আমার নিজের চলা ফেরা, পোশাক-আশাকের ব্যাপারে আমি যথেষ্ঠ কনফিডেন্ট। এই অর্থে যে, যা পরি, বুঝে পরি, যেভাবে হাঁটি জেনেই হাঁটি। নিজস্ব বোধ বুদ্ধি বিচার-বিবেচনার সাথে পরিস্কার হয়েই পরিচ্ছন্ন ভাবেই করি। তবে নারী বলে রাস্তা-ঘাটে বিকৃত যৌনতার শিকার হইনি, এমন নয়। একবার শাহবাগ থেকে মিরপুর টু গুলিস্তান বাসে চড়ে মিরপুরে ফেরার জন্য বাসে উঠতেই হেলপার বুকে একটা মোচড় দিয়েছিল, মানে স্তনের পুরো গোলার্ধ ধরেই মোচড় আর চাপ দিয়েছিল; তখন রাত সাড়ে দশটা। আমি ছাড়ি নি। ওই হাত শক্ত করে ধরে টান দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে কসিয়ে এক চড় মেরেছিলাম। সে রাতে বাসায় না ফিরে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। কিছু বলিনি, শুধু বারান্দায় বসে কেঁদেছিলাম। বুকে অনেক দামি সুগন্ধি ঘষেছিলাম। কিন্তু মনের ভেতর জমে থাকা ওই পঁচা-গলা, নষ্ট গন্ধ তাড়াতে পারি নাই; তৎক্ষণাত, সময় লেগেছিল বেশ। কিন্তু সেটা বছর আটেক আগের কথা।
কিন্তু এই তো গত ১৫ মার্চ ২০০৮ সালে আবার যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম, মুখোমুখি না বলে, যা হজম করলাম, ওটা গত ২৩ বছর ধরে ঢাকা শহরে বসবাস করে কোনদিন ফেইস করিনি। মনে হয়েছিল ২০০৪ সালের রাজশাহি জেলার বাগমারা যেন মিরপুরের মাজার রোড এলাকা। যেখানটায় থাকি সেটা বাতেন নগর আবাসিক এলাকা। আবাসিক এলাকার যাবতীয় ইনফ্রাষ্ট্রাকচার, খেলার মাঠ, ঢোকার মুখে গেইট, তত্ত্ব-তালাশ গেইটম্যানের সবই আছে। তাই আপাত: নিরাপদ এলাকাই বলা যায়। রোজকার মতো ওই দিনও বিকেল বেলায় বেরিয়েছিলাম বাঙলামটর যাবো। ওখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুবাইয়াৎ ফেরদৌস আর দীপায়ন খীসার সঙ্গে একটা গোল টেবিল আয়োজন নিয়ে পরিকল্পনা বিষয়ক আলাপ ছিল। বাসা থেকে বেরিয়ে আমি আর আমার লাইফ পার্টনার (স্বামী বা স্ত্রী শব্দটা আমরা কেউই ব্যবহার করি না) সুমন সিএনজি অটো রিক্সা খুঁজছিলাম। সিকিউরিটি গেটের কাছাকাছি আসলাম মাত্রই একজন বয়স্ক মতো দাড়ি-টুপিওলা আমাদের দুজনের মধ্য থেকে আমাকে থামালেন।
আমি দাঁড়ালাম। প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম, কি বিষয়?
বললেন, ‘তোমার চলা ফেরা, পোশাক আশাক আমাদের পছন্দ না।’
‘মানে?’
মানে এই যে ছোট জামা-কাপড় পরো, ওড়না একপাশ দিয়া আরেক পাশ খালি রাখো, এসব অসভ্যতা।’
আমি রিপোর্টার, মাথা ঠান্ডা রেখে তার উদ্দেশ্য বোঝা আমার প্রাথমিক কাজ, জিজ্ঞেস করলাম,
‘কারা বলছে এসব?’
কাউর আবার বলা লাগে নি? সবাই বলে।’ বুঝলাম একটা গ্র“প আলোচনা করে পরিকল্পনা ঠিক করেছে আমাকে হ্যারেজ করবে আর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাকে।
এবার গলা চড়া করলাম,‘সবাই, আপনার সবাইটা কারা?
‘আবার গলা চড়াই জিগাও বেতমিজ মাইয়া। মাথায় কাপড় দেও। মাথায় কাপড় দিয়া চলা ফেরা করবা।’
এবার সুমন তার পাঞ্জাবীর কলার ধরে জিজ্ঞেস করলো, কাদের লগে কথা কইতাছস, বুঝতাছস?’
সুমনের এলিট ক্লাস বুঝিয়ে জব্দ করার কৌশল কিছুই কাজে লাগে নাই। কারণ সে পরিকল্পিতভাবেই এগুচ্ছিল।
রাগের চোটে আমার গলা দিয়ে শব্দ স্বাভাবিকের বদলে চিৎকার হয়ে বের হওয়া শুরু হলো এবার:
‘আমি জামা পাইরা ঘুরি, না জামা খুইলা হাঁটি, তাতে তোর কি? তুই বলার কে?’ তোরে কি আমি কখনো এই কথা বলছি, তুই জামা কাপড় খুইলা হাঁট, আমার অর্ডার। বলছি? তো তুই বলবি ক্যান?
এবার ওই দাড়ি-টুপি বুড়া আরো উত্তেজিত, ‘চ্যাটের বাল হইছো, যা বলছি, এ এলাকায় থাকলে মাথায় কাপড় দিয়া ঘুরবা।’
এর মধ্যে অনেক লোক জমে গেল। দুই পক্ষকে থামানোর আলগা মাতবরি করা শুরু করলো তারা, সমঝোতার নামে। রাগে গা ভয়ঙ্কর কাঁপছিলো। হাত প্রায় উঠে আসে তাকে চড় মারার জন্য। কিন্তু করলাম না। খালি বললাম, ‘তুই যদি বুড়া ব্যাটা না হইতি, এমন এক চড় দিতাম, সারা জীবন গালের মধ্যে ওই পাঁচ আঙ্গুলের দাগ গুনতি।’
এই কথা শুনে উত্তেজিত জনতা আরো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার আশঙ্কায় ওই লোককে একটা বাসার ভেতর ঢুকিয়ে ফেললো। আমি নাম জানতে চাইলাম, কেউ আমাকে তার নাম পরিচয় বললো না। বললো এলাকার মুরুব্বি। মানে, ওরা দাঁড়ি টুপিওলা ধর্মান্ধ পশুটাকে সরিয়ে ফেলে এবং নাম পরিচয় না জানিয়ে তাকেই সমর্থন করলো।
আমার মন খারাপ হয় নাই, প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়েছে। মেজাজ খারাপ হয়েছে এ জন্য যে, পোশাকে আমার কতখানি ব্রেষ্ট বোঝা যায়, পাছার কতখানি দৃশ্যমান হয় আর আমার ছোট চুল - মেয়েদের চুল এমন হবে কেন এই অস্বস্থি তাদের এমন উগ্রতায় ঠেলে দিল যে আমার পক্ষে একটা লোকও কথা বললো না! আমার মেজাজ গরম হয়, প্রচন্ড। মেজাজ গরম থেকে মন খারাপ করা কান্না,ঠেলে আসতে থাকে গলায়। মনে হয়, এই ২৩ বছরের পুরনো, আমার চির চেনা ঢাকা শহর কি রাজশাহীর বাগমারা হতে চলেছে? কিছু জঙ্গীর ফাঁসি হয়েছে, কিন্তু উগ্র ধর্মান্ধ, এক্সট্রিমিষ্টদের চর্চা কি ফাঁসিতে সমাধান মিলেছে?
৮ বছর আগের ঘটনা বিকৃত তরুণের বিকৃত য়ৌণতা, সুযোগের অপেক্ষায় থাকে যে যৌণ বিকৃতি। আর এইটা পরিকল্পিত পদক্ষেপ। ৮ মার্চ নারী নীতি ঘোষণার পর উগ্র ধর্মান্ধদের চেঁচামেচি, সেখান থেকে হুংকারের ফসল হলো এ পরিকল্পনাগুলো। শুনেছি আরো একজন কর্মজীবী নারীও এমন শিকার হয়েছেন, সম্প্রতিই। আরো অজানারা হয়তো হচ্ছেন অথবা হবেন, কারণ নারীর জন্য স্বাধীন, নিরাপদ কিছু হলে সেটা যে ভয়াবহ কাল হবে ধর্মান্ধ, এক্সট্রিমিষ্টদের জন্য, এটা ওই জানোয়াররা ভালো করেই জানে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, স্বাধীন নারীকে টার্গেট করে মাথায় কাপড় দেয়ার আদেশ-কিসের ইশারায়/খুঁটির জোরে হচ্ছে?
শামীমা বিনতে রহমান
টেলিভিশন সাংবাদিক, ঢাকা।