সামনের আঁকাবাঁকা খাল বেশ সরু আর সুন্দরী , কেওড়া , গেওয়া ও গোল পাতার
গুচ্ছ এমনভাবে মেলেছে যে একহাতে বৈঠা আরেক হাতে চোখা ডাল আর গোল পাতার বাধা ঠেকানো হয়ে ওঠে না । কি মনে করে মনি মাস্টার আজ আর ছোকরাটাকে সাথে আনেননি । তাহলে হয় ডাল ধরে উচু করে দিত বা দা দিয়ে ছেটে দিত । নৌকাটা খুব ছোট এবং হটাৎ জীবজন্তুর আক্রমন হতে রক্ষার জন্য একদম নিরাপদ নয় । বলেনা, জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। পিঠে ঝোলানো বন্দুক ,গলায় ঝোলানো তিন ব্যাটারির টর্চ , লুঙ্গির কোঁচড়ে পেঁচানো ডজন খানেক কার্তুজ। প্রথম জোয়ারে বৈঠা মেরে প্রায় ঘণ্টা পরে বড় খাল হয়ে আবারো চিকন খাল । চিকন খাল ভাটায় শুকিয়ে যায় তাই জোয়ার বুঝে চলাচল । চিকন খালে চলাচল কারো বাপের সাধ্যি নেই বুঝবার আর তা যদি হয় রাতে।
বড় খালে বাধা অনেক বড় নৌকা । বাওয়ালিরা এখন ঘুমুচ্ছে । নৌকা ভেড়াল একটার গায়ে । ভারি আওয়াজ এলো ‘কে মাস্টের নাকি’?
‘এই আলাম আর কি’ ! জবাব মনি মাস্টারের। ‘নাও খান থাকল’।
‘ফিরবা কহন’?
‘একটা শিঙ্গেল পালি হয়’। এটা মাস্টারের হরিন শিকারের রুট। কাদা ভেঙ্গে সুন্দরীর শুলে পা মাড়িয়ে বাদায় উঠে দাঁড়ালো ।চাঁদের আলোয় চারদিক ঝলমল হলেও জঙ্গলের ভিতর নিকষ কালো অন্ধকার । বন্দুকের বেল্ট গলায় ঝুলিয়ে, ট্রিগারে আঙ্গুল আর বা হাতে টর্চ বন্দুকের সামনের বাটে ধরে সতর্ক যাত্রা । তার বাবা শিখিয়েছিলেন এই পদ্ধতি ।
‘ফরেস্টের লোকজন কি আজ আইছিলো এদিকি’?
‘দুপুরবেলা নদী দিয়ে ঘুরে গেছে’ ।
একটু ভিতরে গিয়ে স্বভাব অনুযায়ী আলো ফেলে চারিদিক সতর্ক পর্যবেক্ষণ । এটা তার চেনা পথ তাই বার বার এখানেই আসা হয়। আবারো হাত দিয়ে লুঙ্গি কষে বাধা এবং কার্তুজ গুলো নিরাপদ করা। ঘড়ি দেখল মাষ্টার । এযাবত দুঘণ্টা হয়েছে । ঘন গাছের সারি এড়িয়ে, গা বাঁচিয়ে চলতে থাকল মাষ্টার । কোথাও দাড়িয়ে চার দিকে আলো ফেলে নজরদারি । এই পথে বহুবার আসা যাওয়া বাপের সাথে,যদিও আজতক বাঘের মুখোমুখি হয়নি কখনো তবুও বাপের অভ্যাস পালন করে। আধা ঘণ্টা হেটে একটু ফাকা জায়গায় পৌছুলো মাষ্টার । নিচের মাটি পরখ করল । নাহ কোন হরিনের পায়ের দাগ নেই, তার মানে আসার সময় হয়েছে। তীক্ষ্ণ নজরে আরও একটা পায়ের ছাপ খুজতে লাগল ।
‘নাহ বড়মিয়া এদিকে নেই’ , বিড়বিড় করল মাষ্টার ।
বাপ বলত যেখানেই হরিনের পাল তার পিছ পিছ বড়মিয়া থাকবেই ।
মাঝারি একটা যুৎসই গাছে উঠে মোটা ডালে বসে পরের ডালে পা রেখে কপাল থেকে বাড়তি গামছা খুলে গায়ের ঘাম মুছল । গাছের পাতার ফাক দিয়ে চাদের ছিটেফোঁটা নজরে আসে। চারিদিক অসম্ভব চুপচাপ। মনি মাষ্টার ভয় কাকে বলে জানেনা। তার জীন, ভুত, প্রেত এসবে বিশ্বাস নেই। ভয় শুধু বড়মিয়া।
নৌকায় বসে দূর থেকে দেখেছে আর মৃত বাঘ দেখেছে ফরেস্ট অফিসে। একটা বিড়ি ধরাল মাষ্টার । অনেকক্ষণ বাদে বিড়ির স্বাদটা দারুন লাগছে। অপেক্ষায় মনি মাষ্টার তার আকাঙ্ক্ষিত শিঙ্গেল হরিনের জন্য।
কিন্তু নাহ, আজ কেন এতো দেরি ? অবশ্য মাঝে মধ্যে দেরি হয় এবং মাঝে মধ্যে আসেইনা। তখন খালি হাতে ফিরতে হয় তাকে। রাতে বন্দুকের আওয়াজ বহুদুর যায়। কিন্তু ফরেস্ট বিভাগ আসতে আসতে সকাল দশটা । দিনে শিকার সহজ কিন্তু ধরা পড়ার ভয় বেশী।
তার আশেপাশের গাছে কিছু বাদর ছিল হটাৎ তারা কিচিরমিচির করে ডাল বদলাতে লাগল । মাষ্টারের মনে শঙ্কা জেগে উঠল। শক্ত হাতে বন্দুক ধরল মাষ্টার । তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে। বাদরেরা সরে দুরের গাছে চলে গেল ।
বড় মিয়া বেশ রাজসিক ভঙ্গিতে এলো । তার চোখ দুটো ভাটার আগুনের মত জ্বলছে । ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসা চিকন চাদের আলোতে স্পষ্ট নয় কিছু । তবুও চলন্ত হলদে শরীর সামান্য হলেও দৃশ্যমান।
মনি মাষ্টার তার বুকের ভিতর ঢোল পেটানোর আওয়াজ পেল ।
প্রথমেই ফেলে দেওয়া জ্বলন্ত বিড়ি শুকল । ফোঁস ও ঘোঁত আওয়াজ করে ফাকা জায়গায় পাক খেলো। মুখ তুলে দেখল মাষ্টারের বসা গাছটির দিকে। বড়মিয়ার চোখ কাপিয়ে দিল মাস্টারকে।
আজ বড় একা মনে হতে লাগল মাষ্টারের নিজেকে। গাছের কাছে এসে মৃদু গর্জন করে নখ দিয়ে গাছ আঁচড়াল কিছুক্ষন । মাষ্টারের অজান্তে তার লুঙ্গি ভিজে নিচে পেসাব পড়তে লাগল। বড়মিয়া হা করে মুখের উপর পেসাব মেখে আবারো প্রচণ্ড ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিল। এবার সামনের দুপা বাড়িয়ে মাষ্টারের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা। বিপদসীমার এক দেড় হাত উচুতে মাষ্টার তবুও হতবাক বন্দুক ছুড়তে ভুলে গেছে । বড় মিয়ার পায়ের নিচে অসংখ্য শুল আর তাই সে সুবিধা করতে পারছেনা লাফিয়ে উঠতে। মাষ্টার এবার কাঁপতে শুরু করল। বন্দুক দিয়ে গুলি করার বদলে দুই ডালে রাখা দুই পা ঠেকিয়ে পিঠে গাছের উপর ভর রেখে উঠে দাঁড়ালো ।বড়মিয়া তখনও চেষ্টা চালাচ্ছে পায়ের নাগাল পাওয়ার ।
যে পরিমানে মাষ্টার কাপছে তাতে তার আর উপরের ডালে ওঠা হবেনা । একহাতে খোলা গামছা দিয়ে পিঠের দিকে গাছের সঙ্গে প্যাচ লাগানোর চেষ্টা করতেই তার কোমরে লুঙ্গির কোচড়ে রাখা কার্তুজগুলো ঝরঝর করে নিচে পড়ে গেল ।
কিছুক্ষন হা করে মাষ্টার তাকিয়ে থাকল তার দুর্ভাগ্যের দিকে । আলোর অভাবে কার্তুজ দেখা যায়না । বড়মিয়া কার্তুজগুলো শুকে দেখছে আর এই ফাকে তড়িৎ বন্দুকটা গলায় ঝুলিয়ে কম্পমান মাষ্টার গামছা দিয়ে নিজেকে বেধে ফেলল গাছের সাথে । নিচে সুন্দরীর অগনিত শুল না থাকলে বড়মিয়া উচু একটা লাফে তাকে নামিয়ে নিত। ম্যাচ জ্বালিয়ে নিচে ফেলল , কাজে দিল , আগুন দেখে বড়মিয়া সরে গেল।গাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে বেশ আয়েশ করে বসল ।
মাষ্টারের মনে হল আজ আর জানোয়ারটি নড়ছেনা ।
টর্চের আলো চোখে মেরে তাড়ানোর চেষ্টা করল । কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হল।
বড় মিয়া এবার দুপায়ের উপর মুখ রেখে তার শিকারের দিকে তাকিয়ে ।
‘আজ একা আসা খুব ভুল হইছে’, বিড়বিড় করে মাষ্টার।
তার ভয়টা কিছুটা কমেছে।
গুলি আছে ভরা একটা,যদি মিস যায় কপালে খারাপি আছে, যদি ঘা খেয়ে না মরে তাহলি কপাল আরও খারাপ। যত দোয়া দরুদ ছিল সব পড়া শেষ আর তলপেটে যা ছিল তাও খালাস। বড় পানির পিপাসা পেয়েছে কিন্তু কোথায় পানি। মাথাডা কি খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি?
ঘড়ি দেখল সাড়ে তিনটা । আরেকটু অপেক্ষা করি, ফজর এলে আলো ফুটলে হয়ত বড়মিয়া নিজেই সরে যাবে । ক্রমাগত বিড়ি খেয়ে ভেতরে জমে থাকা ভয় দূর করতে লাগল।
তার কি ভুল হয়ে গেছে ? প্রথমেই চোখ বন্ধ করে গুলি চালিয়ে নতুন টোটা ভরে নিত, কপালে যাই থাকত একদম বড়মিয়ার মুখের আধার তো আর হতে হতো না। হয়ত জখম হয়ে চিৎকার করে করে চলে যেত।
চোর পলালে বুদ্ধি বাড়ে ।
বিড়বিড় করে গাছের সাথে গামছা দিয়ে বাধা মাষ্টার বকে চলে একা।
ভোর হয়ে এলো । বন মোরগগুলো বাগ দিতে শুরু করেছে ।
বড়মিয়া সেই একই ভঙ্গীতে বসা এবং ভোরের আলোতে তার নিস্পলক চোখদুটো দেখছে মাস্টারকে ।
মাষ্টার তার শেষ হিসাব কষে ফেলল , যাই কপালে থাক ।
দুপায়ে শক্তি সঞ্চয় করে শক্ত করে দাঁড়ালো। বন্দুকটা ভালো করে দেখে নিল। টোটার চেম্বার খুলে আরেকবার দেখে নিল।
এবার বন্দুক তাক করল বড়মিয়ার দিকে , প্রথমে মাথায় তারপরে ঘাড়ে নিশানা ঠিক করল । তার মনে হল ঘাড়ে লাগলে নিশ্চিত মৃত্যু , অথবা সরে পিঠে ,মাথায়। কিন্তু গুলি মিস যাবেনা ।
বেশ কিছুক্ষন বন্দুকের নিশানায় চোখ রেখে বন্দুক নামাল এবং দম নিয়ে বন্দুক ওঠাল ,এবার সর্বশক্তি সঞ্চয় করে ট্রিগার চেপে দিল ।
আহত বড়মিয়া ফাকা জায়গায় মাটি খুবলে আশপাশের ঝোপঝাড় ছিন্নভিন্ন করে গগনবিদারী চিৎকার করতে লাগল ।
মাষ্টার কিন্তু এবার ভয় পেলনা , তার সাহস বেড়ে গেল।
মিনিট পাঁচেকের প্রলয়ঙ্করী তাণ্ডবের পর দূরে গিয়ে পড়ে রইল বড়মিয়া । গাছের ফাকা দিয়ে দেখা যায় ডোরাকাটা শরীরের অংশবিশেষ।
পাচ,দশ,বিশ,ত্রিশ মিনিট পর মাষ্টার তার গামছার বাধন খুলে ফেলল। নিচের পড়ে থাকা কার্তুজগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে নিল আবার তাকাল বড়মিয়ার শরীরের দৃশ্যমান অংশটুকুতে ।
যদি ওটা জীবিত থাকে এবং একলাফে এসে একথাবায় মাষ্টারের মাথাটা শরীর থেকে আলাদা করে , কারন ওই সময়টুকু গুলি ভরার ও ফায়ার করার সময় দেবেনা। গুলি খাওয়া আহত বাঘ কয়েকগুন শক্তি নিয়ে আক্রমন করে।
বিসমিল্লাহ বলে মাষ্টার বড়মিয়ার ওদিকে নজর রেখেই নেমে এলো এবং টপাটপ একটা টোটা ভরে নিয়ে বন্দুক তাক করে রইল যদিও এখান থেকে কিছুই নজরে আসেনা। একহাতে বন্দুক আর বাহাতে কার্তুজ কুড়াতে ব্যাস্ত মাষ্টার ।একটা কার্তুজ দাতে চেপে উঠে দাঁড়ালো। ডানদিকে জঙ্গলের ভিতর এগুতে থাকল সতর্ক পদক্ষেপে । কিছুদুর এগুতেই গাছের ফাকা দিয়ে নজরে এলো বড়মিয়ার শরীর । অন্ধকারেই দাড়িয়ে গাছের ছোট্ট ফাকায় বন্দুক রেখে গুলি চালাল পিঠ বরাবর।মুখের চেপে ধরা টোটা সাথে সাথে ভরে নিল । নাহ ,কোন নড়াচড়া নেই । বা দিক দিয়ে বেরিয়ে ফাকা জায়গায় সন্তর্পণে দাঁড়ালো।
দূর থেকে অনেকগুলো গলার আওয়াজ শোনা যেতে লাগল । উচু গলায় চিৎকার করল মনি মাষ্টার । মিনিট দশেকের মধ্যে ১৫ জনের কাঠুরিয়া দল ধারালো কুড়াল ও বল্লম হাতে হাপাতে হাপাতে হাজির।
‘পরপর গুলি শুনে বুঝিছি তুমি বিপদে আছ’ ।
মনি মাষ্টারের মুখে এই প্রথম মৃদু হাসি ফুটল তার বাদার সতীর্থদের কাছে পেয়ে ।
- - - - - - - - - - - - - - - - - -
১৯৯৪ তে মনিকাকার মুখে শোনা ৭৬/৭৭এর ঘটনা ।
বাদা-জঙ্গল
টোটা-বন্দুকের গুলি
আলাম – আসলাম
শিঙ্গেল – পুরুষ হরিন , শিংওয়ালা
আধার- খাবার,খাদ্য
বড়মিয়া- বাঘ । জঙ্গলে বাওয়ালি, মাছশিকারি,আশপাশের গ্রামের মানুষ কখনোই বাঘ উচ্চারন করেনা । বড়মিয়া না হয় জানোয়ার ।