গল্পের প্রাক কখন: খ্রিষ্টীয় ও জর্মন (বড় ছাতা, মানবতাবাদ/পশ্চিমা) মানবিকতা ও উন্নয়নের সাথে নানা ভূমিকায় কাজ করছি, পেট/পেশার কারণে। এর মধ্যে বহুল ব্যবহৃতটি নিশ্চয়ই লিয়াজো ও ভাষান্তরীকের, মাঝেসাঝে কেরাণীরও(এই প্রসঙ্গ নিয়ে পরে বাতচিতের আশা রইল)। জর্মন বস নানা উদ্যোগ ও উদ্যোম নিয়ে মানবকর্ম করছেন। (কিছু শ্লেষ ও শ্রদ্ধা একই সাথে রইল, পেশাদ্বারীত্বের রাজনীতি আর কি)। এরমধ্যে একটি হল কক্সবাজারের বিভিন্ন বস্তিতে যেয়ে যেয়ে কাজের (উন্নয়ন কর্ম নি:সন্দেহে) সম্ভাবনা যাচাই। এমনি এক পর্যায়ে তিনি খোঁজ পেয়েছিলেন জনৈক মহিলার, যিনি ভয়ানক রকম চর্মরোগে আক্রান্ত। তিনি তার ছবি তোলেন এবং পরবর্তীতে ডাক্তারকে সেই ছবি দেখিয়ে প্রয়োজনীয় ঔষুধ কেনেন। এর পরের বার আমরা যখন সেই বস্তিতে যাই তখন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল সেই মহিলাকে খুঁজে বের করা।

দীর্ঘক্ষণ খোঁজার পরও কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না, আমরা জনে জনে জিগ্গেস করছিলাম। অবশেষে আমরা যখন হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম (৭০০০-৮০০০ জনের বস্তিতে কাউকে খুঁজে পাওয়া খুব সহজ নয়), ঠিক তখনি একজন পুরুষ একটি বিশেষ স্মারক মনে করে মহিলাকে চিনতে পারলেন এবং আমাদের পথ দেখিয়ে একটি ছাপড়া ঘরের সামনে উপস্থিত হলেন।

আমার সেই মুহুর্তের অসতর্ক মাথা আর যাই হোক এটা প্রত্যাশা করেনি। এখন স্বীকার করি আসলে ধাক্কা খেয়েছিলাম। আমরা দাঁড়িয়ে আছি একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ীর সামনে। যেই মহিলাকে আমরা খুঁজছি তিনি তারই স্ত্রী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কক্সবাজার এয়ারপোর্টের একপাশ থেকে বস্তি উচ্ছেদ করে আরেকপাশে স্থানান্তরণ করা হয়, আসকর আলীও সপরিবারে উচ্ছেদকৃত হন।

আমি তার সামনে ন্যুজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, আর আমার সামনে পুরো বাংলাদেশ ন্যুজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি কোন কথা বলি না, আমি সমবেদনা জানাতে চাইনা। নিজের নগ্নতার লজ্জা নিয়ে সমবেদনা জানানোর কোন সাহস হয় না।

একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর খাঁটি কৃতজ্ঞতা স্পর্শ করে সবাইকেই। যেই মহৎ একাগ্রতা তাকে প্রয়োজনীয় ঔষুষ সরবরাহ করেছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি লজ্জিত হই। ব্যক্তির সাহায্য গ্রহণে হইনা, রাষ্ট্রের নির্লজ্জতায় লজ্জিত হই।

এই সেই সাদা হাত কঠোর লুটতরাজ/বানিজ্য/ ঔপনিবেশ থেকে মহান মানবতাবাদী সাদা রং। আমার সামনে শতকের পর শতক জ্বলজ্বল করে ওঠে। ব্যক্তি সাদা হাতে আমার কোন বিদ্দ্বেষ নেই। নেই যেমন অন্য রং এ। কিন্তু ইতিহাসের লজ্জা আমি মুছব কি করে। স্বয়ং সম্পূর্ণ না হবার চেষ্টা করবার লজ্জা, দারিদ্রের লজ্জা আমি মুছবো কি করে? ডাকাতের কাছে ঘর ছেড়ে দেবার লজ্জা আমি মুছব কি করে?
নিপূণ পেশাদ্বারীতে শিক্ষিত ফটফট ইংরেজী বলে বলে আমি আমার কাজ করতে থাকি.....দালাল/নৃবিজ্ঞানী/ট্রান্সলেটর কত না ভূমিকার। আর আমার ভেতরটা কাঁদতে থাকে; সাদা চামড়ার কাছে নগ্ন হবার কান্না নয় নিজের আব্রু রক্ষা/বহাল/অধিকার না করার কান্নায় আমার মধ্যে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
উদারনৈতিক রাষ্ট্রের বাহাস, শ্রেণী শোষণ, নব্য উন্নয়নবাদী গিনিপিগ এবং আমাদের অসারতা বোবা কান্নার মত রক্তক্ষরণ ঘটাতে থাকে।