(১৩ জানুয়ারি'র পিকনিক। যাকে যা করতে দেখেছি আর যাকে যা বলতে শুনেছি - সবটা লিখে ফেলছি। কেউ মাইন্ড করলে আমি দায় নেব না!!!!)
কাঠের তলোয়ার (আরম্ভ পর্ব)
কাঠের তলোয়ার (পূর্বান্হ থেকে মধ্যান্হ)
কাঠের তলোয়ার (মধ্যাহ্ন থেকে অপরাহ্ন)
ফিরতি বাসে আমি আগে আগে উঠলাম ! লক্ষ্য, পেছনের সিট দখল করব (আসার সময় তাই করেছি)! কিন্তু ফারজুল ভাই মাঝপথে আটকালেন। একদম সেন্টারে বসালেন।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছি। চলে আসার আগে, চোখ গেল শিপু ভাই-এর ছেলে পার্লিন-এর দিকে ! একটা কাঠের তলোয়ার দিয়ে সে অদৃশ্য শত্রুকে মেরেকেটে ফেলছে ! এসব কিছু'র মাঝেও মনে আসল ক'দিন আগে ক'জন ব্লগারই নাকি এ আয়োজন বানচাল করতে চেয়েছিল ! কি অদ্ভূত কথা ! আমি ব্লগে তেমন নিয়মিত ছিলাম না বলে ওসব পোস্ট একটাও দেখিনি, পড়িনি, কিন্তু হঠাৎ পার্লিনের অদেখা প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ দেখে মনে হল, সেইসব অদেখা ব্লগারদের খোঁচা দিয়ে একটা কবিতা লিখি। নাম দিব "কাঠের তলোয়ার" ! খানিকটা শুরুও করেছিলাম। তবে এরপর এ্ত আনন্দ করলাম আমরা, এত হাসি-গান, মনের মাঝে ওসব চিন্তা আর আনতে ইচ্ছা হল না একদম ! একেবারে শিফ্ট-ডিলিট করলাম।
আনন্দই কি আনন্দের সবচেয়ে বড় পাওনা না???
আচ্ছা, আবার ফিরে যাই বাসে। আমি এখন সেন্টারে বসে। ফারজুল ভাই, আর আরেকজন পিচ্চি'র সাথে (কোনও এক ব্লগারের সাথে এসেছে সে)। মির্জা, মাহি, আশকারি, মনসুর ভাই, সকালের কাক, পানকৌড়ি সমস্ত হিউমেরাস লোকজন একসাথে ! আরও ছিল দূর্জয়, পুশকিন ভাই, জাহিদ ভাই (পরিবারসহ) আর সবাই সবাই (কেন এক এক করে নাম নিতে যাচ্ছি? কাকে বাদ দিতে পারব আমি???)!
শিপু ভাই সামনে থেকে এসে বলল, "দেখেন শাহেদ ভাই, দেখলে কি মনে হয় - এই মানুষগুলা বেশিরভাগই কেউ কাউকে আগে থেকে তেমন চেনেও না !" সত্যিই তো ! আমি নিজে ক'জনকে চিনতাম ! আর এখন??? সকালে প্রথমে বাসে উঠে চুপচাপ এক কোণে বসে ছিলাম। নিজে থেকে মেশার ক্ষমতা আমার নেই, সবাই এসেই আমার সাথে মিশে গেল ! কী বলব আমি আর?
পার্লিন এসে আমার কোলে বসল। সবার গানে সেও পা নাচায়। কোনও গান তার পরিচিত মনে হলে খুশিতে ঝলমল করে তাকায় !
কথায় কথায় হাসাহাসি চলছে। যেমন- দু'একটা বলি, মাহি বাসে উঠে এমন একটা সফল পিকনিক আয়োজন আর সবার আন্তরিকতা নিয়ে একটা ধন্যবাদ বক্তৃতা দিল। ওদিকে শিপু ভাই তখন থেকেই তাকে কিছু বলার জন্য পেছন থেকে কাঁধে হাত রেখে ডাকছে। এতে অবশ্য মাহি'র বক্তৃতা থেমে নেই; সে বলেই চলেছে সম্মিলিত জনতার উদ্দেশ্যে:
"এই যে আমরা সমমনা ব্লগার'রা একদম অপরিচিত হয়েও শুধু আন্তরিকতা'র জোরে আজ কী সুন্দর, অন্তত আমি মনে করি খুব সুন্দর একটা দিন কাটালাম। ব্লগে কিন্তু আমরা সবাই জানি, পরিবেশ সবসময় এমন থাকেনা। কেউ কেউ আছে যারা সবসময় পেছন থেকে খোঁচাতে থাকবে। তাদের খোঁচাতে দিন...."
এ সময় (খুব সম্ভবত) মনসুর ভাই বলে উঠলেন, "...এই যেমন শিপু ভাই এখন আপনাকে পেছন থেকে খোঁচাচ্ছে !"
সবাই হো হো করে হেসে উঠল ! কী বলতে আসা শিপু ভাই-ও হাসছে !
এমনি করেই সারাটাক্ষণ !!!
মাঝে আশকারি আসল চিপস ফেরি করতে ! কেউ কাউকে খোঁচাতে আর জবাব দিতে ছাড়ে না !
মনসুর ভাই মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সম্পূরক প্রশ্ন এবং প্রস্তাব উত্থাপন করলেন, "এখন থেকে আমরা আশকারি'র বাবাকে ডাকব ভাইয়া, আর আশকারি আমাদের সবাইকে আঙ্কেল ডাকবে !" ছাত্রমানুষ আশকারি স্বাধীকার আন্দোলনে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। নষ্ট কবি সমাধান দিলেন, "ঠিক আছে। আশকারি'র বাবা আমাদের বড় ভাই আর আশকারি আমাদের ছোট ভাই !"
আবার গান ! পানকৌড়ি অপূর্ব বিনোদনে আমোদিত করে রাখলেন সবাইকে ! মাঝে ক্যানভাসারদের মত টুথপিক ফেরি করলেন নষ্ট কবি আর পানকৌড়ি। অবিকল সুরে, "সম্মানিত যাত্রী ভাইয়েরা, আপনাদের আসা-যাওয়ার পথে আমি আমার এই ছোট্ট প্রডাক্ট নিয়ে আপনাদের সামনে এসেছি..."
দীর্ঘক্ষণ চলল এ ক্যানভাসিং ! আমি সারাটাক্ষন হাসলাম !
আবার গান, সবাই মিলে ! তবে অচিরেই ডাক পড়ল, যারা গান করছে সবাইকে সামনে যেতে হবে ! শেষ চেষ্টা নিলাম, "আমরা একদম সামনে গেলে পেছনের কেউ শুনবে না। আমরা সেন্টারই ঠিক আছি!" কে শোনে কার কথা !
সামনে গিয়ে ইঞ্জিনের উপর বসলাম আমি, শিপু ভাই, নষ্ট কবি, পানকৌড়ি, আর উৎসাহী গায়কেরা। জিসান ভাই আমাদের জায়গা করে দিয়ে নিজে পেছনে চলে গেলেন ! এরপর সবার গান। সবাই সত্যি ভাল গায় ! অক্লান্ত গায় ! আমি ভাবলাম এমন সবার মাঝে আর্টসেল হয়তো জমবে না, শিপু ভাই আর নষ্ট কবি গলা উচিয়ে গেয়ে সেটাও জমিয়ে দিলেন ! একের পর এক গানের কথা আসছে। কত গান যে আমি জানি না, শুনি নি পর্যন্ত। মাঝে ব্লগার অন্তরা মিতু আমার উপর চরম খেপলেন,"এই ছেলের সমস্যা কি? আমি গান গাইতে শুরু করলে সে গীটার বাজায় না কেন !"
-"এই গান যে কখনও শুনিও নি !"
-"না শুনলে সেই গানে কি বাজানো যায় না?"
যায়, আলবৎ যায়। এক্ষত্রে গানটা কোন স্কেলে গাওয়া হচ্ছে শুধু এটা ধরতে পারলেই হয়। তারপর থ্রি-কর্ডস থিওরি'র আওতায় সহজেই এর সুর ধরে ফেলা যায়। তবে আমি তখন ইঞ্জিনের উপর বসে একটানা ঘরঘর আওয়াজ, আচানক হর্ণ, আর খানিকটা জ্বরে কান ঝা ঝা করছে। হঠাৎ স্কেল ধরতে পারলাম না। অগত্যা মিথ্যা বাহানা দেখালাম,
"আপনার গানের পরের লাইনটা ঠিক কোন সুরে হবে, এটা আগে থেকে না জানলে আমি কী বাজাব বলুনতো?"
কিছুতেই দমে না গিয়ে তিনি বললেন, "ঠিক আছে,আপনি কোন গান জানেন বলেন; ওইটাই গাইব"
কেঁদে বাঁচার উপায় নেই! অসহায়ভাবে বললাম, "আমি যে কয়টা গান জানি, সবক'টা এর মাঝে গাওয়া হয়ে গেছে!"
গায়ক-গায়িকারা হতাশা'র চূড়ান্ত হলেন।
তবু গান থেমে থাকেনি।
তবু গান থেমে থাকে না !
সবাই পারবে এমন একটা গান দরকার ছিল। বাচ্চু'র "সেই তুমি" ধরলাম। আশকারি বলে, "শাহেদ ভাই, সেই তুমি উল্টা'টা ধর ! ওটায় পার্ট বেশি!"
সকালে উল্টা'টা করেছিলাম, আবার ধরলাম। এবার সবাই জমে উঠল খানিক।
যারা শোনেন নি, তাদের জন্য, উল্টা'টা মানে হল, গানে 'তুমি' আর 'আমি'কে উল্টো করে গাওয়া। কোরাসটা দাঁড়ায় এমন:
"আমি কেন বুঝিনা, আমাকে ছাড়া তুমি অসহায়
তোমার সবটুকু ভালবাসা আমায় ঘিরে
তোমার অপরাধ ছিল যতটুকু আমার কাছে !
আমি ক্ষমা করে দিলাম তোমায় !!!"
আরও মজা হল গান নিয়ে। শিপু ভাই খুব আগ্রহে মৌসুমী ভৌমিকের "আমি শুনেছি সেদিন" গানটা ধরলেন, মাঝে এসে নষ্ট কবি জুড়ে দিলেন,
"আমি শুনেছি সেদিন নাকি, তুমি তুমি তুমি মিলে
তোমরা সদলবলে সিন্ডিকেট করেছিলে !!!!"
তুমুল গল্প-গান-আড্ডায় এক সময় পানকৌড়ি বললেন, "আজ প্রথম ইচ্ছা হচ্ছে, রাস্তার জ্যাম যেন শেষ না হয় !!!"
শেষে এসে জ্বর আর অ্যাসিডিটি-তে একটু খারাপ লাগছিল। একথা কাউকে বলিনি, এখানেও বলতে চাইনি, কিন্তু এখন বলতে হচ্ছে আরেকটা আন্তরিকতার উদাহরণ দেখাতে। ব্যাথা'র কথা কাউকে না বললেও হয়তো আমার চেহারায় তার ছাপ পড়েছিল, হয়তো বা। আর দূর থেকে সেটা খেয়াল করেই রুমকী আপু থেকে আশকারি'র হাত ঘুরে আমার জন্য এক বোতল পানি চলে আসল না চাইতেই ! এই মানুষগুলা সত্যিই সবাই সবার অপরিচিত??? তাহলে এতটা খেয়াল রাখার মানে কী???
কেউ কি বিশ্বাস করবে, ঐদিন আমাদের বেশিরভাগেরই প্রথম আলাপ???
শেষ দিকে কিছু কথা।
এদিন সাইরাস হেলাল ভাই অনুপস্থিত ছিলেন - এটা সত্যি না। প্রত্যেকে যখন একজনের অনুপস্থিতি অনুভব করতে পারে, তখন তিনি আর যাই হোক, সেখানে অনুপস্থিত থাকতে পারেন না। তাঁর উপস্থিতিও ছিল সবার মতই সরব ! সবার মাঝে ! হেলাল ভাই, আপনি যা করলেন, এমনটা সবাই করতে পারেনা। অনেকে করার কথা ভাবতেও পারে না। আপনি যাবেন না, একথা আগে চাউর হলে আমি নিজেই যেতাম না। তাই আমি বুঝতে পারছি, আপনার নীরবতা'র সিগনিফিক্যান্স। আপনাকে আলাদা করে ধন্যবাদ দেয়ার কি কোনও মানে হয়?
কোনও মানে হয় না !
আরেকটা কথা। অনেকেই নিজেদের পরিবার, বন্ধু নিয়ে গিয়েছিলেন। আমিও কিন্তু নিয়েছিলাম একজনকে, তার জন্য কোনও টাকাও দিই নি ! আমার অনেক পুরোনো বন্ধু, যে আর সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, আমাকে মিশিয়ে দিয়েছে।
বন্ধুটি আমার পুরোনো নীল গীটার। অঞ্জন দত্ত'র সুরে বললে:
"ইদানিং হঠাৎ করে অনেক ভালবাসার মাঝে এনে ফেলেছে আমায়,
নিজের মত করে কিছু কথা বলবার সুযোগ করে দিয়েছে আমায়;
ভাবিনি তো কোনওদিন আমার এই বন্ধুটা, হয়ে যাবে বন্ধু সবার-
ভাবিনি তো কোনওদিন শুবে সবাই, আমার পুরোনো গীটার !"
(পুরোনো গীটার : অঞ্জন দত্ত)
শেষে এসে আর পারছিলাম না। কারও কাছ থেকে বিদায় নিতে পারিনি, পাশে বসা জিসান ভাই আর নষ্ট কবি ছাড়া।
নামার ঠিক আগে সামনে এক ব্লগার হঠাৎ 'স্যরি' বললেন ! আমি ভীষণ অবাক ! কেন? জানালেন, "আমিই প্রথম বলেছি গান শোনাতে আপনাদের সামনে নিয়ে আসতে। তার জন্য পুরো রাস্তা ইঞ্জিনের গরমে থাকতে হল আপনাকে ! আমি একটু সেলফিশ টাইপের !"
কী বলব আমি? জবাব'টা নিশ্চয়ই আরও দু'তিনদিন পর মনে পড়বে !
(শেষ)