সিনেমার নাম- Tamasha (তামাশা)
সিনেমা সম্পর্কে বলার আগে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে নিতে চাই- এই সিনেমাটা সবার ভাল্লাগবে না। এবং খুব সম্ভবত সবার জন্য এই সিনেমাটা না। তার মানে এই না যে এই সিনেমা ভাল না লাগলে আপনি "জাতে" নেমে গেলেন।
ইমতিয়াজ আলীর স্টোরি কেমন হয় সেটা আমরা যারা তার সিনেমা দেখি তাদের জানা আছে, একটা নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা। নায়ক নায়িকা দেখা হবে, "মাস্তি" হবে, দুইজন আলাদা হবে, অনেকদিন পরে আবার দেখা হবে, "ভুল" হওয়া জিনিস ঠিক হবে বা ঠিক করা হবে এবং সর্বোপরি- নিজেকে খুঁজে ফেরা।
তামাশাতেও ব্যতিক্রম কিছু নেই স্টোরির দিক থেকে, তবে যেই জিনিসটা ব্যতিক্রম আছে এবার সেটা হল গল্প বলার ধরণ- গল্পের আরও বেশি গভীরে ঢুকেছেন এবার ইমতিয়াজ। মানুষের মনের আরও অন্ধকার এবং আরও গভীর জায়গায় নিয়ে গেছেন দর্শকদের। যেই জায়গায় মানুষ একা, যেই জায়গায় মানুষের যুদ্ধটাও একা, নিজের সাথে নিজের, নিজেই মিত্র বাহিনী, নিজেই শত্রু বাহিনী। এবং এই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করার ক্ষমতাও এই একা মানুষের।
ভেদ আর তারা নামের দুই অপরিচিত মানুষের দেখা হয় করসিকাতে। নিজেদের সম্পর্কে (এমনকি নাম সহ) সব মিথ্যা বলে বন্ধুত্ব করবে দুইজনে- এরকম প্ল্যান করে দুজনে এবং প্রমিজ করে আর জীবনেও দেখা করবে না। অবশেষে একদিন হঠাৎ বিচ্ছেদ, করসিকা থেকে চলে আসা। তবে চলে আসা মানেই যে ভুলে যাওয়া নয়- সেটা বুঝা গেল আসার পরে। মনের তীব্র আকর্ষণেই হয়ত নিয়তি দুইজনকে আমার দেখা করিয়ে দিলেন, তবে এবারের ভেদ আগের "উচ্ছল" ভেদ আর নাই, একেবারেই কর্পোরেট অফিসের ছাপোষা মানুষ হয়ে গেছে!কারণ কি এর? ভেদ কি আসলেই এরকম? নাকি সে ভান করছে?
দীপিকা as usual দারুণ, দিন দিন পারফর্মেন্স আর সিনেমা চয়েস ভাল হয়েই যাচ্ছে স্পেশালি আমি তার হাতে চুমা দেয়ার পর থেকে ((সামনে আবার বাজিরাও মাস্তানি) তবে তার স্ক্রিন টাইম রনবিরের তুলনায় একটু কম হয়ে গেছে, তাকে আরও সুযোগ দেয়া উচিত ছিল।
শুধু রনবিরের অভিনয় নিয়ে একটা আলাদা লেখা পোস্ট করা যায় ফেসবুকে- এতটাই দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন তিনি। ডন, রোবট, কর্পোরেট কামলা- সব ক্যারেকটারে একদম পারফেক্ট! এতদিন মনে হত বরফি বা রকস্টার বা রাজনীতি তার বেষ্ট অভিনয়, কিন্তু তামাশা সব হিসাব গোলমাল করে দিসে। প্রচণ্ড কঠিন আর প্রচণ্ড কমপ্লেক্স একটা ক্যারেকটার দেয়া হইসে তাকে এবং সে সেটাতে প্রচণ্ড ভাল করছে। টানা তিনটা ফ্লপ দিয়ে মনে হয় তার অভিনয়ক্ষমতা আরও তিনগুন বেড়ে গেছে! ফ্লপ থেকে ভাল কিছু হলে তাহলে ফ্লপ ই ভাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একা একা monologue বলা, হঠাৎ হঠাৎ নিজের গলা চড়িয়ে কথা বলা এবং নিজের আসল রুপটি বেরিয়ে আসা- পরমুহূর্তে সেটাকে নামিয়ে শূন্যের প্রায় কোঠায় নিয়ে আসা, প্রতিনিয়ত নিজের মনের সাথে নিজের যুদ্ধ করা, নিজের অবস্থা নিয়ে সুখে না থেকেও সুখে থাকার প্রতিমুহূর্তে ভান করা- অদ্ভুত ক্যারেকটার, রনবিরের অদ্ভুত অভিনয় এবং এখন পর্যন্ত নিঃসন্দেহে তার বেষ্ট। শেষের দিকে ক্লাইম্যাক্সে যখন রনবির নিজের বাবার সামনে ১০ মিনিটের গল্প বলে, সেই সিনটা জাস্ট টেরিফিক!
এ আর রহমানের মিউজিক আর ইরশাদ কামিলের লিরিক্স থাকলে গান যে ভাল হবে তা নতুন করে কিছু বলার নাই। আগার তুম সাথ হো গানটা একটা অদ্ভুত কষ্ট দিয়ে যায়, গানটার দৃশ্যায়ন ও আরও কষ্ট দেয়। টেবিলে মাথা লাগিয়ে একজন আরেকজনকে না দেখা, সত্যকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর পরেও তার মুখোমুখি না হতে পারার কষ্টটা এই গানে ভালভাবে দেখানো হয়েছে।
আমরা সবাই এই পৃথিবীতে নিজের একটা ক্যারেকটার নিয়ে এসেছি, আমাদের সবার সেটাই ঠিকমতো প্লে করা উচিত। অন্যের পছন্দ করা ক্যারেকটারে আপনি জোর করে একটা সময় পর্যন্ত হয়ত সুনিপুণ অভিনয় করে যাবেন, তবে দিনশেষে আমি নিজের কাছে ছোট হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে যাবেন। অদৃশ্য হওয়ার আগেই নিজের comfort zone খুঁজে বের করুন, সবচেয়ে বড় কথা নিজেকে খুঁজে ফিরুন নিজের ভাললাগার কাজের মাঝে, নিজের আত্মাকে সঙ্গ দিন- জীবনে মনে হয়না তাহলে আর বেশি আক্ষেপের কিছু থাকবে। তামাশা সিনেমার মূল কথা এটাই। সিনেমার মূল গল্পের আইডিয়া কিন্তু ইমতিয়াজ আলীর ভাইয়ের। তবে ভাইয়ের চিন্তাকে পর্দায় ভালভাবে রূপ দিতে ইমতিয়াজ কোন কার্পণ্য করেন নি। তবে কার্পণ্য থেকে গেছে ফার্স্ট হাফের প্রেডিেক্টবল স্টোরি( তবে করসিকার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য সেটা আশা করি ভুলিয়ে রাখবে) আর "এন্টারটেইনমেন্ট" এর কম উপাদানে।
এগুলো ছাড়া তামাশা সিনেমাটি মোটেই "তামাশা" নয়, শুধু নামে ছাড়া
(পরিষ্কার হল প্রিন্ট দেখসি তাই ডাউনলোড লিঙ্ক দিলাম না। যাদের ইচ্ছা পরে দেখে নিয়েন এবং আবারো বলছি- সবার এই সিনেমা ভাল্লাগবে না এবং ভাল না লাগার অধিকার আপনার আছে। তেমনি আমার ভাললাগার অধিকারও আমার আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০৪