ কি.মি.(প্রথম স্থানটা যুক্তরাষ্ট্রের)। শুধু তাই নয় রাশিয়ান রেলওয়ে Российские железные дороги РЖД (রুসিস্কিয়ে ঝেলেজ্বনিয়ে দোরোগি বা সংক্ষেপে আর ঝ্বে দে)র মোট কর্মচারীর সংখ্যাও তাক লাগার মত। প্রায় দশ লক্ষ! যা শুধু রাশিয়ায় নয় সারাবিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সরকারি কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সোভিয়েত রেলওয়ে প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২২ সালে।১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় সোভিয়েত রেলওয়ের ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম ট্রেন লাইন ও সর্ববৃহৎ কোম্পানী। যার লাইনের দৈর্ঘ্য ছিল সর্বমোট ১৪৭০০০ কিমি.।একাধারে যা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির মুল চালিকাশক্তি। ১৯৯১ সালের পরে যা চৌদ্দ ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তবে তার মুল এবং সবচেয়ে বড় খন্ডিত অংশটাই বর্তমান রাশিয়ান ফেডারেশনের অর্ন্তগত হয়।
১৯৯২ সালে রাশিয়ান রেলওয়ে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশের পরে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই যোগাযোগ খাত প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে দাড়িয়েছিল। রুশীয় অর্থনীতির টানাপোড়েনেপ্রচুর কর্মীকে ছাটাই করা হয় সেই সাথে রেলওয়ের বাজেটে কাটছাট করায় মেরামতের অভাবে শতশত নষ্ট ইঞ্জিন আর ট্রেন কোচ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারনে রেলেওয়ে ট্র্যাক, ইলেকট্রিক লাইন রেল স্টেশন সময়মত মেরামত না করায় প্রায় পুরো রেল যোগাযোগ ব্যাবস্থাটাই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। যার ফলে রুশ অর্থনীতি বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ে।
১৯৯৬ সালে রুশ সরকার রেলের জন্য বড় ধরনের বরাদ্দ ঘোষনা করার পর থেকে রেলওয়ে খাত আবার ঘুরে দাড়ায়।
Moscow State University of Railway Engineering বা Moscow State Communications University সংক্ষেপে MIIT প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৬ সালে যা রেলওয়ে বা যোগাযোগ খাতে সবচেয়ে অগ্রগামী ও বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যার বর্তমান ছাত্র সংখ্যা এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার।
রাশিয়ার প্রথম ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম চালু হয় ১৬৪৯ সালে। আর যোগাযোগ মন্ত্রনালয় প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৬৫ সালে। রাশিয়ান প্রথম যোগাযোগ মন্ত্রী ‘পাভেল মেলনিকভ’ছিলেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ও প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়ার আবার দক্ষ ব্যবস্থাপক। ১৮৩৯ সালে তাকে আমেরিকায় পাঠানো হয় তাদের রেলকাঠামো সারেজমিনে পর্যবেক্ষন করার জন্য। রুশীয় ইতিহাসের প্রথম রেল লাইন পোতা থেকে শুরু করে রেল লাইনকে রাশিয়া থেকে একদিকে ককেসাস, অন্যদিকে উরাল হয়ে সেন্ট্রাল এশিয়া আর ওদিকে ইউরোপের দোড়গোরায় পর্যন্ত পৌছে দেয়ার পেছনে তার অবদান ছিল অসামান্য।এই ভদ্রলোকের ক্যারিসম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ,প্রতিভা আর কর্ম দক্ষতায় জারের আমলে ‘যোগাযোগ মন্ত্রনালয়’ সবচেয়ে সন্মানজনক মন্ত্রনালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মস্কোর ‘কমসোমোস্কাইয়া স্কয়ারে’ তার বিশাল মুর্তি এখনো দাড়িয়ে আছে গর্বিত ভঙ্গীতে।
প্রথম ট্রেন লাইন মস্কো থেকে তৎকালীন রাজধানী শহর সেন্ট পিটারবুর্গ ৬৪৯ কি.মি.ট্রেন পাড়ি দেয় প্রথমবারের মত ১৮৫১ সালে।
এখন সেখপথে ২৫০ কি.মি. গতিবেগে সুপার ট্রেন চলে। রাশিয়ার বিখ্যাত ট্রেন ‘ক্রাসনিয়ে স্ট্রেলা ‘লাল তী'রে করে পিটারবুর্গের নাম পাল্টে যাওয়া লেনিনগ্রাদে পৌছুতে যেখানে আট ঘন্টা লেগে যেত এখন লাগে মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টা। সময় ভাড়াও নেহায়েৎ কম নয় ‘আশি ইউরো’।
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথএর কাজ শুরু হয় ১৮৯১ সালে আর শেষ হয় ১৯০৫ সালে।মাত্র চৌদ্দ বছরে তৈরি করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম রেলপথ।
এই রেল পথের যাত্রা শুরু হয় মস্কো থেকে আর শেষ হয় ৯২৮৮ কিলেমিটার দুরে ‘ভ্লাদিভস্তক’-জাপান সাগরের তীরবর্তী রুশ শহরে । ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথে পুরো পথ ভ্রমন করতে লাগে আট দিন।
বিস্ময়কর ব্যাপার হল,এই পথে যেতে যেতে আপনাকে সাত-সাতবার ঘড়ির কাটা পাল্টাতে হবে!এটা পৃথিবীর তৃতীয় দীর্ঘতম একক ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস।তাহলে প্রথম ও দ্বীতিয়টা কোথায়? সেদুটো-ও প্রাক্তন সোভিয়েতে। তারমধ্যে একখানা মস্কো থেকে পেংইয়ং(উত্তর কোরিয়ার রাজধাণী)আরেকটা কিয়েভ থেকে ভ্লাদিভস্তক। দুরুত্ব মাত্র এগার হাজার পঁচাশি কিলোমিটার!
তবে এ দুটো রেলপথ এককভাবে দীর্ঘতম লাইনের স্বীকৃতি না পাবার কারন দুটো রেলপথেরই বেশীরভাগ অংশজুড়ে আছে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ।
‘ট্রেন ফেরি’বলে কোন কিছু আছে বলে অনেকেই জানেনা। আমাদের দেশেও একসময় ছিল (এখনো থাকতে পারে)তবে শুধু মানুষ পারাপারের জন্য। নদীর এপারে ট্রেন থামে নির্দিষ্ট সময়ে ফেরি বা লঞ্চে নদী পার হয়ে অন্য পারে গিয়ে আরেক ট্রেনে ওঠে-এর মাঝে দুয়েকজন ট্রেন ফেলও করে।
ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেল লাইন কেটে সাতটা লাইন চলে গেছে । তার মধ্যে চতুর্থটা গেছে বৈকাল হ্রদের দিকে যার নামকরন হয়েছে ‘সারকম বৈকাল রেলপথ’। পৃথিবীর অন্যতম নান্দনিক সৌন্দর্য পরিবেষ্ঠিত সেই রেলপথ লেক বৈকালের পূর্ব পাড়ে গিয়ে থেমে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিলনা। ১৬০০ মিটার গভীরতা আর ৬৪০ মাইল লম্বা লেক বৈকালে ব্রিজ বা টানেল বানানোর সাধ্যি আর প্রযুক্তি তখন অব্দি মানুষের হয়নি।
ট্রেন অন্য পারে নিয়ে যাওয়ার বুদ্ধি কি?তৈরি হল ট্রেন ফেরি নাম ছিল ‘ফেরি বৈকাল’যা চব্বিশটা আস্ত রেলের বগি পেটে নিয়ে ভেসে যেত বৈকালের অন্য পারে। বিশেষ ভাবে তৈরি এই আইস ব্রেকার ফেরি শীতের সময়টায় নদীর পুরু বরফ ভেঙ্গে চলার উপযোগী করে তৈরি ছিল। ১৯০৩ -০৪ সালে বৈকালের বরফের পুরুত্ব এত বেশী হয়ে যায় যে ফেরি বৈকাল তা ভেঙ্গে এগোতে পারেনি। উপায় না দেখে সেই বরফের উপর লাইন বিছিয়ে ট্রেনের বগিগুলো ঘোড়া আর কুকুর দিয়ে নদীর উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাশিয়ান সিভিল ওয়ার বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় বিপ্লবীরা ‘বৈকাল ফেরি’পুড়িয়ে দেয়। আর এর-ই সাথে শেষ হয়ে যা বৈকাল হ্রদ পাড়ি সাইবেরিয়ার অভিমুখে ট্রেন যাত্রা।
রাশিয়ার অন্যসব দ্রষ্টব্য স্থানের মধ্যে মেট্রোস্টেশন আর বোখজালওপড়ে। ওরা সব শ্রম মেধা আর অর্থ যেন উদার হস্তে ঢেলে দিয়েছে এই স্টেশনগুলো নির্মানে। ট্রান্স সাইবেরিয়ানে কখনো ভ্রমনের সৌভাগ্য হলে দুদান্ত নৈসর্গীগ দৃশ্য দেখার পাশা পাশি ট্রেন স্টেশনগুলোও মন কাড়বে সবার। ওই পথের বড় বড় ট্রেন স্টেশনগুলো করেছে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রাক্তন প্রদেশের সনামধন্য আর্কিটেক্ট আর ইন্জিনিয়াররা। সেইসব স্টেশনে গিয়ে দেখতে পাবেন সেইসব বীরদের নামগাথা। কেন স্টেশন করেছে টিম মলদোভিয়া কোনটা বা টিম উক্রাইন ।সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তগত আর অধুনা সবগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রের কৃতি সন্তানেরা তাদের সর্ব্বোচ্চ মেধা আর উৎকর্ষ দিয়ে অতিযত্নে তৈরি করেছে এই স্টেশনগুলো ।ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ যদি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতন রেলপথ হিসেবে স্বীকৃতি পায় তবে এই সব স্টেশনগুলোও বিশ্বের সবচেয়ে সুক্ষ রুচিসম্পন্ন ও দৃষ্টিনন্দন ষ্টেশন হবার যোগ্যতা রাখে।
(ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথতো বটেই শুধু ‘সারকম বৈকাল রেলপথ’নিয়ে নিয়ে লিখতে চাইলে আরো এক পর্ব হয়ে যাবে। আমি শুধু অল্প কিছু গুরুত্বপূর্ন তথ্য জানালাম-পাঠকের আরো বেশী জানার ইচ্ছে থাকলে একটু ঢুঁ মারুন নেটে।)
ফুটনোট: মস্কোর যেই স্টেশন থেকে আমি প্রথবার ট্রেনে উঠেছিলাম তার নাম পূর্বেই বলেছি’ পাভেলেতস্কি বোখজাল’(Paveletsky Rail Terminal)-যেখানে এসে শেষবারের মত থেমেছিল শেষকৃত্যের জন্য লেনিনের লাশবাহি ট্রেনটা -ভ্যান নম্বর ১৬৯১। পাভেলেস্কি বোখজালের ঠিক উল্টোদিকে মস্কো রেলওয়ের জাদুঘর। লেনিনের লাশবাহি সেই ভ্যানটা এখনো সযতনে সেখানে সংরক্ষিত আছে। যাদুঘরের সবচাইতে দর্শনীয় বস্তু সেটাই।
চরম কষ্ট হলেও অবশেষে কারো সাহায্য ছাড়াই উল্টোদিকের প্লাটফর্মে ঠিকই পৌছেছিলাম।ভাগ্যিস সেবার ফিরে আসিনি- না হলে …পাঠকদের কষ্ট করে এসব আর পড়তে হতনা।
ছবি: পাভেলাস্কাইয়া বোখজাল।