দেশের নাটক সিনেমা নিয়ে অনেকদিন কথা বলি না। পেটের ভিতর জমে থাকা কথাগুলো খুলে বলতে ইচ্ছা করল আজকে। কতদিন বাঁচি ঠিক নাই, তাই বলে ফেলি কথাবার্তা :p
১- দীপ্ত টিভি নামের একটা চ্যানেল আছে বাংলাদেশে, সেটা কি আপনি জানেন? আপনার টিভিতে কি এই চ্যানেলটা আসে? না আসলে কেন? আপনি কি জানেন না এই নামের কোন চ্যানেল আছে নাকি বাংলাদেশের আর কোন চ্যানেলই আপনাকে বিনোদিত করতে পারছে না as a দর্শক, সো শুধু শুধু নতুন কোন চ্যানেল কেবল লাইনে যোগ করার মানে হয়না।। গত ১৮ নভেম্বর এই চ্যানেলটা আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। প্রচারে কম খরচ করেনি। ঢাকার নামীদামী জায়গায় নিজেদের প্রোগ্রামের বিলবোর্ড বসানো থেকে শুরু করে সব ধরণের প্রচারনাই তারা করেছে- একটাও কি আপনার চোখে পড়েছে নাকি আপনি ইচ্ছে করে চান নাই যে চোখে পড়ুক? আপনি কি জানেন TRP rating এ এই চ্যানেলটি এখন বাংলাদেশে দেখা এক নম্বর বাংলাদেশী চ্যানেল? (তাদের ফেসবুক পোস্টের ভাষ্যমতে)
কি হয় এই চ্যানেল? ধারাবাহিক নাটক থেকে শুরু করে সব ধরণের প্রোগ্রামই হয়। কিন্তু বেশ বড় একটা সমস্যা আছে। এদের প্রায় সব ধারাবাহিক জি বাংলা আর স্টার জলশার অনুকরণে বানানো! সিরিয়ালের নাম থেকে শুরু করে পোশাক, চুলের বেনি করা,ক্যামেরা প্যান করা (একপাশ থেকে আরেক পাশ ঘুরানো), টিল করা (উপর থেকে নিচে ঘুরানো),ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক -সব! কলকাতার সিরিয়াল যারা দেখেন, তারা খেয়াল করে দেখবেন- তাদের বেশিরভাগ সিরিয়াল সিরিয়ালের মেইন নামে পরিচিত না হয়ে, সেন্ট্রাল ক্যারেক্টারের নামে পরিচিত হয়। যেমন- পাখি বা কিরণমালা। পাখি চরিত্রে অভিনয়কারি মেয়েটার আসল নাম কি, ইভেন পাখি না কিরণমালা ক্যারেক্টারটা সেই সিরিয়ালে অভিনয়ে করছে- সেই সিরিয়ালের নাম কিন্তু আমাদের (বিশেষ করে আমাদের মা খালাদের) মাথায় থাকে না। সেম কাজ করা হচ্ছে দীপ্ত টিভি তে। এখানে প্রচার হওয়া নিয়মিত ধারাবাহিকের নাম হচ্ছে- পালকি, অপরাজিতা, খুঁজি ফিরি তাকে- সপ্তাহের ছয়দিন এগুলো রাতের বেলা প্রচার করে দিনে রিপিট টেলিকাস্ট করা হয় (এখানেও সেই জি বাংলা স্টাইল।) পালকি সিরিয়ালের মেইন ক্যারেক্টারের নাম পালকি, অপরাজিতা সিরিয়ালের মেইন ক্যারেক্টারের নাম মন্দিরা। আমাদের নাটকে আমরা পিতা মাতার ক্যারেক্টারে অভিনয় করে মানুষদের কি বলে ডাকি? সহজ উত্তর- বাবা, মা। কিন্তু কলকাতার সিরিয়ালে মুসলমান ক্যারেক্টারে অভিনয় করা পিতা মাতাকে "আব্বু , আম্মু" বলা হয় বাবা মা না বলে। মজার ব্যাপার হল- দীপ্ত টিভির সিরিয়ালেও বাবা মাকে "আব্বু আম্মু" বলা হয়! :p
"আচ্ছা সাকিব ভাই, আপনি এগুলা এত বিস্তারিতভাবে ক্যামনে জানেন? তারমানেও আপনিও জি বাংলার সিরিয়াল দেখেন মনোযোগ দিয়া? ছি ছি ছিঃ সাকিব ভাই, আপনার কাছে এটা আশা করি নাই। আপনার রুচি সম্পর্কে ভাল আইডিয়া ছিল, এখন দেখছি আপনার আসলে কোন রুচিই নাই! সস্তা! ছ্যাঃ!" এরকম যাদের এখন মনে হচ্ছে, তারা যা ইচ্ছা মনে করতে পারেন। আমি জি বাংলার সিরিয়াল দেখি না। মাঝে মাঝে চোখে পড়লে গেলে গভীর মনোযোগের সাথে শুধু লক্ষ করি, তারা এমন কি জিনিস দেখায় যেটা থেকে আমাদের মা খালাদের মুক্ত করা যাচ্ছে না কিছুতেই? সব দোষ কি সারাদিন কাজ করে একটু "সহজ" বিনোদনের আশায় টিভি সেটের সামনে বসা আমাদের পরিবারের নারী সদস্যদের? নকল গল্প, নাটকের বদলে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে বেশি নজর দেয়া, চিবিয়ে বাংলা বলা আর্টিস্টদের দিয়ে কাজ করানো, দিন দিন আশংকাজনক হারে নাটকের বাজেট কমে যাওয়া, ঘুরে ফিরে সেই একই মুখ, অযথা নেকামি- এগুলার কি কোন দোষ নাই? কিন্তু এসব থেকে মা খালাদের মুক্ত করার উপায় কি এই যে আমরা হুবুহু তাদের মত নকল করে ধারাবাহিক দেখাব?! শুনেছি দীপ্ত টিভির এই ধারাবাহিকগুলো বানানোর জন্য পরিচালক আর স্ক্রিপ্ট রাইটার কলকাতা থেকে আনা হয়েছে! আমাদের কি গল্পের এতই অভাব? দিন দিন কি আমরা মেধাশুন্য হয়ে যাচ্ছি? আমাদের কাজে আমাদের নিজস্ব অঞ্চলের কনটেন্ট এর কোন ছাপই কি পাওয়া যাবে না? তাদের কাছ থেকে নকল করে আবার তাদের সিনেমা বা নাটক যাতে এই দেশে না আসে সেইজন্য গায়ে কাফনের কাপড় জড়িয়ে মিছিল করা- এগুলা কোন ধরণের ভণ্ডামি আর ডাবল স্ট্যান্ডার্ডগিরি?
শুধু দীপ্ত চ্যানেলকে ধুয়ে দিলাম? সাকিব খারাপ? আচ্ছা, এবার ভাল দিকের কথা বলি। তুর্কি একটা সিরিয়াল এই চ্যানেলে বাংলায় ডাবিং করে দেখানো হয়- নাম সুলতান সুলেমান। বাংলা ডাবিং মন্দ নয়, ডাবিংবিচ্যুতিও কম।শব্দচয়নে সতর্কতা লক্ষণীয়,সন্দেহ নেই, সুলতান সুলেমান একটি প্রাণবন্ত সিরিজ। সারা সপ্তাহ দেখিয়ে শুক্রবারে আমার সারা সপ্তাহের পর্বগুলো একসাথে দেখানো হয়, যারা কাজের ব্যস্ততার জন্য মিস করেছেন তাদের জন্য। ইতিমধ্যে সিজন ওয়ান দেখানো শেষ, সিজন টু ও তাড়াতাড়ি শুরু হবে। এছাড়া দীপ্ত চ্যানেলের আছে নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ আর টুইটার- যেগুলা মাশাল্লাহ ভাল রকমের একটিভ। ইউটিউব এ আপনি তাদের সব প্রোগ্রামের এপিসোড পাবেন। মুক্তিযুদ্ধ আর ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাদের কিছু দুর্দান্ত ডকুমেন্টরি আছে। সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হচ্ছে দীপ্ত টিভি তে বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা নেই বললেই চলে, খুবই কম বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপনেও তাদের অন্যান্য প্রোগ্রামের টিজার দেখানো হয় (এইখানেও জি বাংলাকে অনুকরন, তবে এই ধরণের অনুকরণে আমার কোন আপত্তি নাই। ভাল জিনিস পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে অনুসরণ করাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন সমস্যা দেখি না। মনে রাখতে হবে এই বিজ্ঞাপনের জ্বালাতেই আমরা আমাদের অধিকাংশ দর্শককে হারিয়েছি আর হারাচ্ছি।) দীপ্ত টিভি চ্যানেল ফুল HD- একদম ঝকঝকে তকতকে! এছাড়া দীপ্ত টিভি চ্যানেলে আছে একঝাঁক নতুন অভিনয়শিল্পী। এদেরকে দীপ্তটিভি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওয়ার্কশপ করিয়ে অভিনয় শিখিয়েছে।ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন মানুষদের অনেক দরকার। দীপ্ত টিভি চ্যানেলের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।তাদের কাছে আরও অনেক মানসম্পন্ন প্রোগ্রাম (দেশীয় স্টাইলে) আশা করি।
২- এবার আসি সিনেমাতে। গত চারবছর ধরে মোটামুটি নিয়মিত হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয়, সেটা যার সিনেমাই হোক না কেন।আমার একটা বদঅভ্যাস আছে (!), সিনেমা দেখতে গেলে সিনেমার টিকেট কাউন্টারে থাকা মানুষটা বা সম্ভব হলে হল মালিকের সাথে কথা বলে সিনেমার অবস্থা জানা।খুবই দুঃখের সংবাদ হচ্ছে- আমাদের জনগণেরা বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণী একেবারেই হলে যেতে চান না। বলাকাতে আন্ডার কন্সট্রাকশন দেখতে গেসিলাম দুপুরের শো। পুরো হলে আমি আর আমার ফ্রেন্ডরা সহ দর্শক মাত্র বারজন! :O তার মাঝে একজন আসছেন একটু শান্তিতে ঘুমাতে, বাকিরা এসেছেন প্রেম করতে। টিকেট কাউন্টারের লোককে জিজ্ঞেস করলাম- কোন সিনেমাতেই কি দর্শক বেশি হয়না? তিনি বললেন- না। শাকিবের সিনেমাতে কিছু হয় দর্শক, তবে শাকিবের সব সিনেমাতে না। এরপরে যেই ভয়ঙ্কর তথ্যটি তিনি জানালের সেটি হচ্ছে- ব্যবসা ভাল চলে আর লোক সমাগম হয় শুধু যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলোতে। আমরা যাঁদেরকে "ফকিন্নির বাচ্চা" বলে গালি দেই, তারাই এসব হল বাঁচিয়ে রেখেছে সিনেমা দেখে। আমরা ফেসবুকে লাফানো জনগণ সিনেমা হলে যাই না বলেই কৃষ্ণপক্ষ বা জালালের গল্পের মত সিনেমা মাত্র ১৪ টি করে হল পায়।(এগুলা ভাল নাকি খারাপ সিনেমা, সেটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু না দেখে আমা যদি শুধু ফেসবুকে লাফাই তাহলে, সদ্য সিনেমা নিয়ে রিভিউ পোস্ট করার সাথে সাথেই "ভাই, ডাউনলোড লিংক দেন" বলে চেঁচাই, তাহলে ইন্ডাস্ট্রিটা বাঁচবে ক্যামনে আমারে কেও একটু বুঝায় বলবেন?) সাড়ে বারশ সিনে হল থেকে এখন মাত্র ৩০০ তে নেমে এসেছে সিনেমার হল! পঞ্চগড়ের মত একটি জেলাতে এখনও কোন সিনেমা হল নেই, সব বন্ধ! চিন্তা করেছেন অবস্থা? সিনেমা বানিয়ে যদি চালাতেই না পারি, দর্শককে দেখাতেই না পারি তাহলে লাভটা কই? পঞ্চগড়ে নিম্নবিত্তের যারা সিনেমা দেখতেন হলে গিয়ে, তারা এখন আর যাচ্ছেন না- কারণ মোবাইলের দোকানে মাত্র ১০ টাকায় ৩টা কলকাতার সিনেমা তাদের মোবাইলে লোড করে দেয়া হচ্ছে। এত কম টাকায় এত চটুল বিনোদন একের অধিক পেয়ে গেলে আর কেও ক্যান যাবে সিনেমা হলে? ভাল সিনেমা বা এন্টারটেইনিং সিনেমা- একটাও যদি আমরা বানাতে না পারি, তাহলে কয়দিন পরে এইসব রিকশাওয়ালারাও আর হলে যাবে না। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আর আমরা শুধু আছি একজন আরেকজন কে খোঁচানোর জন্য, ফেসবুকে সিনেমা হিট করার জন্য, "ঢাকা মানেই বাংলাদেশ, অন্য ৬৩ জেলার গুল্লি মারি, সিনেপ্লেক্স এ ভাল চলা মানেই সিনেমা হিট!"- এগুলা করার জন্য। পরিচালক, অভিনেতা, দর্শক, সমালোচক, প্রযোজক, সেন্সর, স্ক্রিপ্ট রাইটার- সবাইকে ঢেলে না সাজালে এই অবস্থা দেখে মুক্তির উপায় আপাতত আমার চোখে পড়ছে না।
এর মাঝে গত কয়েকদিন আগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণা করা হল। বেষ্ট সিনেমার পুরস্কার পেল বৃহন্নলা। অথচ এই সিনেমাটি সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের গাছটা বলেছিল গল্প থেকে মেরে দেয়া, যদিও সিনেমার কোথাও সেটার উল্লেখ নাই! সিনেমার একটি গানের নকল ও আবিষ্কার করা হইসে। নকল করতে করতে আমরা শুধু লজ্জা শরমের মাথা না, পুরা শরীর খেয়ে ফেলসি, প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মত আয়োজন!
সিনেমা হলের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মরহুম প্রিয় পরিচালক তারেক মাসুদ বলেছিলেন- সিনেমা হল না বাঁচলে শাকিব খান না শুধু, কোন "খান"ই বাঁচবে না তিনি চলে গেছেন, আমরা বেঁচে আছি। বেঁচে থাকা আমরা যদি নিজেদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য কিছু না করি যার যার অবস্থান থেকে, তাহলে বেঁচে থাকাই দায়!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:১৮