৬৬৬ টাকা, গ্রামের হাটে শাহালমের দোকানে সারাদিনের বিক্রি।আজকাল তার প্রায় সকল কথপোকথনই একপর্যায়ে দোকানের নতুন আইটেমে চলে আসে।আর এই আইটেমে আয় করবে, ৮ বছর বয়সী ছেলে নাইমের ভবিষ্যতের পড়ার খরচ চালাবে এইসব নিয়ে শাখাপ্রশাখা গজায়।শাহালম জিলাপি বিক্রি করত।নতুন আইটেমটা ময়দার তৈরি,খেতে মিষ্টি,দেখতে অনেকটা গুলগুলির আধুনিক ভার্ষণ,তবে সাইজটা গুলগুলির থেকে বড় আর খেতে হয় গরম থাকতেই।
শাহালম আর রাবেয়ার চার বছরের প্রেমের বিয়ে।সকল সপ্নের রাস্তার গোড়া একে একে পিছনে ফেলে, জীবন যখন শুধুই বেচে থাকায় পরিনত হয়েছে তখন জন্ম হলো নাইমের। প্রেমকালীন অসংখ্য জল্পনা-কল্পনার ছেলের নামটাই শুধু বাস্তবে রুপান্তর করতে পেরেছে ।শূন্য স্লেটে নাইমকে ঘিরে নতুন করে সপ্ন আকা। শাহালমের মালয়েশিয়া যাওয়া হয়নি।টাকা যোগার সম্ভব ছিলোনা বলে।বুঝত আগেও।বিশ্বাস করেনি।সময় বিশ্বাস অবিশ্বাসের দাম দেয়না,একসময় বাধ্য করে ফেলে মেনে নিতে।
হাটবারে বাড়ি ফিরতে শাহালমের এমনিতেই রাত হয়ে যায়। ছেলেবেলার ক্লাসমেট লতিফ চাকরির ছুটিতে গ্রামে আসলে বরাবর শাহালমই বাংলা মদ জোগার করে দেয়। সংগও দেয়। রোজার মধ্যে এসব করার ইচ্ছা তার ছিলোনা। লতিফের জোড়াজুড়িতে নিজে নাখেলেও তাকে সংগ দিতে বেশ রাত হয়ে গেল। শাহালম বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল। পাশের রুমে নাইম ঘুমিয়ে পড়েছে। দাদি মারা যাওয়ার পর থেকে সে একা ঘুমায়। রাবেয়া এখনো জেগে। শাহালম বলল
-আজকে ইস্কুলে নাইমের বেতন দিবার গেছিলাম,স্যারে নাইমের সুনাম করলো মেলা।কয় তুমার পুলার কল্পনাশক্তি ভাল।
ছেলের কল্পনাশক্তি নিয়ে রাবেয়াও গর্বিত।সে বলে
-তুমি যে মুরগি জোড়া আনছোনা হাটে থিকে?পুলায় কয় কি জান? দুইটা থিকে বাচ্চা তুলাইয়া দশটা কইরা বাচ্চা টিকলেও ছয়মাসের মধ্যে বিশটা, হেনথেকে দশটাও যদি মুরগি হয় তাইলে ওগল্যা সবগুলায় দশটা কইরা মুরগি দিলে আর ছয়মাস পর একশ,তার ছয়মাস পর পাচশ, কয় বছরের মধ্যে হাজার হাজার মুরগি হইয়া আমরা বড়লোক হইয়া যামু।হা হা!!
-হ পুলায় ভালই আজব হইছে।মাছের ডিম খাইতে কত পছন্দ করে কিন্তু খাবনা! ঐডিম থিকে লাখ লাখ মাছ হইত দেইখ্যা!
এইসব আলাপে আলাপে একসময় দুজনেই চুপ হয়ে যায়।মিনিট কুড়ি পরে শাহালম মুখ খুলে
-এ্যাইচ্ছা কেউ মারা গেলে নাকি তার মুনে চল্লিশদিন আগে থিকে জানান দেয়?
রাবেয়া উত্তর দেয়না।ঘুমিয়ে পড়েছে।
শুক্রবার দুপুর ১২টা ২৩। জুমার নামাজ পড়তে ছেলের খোজ করলে রাবেয়া জানায় পূর্ব পাড়ায় পাগার ভাংগা দিছে,ঐখানে মাছ মারতে গেছে।ছেলেকে ডাকতে যাওয়ার সময় নাথাকায় শাহালম একাই চলে যায়।খুদবায় হুজুর সবে বরাতের বরকত নিয়ে আলোচনা করলেন।রমজানের শেষ দশ দিন নাজাতের।আজকাল মানুষের ক্ষমার বড় প্রয়োজন।আলোচনা বেশ জমে উঠলো। ফেরার পথে শাহালম আশেপাশের মানুষের মধ্যে একধরনের চাঞ্চল্য দেখতে পায়।দুই একজনের কথা শুনে বুঝতে পারল তাজা কই মাছ গলায় আটকে একটা ছেলে মারা গেছে।শাহালম অদ্ভুত একটা মানষিক অবস্থার মধ্যে পৌছে যন্ত্রের মত পাগারের দিকে দৌড় শুরু করল।
একটা মাছ ধরে পাড়ে রাখা পাতিলে রাখতে যাওয়ার সময় আরেকটা মাছ পায়ের তলায় পড়ে,নাইমের মনে হয় আজকে ভাগ্যটাতা বেশ ভাল!দুই হাতে দুইটা মাছ নিয়ে পাতিলে রাখতে গেলে পায়ের তলায় আরেকটা মাছ পড়ে।ডানহাতের মাঝারি সাইজের দেশি কইটা মুখে নিয়ে পায়ের তলায় তৃতীয় মাছটা ধরতে গেলে মুখের কই মুখের আরো ভিতরে ঢুকে পরে।
চারদিকে মানুষের বৃত্তের মাঝে রাবেয়া নাইমের মাথা কোলে নিয়ে চিৎকার করছে।নাইমের মুখের কোনায় শুখনো রক্তের ছোপ।মাছটাও বাচতে পারেনি,নাইমের মাথার একহাত দূরে পড়ে আছে।রাবেয়ার আহাজারির সাথে তাল ধরেছ তার মা।সে অবশ্য দুইটি লাইনি একসুরে পুনরাবৃত্তি করছে।
-ওরে আমার নানা রে,তুই কই গেলিগ্যা?।
সন্ধ্যার মধ্যে গ্রামের কবরস্থানে নাইমের জায়গা হয়ে গেল।
সন্ধ্যা ৭:৩০। বদির চায়ের দোকানে গ্রামের মাঝবয়েসী লোকের সংযোগস্থল।গ্রাম্য রাজনীতি থেকে বিশ্বরাজনীতির বিষয়বস্তুকে হটিয়ে আজকের আলোচনা চলছে নাইমের কবর নিয়ে ।বড় করে রাখা কিছু চুল চাদি মাথার একাংশ ঢেকে রবিউল কথা শুরু করে।
-আর যাই হোক কব্বরডা কাটা কিন্তু ভাল হইছে।
সায় দেয় আর দুএক সদস্য।বয়জেষ্ঠ ফালু কথা কেড়ে নিয়ে বলল
-কব্বর খুদত সিকদার পাড়ার সালেক।দুইচার এলাকায় ওর নাগাল কব্বর কেউ খুদতে পারতনা।সালেক মরলে ওর কব্বর দিয়াইত জসিম কব্বর খুদা শুরু করছাল ।ম্যানষের জন্যে সারাজীবন সুন্দর সুন্দর কব্বর খুইদ্যা কাইটা নিজে পাইলো কি পছা কব্বর!
দবির মাদবর গোরস্থানের এরিয়া পাকা ও বড় করা বিষয়ে আলাপ তুললে আলোচনা শেষমেষ গ্রাম্য রাজনীতিতেই পৌছায়।
সন্ধ্যা ৭:৩০। ব্যাডমিন্টন খেলার আগে মাঠে বসে আছে গ্রামের তরুনদের কয়জন।যথারীতি এখানেও আলোচনা নাইমের মৃত্যু।তাদের মধ্যে একজনের প্রেমিকা এসেছিলো লাশ দেখতে তা নিয়েও রসিকতা হয় একচোট। লাশ দেখতে এত মানুষ এসেছিল তা নিয়ে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হলে এতক্ষন চুপচাপ থাকা জাকির মুখ খুলে।জাকির ঢাকায় পড়াশোনা করে।আউট বই পড়ার অভ্যাস আছে এবং তা বুঝিয়ে দেয়ার একটা চেষ্টা তার কথায় সবময় লক্ষ্য করা যায়।
জাকির বলল
-এত মানুষ হইছিলো তাজা কই মাছ গলায় ঠেইক্যা মরছে দেইখ্যা।আমেরিকায় এক পরিসংখানে দেখা গেছে-সুইমিংপুলে পইড়া শিশু মৃত্যুর হার ৭০ ভাগ আর পিস্তলের গুলি খাইয়া মৃত্যুর হার ২ভাগ।কিন্তু যে প্রতিবেশির লাইসেন্স করা পিস্তল আছে ঐসব বাসায় গার্জেনরা তাদের পুলাপান যাইতে দেয়না।তবে সুইমিংপুলের ব্যাপারে তাদের সমস্যা নাই।একজন এর মানে কি জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়,মানে নাই কোন।
রাত ৯:২০। তারাবির নামাজ শেষে বাজার মসজিদে ভিন্ন বয়সী নামাজী বসে আছে।তাদের একজন বলল
-পুলাডায় রোজার মধ্যে মারা গেল এইদিক দিয়া তাও ভাগ্য ভালই।আর জানাযায় কত মানুষ হইছাল!
অল্প বয়সী আলামিন এ মৃত্যুকে ভাগ্যবানের উদাহরন হিসেবে মেনে নিতে না পারেলেও চুপ করে থাকে।
রাত ৯:৪৫। নাইমের ক্লাসমেট হালিমার শরীর এখনো বীপরীত লিংগের প্রতি আকর্ষন জন্মানোর জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে শেখেনি।তবে নাইমের জন্যে তার চোখের পানি ঝরে বালিশ ভিজে গেছে।
রাত ৯:৪৯।কাদছে নাইমের আরেক ক্লাসমেট সাকিবও।ক্রিকেট খেলায় নাইমের সাথে ঝগরা করেছে গতকাল।এ নিয়ে এখন অপরাধবোধে ভূগছে।সে নিজের হাতে কামরাচ্ছে।চোখ নাক বেয়ে পানি ঝরছে।
রাত ১০:৮।মৃতের বাড়ি থেকে একে একে সবাই চলে গেছে। শুধু নাইমের নানি তার ছেলের ঘরের নাতনি নিয়ে নাইমের রুমে শুয়ে আছে
।রাবেয়ার কান্না থেমে গেছে।খাটে শুয়ে আছে।শাহালাম বলল
-হারা দিন না খাইয়া রইছো। মাদবরগো বাড়িতে থিকে গরুর মাংস দিছে,পাক ভাল হইছে।একটু গরম কইরা খ্যাইয়া ন্যাও।
রাবেয়া আবারো কেদে ফেলে
-গরুর মাংস নাইমের সবথিকে পছন্দের মাংস আছাল!
পৌনে এগারটায় রাবেয়ার খাওয়া হয়ে যায়।শাহালম রাবেয়াকে সান্তনা দেয়ার চেস্টা করে।
-এত ক্যান্দোনা।আমগো কি আর পুলাহান অবনা?
শাহালম আর কথা খুজে পায়না।রাবেয়াকে বা নিজেকে সান্তনা দেয়ার ভাষা তার জানা নেই।লোকজনের শান্তনার কথা শুনে প্রত্যেকের দুইগালে থাপ্পড় বসাতে ইচ্ছা করেছে শাহালমের।সামাজিক শৃঙ্খলায় সব ইচ্ছা প্রকাশ করা যায়না।বলতে হয়
হ তাইতো,চিন্তা কইরা,মন খারাপ কইরাতো কোন লাভ নাই। শাহালমও এইসব বলেছে।
দুজনে পাশাপাশি শুয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ থাকে।তারপর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষন।রাত পৌনে বারটার দিকে তাদের আনপ্রটেক্টেড ফিজিকাল এ্যাক্ট সংঘটিত হয়।এবার শাহলমের X ক্রমোজম রাবেয়ার X ক্রমোজমকে আলিংগন করে।বিভিন্ন সময় যখন রাবেয়া তার মেয়েকে মৃত ভাইয়ের গল্প শুনাবে তখন রাবেয়ার চোখ ভিজে উঠবে।
রাত ১২ টা।গোরস্থানে নতুন খোরা কবরের ভেতরে নাইম। কবরের উপরের মাটি কোয়াশায় ভিজে গেছে।নাইমের আট বছর,তিন মাস,পনের দিনের জীবন এখানেই থেমে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:২৬