শুধুমাত্র বাইরের দেশ থেকে যখন চাপ আসত তখন আই ওয়াশের জন্য ব্যাপারিদের সাথে সমোঝোতার ভিত্তিতে দু চার পাচজনকে জেলে পুরত।
পর্ব-২
আমি দেখতাম আমার ওই বন্ধুর কাছে প্রায়শই পুলিশের বড়কর্তা ফোন করতেন। একটু খানি হাল হকিকত জিজ্ঞেস করে আসল কথায় আসতেন-
প্রথমেই জেনে নিতেন তার ডাঙ্কি কবে নাগাদ যাচ্ছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ওর খবর জেনে নিয়ে তারপরে অন্যসবার হাড়ির খবর! এমাসে কার ক’জন লোক এসেছে? কোত্থেকে এসেছে? কবে যাচ্ছে? এসব।
ওখানে যতগুলো ডাঙ্কার ছিল তার মধ্যে আমার ওই বন্ধূটিই রোমানিয়ান ভাষায় একটু আধটু কথা বলতে পারত। বাকী সবাই রুমানিয়ানতো দুরে থাক রুশ ভাষায় লাইন প্রতি বার সাতেক হোচট খায়! আর ’পাকি’রাতো রুশ বলে তাদের নিজেদের মত করে। সেজন্য ওর সাথে কথা বলে হয়তো তিনি মজা পেতেন।
তাকে মাঝেমধ্যে গোয়েন্দা প্রধানের দফতরে নিয়ে গিয়ে গোপন ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখাতেন। কখনোবা বন্ধু বা অন্য ব্যাবসায়ীদের সাথে কোন রেস্টুরেন্টে গল্পে মত্ত কখনোবা বান্ধবীর হাত ধরে রাস্তায় কিংবা লেকের পাড়ে। বুঝিয়ে দিত তোমার পিছে টিকটিকি আছে! একটু এদিক ওদিক করলেই ’ক্রাসনি ইজ্দানিয়ে’ বা লাল দালান। তথ্য প্রমান হাতেই ধরা,আর- টেলিফোনে আড়িপাতাতো আছেই।
এসব দেখে শুনে ভয়ে সে গড় গড় করে সব সত্যি বলে দিত। কখোনবা দু’চার টাকা ভেট।
তখন ব্যাবসাটা ভাল যাচ্ছিল। রাশিয়ার ভিসা সহজেই মেলে। দেশ ভাগ হওয়ার পরেও ইউক্রাইন বা মালদোভিয়ার আলাদা করে ভিসার ব্যাবস্থা চালু করেনি। তখন ট্রেনে করে অন্যদেশের উপরদিয়ে যাবার সময় ক্ষনিক জিরিয়ে নিতে চাইলেও ট্রানজিট ভিসার প্রয়োজন ছিলনা। যেকোন দেশে ঢোকার মুহুর্তে শুধু পাসপোর্টটা চেক করে দেখে রাশান ভিসা আছে কি নেই।
আদম বেপারিদের প্রতিনিধিরা মস্কো থেকে ১৫/২০ জনের একটা দলকে টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দিয়ই সস্তির শ্বাস ফেলত! যদি মধ্যিখানে ট্রেন থেকে নেমে না পড়ে তাহলে আড়াই দিন বাদে ঠিক ঠিক গিয়ে পৌছুবে কৃসিনেভে!তখন আরেক প্রতিনিধি এদেরকে স্টেশন থেকে রিসিভ করে পৌছে দিত বিভিন্ন ভাড়া করা ফ্লাটে।কোনটাতে দুজন কোনটাতে পাচজন আর রুম- খালি পড়ে থাকলে একটাতেই সবগুলো।
বেপারির কড়ানির্দেশ ছিল কড়িডোরও যেন খালি না থাকে॥
তার চ্যালা আদমদের শত অনুরোধ আবদার সত্বেও বসের নির্দেশ-অক্ষরে অক্ষরে পালন করত।
মাঝারি মানের একটা রুমে ২০/২৫ জন লোক যে কিভাবে দিনের পর দিন মাসের পর মাস দরজা জানাল বন্ধ করে নিঃশব্দে পড়ে থাকতে সেটা একটা বিস্ময় !
দেশ ভাগের পরে হঠাৎ করে ডলারের বিপরিতে ওদের মুদ্রারমান অনেক অনেক নিচে নেমে গেল। স্থানীয় মুদ্রার রিভ্যাল্যুয়েশন হল হাজারগুন। জিনিসপত্রের দাম দ্রুত গতিতে বাড়তে লাগল। আয়ের সাথে ব্যায়ের সামঞ্জস্য রাখা সে সময়টাতে ছিল সত্যিই কস্টকর! সেই দুঃসময়ের কথা অল্প দু চার কথায় বোঝানো সম্ভব না।
সে সময়টাতে বেপারিদের দরকার তাদের আদমদের রাখার জায়গা। সল্প আয়ের- লোকেরা সহজ আয়ের কোন পথ না ওদেরকে বাসা ভাড়াদিল। পুরোটা ছেড়ে দিলে থাকবে কোথায় সেজন্য- বউবাচ্চা মিলে একরুমে কোনমতে মাথা গুজে বাকিটুকু সাবলেট।
সেখানে দুজন থেকে বিশজন থাকলেও তাদের জোরে কথা বলা অট্রহাসি হাসা,গান গাওয়া বা গান শোনা, ঝগড়া করা সহ এমন কিছু করা সম্পুর্ন নিষেধ ছিল-যাতে গায়ে গা লেগে থাকা প্রতিবেশীর শান্তি ভঙ্গ হয়।
পাশের ফ্লাটের হিংসুটে বুড়িরাও সারাক্ষন কান পেতে থাকত একটু ট্যা টু করলেই পুলিশের কাছে ফোন।
এদিকে বাড়ির মালিকের সমস্যা হয় সেজন্য রান্না করা ও টয়লেটে যাবার সময় বেধে দেয়া হত। সেটা ছিল জেল খানা থেকে ভযঙ্কর। জেলে তাও-বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা চৌহদ্দিতে একটু আধটু ঘুরতে দেয় আর সেখানে সারাক্ষন দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাখা হোত।
ঘরের বাইরে তো দুরের কথা রুমের বাইরে বেরুতেও অনুমতি লাগত। তার-অনুমতি ছাড়া কোন ফোন রিসিভ বা ফোন করা যাবে না। বের হতে না দেয়ার পেছনে কারন ছিল পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে।
কিন্তু আসলে বড় কারনটা ছিল, অন্য ব্যাবসায়ী এর ভোগের মাল-ছিনিয়ে (ছলে বলে কৌশলে) নিতে পারে। সেরকম সম্ভাবনার কারনেই প্রত্যেকেই কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করত।
প্রতি সপ্তাহে বেপারির চেলা এসে স্টপ ওয়াচ ধরে যার যেটুকু প্রয়োজন দেশের বাইরে কথা বলতে দিয়ে নগত তিন/চার গুন পয়সা আদায় করে নেয়। এটা তার নিজের আয়। আর খাবার দায়িত্বটা যেহেতু তার-সেহেতু থাক ব্যাটা মাস তিনেক আলু বাধাকপি সেদ্ধ আর কালো রুটি(রাশানরা বলে ‘খ্লেব' যা দেখতে কিছুটা কালচে। যথাসম্ভব যব দিয়ে এই রুটি করা হয়) খেয়ে। মাঝে মধ্যে শক্ত-সাদা রুটি খেয়ে রুচি পরিবর্তন।
ভাত? ছিঃ ওনাম মুখে আনতে নেই ওটা আমাদের খাবার। ভেতো বাঙ্গালীর ভাতের জন্য সে কি কাকুতি ! .ক্রমশ
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১১:০৮