“এক্সকিউজ মি স্যার, ইউ নিড টু সুইচ অফ দ্যা ফোন।“, কিছুক্ষণ বিরতি, আবার “প্লিজ সুইচ অফ। সুইচ ইট অফ নাও”। টার্কিশ ফ্লাইট এটেনডেন্ট ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকবার করে বলে যাচ্ছে সামনের সিটে বসা ভদ্রলোককে। আর ভদ্রলোকও বাক স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে তার সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত ব্যবহার করে চলেছেন, “হ হ প্লেন ছাইড়া দিসে, না না এখনো উঠে নাই, তুই রাসেলরে কইস বাসায় বাজার দিয়া যাইতে”। টার্কিশ ফ্লাইট এটেনডেন্ট তখনো এসে সেই ভদ্রলোককে মনে করিয়ে দিচ্ছে এবং তার নায়ক সুলভ চেহারা মোবারক ক্রমশ লাল হতে হতে টমেটোর আকার ধারণ করেছে প্রায়। স্যার স্যার বলে কাউরে থামানো বিশেষত বাঙালীকে, যে একটি বিশেষ পরিশ্রমের বিষয় তা তার আর্ন্তজাতিক এটিকেট হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। তো সেই ভদ্রলোক অবশেষে থামলেন, অবশ্য ঠিক তখনি যখন স্থানীয় মোবাইল নেটওয়ার্কের সীমানা প্রায় শেষ। এদিকে ফ্লাইট এটেনডেন্টও তার ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত প্রায়। আমি বুঝলাম, সামনের সাড়ে সাত ঘন্টা এই দুজনে একটা ইন্টারেস্টিং দ্বৈরথ হবে। আমার অনুমান ভুল ছিল না। সামনের ভিস্যুয়াল ডিভাইসটি নষ্ট, মুভি দেখা, গান শোনার ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। বিনোদনের জন্য উপায়ন্তর না দেখে আমিও গ্যালারীতে বসলাম।
জর্মন সরকারের ভিজিটর প্রোগ্রামে আমন্ত্রিত হয়ে, বার্লিন যাচ্ছি। ৩রা অগাস্ট থেকে ৯ই আগস্ট প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামের শিরোনাম “ব্লার্গরস জার্নি”। কনফারেন্সের থিম, “সাইবার পলিসি”।
আমাদের ভ্রমণের অফিসিয়াল বয়ান
এখানে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের একটা জরুরৎ আছে। এই প্রোগ্রামে আমাকে রেকোমেন্ড করেছেন আরেক বাঙালী। ফলে প্রচলিত যে কথা আছে, “এক বাঙালী যে আরেক বাঙালীর জন্য সুযোগ তৈরি করেন না” এই কথাটা তিনি অনেকাংশে লাঘব করেছেন। তার প্রতি আবারো কৃতজ্ঞতা। আমার সঙ্গী তৃষিয়া নাস্থারান। তিনি সচলায়তনের ব্লগার। যোগ্য মানুষ হিসেবেই দলে আছেন। পনেরোটা দেশের ব্লগারদের মধ্যে দুজন বাঙালী প্রতিনিধি, খারাপ না বিষয়টা। আরো বেশি হলে আরো ভালো।
তো ৩রা আগস্ট এর ভোর ছটা দশের ফ্লাইট ধরতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ফ্লাইটের ঠিক তিনদিন আগে থেকে জ্বর-কাশি-সর্দি। ইবোলা ভাইরাসের আতংকে ওয়ার্ল্ড হেলথ এর মত আমিও আতংকিত। মানে ইবোলায় যতটা না নয় তারচেয়ে অনেক বেশি জর্মনে ঠিকঠাক পৌছাতে পারবো কিনা সেটা নিয়ে। মা-বাবা-বোন সারারাত ধরে সেবা করে আক্ষরিক অর্থেই বিছানা থেকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। চেক ইনের সময় আমি তখনো টলছি। তবে যাবার পথে সিট পাল্টে উইন্ডোতে দুটো সিট পেয়ে গেলাম। ফলে সামনের সিটের চলমান নাটক (মানে সেই ভদ্রলোক এবং টার্কিশ এটেনডেন্ট এর) দেখাটা সহজ হয়েছিল। এই যেমন কিছুক্ষণ পরপর সেই ভদ্রলোক বলছে স্প্রাইট চাই, এটেনডেন্ট বলছে নাই। সে আরো রেগে যেয়ে বলছে তাহলে ওয়াইন চাই। এটেনডেন্ট বলে কোনটা চাও, সে বলে রেড ওয়াইন। আর এডেনডেন্ট বলে হোয়াইট আছে। সে এক কাহীনি। আমি জানালা দিয়ে আকাশ দেখি, মেঘ দেখি। মাঝে মাঝে ছবি তুলি, আবার জ্বরে মটকা মেরে পড়ে থাকি। ইস্তানবুলে চার ঘন্টার ট্রানজিট। একটু ঘোরাঘুরি, একটু কেনাকাটা এভাবে মোটামুটি টলতে টলতে ফাইনাল চেক ইন করে যখন বার্লিনের টেজেল এয়ারপোর্টে পৌছলাম তখন সর্বমোট সতের ঘন্টার জার্নি শেষ করে ফেলেছি।
ইস্তানবুলে নামার আগে।
ইমিগ্রেশন পার হয়ে দেখি মাথা ন্যাড়া, গান্ধী স্টাইলের চশমা পড়া এক ভদ্রলোক চৌধুরী আর ত্রিষিয়া নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। ইনি মি. সেবাস্টিয়ান।
খুব কি ভুল বর্ননা করেছি?
আমাদের ভিজিটের সবচেয়ে কর্মব্যস্ত ব্যক্তি। সারাদিন ধরে গেস্টদের রিসিভ করা আর হোটেলে পাঠানোর কাজের মধ্যেই আছেন। এমনিতেই ফ্লাইট দেরী করেছে, তার উপর জ্বর এবং মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে ঠিক রাত আটটায় প্রথম অফিসিয়াল ডিনার। এয়ারপোর্ট থেকে মার্সিডিজ বেঞ্জের ক্যাবে করে যখন হোটেল এ পৌছলাম তখনো দিনের আলো থাকলেও, ঘড়িতে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭ টা ৪৫। মানে হোটেলে চেকইন করে একটু সভ্যভব্য হয়ে নীচে নামার সময় মাত্র মিনিট পনেরো। এদিকে সেবাস্টিয়ান খুব চমৎকার করে জানিয়ে দিল, “ইউ মাস্ট বি ভেরি টায়ার্ড, সো উই আর মিটিং এ্যাট এইট, এভরিবডি ইজ ওয়েটিং”। মুখ দিয়ে “কিছু একটা” বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রায়। নিজেকে সংযত করে চিবানো হাসি দিয়ে বললাম, “শিওর”। দেশের মান ইজ্জত বলে কথা।
ডিনারে পরিচয় হল বাকীদের সাথে। তবে সবারে আগে কথা হল জিয়াদের সাথে। আগ্রহটা আমারই বেশি। জিয়াদ প্যালেস্টাইনি। প্যালেস্টাইন নিয়ে এদেশের মানুষের উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথা জানালাম তাকে। মৃত শিশুদের মুখগুলো মনে করে ডিনারের পরিবেশ আমাদের অজান্তেই ভারী হয়ে উঠল। সমবেদনা জানানোর ভাষা খুঁজে পেলাম না। কি এক নিষ্ঠুর এবং একচোখা বিশ্বে আমাদের বসবাস।
ডিনার শেষ করে পরিচয় হল শ্রীলঙ্কান দিনিদুর সাথে। বিড়ি কিনতে গিয়ে জানা গেল তার ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড ঠিক কাজ করছে না। তাই সাড়ে সাত ইউরো ধার দিতে হল। ডিনারেই কথা হল ড. ওডিলা ট্রিবেলের সাথে। তিনি এই আর্ন্তজাতিক ডায়ালোগের মুল পরিকল্পনাকারী। পুরোই ডাক সাইটে নারী। ভীষণ এনার্জেটিক এবং কড়া। পরিচয় হল আমাদের ট্রান্সলেটরের সাথেও। বিনাকা এবং মার্গারেট। সেবাস্টিয়ানের কাছে জানা গেল আগামীকাল আমাদের সবচেয়ে টাইট শিডিউল এবং সবচেয়ে ফর্মালও বটে। সকাল আটটায় লবিতে মিলিত হচ্ছি সবাই ।
আমার রুম থেকে সকালের বার্লিন
বুন্দেসটাগ বা জার্মান গণতন্ত্রের কেন্দ্রে
৪ঠা আগস্ট সকাল সাড়ে আটটা। গলায় গরুর দড়ির মত ট্রান্সলেটর যন্ত্র, কাঁধে ব্যাগ, হাতে সারাদিনের টাইট শিডিউল এবং পুরোই ফর্মাল গেটআপ। মনে করিয়ে দেয়া ভালো যে গতরাতে ঘুমাতে গিয়েছি ভোর সাড়ে চারটায়। বিছানা আরামদায়ক হলেও ম্যাট্রেস তিনতলা উঁচু হবার কারণে কেবলই মনে হচ্ছিল গড়িয়ে পড়ছি কোথাও। এদিকে বীর বাঙালী হয়ে জর্মন ফর্মাল ডিনার শেষ করলেও বুকে জমাট বাঁধা কফ এমনভাবে জেঁকে ধরেছে যে “হাসিলেও কাশিতেছি, এমনকি স্মিত করিয়া একটুখানি মুখ ব্যাকাইলেও”। পিঠের পিছন থেকে এক অদৃশ্য হাত প্রবল আক্রোশে বিপরীত দিকের অংশে অপর এক অদৃশ্য হাতের সাথে প্রবল পাঞ্জায় লিপ্ত, মাঝখানে আমার ফুসফুস তো যায় যায়। এমতাবস্থায় বাঙালী মহা ঔষুধ “সরিষার তেল ডলিবার” কাউকে না পেয়ে মন বড়ই বিক্ষিপ্ত। যাই হোক কয়েক স্তরের সিকিউরিটি চেক শেষ করিয়া অবশেষে বুন্দেসটাগে প্রবেশের অনুমতি মিলল। আমাদের টিমটা একেবারে ছোট নয়। আমাদের ম্যানেজ করাও সহজ নয়। বাকীটা না হয় ছবিতেই দেখে নেয়া যাক।
জার্মান পার্লামেন্ট
জার্মান পার্লামেন্টের সামনে আমি
রাইখস্ট্যাগ নামে পরিচিত এই বিল্ডিং এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৯৪ থেকে মানে জার্মান এম্পায়ের উত্থানের সাথে। এবং ১৯৩৩ এ পুড়ে যায় এবং পরিবর্তিতে পুন:নির্মিত হয়। আমরা জানলাম যে এই পুন:নির্মাণে ৫০টি দেশের আর্কিটেক্ট এর কাছ থেকে ডিজাইন চাওয়া হয় এবং শেষমেষ ডোম এর ডিজাইনটি জয়ী হয়।
পার্লামেন্টের ভিরতটা স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি এবং থিমটা হল গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা।
আরেকটি খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় হল, আর্কিটেকচারেই দেখানো হয়েছে যে এখানে পার্লামেন্টিরিয়ানরা জনগণের নীচে। তাই তাই জনগণের বসার জায়গা উপরে এবং সংসদ সদস্যদের নীচে। চেয়ারের রং ও মিডিয়াবান্ধব। মানে ব্রডকাস্ট মিডিয়া।
আমাদের ইতিহাস এবং আর্কিটেকচার বোঝাচ্ছেন গাইড। মডার্ন আর্ট সম্মৃদ্ধ বিল্ডিং।
পার্লামেন্ট বিল্ডিং এর নীচে। ছোট্ট করে একটা রুম। অনেকটা গির্জার মত। সামনে বেদী, তেমনি সাথেই লাগোয়া ছোট রুম এ জায়নামাজ। ফলে সংসদ সদস্যরা যারযার মনে করে প্রার্থনা করতে পারেন।
এরপর আমরা নেমে গেলাম নীচে, দুই তলা নীচে দেখা মিলল পুরোনো রাইখস্টাগের স্মৃতিচিহ্ন।
বেশ একটা যাদুঘরই বানিয়ে রেখেছে তারা। সেইসাথে পুরোনো সিটিং এ্যারেঞ্জমেন্ট, এস্কেপরুটের ধংসাবশেষ। পুড়ে যাওয়া রাইখস্ট্যাগ।
আরেকট খুব ইন্টারেস্টিং অংশ হল, রাইখস্ট্যাগের ভেতরের দেয়াল যা পুন:সংরক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে ২য় বিশ্বযুদ্ধর পর। খেয়াল করে দেখবেন রাশিয়ান ভাষা, ১৯৪৫ সন। স্পষ্ট বোঝা যায়।
সংসদ সদস্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মৃতিতে তৈরি আরেকটি আর্ট ওয়ার্ক। যা মনে হবে জংধরা ছোট বাক্সের (জুতার বাক্সের মত) দেয়াল। আসলে দারুণ একটা মডার্ণ আর্ট।
মাটির নীচ থেকে এবার আমরা চলে যাচ্ছি উপরে। একদম পার্লামেন্টের ছাদ থেকে দেখবো বার্লিন এবং সেই বিখ্যাত কাঁচের ডোম।
ডোমটা এমনভাবে তৈরি যে কাঁচের জানালা দিয়ে বাতাস ক্রমশ নীচের দিকে যায়। ফলে পুরো বিল্ডিং এ একটা বাতাস প্রবাহ বহাল থাকে। অন্যদিকে এটা স্বচ্ছতা ও পরিবেশের প্রতি কমিটমেন্টেরও প্রতীক। পুরোনো বিল্ডিং এর রোমান আর্কিটেকচারও দেখতে পাবো আমরা। খেয়াল করে দেখবেন বার্লিনে কোন স্কাই স্ক্র্যাপার নেই। এটা ইচ্ছাকৃত।
পার্লামেন্ট দর্শনের পর্ব শেষ করে আমরা চলে যাবো খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ। আমাদের দেশের সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য এই মিটিং গুলো ছিল ভীষণ শিক্ষনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। ফিরে আসছি পরবর্তী পর্বে।