"তোমার চাকরিটা তাহলে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত রাজিব?"
সুন্দর করে ভাতের নলা তৈরি করেছিল রাজিব, বাবা আব্দুর রহমানের প্রশ্ন শুনে ভাত মুখে ঢুকাতে গিয়ে বিষম খেল! অবস্থা ঠিক হওয়ার বদলে আরও বাজে হয়ে গেল, রাজিব কাশতেই লাগলো। রান্নাঘর থেকে রাহেলা বেগম দৌড়ে এলেন। "পানি খা বা, পানি! নিশ্চয় কেও তোর নাম নিয়েছে" বলে একমাত্র ছেলের পিঠ মালিস করতে লাগলেন। রাজিব একটু ধাতস্ত হল।
আব্দুর রহমান প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। যেই ছেলে সামান্য একটা প্রশ্ন শুনে ভাত খেতে গিয়ে গুবলেট পাকায়, তার চাকরি হবে কীভাবে? আর হলেও করবে কীভাবে? বাবা হিসেবে অতি সামান্য একটা প্রশ্ন করেছেন তিনি, এটার জন্য এরকম রিএকশন দেখাতে হবে ক্যান? তার একটামাত্র ছেলে তাকে এত ভয় পায় কেন সেটা তিনি কিছুতেই ভেবে পাননা! হ্যাঁ, ভার্সিটি পাশ করে ছয় মাস ধরে ঘরে বসে থাকা একমাত্র ছেলেকে তিনি মাঝে মাঝে বকাঝকা করেন, ছেলেও চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনে যায়। কিন্তু তারমানে তো এই না যে তিনি তার ছেলের খারাপ চান! কবে যে বুঝবে! হয়ত আমি চলে গেলে বুঝবে- মনে মনে এই কথা বলেন। অনেক বলার পরে এতদিনে তার আশা পূরণ হয়, আজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে তিনি রাহেলার কাছ থেকে জানতে পারেন, কি একটা কোম্পানিতে নাকি তার ছেলেটার চাকরি হয়েছে, আগামীকাল থেকে জয়েনিং। বিগত ছয়মাস অনেক আশার কথা শুনে হতাশ হয়েছিলেন রহমান সাহেব, এবারও ভেবেছিলেম এমন কিছু হবে, তবে রাহেলা বললেন- এবার নাকি আসলেই পাকা! পাকার খবর শুনে মন খারাপের আরেকটা কারণ আছে, এই কথাটা সরাসরি বাবাকে বলা যেত না? মায়ের কাছে কেন সব বলতে হবে? পাকাটা আসলেই কতটা সত্য সেটা জানার জন্যই একটা নিরীহ প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু...খাবার শেষ না করেই ডাইনিং টেবিল থেকে বিদায় নেন রহমান সাহেব।
বিদায় নেবার আগে শুনতে পান, পিছন থেকে তার ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে- হ্যাঁ, বাবা, এবার আসলেই হচ্ছে, কালকে সকালে অফিস।
বাবা শুনলেন কিনা, রাজিব বুঝতে পারর না। "বাবা, আপনি কি শুনেছেন?" এটা বলার মত কলিজাও তার হয়নি।বাবাকে ভয়ের চেয়ে শ্রদ্ধাটা সে বেশি করে, সেটাই সে আজ পর্যন্ত বুঝাতে পারল না। এমনিতে সে দুটো ভাষা পারে- বাংলা আর ইংরেজি, কিন্তু বাবার সামনে গেলেই সে কীভাবে যেন জিব্বা থাকা সত্ত্বেও বোবা হয়ে যায়। ভার্সিটি পাশ করে ছয় মাস চাকরি না পেয়ে যেই মানুষটাকে সে এই বয়সেও কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে, এই অপরাধবোধই মনে হয় তার বাবার সামনে তাকে বোবা বানিয়ে রাখে। তার নিজের খুব একটা দোষ ছিল না, দেশের অবস্থা খুব একটা ভাল না, খালি রাজনীতির "ক্যাচাল"। তবে এবার চুপ থাকার দিন শেষ, বেতন পেলে বাবা আর মায়ের জন্য কি কি কিনবে, সব ভেবে রাখা আছে তার- পুরাই গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল অবস্থা! কষ্টের আঁধার কেটে যাওয়ার সময় হয়েছে, কাল থেকেই তার নতুন সকালের শুরু। নিজের বিছানায় শুয়ে এই সমস্ত কিছু ভাবতে থাকে রাজিব। ঘড়ির দিকে তাকায়, আজকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে, পরীক্ষার আগের রাতে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলে, কিন্তু প্রথম কর্মদিবসের আগের রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার কথা কেও বলে না।বাতি নিভানোর আগে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল রাজিব, বেকার জীবনের শেষ তারিখটা মনে রাখতে চায় সে।
তারিখটা ছিল, ২৫ শে মার্চ, ১৯৭১!
সেই ভয়াল রাতে রাজিব, আব্দুর রহমান আর রাহেলা বেগম- কেও বাঁচতে পেরেছিলেন কিনা, সেটা ২০১৬ সালের ২৫ শে মার্চে বেঁচে থাকা শাহরুখ সাকিব জানে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:১৬