সারাদিন কর্মব্যস্ততা শেষে বিকেলের দিকে অন্তর্জালে উঁকি দিয়ে স্বদেশের খবর নেওয়া একপ্রকার রুটিন ওয়ার্ক। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর এই রুটিন কাজটুকু করতে গিয়ে মুহুর্তে আমি বেদনায় মুষড়ে গেলাম। মধ্যপথে অকস্মাৎ থেমে গেল এক বিস্ময় পুরুষের জীবন গাড়ি। সঞ্জীব চৌধুরী আর নেই। আমার হৃদয় বিদির্ণ করে এক ঝাপটা হু হু হাওয়া বেরিয়ে মিশে গেল বিস্তির্ণ মরুর দিকশূন্য বুকে। এই সব্যসাচী মানুষটার সাথে আমারো যে অতি সামান্য কিন্তু অতি মূল্যবান কিছু স্মৃতি আছে।
আমরা তখন ভোরের কাগজ পাঠক ফোরাম আর দারুন সব ব্যান্ডদলের গানে বুঁদ হয়ে থাকা প্রজন্ম। সঞ্জীব চৌধুরীর অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের সাথে গায়কী মিলিয়ে দলছুট ব্যান্ডের গান আমাদের সোনালী তারুণ্য জয় করে ঠাঁয় নিয়েছে হৃদয়পুরে। আমাদের মুখে মুখে দেহগাড়ির সুর ব্যাঞ্জনা। আর বোধের নিউরণে পাঠকফোরামের শব্দ অনুরণন।
আমার বন্ধু সরফরাজ আর বোরহান তখন নামিদামি পাফোস। পাফোসদের সাথে সঞ্জীব চৌধুরীর হরিহর আত্মা। আমি তখনো ওস্তাদ ডাইনে প্যালাস্টিক টাইপ নগণ্য। লেখা পাঠিয়ে বি.স-এর দিকে তাকিয়ে থাকি আর মাঝে মধ্যে সরফরাজের সাথে বাংলামোটরের সেই বিখ্যাত চারতলায় ভোরের কাগজ অফিসে যাওয়া আসা করি। শব্দ শিল্পীদের সাথে পরিচিত হই, শব্দ বুননের গল্প শুনি। আর মনের ভেতর সুপ্ত আশা যদি একবার সঞ্জীব বাবুর সাথে দেখা হয়। কিন্তু ততোদিনে গানের ভুবনের রাজপূত্র সঞ্জীব পাঠক ফোরামের থেকে কিছুটা দুরে। একদিন সরফরাজ আকাশচুরি এলবাম দেখিয়ে বল্লেন দেখ সঞ্জীব দার গিফট। আহা সেই গান "তোমার বাড়ির রংয়ের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ"। একদিন আমার স্বপ্ন পুরন হল। ভোরের কাগজের চার তলাতেই কিভাবে যেন দেখা পেলাম তাঁর। সেখানেই কুশল বিনিময়। তন্ময় হয়ে দেখলাম নিজের গানের মতোই অসাধারন ব্যক্তিত্বের দরাজ গলার সুপুরুষ সঞ্জিব চৌধূরী। নষ্ট শহরে বুক চেতিয়ে প্রেম ও দ্রোহের গান গাওয়া ক্ষেপাটে যুবক, যার গান কাঁপন জাগাতো হাজারো বোহেমিয়ান অন্তরে.......চলতে চলতে ক্ষনিকের তরে আরো একবার দেখা হয়েছিল মোহ জাগানিয়া প্রিয় মানুষটির সাথে।
আমার আর ভোরের কাগজে যাওয়া হয়নি। হাজারো ভুলে ভরা গল্প বুকে জমা রেখে জীবনের তাগিদে আমি দেশান্তরী হলাম। প্রিয় স্বদেশ,পাঠক ফোরাম,সরফরাজ বোরহানদের সাথে কান্নার রং ছুঁয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্নতা। শুধু ইথারে সাথী হয়ে থাকলো সঞ্জীবের একেকটা সঞ্জীবনী গান। হায়! এই ইথারেই একদিন নেমে এল জগতের সমস্ত নিস্তব্ধতা। ইথারের জানলাম কাউকে কিছু না জানিয়ে মধ্যপথে মানব গাড়ি থামিয়ে ভীনদেশে পাড়ি দিয়েছেন অনাডম্বর জীবনে বর্ণিল প্রতিভার অধিকারী অন্যরকম এক মানুষ সঞ্জীব চৌধুরী।
আজ তার বিরাণ পথে হেঁটে যাওয়ার একযুগ। অথচ সঞ্জীব চৌধুরী মোটেও হারিয়ে যাননি। শত কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন কিংবদন্তীর পিতা হয়ে অনন্তকাল। এই নষ্ট শহরে নাম না জানা এক মাস্তান সহস্র অনুরাগীর চোখের সমুদ্রে নাও ভাসিয়ে বারবার ফিরে আসবে মানবতার চিঠি নিয়ে, প্রেম ও দ্রোহের গান শোনাতে।
এপারে-ওপারে অনন্তকাল ভাল থাকুন প্রিয় শিল্পী, প্রিয় সঞ্জীব দা..........
প্রকাশিতঃ দৈনিক ভোরের কাগজ/ ২২.১১.১৯