১।
-আপনার আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি?
সুজন সিগনালে থামা লাল রংয়ের প্রাইভেটকারের দিকে এগিয়ে প্রশ্ন করে।ড্রাইভারের পাসের সিটে বসা রিয়াদ নর্থ সাউথে বিবিএ করছে।রিয়াদ ঘাবড়ে গেলেও চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্ন ধরে রাখে । পাল্টা প্রশ্ন করে সে
-কি বললেন?
-বললাম,আপনার আর আমার মধ্যে পার্থক্যটা কোন জায়গায়?
সুজন নির্লিপ্ত ভংগিতে প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকে।
গাড়ির কাচ নামিয়ে রিয়াদ পুরো ঘটনা ইগনোর করলো। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং,বন্ধুদের সাথে গল্প করার মজার বিষয় পেয়ে যেত।কিন্তু প্রাইভেটকারের বসে শর্টসার্কিট টাইপ পাব্লিক ইগনোর করাই বুদ্ধিমানের কাজ।ফলে ঘটনা দীর্ঘায়িত হয়না।তবে ঐ রাতে রিয়াদ তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে এই অদ্ভুত ঘটনার উপর দীর্ঘ ফোনালাপ করে। যা তাদের রুটিনিক কথাবার্তার একঘেয়েমী কাটায় ।
সুজন জগন্নাথে বাংলায় অনার্স করছে। শ্যামপুর এক মেসে উঠেছে দুই সপ্তাহ হয়েছে। মেসের বড়ভাই জুরাইন রেলগেটের বাজার চিনিয়ে দিয়েছিলো।তারপরও বাজারের ডেট আসলে সুজন ওলিগলির একটা গলি ভূল করে ফেলে।লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখে বাজার থেকে বেশ দূরে চলে এসেছে । বিরক্তি নিয়ে রেলে লাইনের পার ধরে বাজারের দিকে হাটা শুরু করে কানে হেডফোন লাগিয়ে।কানে বাজতে থাকে
"যদি মাঝরাতে ঘুম ভাঙে,আমি পাশে নেই
ভয় পাবে কি?"
ফলে বিরক্তির সাথে আদ্র আবেগের মিশ্রন ঘটে সুজনের মন বেখায়ালী মোডে চলে যায়।তবে হটাৎ করেই একটা দৃশ্য তার খেয়াল মোডের সুইচ অন করে দেয়।সে দেখে এক বয়স্কলোক কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়েকে টেনে ধাক্কিয়ে রাস্তার কিনারে সরিয়ে দিচ্ছে।বিদ্যুৎগতিতে সুজনের মস্তিস্কে সিগনাল চলে যায়,ট্রেন আসছেনাতো?! তড়িঘরি রাস্তার আরেক কিনারে সরে পরে ।৬ সেকেন্ডের মধ্যে ট্রেন সুজনের সীমানা অতিক্রম করলে সুজন খেয়াল করে,কোন হুইসেল তো বাজেনি?হুইসেল বাজলে ভালভাবেই শোনার কথা!অদ্ভুত এক অনূভুতির কবলে পরে সুজন।পিচ্চি ছেলেমেয়েদের ঐ দৃশ্যটা চোখে না পরলে এই মূহুর্তে রেল লাইনের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভিড়ের কেন্দ্র হয়ে যেত সে!
ট্রেনে কাটা না পড়ে সুজন বুঝতে পারে মানুষ জীবনের গভীরতম উপলব্ধীগুলো বই পড়ে সঞ্চয় করেনা শুধু।নিজ জীবনের সাথে ঘটা ঘটনাই মানুষকে জীবনের পাঠ দেয়।
মেসে ফিরে অভিজ্ঞতা মেসমেটদের সাথে শেয়ার করলে আশানূরোপ প্রতিক্রিয়া পায়না।বরং রেললাইনে হেডফোন কানে গান শোনায় ঝারি খায় দফায় দফায়। দু-এক সপ্তাহ পরপরই নাকি ঐখানে এক্সিডেন্ট হয় ল। ঐ রাস্তায় ট্রেনে কখনোই হুইসেল দেয়না। কোলাহলে,ডিপ্রেশনে,বেখেয়ালে রেলের পায়ের শব্দ কানে পৌছায়না মাঝেমধ্যে কারো কারো।তখন এসব বেখায়ালীদের মাড়িয়ে ট্রেন চলে যায় নিজের মত।
সুজনের ছেলেবেলার দেখা আলিফ লায়লার একটা এপিসোডের কথা মনে পড়ে। এক রাজ্যে প্রতিবছর বিশালাকার দৈত্য এসে একটা করে কুমারি মেয়ে নিয়ে যেত।সুজন ট্রেন এক্সিডেন্টের সাথে এই গল্পের মিল খুজে পায়। পার্থক্য শুধু দৈত্যের জন্যে এলাকাবাসী নির্দিষ্ট কাউকে চুজ করে দিত,আর এক্ষেত্রে কয়েকহাজার মানুষ থেকে অললৌকিক লটারিতে যে কোন কাউকে ছেচে কেটে চলে যায়।
এসব উপলব্ধীর আর কল্পনার তাপে মস্তিস্ক বুদবুদ তৈরি শুরু করলে, সুজন মানুষের সাথে মানুষের পার্থক্য খোজে।সুযোগ পেলেই পরিচিতজনে আর ফেসবুকে মানবাধিকার জাতীয় শব্দগুলোর অর্থহীনতা আলোচনার বিষয় বানায়।এত বিশালাকার দরিদ্র জনসংখ্যার জীবনের নিরাপত্তা এতটাই ভংগুর!তার জের ধরেই রেল লাইনের বাজারের বলির বখরি আর প্রাইভেট কারজীবিদের পার্থক্য বুঝার চেষ্টা সুজনের ।
২।
রিয়াদ ইগনোর করে গাড়ির জানালা আটকে দেয়ায় সুজনের মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিলো সারাদিন।রুমের বড় ভাই রান্নায় সাহায্য করতে ডাকলে মেজাজ আরও বিগ্রে গেল।বুয়া আসেনি আজ।মাঝেমধ্যেই মিস দেয়।
বড় ভাই রান্নার আয়োজন করে,সুজন পেয়াজ মরিচ কাটে। নিজ মনে কথা বলতে থাকে বড়ভাই
-এই বালের বেতনে সারাজীবন ব্যাচেলরি থাকন লাগবো।আর এইভাবে জইলা শুখাইয়া মরন লাগবো।
সুজনের মুখে মুচকি হাসি দেখে বলে,
-তুমিত হাসবাই।তুমারতো আছে।বাংলাদেশে কয়লাখ ৩০ বছর বয়সী ভার্জিন আছে ধারনা আছে তুমার!ই কি খালি প্রডাকশন দিবার জন্যে দিছে?!তাইলে পৃথীবি এত দিন মানুষশূন্য হইয়া যাইতো।
পাশের রুমের আরেক বড় ভাই চেতে গিয়ে গলা উচায়
-তর সকল কথাই শেষমেশ এইবিষয়ে এ্যাইসা থামে?জুনিয়র সিনিয়র বুঝসনা?এই বুয়া নিয়া কি করবি সেইটা চিন্তা কর আগে।
আলোচনা হয় যতদিন আসবেনা ততদিনের বেতন কেটে দিবে।এ আলোচনা এর আগেও হয়েছে,বাস্তবায়িত হয়নি কখনো।
পরদিন সকালে সুজন দড়জায় নকের উত্তর দিতে গিয়ে দেখে বুয়া চোখে মুখে বিদ্ধস্ত ভংগি নিয়ে দাড়িয়ে।
-কি ব্যাপার খালা?কালকে আসেননাই ক্যান?
- বাসায় চুরি হইছে মামা।মুবাইল,ট্যাকা,গয়না সব নিয়া গেছে।
ঘটনার সত্যতা নিয়ে সুজনের সন্দেহ হয়।সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেনা অবশ্য।বিরক্ত কন্ঠে বলে,
-মুরগি এ্যাইনা রাখছে, নয়টা বড় খন্ড রান্না করেন,বাকিটুকু কালকের রাধবেন।দুপুরে পাচ জনের মিল অব, রাতে চার জন।
চুরির ঘটনা অবশ্য সত্যিই ঘটছে।বুয়া এখানে আসার আগেও স্বামীর সাথে ঝগড়া হয়েছে।দুজনেই চেষ্টা করেছে একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর ।ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নেহাত কম নয়। রান্না করতে দাড়িয়ে বুয়ার চোখে দমকে দমকে পানির চাপ সৃষ্টি হয়। দু-এক ফোটা সফলতা পেয়ে চোখের বাইরে অবস্থান নিতে সক্ষম হলে ট্যাপের পানি দিয়ে লবণের তিক্ততাকে পরাজিত করে দেয়।
চুরিটা করেছে তিন জনের একটা দল।তিনজনের মধ্যে কাউসার দলনেতা গোছের।সে বিয়ে করেছে বছর ঘুরে গেছে।তবে স্ত্রীকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে মাস দুয়েক হয়।রিতা কাউসারের চুরির ব্যাপারে জানতোনা।ঢাকায় এসে জানতে পেরে কয়েকদিন কান্নাকাটি করেছে খুব।ডাল বাঘার দেয়ার কাটার পিটুনি খেয়ে চুপ মেরে গেছে।
বিয়ের আগে রিতার কাদেরের সাথে সম্পর্ক ছিলো।তিন বছরের প্রেম। জানা জানি হলে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টায় নেমে পড়েছিলো রিতার বাবা।ফলে কাউসারের বিয়ের প্রস্তাব আসলে মত দিতে দেরি করেনি। বাড়িঘরের হটাৎ ভাল উন্নতি করেছেলো কাউসার।লোহার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে এইসব করেছে বলে গ্রামে প্রচলিত।রিতাও প্রতিরোধের সাহস পায়নি।ফলে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়।
জীবন সম্পর্কে জ্ঞানহীন পাতলা হৃদয় একটু খোচাতেই ছিদ্র হয়ে যায়।রিতার বিয়েতে তড়িৎ এত বড় ফুটোর কুল কিনারা করতে নাপেরে কাদের বাড়ির পেছনের কাঠাল গাছে ঝুলে পড়ে।
কাদের ফুটবলটা খুব ভাল খেলতো।এলাকার বড় দলের গোল কিপার হিসেবে খেলার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলো। গ্রামের অনেকেরই তার প্রতি একধরনের দুর্বলতা কাজ করতো।ফলে তার ঝুলে যাওয়া এলাকার অনেককেই স্তব্ধ করে দেয়।বিশেষ করে দীর্ঘদিন চাকরির পর রিটায়ার করা সখের ফুটবল কোচ বনে যাওয়া সজীব চৌধুরির।
কাদেরর আত্নহত্যায় পুলিশি ঝামেলা মেটাতে রিতার বাবাকেও ২০ হাজার টাকা কন্ট্রিবিউট করতে হয়।পঞ্চম শ্রেনী পাশকরা কাদের আকাবাকা হাতের লিখার একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলো বলে।বিয়েতে খরচের পর হাত ছিলো একেবারে খালি।২০ হাজার টাকা যোগাতে রিতার বাবার ১৫ বৎসর বয়সী মেহগনী গাছ দুটো কেটে ফেলতে হয়।সজীব চৌধুরি সাহায্য না করলে টাকা আরোও লাগত।সরকারী চাকুরিজীবি ছিল বলে পুলিশ তাকে সম্মানের চোখে দেখেছে বলে কম টাকাতেই মিটিয়ে দিয়েছে।
বিয়ের দিন গাঞ্জা মতি গাজার আশর থেকে ফেরার পথে রাত সাড়ে দশটায় কাদেরকে ঝুলন্ত অবস্থায় আবিস্কার করে। এগারোটার মধ্যে রিতার বাসর ঘরে কাদেরের আন্তহত্যার সংগীত পৌছে গেলে রিতা অজ্ঞান হয়ে যায়।
রাত দুইটায় কাউসার বলপূর্বক শারিরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টায় গেলে রিতা দ্বিতীয় বাড়ের জন্যে অজ্ঞান হয়।
পরদিন কাউসার গ্রামের বন্ধুদের কাছে প্রথম অজ্ঞানের ঘটনা লোকালেও,দ্বিতীয় অজ্ঞানের ঘটনা গল্পাকারে বলে ফেলে।
কিভাবে যেন দুই অজ্ঞানের ঘটনাই এলাকার যুবকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।দশ বছর পরের যুবকদের কাছেও ঘটনাটার আবেদন রয়ে যায়।তারা নির্মমতার উদাহরনের লেপনে গল্পটায় মাতে। ভেতরে থাকে ভয়ারিজমের পুলকতা।