দান দান, তিন দান- মুসাফির দেখার জন্য হলে প্রবেশ করার সময় মাথায় এই লাইনটা ঘুরছিল। ঘুরার কারণ সহজ- পরিচালক আশিকুর রহমান এর আগে দুটো সিনেমা বানিয়েছেন- যেগুলোর ট্রেলার অনেক চকচকে থাকলেও, সিনেমা দুটো দেখে হতাশ হয়েছি। মুসাফির তার তিন নাম্বার সিনেমা, মুসাফিরের ট্রেলারও বেশ দারুণ ছিল, এবারও তাই ভাবছিলাম- আবার কি আগের মতই? কিন্তু সিনেমা শেষ জবাব নিজের মুখ দিয়েই বেরিয়ে আসলো- নাহ, এবার ঠিক আছে, বলতে গেলে ট্রেলারের চেয়ে বেশিই ঠিক আছে
দশ বছর জেল খেটে অবশেষে বের হয় আরেফিন শুভ। প্রতিশোধ নিতে চায় তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে খুন করে, যার কারণেই তাকে ১০ বছর জেলে কাটাতে হয়েছে।তবে এই দশ বছর সে সময় অপচয় করেনি, জেলে সে নিজেকে একজন দক্ষ ফাইটার হিসাবে তৈরী করেছে। প্রশিক্ষণ নিয়েছে তারই সাথে জেলে থাকা একজন ফাঁসির আসামীর কাছ থেকে যে একসময় সিক্রেট সার্ভিস অফ বাংলাদেশের একজন এজেন্ট হিসাবে কাজ করত।জেল থেকে বের হয়ে শুভ আবার জড়িয়ে পড়ে অপরাধে।ধরা পড়ে যায় সিক্রেট সার্ভিসের প্রধান কর্মকর্তা মিশা সওদাগরের কাছে।মিশা তাকে প্রস্তাব দেয় ড. জারা কে খুঁজে বের করার জন্য যে সিক্রেট সার্ভিসের বেশ কিছু গোপন তথ্য নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে।তাকে খুঁজে বের করে জীবিত অবস্থায় সিক্রেট সার্ভিসকে ফেরত দিতে পারলেই মুক্তি পাবে শুভ।খুঁজেও পায় শুভ-ড. জারাকে। কিন্তু এইসময় তাদের পিছে লাগে টাইগার রবি আর তার ভাই রাজ (সোহেল রানা)।তাদের টার্গেট ডক্টর জারার মৃত্যু।কিন্তু সবাই ড. জারাকে মারতে চায় কেন?
সিক্রেট সার্ভিস, সিক্রেট এজেন্ট, এসপিওনাজ- এই ধরনের শব্দগুলো হলিউড বা বলিউড সিনেমার ক্ষেত্রে শুনলেও, বাংলাদেশে এইসব জিনিস নিয়ে গোটা একটা সিনেমা সম্ভবত এই প্রথম। আর সবচেয়ে আশার ব্যাপার হচ্ছে এইসব জিনিসকে অনেক স্মার্টলি হ্যান্ডেল করেছেন পরিচালক আশিকুর রহমান। সিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, পরিচালনা- সব একাই সামলেছেন এবং বেশ ভাল সামলেছেন। সিনেমার পজিটিভ আর নেগেটিভ দিকে চলে যাচ্ছি সরাসরি-
১- সিনেমার গল্প- মৌলিক। কোন তামিল তেলগু থেকে মেরে দেয়া না। চিত্রনাট্য টানটান আর খুব এঙ্গেজিং- বিশেষ করে ফার্স্ট হাফ তো দুর্দান্ত। সিনেমাকে আশিকুর রহমান কোথাও খুব বেশি ঝুলে যেতে দেননি। একের পর এক বাঁক সিনেমার দর্শকদের মনোযোগ আটকে রেখেছিল। সংলাপ খুব পাওারফুল আর খুবই ইউনিক। "আইন মানুষের পোশাকে থাকে না, আইন থাকে মানুষের মনে" এই ধরনের কিছু সংলাপ মাথায় ঘুরপাক খায়। যখনই সিনেমাতে সিক্রেট এজেন্ট নিয়ে একটু টানা কথা বলা হচ্ছিল তখনই কমিক রিলিফ বা একশন সিকুয়েন্স এসে সিনেমাকে বোরিং হতে দেয়নি। আর সিনেমার শেষের টুইস্ট নিয়ে আর বললাম না- দারুণ ছিল। ক্রেডিট অল গোজ টু আশিকুর রহমান।
২- সিনেমার একশন- এক কথায় ফার্স্ট ক্লাস! একদম খাঁটি একটা একশন সিনেমা হইসে মুসাফির নিঃসন্দেহে। নাইফ ফাইটিং, হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট, গোলাগুলি- কি নাই সিনেমাতে! এমনকি parkour পর্যন্ত আছে এই সিনেমাতে! parkour জিনিসটা খোদ হলিউডেই খুব হাতেগোনা কিছু সিনেমাতে দেখা গেছে। পাশের দেশেও parkour জিনিসটা সিনেমাতে নাই বললেই চলে। বলিউড এ মাত্র তিনজন ব্যক্তি parkour পারেন আমার জানামতে- অক্ষয় কুমার, বিবেক অবেরয় আর হালের টাইগার স্রফ। সেখানে বাংলা সিনেমাতে parkour দেখাটা অন্যরকম এক্সপেরিয়েন্স। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি অলিগলিতে parkour এর এরকম একটা সিকুয়েন্স ধারণ করার জন্য পরিচালক আর একশন ডিরেক্টরকে দুইটা বিরাট থাম্বস আপ (y) (y) সিকুয়েন্সটা আর একটু বাড়ালে আরও খুশি হতাম :p
৩- অভিনয়ে সবাই ভাল। আরেফিন শুভ অ্যাসাসিন ক্যারেক্টারে বেশি জোস। প্রচুর খেটেছেন তিনি এই সিনেমার জন্য সেটা প্রতিটা একশন সিকুয়েন্সে স্পষ্ট। ড্যামকেয়ার আচরণ,ডায়লগ ডেলিভারিতে আগের চেয়ে উন্নত হওয়া, এক্সপ্রেশনে আগের চেয়ে উন্নত- সবকিছু তাকে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য বানিয়েছে। এছাড়া তার হাইট আর ফিজিক তো আছেই। মিশা সওদাগর আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা এসেট, এটা সম্পদ। সিনেমাতে তিনি কি আসলেই ভাল, না খারাপ- সেটা বুঝতে আপনার বেশ সমস্যা হবে আর এখানেই তার অভিনয়ের সার্থকতা। টাইগার রবি সবসময় যেমন করেন, তেমনই, তবে কিছু জায়গায় আগের চেয়ে ভাল। তার সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার বিরাট সাইজের শরীর,সেটা দেখলেই ভয়ঙ্কর লাগে। সিনেমার ছোট ক্যারেক্টারগুলো অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছে- টাইগার রবির ভাই চরিত্রে সোহেল রানা,আশ্রয়দাতার ক্যারেক্টারে দেবাশিষ বিশ্বাস,নার্স ক্যারেক্টারে সিন্ডি রোলিং, কসাই ক্যারেক্টারে জাদু আজাদ আর কন্ট্রাক্ট কিলার ক্যারেক্টারে(যিনি এতটাই ভয়ঙ্কর যার কোন হাতের ছাপ আর ছবি পুলিশের রেকর্ডে নেই) শিমুল খান- দে অল আর জাস্ট অসাম- বিশেষ করে শিমুল খান আর সোহেল রানা। সীমিত সময়ে এই দুইজন অসাধারণ কাজ করেছেন। আফজাল শরীফ কে অনেকদিন পর কমেডিয়ান ছাড়া অন্য একটি ক্যারেক্টারে দেখে ভাল লেগেছে। ভাল লেগেছে ইলিয়াস কোবরাকেও।
৪- সিনেমার গান-শ্রুতিমধুর। টাইটেল সংটা র্যাপ স্টাইলে গাওয়ার কারণে বেশি জোস লাগে। বিশেষ করে- আমারই আদালত, আমিই বিচারক, হত্যা করি পাপি না মানী স্বর্গ মর্ত্য- এই অংশটুকু। তাহসানের বিরুদ্ধে কমন অভিযোগ হল তিনি রোম্যান্টিক গান ছাড়া আর কোন গান করেন না বা পারেন না।পথ জানা নেই নামক রক ধাঁচের গানটা করে তিনি এই ধারণা পরিবর্তন করলেন। আলতো ছোঁয়া গানটা ভাল লেগেছে বেশ, বাকি গানগুলো আর তাদের কোরিওগ্রাফি, দৃশ্যধারণ ভাল।
৫- যার অভিনয় নিয়ে আলাদা একটা পয়েন্টে না বললেই নয়, তিনি হলেন বান্টি চরিত্রে অভিনয়কারী হারুন রশিদ। সিনেমাতে তিনি দারুণ কমেডি রিলিফ হিসেবে ছিলেন। কোন ভাঁড়ামি না করে, স্থূল রসিকতা না করে শুধু ডায়গল ডেলিভারী দিয়ে দর্শককে প্রচুর হাসিয়েছেন।দর্শক অপেক্ষা করেছে তার জন্য- এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।
এবার একটু সমালোচনা বা নেগেটিভ সাইড-
১- নায়িকা চরিত্রে অভিনয়কারী মারজান জেনিফার প্রথম সিনেমা এটি। প্রথম সিনেমাতে যে তিনি খুব ভাল করবেন সেটা আশা করিনি, তবে যেহেতু তাকে গল্প করে সিনেমা, সেহেতু তার কাছ থেকে আরও ভাল কিছু আশা করাটা খুব বেশি চাওয়া হয়না। বিশেষ করে কান্নার দৃশ্যে তাকে আরও ভাল করতে হবে। সিক্রেট এজেন্ট হিসেবে তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সিক্রেট এজেন্টের মত ছিলনা।
২- ভিএফএক্স। জাদু আজাদের সাথে আরেফিন শুভর চলন্ত ট্রেনের ছাদে একটি একশন সিকুয়েন্স আছে, সত্যিকারে এটি করা যেহেতু সম্ভব না, সেহেতু পরিচালক সাহায্য নিয়েছেন ভিএফএক্সের। কোন দরকার ছিলনা এটা করার।ট্রেনের ভেতরে তাদের একশনটাই যথেষ্ট উপভোগ্য ছিল।এমনিতেই বাংলা সিনেমার বাজেট কম থাকে,ভাল VFX এর জন্য অনেক বেশি বাজেট দরকার। সেটা যেহেতু নাই সেইক্ষেত্রে কম বাজেটে এই ধরনের দৃশ্য করলে সেগুলো অবাস্তব লাগে।
৩- একশন দৃশ্যগুলোর বেশ কিছু জায়গায় ক্যামেরা শেকি ছিল।একশন দৃশ্যে বেশি কাট থাকলে সেটা জমে ভাল। আর একটু বেশি কাট থাকলে ভাল লাগতো।
৪-সিনেমার একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে বাই রোড জার্নি। সেখানে বিভিন্ন জায়গার নাম মেনশন করা হলেও ঘুরে ফিরে বেশিরভাগ জায়গা কিছু নির্দিষ্ট জায়গার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল।
৫- সিনেমাতে আশিকুর বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু ক্যারেকটার সৃষ্টি করেছেন- সোহেল রানা,নার্স ক্যারেক্টারে সিন্ডি রোলিং, কসাই ক্যারেক্টারে জাদু আজাদ আর কন্ট্রাক্ট কিলার ক্যারেক্টার শিমুল খান। কিন্তু এদের স্ক্রিন টাইম অনেক কম হয়ে গেছে। এদেরকে আরও কিছু সময় দেয়া দরকার ছিল।ইলিয়াস কোবরার ক্যারেক্টারটাও হঠাৎ কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে গেল!
৬- সিনেমার সব ফাইট সিকুয়েন্স দারুণ হলেও শেষেরদিকে শুভর সাথে টাইগার রবির ফাইট সিনটা খুব একটা জমেনি। আরও ভাল আশা করেছিলাম এটা।
২০১৬ সালে এখন পর্যন্ত দেখা আমার মতে বেষ্ট সিনেমা হল মুসাফির। খুবই এঞ্জয় করেছি- যাকে বলে একদম পয়সা উসুল সিনেমা। বাংলাদেশে এই ধরনের সিনেমা দেখব, সেটা গত কয়েকবছর আগেও ভাবিনি। পরপর দুইটা 'নট আপ টু দ্যা মার্ক' সিনেমা দিয়ে আশিকুর রহমান এভাবে দারুণ কামব্যাক করবেন সেটা ভাবিনি। সিনেমার কনসেপ্ট যে শুধু মৌলিক তা নয়, সিনেমার শেষটাও দারুণ করেছেন আশিকুর। মুসাফির পার্ট টু এর ইঙ্গিত দিয়েছেন যিনি- যেটা নিঃসন্দেহে যারা মুসাফির দেখেছেন তাদের জন্য আনন্দের সংবাদ। টিকেট কাউন্টারের লোকের সাথে (শ্যামলী সিনেপ্লেক্স) কথা বলে জেনেছি- দর্শক সমাগম নাকি বেশ সন্তোষজনক।
পুনশ্চ- মুসাফির নামে একটি হিন্দি সিনেমা আছে, সঞ্জয় দত্ত আর অনিল কাপুরের, ২০০৪ সালের। মুসাফির নামের একটি মালায়ালাম সিনেমাও আছে- ২০১৩ সালের। নিন্দুকেরা যদি ভেবে থাকেন, আশিকুরের সিনেমা এই দুইটা সিনেমা থেকে মেরে দেয়া আর সেটা ভেবে যদি খুব উৎসাহী হয়ে উঠেন, তাহলে আপনাদের সেই গরম উৎসাহে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিচ্ছি আমি। তিনটা সিনেমাই আমি দেখেছি আর তিনটার কারো সাথেই কারো নামে মিল নাই- নাম ছাড়া। বিশ্বাস না হলে ইউটিউব থেকে কষ্ট করে দেখে নিতে পারেন।
ইউটিউব এ কয়েকদিন আগেও ইংরেজিতে মুসাফির লিখে সার্চ দিলে ২০০৪ সালের সিনেমাটা সবার আগে চলে আসতো।আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে এখন ইংরেজিতে মুসাফির লিখে সার্চ দিলে আশিকুরের মুসাফিরের সাজেশন সবার আগে আসে। আনন্দের পরিমাণটা এর চেয়েও বাড়বে যদি আপনি হলে গিয়ে সপরিবারে এই সিনেমাটা দেখেন। এই সিনেমার প্রোডিউসার হচ্ছে ঢাকা ভার্সিটির সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক- জোবায়ের আলম। একজন আলু পটলের ব্যবসায়ী সিনেমার প্রযোজক হলে সেই সিনেমার কি অবস্থা হয় আর একজন শিক্ষিত মানুষ যার সিনেমার প্রতি অনুরাগ আছে, তিনি সিনেমার প্রযোজক হলে কি অবস্থা হয়- তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে মুসাফির। মুসাফির টীমকে স্যালুট।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:৫১