আসকর আলী মারা গেলেন ২১শে জুলাই ২০০৯ এ। বয়স ৬৫ বৎসর আনুমানিক। যদিও আমার অনুমান ছিল তাঁর স্ত্রী ই আগে বিদায় নেবেন। খতিজা বেগমের শরীরে লীভার সংক্রমণের প্রমাণ স্পষ্ট হচ্ছিল প্রকট ভাবেই। প্রথমে স্ক্যাভীজ মনে করেছিলাম, যদিও ভুল ভেঙ্গেছিল পরের ডায়াগনোসিসেই। কক্সবাজার হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল। ওখান থেকে জার্মানীর লিভার কন্স্যালটেন্সী নিশ্চিত জবাব পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি আর আমার সহকর্মী আশা করছিলাম একদিন খতিজা বেগম আর ঘুম থেকে উঠবেন না আর হয়ত এটাই তার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে।
দূরারোগ্য ব্যাধি, দূরারোগ্য দারিদ্র, দূরারোগ্য পরিস্থিতিতে খাতিজা বেগম বেঁচে রয়েছেন এখনো; কিন্তু আসকর আলী চলে গেলেন একেবারে আচমকাই। খবরটা পেলাম ২৩ এ...। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার সাড়ে সাত হাজার টাকার অর্ধেক পাওয়া গিয়েছিল বাকীটা এলাকার মানুষজনের বদান্যতা। কক্সবাজারের দক্ষিণ কুতুবদিয়া বস্তির উচ্ছেদকৃত মানুষের টাকায় দাফন হয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার।
আসকর আলী ছোটলোকের বাচ্চা কিনা? বাংলাদেশের ৯০ ভাগ লোক কি বড়লোকের বাচ্চা?
মুক্তিযোদ্ধারা কি বড়লোকের বাচ্চা ছিলেন? কতজন ছিলেন? ভবিষ্যতে কতজন থাকবেন?
অবসর প্রাপ্ত পুলিশ কর্মচারী আসকর আলীর সারদার ট্রেনিং কাজে এসেছিল। নিজের জায়গা থেকে উচ্ছেদকৃত হয়ে, নিজের সারাজীবনের সঞ্চয় চোখের সামনে ভেঙ্গে মিশে যাবার পরও হার মানেন নি।
তত্ত্বাবধায়ক সামরিক সরকার কক্সবাজারের বিমানঘাঁটি সম্প্রসারিত করার নামে একদিনের নোটিশে ৮৩০ঘর ৭-৮ হাজার মানুষের জীবন, আশ্রয় এক লহমায় ভেঙ্গে দিয়েছিল। আসকর আলীর সাথে যখন এই বিষয়ে কথা হচ্ছিল তখন তিনি হতাশ অশ্রুসজল হয়ে বলেছিলেন; নিজের দেশের মানুষ পাক বাহিনীর চাইতে বেশি অত্যাচার করেছিল সেদিন।
উচ্ছেদের পর এই জনগোষ্ঠীকে যেখানে অস্থায়ী জায়গা দেয়া হয়েছে সেটা সমুদ্রের জোয়ার প্রবণ এলাকায়, প্রায়শই পানি আটকে থাকে। এই বলপ্রয়োগী পূর্নবাসনে আশ্রয়দাতা ও দিক নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন আসকর আলী। উনি বীরপ্রতীক ছিলেন না, বীর উত্তমও ছিলেন না কিন্তু একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই জীবনে যাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে তারা হয়ত এই অনুভূতিটা বুঝতে পারবেন। এই মানুষগুলোর ভেতরে এমন একটা কিছু আছে যা আপনাকে বারবার একটা অমোঘ শক্তির কথা মনে করিয়ে দেবে। দ্রারিদ্র বয়স শ্রেণী নির্বিশেষে এমন একটা আলো, দ্যুতি এবং পরিশেষে গভীর বেদনা ধ্বিক ধ্বিক জ্বলতে থাকে যেটাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বাঙালী রক্তের সবচেয়ে শক্তিশালী শুদ্ধ মেধাবী স্রোত ধারার স্পন্দন আপনি এমনভাবে টের পাবেন, যেটা আপনাকে আশাবাদী করতে বাধ্য। আমাকেও করেছে বারবার। তাই আমি ছুটে গেছি।
কোন রকম প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়া আমাদের তিনি সাহায্য করেছেন নিরলসভাবে। এই মহত্ত্ব, এই দৃঢ়তা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে আমার পূর্ব পৃরুষের শক্তিমত্তাকে, দৃঢ়, যোদ্ধাসত্তাকে।
সেই আসকর আলী খুন হলেন। হ্যা আসকর আলীর মত মানুষেরা প্রতিদিন রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাপনায় খুন হন। ঠিক এই মুহুর্তে হচ্ছেনও অবশিষ্ট্য দূর্লভ এই মানুষেরা। এরা কেউই মসনদে নেই। এরা কোনদিনই মসনদে বসেন না। এরা মসনদের বলি। কিভাবে?
মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণিত হবার জন্য তাকে যাচাই বাছাইয়ের পরীক্ষা দিতে হয়েছে বারবার বহুবার। নিজের যুদ্ধ অঞ্চল সিলেট থেকে কক্সবাজারে সদস্যপদ স্থানান্তরণের জন্য আবেদন করতে হয়েছে। ধর্ণা দিতে হয়েছে। কোনদিন সরকারের কাছ কিছু চাননি, শান্তিটুকু ছাড়া। সরকার তাকে প্রতিদান হিসেবে শান্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। উচ্ছেদ হয়েছেন নিজের গৃহ থেকে, নিজের অস্তিত্বের শেষ সম্বলটুকু গুড়িয়ে দিয়েছে সরকারী বুলডোজার। আশ্রয় হয়েছে উচ্ছেদকৃতের বস্তিতে।
দারিদ্রের শৃঙ্খলে নিষ্পষিত হয়ে, আত্ম সম্মানের শোকে মারা গেছেন আসকর আলী। বাড়ীতে ক্ষুধায় থাকতে না পেরে তার কনিষ্ঠ মেয়ে পালিয়ে যান চট্টগ্রামে, সেখানে মাদক ব্যাবসা আর পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িয়ে পড়েন। বহুদিন ধরে খোঁজ খবরের পর সেখানে ছুটে যান আসকর আলী। চট্টগ্রাম জেল থেকে মেয়েকে ছাড়িয়ে বাসায় নিয়ে আসেন। এর ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যান। একজন আসকর আলীর এই যে উপায় হীনতা তা উন্মোচন করে দেয় রাষ্ট্রের মুখোশ। এখানে আওয়ামী বিএনপি বাম জামাত সবাই এলিট। গণমানুষের শক্তি আর সামর্থ্যের ব্যবস্থাগত হত্যাকান্ডে সবাই অংশীদ্বার।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এই ব্লগ, টুকরো টুকরো সেমিনার, আমাদের গণস্বাক্ষর ইত্যাদির চাইতে এত বড় বিষয় তা সম্ভবত আমরা অনুমানও করি না। করলে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চাইতে বড় মনে করার সাহস হোত না আসলে। আর যারা আছেন মুক্তিযোদ্ধা- রাজাকার ধোঁয়া ব্যবসায়ী তাদেরও সাহস অনেক। আমারাই দিয়েছি আসলে। ক্রমান্বয়ে আপস করতে করতে। আমি কখনো ব্যক্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বুঝি না। শেখমুজিব জিয়া দিয়েও নয় অথবা ব্লগের অমি রহমান পিয়াল দিয়েও নয়। ব্যাক্তি পিয়াল যদি “পর্ণ ব্যবসায় (বানোয়াট অভিযোগ বা সত্য যে কোন অর্থেই)” নামেন তাতে মুক্তিযুদ্ধের শুদ্ধতা নষ্ট হয় না । কারণ আমার মুক্তিযুদ্ধ তার উপর নির্ভর করে না। আসলে কারোরই করে না। মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর করে এর চেতনার উপর। আর এই চেতনা সচল রাখতে যে যতক্ষণ আছেন আমি তার সাথে আছি। এই চেতনার উপর দাগ মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের ব্যাক্তিগত ভুলে কেবল তৈরী হয় না, হয় এইটা নিয়ে নির্বোধ ব্যক্তি নির্ভরতায়। যখন মানুষজন তাদের চিন্তা উপলব্ধির ভার অন্যের উপর দিয়া রাখেন; সেইটার মাধ্যমে খালাশ পাইতে চান তখন। আমি এই খালাশ পাওয়ার জায়গা বন্ধ করার আহবান জানাই। তা না হলে শত শত নিজামী জন্ম নিব এই মাটিতে, আর শত শত আসকর আলী মারা যাবেন ক্ষুধা আর অমর্যাদায়।
ঐ মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু সিস্টেমেটিক কিলিং এ মরছেন (উৎসর্গ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৮টি মন্তব্য ৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন