আহ্ চেহারার দিকে তাকানো যায়না বেচারার! সারাদিন মুখ গুজে বসে রইল –খাওয়া দাওয়া বন্ধ। জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর না দিয়ে 'ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।'
আমরা ভাবলাম শ’ ডলারের নোটখানা হারিয়ে গেছে বোধহয়। ব্যাপারটা ভাবতেই,এই দুঃসময়ে বন্ধু শত্রু নির্বিশেষে সবাই চরম আহত হলাম!
অবশেষে ঘটনা প্রকাশ পেল রাতে;
ডলার বেচাকেনা করার জন্য তখন পাসপোর্ট লাগত না। বিদেশীরা ব্যাংক, ফরেন মানি একচেঞ্জ বা বিদেশী মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র থেকে শুরু করে যেখানে সেখানে ডলার ভাঙ্গাতে পারত।
সে বরাবরের মত শহরের মধ্যিখানে একমাত্র ‘বিদেশী মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রে’ গিয়েছিল ডলার ভাঙ্গাতে। সেই এক্সচেঞ্জের কিউ এ দাড়াতেই অনতিদুরে এক রমণীর হাতছানি। মেয়েটাকে দেখে তার চোখ কপালে! দারুন বাহারী ঘাঘড়া চোলী, হাতে বালা, কোমড়ে রুপার বিছা,কানে ভারি দুল আর গলায় রঙ্গীন পাথরের গয়নায় কালো চুল আর কালো চোখের দুর্দান্ত দেহবল্লভীর যেন ভারতীয় কোন রমনী মিষ্টি বক্র হাসি দিয়ে তাকে আহ্বান করছে। সে আহ্বান উপেক্ষা করার সাধ্য তার ছিলনা।
মেয়েটির কাছে যেতেই মোহিনী হাসি দিয়ে’ইন্দিস্কি প্রিয়তম’ বলতেই সে গলে গেল।
-তুমি কি ডলার ভাঙ্গাবে?’
মেয়েটি একথা জিজ্ঞেস করতেই সে সম্বিৎ ফিরে পেল।
-হ্যা কেন?
-‘এরা তোমাদের বিদেশী পেয়ে খুব ঠকায়। আমরা সারা দেশ ঘুরে বেড়াই। সাইবেরিয়াতে ডলারের দাম অনেক বেশী। তুমি চাইলে আমি তোমাকে এক ডলারে এদের থেকে একশ রুবল বেশী দিব।‘
-‘তাই নাকি? ‘মনে মনে ভাবল সে এর মানে একশ ডলারে দশ হাজার রুবল বেশী! দারুন...’
বেশী ভাবনা চিন্তা না করে ডলারটা মেয়েটার হাতে দিতেই -যেন মাটি ফুড়ে উদয় হল ছেলে বুড়ো নারী পুরুষ মিলে উদ্ভট পোষাক আর ভারতীয় চেহারার আরো আট দশজন। সবাই ঘিরে ধরে তাকে ব্যাতিব্যাস্ত করে তুলল কথার ফোয়ারায়। কেউ নাচ দেখায় কেউ গান শোনায়, কেউ তার হাত দেখতে চায়।ওদের এড়িয়ে তার নজর তখন ডলারের দিকে।
মেয়েটা শ’ডলারের নোটখানা একে ওকে দেখিয়ে নিশ্চিত হতে চায় সেটা আসল কিনা? মিনিট কয়েক এ হাত ও হাত ঘুরে নোটখানা সেই মেয়েটাই তাকে ফেরত দিয়ে বলল,
‘এত পুরনো নোট আমাদের চালাতে কষ্ট হবে।তুমি কিছু মনে নিওনা প্রিয়তম। আমি ভীষন লজ্জিত আর দুঃখিত।‘
আমার সেই বন্ধু দশ হাজার রুবল হারানোর শোকে দুঃখের ভেলায় ভাসতে ভাসতে অবশেষে ফের গিয়ে দাড়াল সেই ‘বিদেশী মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র’র ছোট্ট ঘরটার সামনে।
চরম অনিচ্ছায় নোটখানা বাড়িয়ে ধরল কাচের ওপারে বিনিময় কর্মকর্তার দিকে। ভদ্রলোক নোটটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে বেশ খানিক্ষন পরিক্ষা নিরিক্ষা করে দুঃখিত বলে তার হাতে ফেরৎ দিয়ে বলল, 'এটাতো নকল নোট! তুমি কোথায় পেলে?'
বন্ধু আমার তখন বজ্রাহত!কোনক্রমে ডানদিকে ঘাড়খানা ঘুরিয়ে হতবাক' কেউ নেই ওখানটায়। মুহুর্তেই বাতাসে যেন মিলিয়ে গেছে সবগুলো’সিগান’!
জিপসিদেরকে রুশীয়রা বলে রুস্কা রোমা বা ‘সিগানে’(ZIGANI or Czigany) সারা রাশিয়াতেই এদের দেখা মিলবে তবে শুধুমাত্র ব্যতিক্রম সেন্ট পিটারবুর্গ বা লেনিন গ্রাদ-যে শহরে ওদের প্রবেশ নিষিদ্ধ!
রাশিয়া শীতের দেশ। আমাদের দেশে না হয় বেদে বেদেনীরা সামান্য শীতে নৌকার ছৈয়ে ছালা কাথা মুড়ে চালিয়ে দেয়।আর মরুভুমিতে; দিনে সুর্যর প্রখর তেজ আর রাতে তীব্র ঠান্ডা থাকলেও বরফ আর বৃষ্টির বালাই নেই-চরম দৈহিক কষ্ট আর তীব্র পানির সংকটের মধ্যেও যাযাবরেরা এক মরুদ্যান থেকে আরেক মরুদ্যান দাবড়ে বেড়ায়। কিন্তু একবার ভাবুন রুশীয় সিগানদের কথা?সারা গ্রীস্ম আর বসন্তের সময়টা এ শহর ও শহর ঘুরে নেচে গেয়ে যাদু টোনা হেকিমী বৈদ্যি থেকে শুরু করে চুরি চামারি ছোটখাট ছিনতাই পর্যন্ত করে গাঁটে দু পয়সা গুজে শীত এলেই এরা উধাও!
শীতের এই দীর্ঘ সময়টা কোথায় থাকে তারা? ভাবুন একটু- যত জাঁদরেল যাযবরই হোকনা কেন-ভয়ঙ্কর গরমে মরুভুমি দাবড়ে বেড়াতে পারে কিন্তু মাইনাস পচিশ ত্রিশ কিংবা পয়ত্রিশ ডিগ্রী সে. তাও আবার যখন তখন তুষার ঝড় উঠে আসে সেই সময়টা চার দেয়ালে নিজেদের আটকাতেই হবে!
কিন্তু চৌদ্দ’শ বছরের জীপসি রক্ত যাদের দেহে বইছে তারা এত সহজে কাবু হবে কেন? দলবল নিয়ে এরা চলে যায় লোক চক্ষুর অন্তরালে গভীর বন কিংবা উপত্যাকায়। যেখানে প্রকৃতি ওদের সযতনে আগলে রাখে কিংবা ওরা প্রকৃতির রুদ্র রোষের বিরুদ্ধে বুক চেতিয়ে দাড়ায়। সামান্য চামড়ার কিংবা ক্যাম্বিসের তাবু খাটিয়ে আরগাছের ডাল ভেঙ্গে আগুন জ্বালিয়ে ওরা সেই ভয়ঙ্কর শীতকে মোকাবিলা করে।কেউ বলে তীব্র তুষার পাতের সময় অনেক সেগানরা ঠান্ডার বিরুদ্ধে তাদের শৌর্য পরিক্ষা করার জন্য সেই তাবুখানাও খুলে ফেলে। সেই সময়টাতে ওদের নিরবিচ্ছিন্ন অবসর। এমনিতেই আমুদে এই জিপসিরা পুরো শীতকালটাই গান নাচ বাজনা আর খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকে।
শুভ্র শ্বেত প্রকৃতির মাঝে এমন রঙ্গের বৈচিত্র নিয়ে ওদের উচ্ছল আনন্দের দৃশ্য যেন প্রকৃতির অনিন্দ্যসুন্দর চিত্র। 'সেগান’রা এর জাতি প্রকৃতি দ্বারা সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর -কিন্তু সেই শ্বেত সৌন্দর্য তাদেরকে অল্প বয়সেই বুড়ো বানিয়ে নিজেদের সৌন্দর্যকে ধ্বংস করে দেয়! বরফের উপর রিফ্লেক্টেড সানলাইট তাদের চোখের জ্যোতি কমিয়ে ফেলে, ফ্রস্ট বাইটে( তুষারের কামড়)অনেকেই পঙ্গু হয়ে যায় চিরতরে।তীব্র শীত তাদের ত্বকের সংবেদনশীলতা কমিয়ে ফেলে।কমনীয় চেহারায় একসময় প্রকট ভাবে ফুটে ওঠে বন্যতা হিংস্রতা আর রুঢ়তা!
রুশীয়রা সিগানদেরকে যথাসম্ভর এড়িয়ে চলে।সিগানরাও এলিট-স্মার্ট রুশদের ঘাটায়না।ওরা সাধারনর বোকাসোকা আর গ্রাম্য রুশীয়দের টার্গেট করে- বোকা বানায়।
তবে হাল আমলে অনেক বুদ্ধিমতি সিগান রমনী তাদের নিজস্ব ধারার গান নাচ জিমন্যাস্টিক আর শিল্পকলা দেখিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে বেশ দু-চার পয়সা রোজগার করছে। এদের কেউ কেউতো বেশ বিখ্যাত। অনেকে আবার রুশ পুরুষদের বিয়ে করে সংসারী হয়ে গেছে!
তবে সব রমনীই বুদ্ধিমতি নয়- অল্প দু-চারজন। কেউবা চায়না আর কেউ চেষ্ট করেও পারেনা। সিগান সমাজ আমাদের বেদে সমাজের মত মাতৃতান্ত্রিক! নাচ গান যাদু-টোনা ছলা-কলা সব কিচছুই করে মেয়েরা। আর ছেলেরা কিছু ক্ষেত্রে সংসার সামলায় বা ঘোড়ার রোগ সারায় কিংবা ঘোড়া বেচা-কেনায় যুক্ত থাকে(মুলত অকর্মন্য) আর নারীদের সব কিছুতে সঙ্গ দেয়।তবে যেকোন দল বা গোত্রের একজন গোত্র প্রধান থাকেন সে মুলত পুরুষ! যাকে বলা হয় ‘Ciganski Attaman’.
সিগানদের গান আর নাচ কিন্তু রাশিয়াতে বেশ জনপ্রিয়।ওদেরকে এড়িয়ে চললেও ওদের নাচ-গান এর আকর্ষন এড়ানো কিন্তু এত সহজ নয়।
সিগান,জিপসী,বেদুইন কিংবা বেদে যেই নামেই ডাকা হোক না কেন সবার মানসিক চরিত্র একই প্রায়।
এদের নিয়ে আমাদের অতি প্রিয় এক যাযাবর( জীবনে কোথাও থিতু হয়ে বসেননি- সুযোগ পেলেই দেশ-বিদেশ চষে বেড়িয়েছেন।) লেখক বলেছেন;
দেশ –বিদেশে আমি বিস্তর বেদে দেখেছি। এরা আজ এখানে কাল ওখানে, পরশু আরো দুরে, অন্য কোথাও। কখন্ কোন্ জায়গায় কোন্ মেলা শুরু হবে, কখন শেষ হবেসব তাদের জানা। মেলায় মেলায় গিয়ে কেনা-কাটা করবে,নাচ দেখাবে, গান শোনাবে,হাত গুনবে, কিন্তু কোথাও স্থির হয়ে বেশী দিন থাকবে না। গ্রীস্মের খরদাহ, বর্ষার অবিরল বৃষ্টি মাথায় করে চলছে তো চলছে, কিসের নেশায় কেউ বলতে পারে না। বাচ্চাদের লেখা পড়া শেখাবার চাড় নেই,তাদের অসুখ বিসুখ করলে ডাক্তার-বদ্যিরও তোয়াক্কা করে না। যা হবার হোক, বাসা তারা কিছুতেই বাধবে না। বাড়ির মা কি তারা কখনো জানেনি, কোনদিন জানবেও না।ইংলন্ড দুশো বছর ধরে চেষ্টা করে আসছেএদের কোন যায়গায় পাকাপাকি ভাবে বসিয়ে দিতে। টাকা পয়সা দিয়েছে, কিন্তু না না না, এরা কিছুতেই কোন জায়গার কেনা-গোলাম হয়ে থাকতে চায় না।ইংলন্ড যে এখনো দেশের প্রাথমিক শিক্ষার হার শতকরা পুরো একশ করতে পারেনি তার প্রধান কারন এই বেদেরা। এরাতো আর কোন জায়গায় বেশী দিন টিকে থাকে না যে এদের বাচ্চারা ইস্কুলে যাবে? শেষটায় ইংরেজ এদের জন্য ভ্রাম্যমান পাঠশালা খুলেছে, অর্থাৎ পাঠশালার মাস্টার শেলেট পেনসিল নিয়ে ভবঘুরে হয়ে তদের পিছনে পিছনে তাড়া লাগাচ্ছে, কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা, তারা যেমন ছিল তেমনি আছে।
বেদুইন তার উট খচ্চর, গাধা ঘোড়া নিয়ে আগের মতোই এখানো ওখানে এখনো ঘুরে বেড়ায়। উটের লোমের তাবুর ভিতরে রাত্রিবাস করে। তৃষ্ণায় যখন প্রান কণ্ঠাগত হয় তখন তার সন্তানের থেকে প্রিয় উটের কণ্ঠ কেটে তারই ভিতরকার জমানো জল খায়। শেষটায় জলের অভাবে গাধা-খচ্চর, বউ বাচ্চা গুষ্টি সুদ্ধ মারা যায়। তবুও ‘পা-জমিয়ে’ কোন নীড় বানাবে না।– স্যার সৈয়দ মুজতবা আলী, জলে-ডাঙ্গায়।
প্রতিটা সংসারী মানুষের মনের গহীন কোনে-যাযাবর হবার বাসনা থাকে। তাইতো স্বয়ং কবিগুরু আক্ষেপ করে বলেছেন,
‘ইহার থেকে হতেম যদি আরব বেদুইন
চরন তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।‘
সংক্ষেপে হিস্ট্রি অব জিপসি:
প্রারম্ভিক ইতিহাস (৬ষ্ঠ থেশে পনের শতক); ভাষাগত এবং জেনেটিক গবেষণা অনুসারে, জিপসীদের পূর্বপুরুষ প্রায় ১০০০ লোক একটি গ্রুপ ভারত থেকে এসেছেন ষষ্ঠ শতাব্দীতে। ধারনা করা হয় ফার্সী শাসকের অনুরোধে তৎকালীন ভারতীয় শাসক সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় পারদর্শী সেইসব নাগরিকদের পাঠীয়েছিলেন। পরবর্তীতে তারা পারস্য ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে পূর্ব থেকে ভারত ও মধ্য এশিয়া থেকে, এবং পশ্চিমে ফিলিস্তিনের শুরু করে সেখানথেকে মিশর (পূর্বপুরুষদের ঘর), এবং তার পরে আর্মেনিয়া থেকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
ইউরোপিয়ান বর্তমান জিপ্সি রোমা বা সিগানে এরা মুলত এই গ্রুপেরই পরবর্তী প্রজন্ম।এদেরই একটা বড় অংশ যারা ইতিপূর্ব ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল পরবর্তীতে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহন করে।
বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য পতনের সাথে সাথে এরা ছোট ছোট উপদলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে।
প্রথমে এরা সাপ ধরা ও তার প্রশিক্ষন –ভল্লুক এর প্রশিক্ষন ও বিভিন্ন প্রাণীর রোগ উপশম করে অর্থ উপার্জন করত। প্রথমে মুলত রুচিবান নিখুত হাতের কাজে পারদর্শী শিল্পী,নৃত্য ও সঙ্গীত শিল্পিরাই নিজের ভাগ্য অন্বেষনের জন্য ছড়িয়ে পড়ে -কিন্তু পরবর্তীতে এদেরই একটা অংশ জড়িয়ে পড়ে চুরি ছিনতাই ভাগ্য গননা ছল চাতুরি সহ বিভিন্ন অপরাধ মুলক কর্মকান্ডে যা আজ অব্দি বিদ্যমান।
রাশিয়ার সরকারি নথি থেকে জানা যায় রোমা বা সিগানদের ওখানে সর্বপ্রথম দেখা যায় ১৭৩৩ সালে।
*(ইতিহাসে ভুল থাকলে অপরাধ মার্জনীয়।)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১২ দুপুর ১:৪৬