ছেলেটি চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
এমনিতে সে এভাবে এতটা চুপচাপ থাকে না, কিন্তু এখন সে যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে আসলেই তার গলা শুকিয়ে যায় কেন জানি। অথচ মানুষটা তার মা, যেই মা তাকে দুনিয়াতে এনেছেন! আজকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার একটা বড়সড় কারণ যদিও আছে এবং আজকে গলাটা একটু বেশিই শুকিয়ে গেছে অন্যদিনের তুলনায়।
হানি ইরানি দামী সোফায় বসে আছেন। তার মুখ থমথমে। তার চোখ একবার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তার ছেলের দিকে যাচ্ছে আবার একটু পর তার হাতে থাকা একটি সাদা কাগজের দিকে যাচ্ছে।কাগজটি তার ছেলের কলেজ থেকে এসেছে। কাগজে লেখা আছে- তার ছেলে ক্লাস করতে চায় না, তার ক্লাসে উপস্থিতির নাম্বার অনেক কম। পড়াশুনায় তার মন নেই। শেষ লাইনে সারাংশ লেখা হয়েছে এভাবে- আপনার ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, তাই আমরা তাকে কলেজ থেকে বের করে দিতে বাধ্য হচ্ছি।
হানি ইরানি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিমধ্যেই অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছেন। স্বামী জাভেদ এর সাথে অনেকদিন আগেই ডিভোর্স হয়েছে। সন্তান নিয়ে তিনি আলাদা হয়ে গেছেন। ভেবেছিলেন স্বামীর সাথে আনন্দে থাকতে না পারলেও, সন্তানের সাফল্য হয়ত তাকে আনন্দ দিবে। কিন্তু আনন্দের বদলে তার সন্তান তাকে যা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত- সেটা নিয়ে তিনি চূড়ান্ত রকমের হতাশ। তার ছেলে কলেজ এর সেকেন্ড ইয়ারে অনার্স শেষ না কর বের হয়ে যাবে এটা কোন কথা হতে পারে? কোন মা কি এটা মেনে নিতে পারেন এত সহজে?
হানি ইরানি আর ভাবতে চাইলেন না, রাগে তার গা কাঁপতে লাগলো, ভেবেছিলেন ছেলেকে কিছু কঠিন কথা শুনাবেন, কিন্তু পারলেন না। তার ছেলেটা এমনিতে খারাপ না। কখনও মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়েছে- সে কিচ্ছু বলেনি। চুপচাপ মায়ের সাথে চলে এসেছে। কিন্তু পড়ালেখাটা না করলে যে এই সমাজ ভালোকে কিছুতেই ভাল বলতে চায় না। কি করবে তাহলে তার ছেলে? চিন্তায় ঘুম হয়না মায়ের। "তুমি আমার সামনে থেকে এখন দূর হও! নিজের রুম থেকে আমি যেন বের হতে না দেখি। আজকে থেকে তোমার বাইরে যাওয়া বন্ধ!"
তার এই কথাটা তার ছেলে এতটা সিরিয়াসলিভাবে নিবে সেটা মা নিজেও ভাবতে পারেননি। এরপর থেকে ছেলে আর ঘর থেকে বের হয়না। সারাদিন সে সিনেমা দেখে। দেশ বিদেশের নানারকম সিনেমা। "এ দেখি মহাযন্ত্রণা!" বলে একদিন মা নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না, বাজখাই স্বরে বললেন- সমস্যা কি তোমার? আমাকে কি একটু শান্তিতে থাকতে দিবে না তুমি? সারাদিন সিনেমা দেখার মানে কি? এত সিনেমা দেখে কি হয়? একটা মানুষ আর কোন কাজ না করে কীভাবে সারাদিন সিনেমা দেখতে পারে? আমি আজকে প্রথমবার আর শেষবারের মত বলে দিচ্ছি- আজকে থেকে তুমি যদি অন্য কোন কাজে নিজেকে ব্যস্ত না রাখ, তাহলে আমি তোমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিব! রাস্তায় থাকবে তুমি, কথা মনে থাকে যেন!"
নিজের মায়ের এরকম রূপ আগে কখনও দেখিনি সে! প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। সিনেমার অর্ধেকে ছিল সে, পুরোটা না দেখেই অফ করে দিল! ভাল্লাগে না কিছু তার, সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে- যেখানে কড়া শাসন করার কেও থাকবে না। হঠাৎ মাথায় আইডিয়া খেলে গেল তার! আরেহ, এইসব জিনিস নিয়ে একটি গল্প লিখে ফেলি না কেন ডায়রিতে?
যেই ভাবা সেই কাজ! প্রতিদিন অল্প অল্প করে লিখতে থাকে সে। মা নিজেও খুশি- কলেজে না পড়লেও বাসায় হয়ত তার ছেলে কিছু লেখালেখি করছে। বাবার স্বভাবটা তাহলে পেল ফাইনালি!
মায়ের সামনে চুপচাপ থাকা এই ছেলে তার কাছের বন্ধুদের কাছে কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। শুধু তাই না, এর মাঝেই এক মেয়ের প্রেমেও পতিত হওয়া শেষ তার এবং ২০০০ সালে সেই মেয়েকে বিয়েও করে ফেলল সে! "বিয়ে করেছিস, তো খাওাবি কি বউকে? নাকি তোর বউকেও আমি খাওয়াব?" মায়ের এমন কথায় ছেলে বলল- না মা। তোমাকে বেশি টেনশন করতে হবে না। আমি সিনেমা বানাব। সিনেমা দিয়েই আমি করে খাব।
পরের বছর মুক্তি পেল দিল চাহতা হ্যায় নামের সিনেমা। ডিরেক্টর নতুন এক ছেলে, আগেও কেও নাম শুনে নাই। তবে নামের শেষে "আখতার" পদবী থাকায় সবাই বুঝে গেল- এই ছেলের বাবা কে। বাবা যেই পরিমাণ গুণের অধিকারী, ছেলে বাবার সেই সম্মান রাখতে পারবে তো- এই ভয় ছিল সবার মাঝে। তবে ছেলে পেরেছিল, শুধু পারেনি, এরপরে একটার পর একটা কাজ দিয়ে নিজের বাবাকেও আস্তে আস্তে টপকে যাচ্ছিল সে। আর বর্তমানে সে বলিউড এর ওয়ান অফ দ্যা মোস্ট ট্যালেন্টেড অভিনেতা। জি হ্যাঁ, সেই ছেলের নাম ফারহান আখতার।
দিল চাহতা হ্যায় সিনেমা দেখতে যতটা আরাম বোধ হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে, এই সিনেমা মেকিং এতটা আরামময় ছিল না। হয়তো ভাবছেন, ফারহান আখতার এর ছেলে, তার তো নামই যথেষ্ট। এরকম ভাবলে ভুল করবেন- শুধু আমিরের সাথে দেখা করতে আর হালকা আলাপ করতেই তার প্রায় এক বছরের বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। প্রথমে ভেবেছিলেন- অভিষেক, ঋত্বিক আর শাইনি আহুজাকে নিয়ে দিল চাহতা হ্যায় বানাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাইনাল হল আমির, সাইফ আর অক্ষয় খান্না। এত কষ্টের পরে ফলাফলটা ভাল ছিল। প্রথম সিনেমাতেই ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। সেই সাথে সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা।এই সিনেমাটি যেন বলিউড এর রাস্তাটা বদলে দিল। ক্লিশে একই ধরনের রোম্যান্টিক সিনেমা ছাড়াও অন্যভাবে যে সিনেমা বানানো যায় যেখানে হাসি, আনন্দ, কান্না, ঠাট্টা এবং অবশ্যই বন্ধুত্ব থাকবে- সেটা দিল চাহতা হ্যাঁয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আমিরের ছোট দাড়ি আর ছোট চুলের স্টাইল ভাইরাল হয়ে গেল এই সিনেমা মুক্তির পর। অনেকের মতে দিল চাহতা হ্যাঁয় বলিউড এর নির্মাণ কড়া ওয়ান অফ দ্যা বেষ্ট সিনেমা।
প্রথম সিনেমাতেই এরকম বাজিমাত করার হাতেখড়িটা ফারহানের হয়েছিল অনেক আগেই, ১৭ বছর বয়সে। লামহে এবং হিমালয় পুত্রা নামক মুভিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন এর আগে। সাথে ছিল নিজের আত্মবিশ্বাস আর বন্ধু রিতেশ সিধওয়ানি এর সাপোর্ট ও সহযোগিতা- ব্যস! এগিয়ে যেতে আর কি লাগে?
এরপরে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সিনেমা বানালেন তিনি, যার নাম Lakshya. ঋত্বিক আর অমিতাভের মত অভিনেতাকে একসাথে নিয়ে আসলেন। ঋত্বিকের করা ওয়ান অফ দ্যা বেষ্ট ওয়ার্ক এখন পর্যন্ত অনেকের মতে। হলিউড এর Bride and Prejudice (2004) সিনেমার গানের লিরিক্স ও লেখেন ফারহান এই বছর।
ছোটবেলায় একসাথে অনেক বেশি সিনেমা দেখা তার পরবর্তী জীবনে অনেক বেশি প্রভাব রেখেছিল। এরকম তার জীবনে প্রভাব রাখা একটি সিনেমার নাম হল অমিতাভের ডন। অমিতাভকে এই সিনেমাতে দেখে তিনি একইসাথে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন আবার একইসাথে তাকে প্রচণ্ড ভালবেসেছিলেন। সিদ্ধান্ত সম্ভবত তখনই নেয়া হয়েছিল, যারা পুরনো ডন দেখেনি, তাদেরকে নতুন ডন দেখাবেন তিনি, নিজের স্টাইলে।
প্রথমে ভেবেছিলেন ঋত্বিক কে নিবেন ডন ক্যারেকটারে। কিন্তু মনে হল ঋত্বিকের চেয়ে আরেকটু বেশি বয়সের কাওকে দরকার এই রোলে। অবশেষে শাহরুখ খান নির্বাচিত হলেন। আগের কাহিনী, আগের নাম- শুধু মেকিং স্টাইল আলাদা, পরিচালনার চেয়ারে ফারহান। সবাই সেটা ভেবেই দেখতে গিয়েছিল সিনেমা- তবে বাবার লেখা ডন সিনেমার শেষ অংশটা ফারহান যে সম্পূর্ণ নিজের মত করে বানাবেন আর দর্শকদের বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা দিবেন- সেটা কেই বা জানত! এই সম্পর্কে ফারহান বলেন- আমি যখন অমিতাভের ডন দেখি, তার তার সেই বিখ্যাত ডায়লগ - ডন কে শুধু ধরা মুশকিল নয়, অসম্ভব- এটা বলার ১৫ মিনিটের মাঝে আসল ডন মারা যায়। এই জিনিসটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি, এটা মেনে নিলে এই সংলাপটার সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। এই কারণেই আমার বানানো ডনে আমি শাহরুখ কে আরও বেশি চালাক হিসেবে দেখালাম এবং ফলাফলটা খারাপ হয়নি সেটা দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখেই বুঝেছি।
আপনি তো শাহরুখ আর আমির- দুইজনের সাথে কাজ করেছেন। একটু বলবেন কি দুইজনের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন? দুইজনের কাজের স্টাইল কীভাবে আলাদা? দুইজনের মাঝে কার সাথে কাজে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এক ইন্টার্ভিউতে বলেন -
দেখুন, আপনার শেষ প্রশ্নের ধরনটা একটু problematic. দুজনের সাথে কাজ করেই আমি দারুণ সময় পার করেছি। দুইজনে আমাদের দেশের দুইটা রত্ন। শাহরুখের কথা বলি শুরুতে যেহেতু তার সাথে আমি বেশি কাজ করেছি। অনেক বেশি এনার্জিটিক আর পরিশ্রমী একটা মানুষ। ডন ক্যারেকটারে তাকে নেয়ার এটা আমার অন্যতম কারণ, আমি একজন restless মানুষকে চাচ্ছিলাম, শাহরুখ সেরকম। দিন নাই, রাত নাই সে কাজ করেই যাচ্ছে। আপনি তাকে খাটাবেন, সেও খাটতে থাকবে, যেভাবে বলবেন, সেভাবে করবে। আমার সাথে কাজের সময় সে সবসময় তিনটা শট দিবে কোন এক বিচিত্র কারণে, ১ম আর ২য় শট অনেক ভাল হওয়ার পরেও সে বলবে- আরেকটা দেই। তোমার যেটা ভাল্লাগে সেটা সিনেমাতে রেখে দিও। একদিনের ঘটনা বলি- শাহরুখ তার মেয়ের জন্মদিন সেলিব্রেট করে এসেছে ডন এর শুটিং সেটে। স্বাভাবিকভাবেই সে অনেক বেশি হাসিখুশি সেদিন, অনেক বেশি উচ্ছল। কিন্তু সেদিন তাকে খুব রাগের একটা সিনে অভিনয় করতে হবে। আমি বললাম- তুমি একটু রেস্ট নাও, একটু ক্যারেকটারে ঢুকো। পরে আমরা শটটা নেই ঠাট্টা ইয়ার্কি শেষ হলে। সে বলল- নাহ! আমি এখনই পারব। তুমি ক্যামেরা রোল কর। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা - আমি "একশন" বলার সাথে সাথে মাত্র মেয়ের জন্মদিন সেলিব্রেট করে আসা বাবা এক মুহূর্তে ডন নামের ভয়ঙ্কর এক খুনিতে রূপান্তরিত হল। instant expression এ তার জুড়ি মেলা ভার। দ্রুত একটার পর একটা টেক দিয়ে যাচ্ছে সে। সে শুটিং সেটে আসলে আপনি নিশ্চিন্ত- আপনার বেশিরভাগ কাজ সে নিজের ঘাড়ে তুলে নিবে আর খুব কম সময়ে শেষ করে দিবে। আমি নিজে অনেক ভিডিও গেমস খেলি, শাহরুখ ও ফ্রিক ভিডিও গেমস এর- সো আমাদের বনে ভাল, যদিও আমি তাকে এখনও গেমসে হারাতে পারিনি তবে আমি সিউর একদিন আমি পারব!
এবার আমিরের কথা বলি, আমিরের সাথে সবাই কাজ করতে পারবে না। আমিরের সাথে কাজ করতে হলে আপনাকে অনেক অনেক বেশি ধৈর্যশীল হতে হবে। নিজের ক্যারেক্টারের প্রতিটা ইঞ্চি নিয়ে সে ভাববে। ক্যারেক্টারের হাঁটা চলা, খাওয়া, পোশাক- সব বিষয়ে তাকে জানাতে হবে ডিটেলস। একদিনের কথা বলি- দিল চাহতা হ্যাঁয় তে আমিরকে একটা কান্নার সিনে অভিনয় করতে হবে। আমি বললাম দুইদিন পরে তোমার এই সিনেমার শুট, দুইদিনে আমি বাকিদের দৃশ্য শুট করে ফেলব, তোমার এই দুইদিন শুটে না আসলেও চলবে। কিন্তু সে এসেছিল এই দুইদিন। এসে এক কোনায় একটি রুমে নিজেকে বন্দি করে ফেলেছিল, দুইদিন সে শুধু দুঃখের গান শুনেছিল। এই রুমে অন্য কারো ঢোকা নিষেধ ছিল, এমনকি আমারও! ও বলেছিল এই দুঃখের গান শোনাটা তাকে ঐ কান্নার দৃশ্যে অভিনয় করতে সাহায্য করেছিল। এই হল আমির খান। আপনি যদি আমিরের সাথে ধৈর্য নিয়ে কাজ করতে পারেন একটু কষ্ট করে, তবে বিশ্বাস করেন, দিনশেষে যেটা বের হবে- সেটা দেখে আপনি নিজেই খুশি হয়ে যাবেন। আমির শাহরুখ দুইজনের কাজের পদ্ধতি আর চিন্তাধারা একেবারেই আলাদা, জীবন দর্শন আলাদা- এবং সেটা হওাই স্বাভাবিক। তবে কিছু বিষয়ে তারা এক- একশন বলার সাথে সাথে দুইজন অন্য দুনিয়ার মানুষ হয়ে যায়। দুইজনের ডেডিকেশন লেভেল নিয়ে কোন সন্দেহ নাই।
ডন এর সাফল্য ফারহানকে অন্য উচ্চতায় পোঁছে দিল। তবে এতদিন যেই মানুষটা ক্যামেরার পিছনে ছিলেন, এবার তিনি ক্যামেরার সামনে আসলেন, ফলাফল- এখানেও বাজিমাত! ২০০৮ সালে রক অন সিনেমাতে দারুণ অভিনয় করেন তিনি। সাথে সিনেমাতে নিজের গলায় সবগুলো গান গেয়ে দেখান। সৃজনশীলতার খুব কম জায়গাই আছে যেখানে ফারহান আখতারের ছোঁয়া লাগেনি। কলেজ জীবনের বন্ধু রিতেশ এর সাথে মিলে তৈরি করেন এক্সেল প্রোডাকশন হাউজ। চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্য লেখক, প্রযোজক, অভিনেতা, গীতিকার, শিল্পী এবং উপস্থাপক- আর মনে হয় কিছু বাকি নেই তার করার।
২০০৯ সালে বোন জয়া আখতারের লাক বাই চান্স সিনেমাতে অভিনয় করলেন। এরপরে করলেন সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার কার্তিক কলিং কার্তিক। এই সিনেমাতে শুটিং এর সময় ফারহান প্রথম বাইক চালানো শিখেন ক্যারেক্টারের প্রয়োজনে, এর আগ পর্যন্ত তিনি বাইক চালাতে পারতেন না। লাক বাই চান্সে ভাই অভিনয় করার পড়েই বোন জয়া বলেছিলেন, আমার পরের সিনেমাতেও তুই থাকবি, সেটা হবে একটা গাড়ি নিয়ে তিন বন্ধুর ছুটে চলার গল্প। অবশেষে ২০১১ সালে সেই সিনেমা মুক্তি পেল, নাম জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা। নিজের অসাধারণ অভিনয় দিয়ে তিনি এবার সবার মন জয় করে নিলেন, সাথে করে ঘরে নিয়ে আসলেন ফিল্মফেয়ার এর বেষ্ট সাপোর্টিং রোলের পুরস্কার। এই পুরস্কার এত সহজে আসেনি অবশ্য। সিনেমাতে টম্যাটো ফেস্টিভ্যালের একটা গান ছিল, যেটা দেখতে আমাদের পাঁচ মিনিট লাগলেও শুটিং করতে সময় লেগেছিল তিন দিন। আট ঘণ্টা প্রতিদিন টম্যাটোর মাঝে থাকার পরে ৬-৭ মাসের মত ফারহান আর টম্যাটোর চেহারা দেখেন নি। এই সিনেমাতে তার কিছু কবিতা আবৃতির দৃশ্য ছিল, মজার ব্যাপার সেইগুলো সব তার নিজের লেখা। অদ্ভুত ক একটা কবিতা, প্রতিটা কবিতায় যেন মানুষ তার হারানো সত্ত্বাকে খুঁজে পায় আর দিনশেষে বলে- ".... toh zindaa ho tum"
২০১১ সালেই মুক্তি পেল শাহরুখের সাথে ডন সিনেমার দ্বিতীয় কিস্তি- ডন ২। ফারহান আখতারের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবসাসফল সিনেমা ডন ২। ফারহান শাহরুখ এর জুটি সম্ভবত অনেক নায়ক নায়িকার জুটি থেকেও বেশি সফল, ডন সিনেমার সাফল্য সেটাই বলে।
ফারহান যেই সিনেমাতে অভিনয় করেন, সেটা তিনি নিজে পরিচালনা করেন না। আবার যেই সিনেমা পরিচালনা করেন, সেই সিনেমাতে তিনি অভিনয় করেন না। তার মতে- এতে কাজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, মনোযোগ ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে যায়।
তবে সবচেয়ে কষ্টকর কাজ তিনি সম্ভবত করেন ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ফাইলং শিখ খ্যাত মিলখা সিং এর জীবনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত সিনেমাতে দুর্দান্ত অভিনয় করে। নিজের এখন পর্যন্ত সেরা কাজ তিনি এই সিনেমাকেই মানেন। সপ্তাহে ছয়দিন প্রতিদিন ৫ থে ৬ ঘণ্টা এক্সারসাইজ করে টানা ১৮ মাস পরিশ্রমের পর তিনি মিলখা সিং এর মত ফিগার বানান এবং নিজেকে দৌড়বিদের ক্যারেক্টারে অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত করেন। মজার ব্যাপার হল এই সিনেমার জন্য ফারহান পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন মাত্র এক রুপী। তবে সেই বছরের বেষ্ট অভিনেতার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডতা তার হাতেই গিয়েছিল। মিলখা সিং অনেক বেশি পরিমাণে খুশি হয়েছিলেন ফারহানের পারফর্মেন্সে। এই সিনেমার জন্য ফারহান যেই পরিমাণে প্রশংসা পেয়েছেন, নিজের অন্য কোন পারফর্মেন্সের জন্য এতটা পাননি।
কাজের এত অনুপ্রেরণা তিনি পান সিনেমার জগতের মানুষদের কাছ থেকেই। Robert Di Nero, Martin Scorsese, Ridley Scott, Woody Allen, Billy Wilder, Alfred Hitchcock- এদেরকে তিনি সিনেমার ঈশ্বর মনে করেন। আর নিজের দেশে তার পছন্দ হল- Guru Dutt, Bimal Roy, Raj Kapoor and Vijay Anand।
যাকে একসময় বলা হয়েছিল সে কিছুই করতে পারবে না, তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার, সেই ফারহান এত কাজ করেও নিজের শিকড়কে ভুলে যাননি। নিজের মাকে নিজের সবচেয়ে বড় সমালোচক বলেন, সাথে এটাও বলেন- আমার মা সেদিন আমাকে বাড়ি ছাড়ার হুমকি না দিলে আমি হয়ত আজকে এখানে আসতাম না। মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও বাবার সাথে এখনও বেষ্ট সুসম্পর্ক আর শ্রদ্ধা আছে তার। নিজের সিনেমার সব গান ফারহান এখনও তার বাবাকে দিয়ে লেখান, বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন আর শ্রদ্ধা করেন বলেই হয়ত। সম্পর্কের রং ফিকে হলেও, ভালোবাসার রঙটা এখনও গাড় আছে।
সময়ানুবর্তী এই মানুষটি তেলাপোকাকে অনেক বেশি ভয় পান এবং আশা করেন একদিন এটি কাটিয়ে উঠবেন। আরেকটি রোগ আছে তার, কোন জিনিস তার জায়গামত না থাকলে তিনি কাজ করতে পারেন না, সোফা যদি সোফার জায়গায় না থাকে, তবে কাজ করতে ভীষণ অসুবিধা হয় তার। মিষ্টি খাবারের প্রতি অনেক বেশি রকমের দুর্বলতা আছে তার। নিজের জীবনের এমন কোন সিদ্ধান্ত আছে বা ঘটনা যেটার জন্য আপনি একন আফসোস করেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন- ১-কলেজ জীবনটা শেষ করার উচিত ছিল আমার ঠিকভাবে। আরেকবার সুযোগ পেলে সেটি করতে চাই। ২- আমির খানের রং দে বসন্তি আমাকে অফার করা হয়েছিল, আমি না করে দেই। জীবনে আর কখনও আমার এত আফসোস হয়নি রং দে বসন্তি দেখার পরে যতটা হয়েছিল, শুধু ভেবেছিলাম- এ আমি কি করলাম!
এই বছর তার প্রোডাকশন হাউজ থেকে আসছে Raees নামক সিনেমা যেখানে শাহরুখ খান ভিলেন আর নওাজুদ্দিন সিদ্দিকি পুলিশ হিসেবে থাকবেন। গতকালকে মুক্তি পেয়েছে অমিতাভের সাথে তার নতুন সিনেমা ওয়াজির। এছাড়া সামনে অভিনয় করবেন রক অন টু সিনেমাতে। ২০০৮ এ রক অন সিনেমাতে ম্যাজিক নামের ব্যান্ড যেই "ম্যাজিক" দেখিয়েছিল, সেটা ২০১৬ তে দেখাতে পারবে কিনা- সেটা সময়ই বলে দিবে। তবে যাই হোক, তাতে ফারহান আখতারের মত মাল্টি ট্যালেন্টেড মানুষের ট্যালেন্ট এর স্ফুরণ যে আরেকবার বেশ জোরেশোরেই দেখা যাবে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
শুভ জন্মদিন ফারহান আখতার দ্যা মাল্টি ট্যালেন্টেড।
পুনশ্চ- পড়া শেষ? খুব ভাল্লাগসে লেখা? মন ভাল হইসে? আপনার মনটা খারাপ করে দেই রাখেন। আজকে আরেকজন অতি গুণবতীর জন্মদিন। কোরিওগ্রাফার হিসেবে তিনি দারুণ হলেও ডিরেক্টর হিসেবে গত কয়েকবছর যাবত তিনি আমাদের উপর যে কি অত্যাচার চালাচ্ছেন,সেটা তিনিই ভাল জানেন- নাম তার ফারাহ খান। আরও অদ্ভুত ব্যাপার শুনবেন? সম্পর্কে তিনি ফারহান আখতারের কাজিন হন!
সম্পূর্ণ দুই মেরুর মানুষ কাজিন- পৃথিবী আসলেই বেশ রহস্যময় জায়গা!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:০৩