somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ কাকতাড়ুয়া

০৭ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ৮:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গত রাতের প্রলয়ংকারী ঝড়ে তার মাথাটা ভেঙ্গে গেছে। হাত দুটো চৈত্রের বাতাসে দুলছে। গায়ের পোশাকটা অর্ধচ্ছিন্ন। চৈত্রের মৃদু বাতাসে মাঝেমাঝে তাকে অর্ধনগ্ন মনে হচ্ছে। মাথাটা আকাশের দিকে মুখ করে আছে। গ্রামের লোকজন ইতোমধ্যে ঘুম থেকে জেগে যে যার প্রাতঃকাজ সারায় ব্যস্ত। তাদের কেউ কেউ এদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সে লজ্জাপ্রকাশ করবে কিনা ভেবে পাচ্ছে না। আপাতদৃষ্টিতে তাকে নারী বা পুরুষ কিছুই মনে হয় না। তাকে জড় পদার্থ মনে হচ্ছে। তার এত লজ্জা প্রকাশেরই বা কি আছে? হ্যাঁ। সে যখন মানুষ ছিল জলজ্যান্ত পুরুষ মানুষ ছিল। ঘটনার খানিক বর্ননা শুনেই বুঝতে পারা যায় ঝড়ে উল্টে পড়া এই জড় বস্তুটা কাকতাড়ুয়া বৈ কিছুই নয়।

গ্রামের এক কৃষকের ভিটেমাটিতে তার ব্যুৎপত্তি, ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন। কৃষক তার জমিতে মৌসুম ভেদে হরেক শাক সবজি ও ফসল ফলাত। ফসলের ফুল ও শস্য খেয়ে যেত বিভিন্ন ধরনের পাখি। কৃষক স্বউদ্ভুত এক প্রকার তীঁর ধনুক নিয়ে সারাদিন পাখি তাড়াতো। তার বউও এই কাজে সাহায্য করতো। দেখা গেল এই কাজ করতে গিয়ে সংসারের অন্যান্য কাজ ঢিমেতালে চলে। এক বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। জটিল কোন বুদ্ধি নয়। একটা সরল বুদ্ধি। একটা মানুষের অবয়ব ক্ষেতের মাঝখানে দাঁড় করালে কেমন হয়। কয়েক দিন আগে সে একটা বিষয় খেয়াল করেছে। তার বাড়ির বেড়ার কোনায় একটা বাঁশের উঁচু খুটি আছে। সেখানে একটা ফুঁটো ভাতের হাঁড়ি শোভা পাচ্ছে। বউয়ের অসাবধনতাবশত তলায় সামান্য ফুঁটো হয়ে যায়। হাঁড়িটা ভেঙ্গে গিয়ে যাতে কারো পায়ে আঘাত না লাগে এজন্য উঁচু ঐ খুঁটিতে উল্টো করে রাখা। কৃষক ভাবে এটা গরু খাওয়া ঈদের সময় কাজে লাগবে। ছোট ছেলেটার জন্য একটা বাদ্য বানায় দেয়া যাবে। হাঁড়ির গলা আর গরুর ভূঁড়ির বাহির পর্দা মিলে ঢোলের মত একটা বাদ্য হয়, সেটা বানায় দেয়া যাবে। গরু খাওয়া ঈদের কথা মনে করেই সে একটু আনমনা হয়ে গেল। আহারে! একটা জমাট দীর্ঘশ্বাস শীতল হয়ে বের হয়ে এলো কৃষকের বুক ফুঁড়ে। বড় ছেলেটা ঈদের সময় ভেট তুলতে গিয়ে পানিতে ডুবে মরলো। বেঁচে থাকলে আজ কত বড় হতো। এতদিনে বিয়েথা করে সংসারের হাল ধরতো। নিজে তো জীবনে অনেক কষ্ট আর্তি করলাম। আর কতকাল জীবনের হাল টেনে যাবো! হে খোদা!

বাড়ীতে হাঁস-মুরগীর জন্য ভাত ছিটালে মুহূর্তেই কাক, ভাত শালিক, চঁড়ুই সহ বেশ কয়েক ধরনের পাখি ছুটে আসে। কৃষক খেয়াল করলো আজ ভাত ছিটানোর পরও পাখিগুলো আসলো না। যে কয়েকটা আছে তারাও ভয়ে দূরে সরে আছে। কেউ বাড়ীর আঙিনায় আসার সাহস পাচ্ছে না। তার নজর সেই উল্টানো হাঁড়ির দিকে গেল। এই বুদ্ধিটা ভিটের ক্ষেতে খাটালে কেমন হয়।

আজ সে যখন পাখি তাড়াতে তাড়াতে ক্লান্ত তখন সেই বুদ্ধিটাই খাটানোর চেষ্ঠা করলো। ক্ষেতের মাঝখানে একটা বাঁশের বড় খুঁটি পুতে তার মাথায় হাঁড়িটা বসায় দিলো। কিছুটা সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য খুঁটির উপরের দিকে একটা কঞ্চি আড়াআড়িভাবে বেঁধে দিয়ে মানুষের অবয়ব আনার চেষ্ঠা করলো। এরপর সে বাড়ির ভেতরে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো। নাহ! তেমন কোন পাখি তার ক্ষেতের ধারে কাছে ঘেঁষছে না। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সংসারের অন্যান্য কাজে মনোনিবেশ করলো। সারাদিন সংসারের টুকিটাকি কাজ সারার পর বিকেলের দিকে ক্ষেতের দিকে মুখ ফেরালো। নাহ! এখনো কোন পাখি দেখা যাচ্ছে। তবে দূর থেকে অবয়বটা ঠিক ফুটে উঠছে না। এজন্য কৃষকের মন উসখুস করতে লাগলো। তার বড় ছেলেটা মারা যাওয়ার সময় গায়ে একটা ঈদের নতুন শার্ট ছিল। ছেলের স্মৃতিস্বরুপ শার্টটা ট্রাঙ্কে রেখে দিয়েছিল। ওটাই সে সযতনে অবয়বটাতে পড়িয়ে দিলো। এখন দূর থেকেও ওটাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।

গ্রামের লোকজন অবয়বটার নাম দিলো কাকতাড়ুয়া। যদিও কাকের সাথে অন্য পাখিগুলোও ভয়ে ক্ষেতের পাশে ঘেঁষতো না। তবু তাকে এই নামটাই নিতে হলো। তবে কৃষক দম্পতি মনে মনে সেই হারানো ছেলেটার কথাই কল্পনা করা শুরু করলো। তাদের ধারণা, হারানো ছেলের আত্মা এই অবয়বে ভর করে ফিরে এসেছে। তা নাহলে কি করে সেই অবুঝ পাখিগুলো ভয়ে ক্ষেত থেকে দূরে সরে যায়। নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা তাদের প্রতি সদয় হয়েছেন। তা নাহলে এই অলৌকিক কাজ কেমন করে ঘটে। তারা তাকে হারানো ছেলে বাবুল বলে সম্বোধন করা শুরু করলো। তারা অতি আদরে বাবুলের নাক, কান, চোখ, ভ্রু গোলাকার করে এঁকে দিলো।

কাকতাড়ুয়ার চেয়ে বাবুল নামটাই তার কাছে বেশী প্রিয়। বাবুল গোলগোল চোখ দিয়ে সারাদিন এক দৃষ্টিতে একই দিকে চেয়ে থাকে। রাত হলে ঘুমায় না। কোন নাওয়া নেই খাওয়া নেই। পুতুলের আবার নাওয়া খাওয়া। এই কথা মনে হলেই তার হাসি পায়। হাসতে গিয়ে তার ঠোঁট নড়েনা। সে হাসে সেই গোল অনঢ় মুখে। ক্ষেতের পাশে উৎসুক মানুষের হাসি দেখে সেও হাসতে চায়। কিন্তু সেই অনঢ় মুখের অভিব্যক্তি কেউ পড়তে পারে না। তার মন খারাপ হয়ে যায়। সে কাঁদে। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জলও পড়ে না। রাতের বেলা মন খারাপ করে এক দৃষ্টিতে কৃষকের বাড়ি বরাবর চেয়ে থাকে। কেননা ঐদিকে তার মুখ ফেরানো। তার গোলাকার কান দিয়ে কৃষক পরিবারের কথা শুনে। মাঝে মাঝে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। কৃষক ও তার বউ কাঁদে। বিলাপ করে তাদের হারানো ছেলের কথা মনে করে। বাবুলেরও কান্না পায়। সে চোখের কাছে হাত আনতে গিয়ে হাতও নড়ে না। তার অনঢ়, বিবশ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভাল লাগে না।

দিনের আলো ফুটলে বিভিন্ন ধরনের পাখি তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। তার ডানা মেলা পাখি দেখতে ভাল লাগে, ফড়িং দেখতে ভাল লাগে। তার পাখি হতে ইচ্ছে করে। ফড়িং হতে ইচ্ছে করে। এরমধ্যে একদিন গ্রামের এক ষোড়শী আসে শুশনি শাক তুলতে। তার দু'বেনী করা চুল, গায়ের পদ্ম রঙ। তাকে দেখে সে প্রেমে পড়ে যায়। যুবক হয়ে ছুটে গিয়ে তার চুলে ঘাসফুল গুঁজে দিতে ইচ্ছে করে। সে হাঁটতে পারে না। তার মন খারাপ হয়ে যায়।

সূর্য ডুবে গোধূলী লগ্ন। এক মাছরাঙা পাখি পথ ভুলে বাবুলের বাহুতে এসে বসে পড়ে। বাবুল বেজায় খুশী হয়ে যায়। দিনের আলোতে কোন পাখি তার ধারে কাছে ঘেঁষতে চায় না। তার পাখির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। আজ একজনকে কাছে পেয়ে তার মন ভাল হয়ে যায়। যাক এতদিনে মনের কথা বলার জন্য সুন্দর এক পাখি, মাছরাঙাকে পাওয়া গেছে। এই যে ছোট্ট পাখি? মাছরাঙাটা হঠাৎ এক কর্কশ শব্দে সচকিত হয়। সে উড়ার জন্য পাখা মেলে। ভয় পেয়োনা। আমি তো নড়তে চড়তে পারিনা। তোমার কোন ক্ষতি করবো না। বাবুল অভয় দান করলে পাখিটা আবার আরামসে বসে পড়ে। কি নাম তোমার? আমি। আমার নাম ইটুল আমার বউয়ের নাম বিটুলী। হুম। কেমন আছো তুমি? আমি ভাল আছি। কিন্তু কিন্তু। কিন্তু আবার কি? আমার বউ আজ খুব ভয়ে থাকবে। এজন্য খুব খারাপ লাগছে বুঝি? হুমম...। ওনা সন্তানসম্ভবা। সারাদিন বসে বসে ডিমে তা দিচ্ছে। এইতো আর কটা দিন গেলে সুন্দর ফুটফুটে দুটো ছানা হবে। তাই নাকি! তাহলে ভীষণ খারাপ কথা। তোমার বউ সারারাত অস্থির সময় কাটাবে, এই বলে বাবুল কিছুক্ষণ আনমনা থাকে। পাখিদের অনেক সুখ! তাইনা? তারা পাখা মেলে আকাশে উড়ে বেড়ায়! দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। গাছে গাছে বাসা বেঁধে থাকে। তোমার তো আরো সুখ। পুকুরপাড়ে গেলেই টুকটুক করে মাছ খেতে পারো, এক নিঃশ্বাসে বলে বাবুল। এই কথায় ইটুল কিছুটা রেগে যায়। কে বলেছে তোমাকে? আমরা ঝড় বৃষ্টিতে কত কষ্ট পাই জানোনা! বৃষ্টিতে আমরা ঠান্ডায় কাঁপি। ঝড়ে প্রায়ই আমাদের বাসা ভেঙ্গে যায়। এরপর খড়কুটো আনো, আবার বাসা বানাও। তাহলে তো তোমরা অনেক কষ্ট করো। আমাদের আরও কষ্ট আছে। এই তো কয়েক বছর আগে এক বর্ষায় এক পুকুরে মাছ খেতে গিয়ে আমার আগের বউটা এক শিকারীর হাতে ধরা পড়লো। তারপর খাঁচায় পুরে শহরের দিকে হাঁটা শুরু করলো। শিকারীর পিছনে কত ছুটলাম। বউটাকে ফেরত আনতে পারলাম না। অনেক কষ্টের কথা শুনালে। আরও আছে। এই দেশে এখন আগের মত গাছপালা নেই যে বাসা বানাবো। সব গাছ মানুষ কেঁটে সাবার করছে। মনের মত কোন গাছ আর পাওয়া যায় না। বনখেকো মানুষ সব গাছ কেটে ফেলছে। বন উজার করছে। বাসা বানানোর জন্য কত জায়গায়ই না ঘুরতে হয়। তাই বুঝি! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবুল। ইটুল বলতে থাকে, দু'বছর আগে আমাদের সংসারে দুটো টুকটুকে ছানা আসে। কি যে সুন্দর! একদম মখমলের মত পাখা ছিল ওদের। বিটুলী আর আমি সারাদিন পোকামাকড় এনে খাওয়ায় তাদেরকে বড় করতে থাকলাম। একদিন বিকেল বেলা বাসায় ফিরে দেখি আমাদের ছানা দুটো নেই। পাশে হাড়গোড় পড়ে আছে। আহারে! বাবুল গোল মুখে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে। ইটুল মন খারাপ করে থাকে। থাক মন খারাপ করে আর কি হবে! তোমার বউ ঠিকই হেফাজতে থাকবে, বাবুল অভয় দান করে। এতক্ষণে তারা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। বাবুলের পাখি হওয়ার ইচ্ছেও উবে গেছে। আচ্ছা ইটুল মানুষ হলে কেমন হয়? এই কথা শোনার পর ইটুল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। তুমি হবে মানুষ! তুমি তো একটা হাঁড়ির পুতুল। এই বলে আবারও হাসা শুরু করে। আমিতো এতদিন তোমাকে মানুষই মনে করতাম। সারাদিন দু'হাত তুলে ক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকো। তোমার ভয়ে আমরা তোমার ধারে কাছে ঘেঁষি না। তা বলো কি জন্য এই মতিভ্রম হলো তোমার? বাবুল কিছুক্ষণ নীরব থাকে। আমতা আমতা করে বলে, ঐ যে এই গাঁয়ে একটা মেয়ে আছে না! সুন্দর পদ্ম রঙা। মাথার চুল বেনী করে চারিদিকে টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। ইটুলের মুখে হাসি খেলে যায়। হ্যাঁ, আমিতো ওকে অনেক দেখেছি। কাজলাপুকুরে প্রায়ই স্নান করতে যায়। সারা শরীর ঘঁষে ঘঁষে পরিস্কার করে। ছোট্ট পাখিটার এই কথায় বাবুলের লজ্জা লাগে। কিন্তু খোঁজ খবর জানার জন্য ব্যাকুল হয়। তাহলে তো তুমি ওকে ভাল করেই চিনো। চিনি মানে! ইটুল মুখে গম্ভীর ভাব আনার চেষ্ঠা করে। ওর নাম বাপের নাম সবই জানি। তাহলে তাড়াতাড়ি বলোনা! ওর নাম আয়না। নাম শুনে বাবুলের মনে রোমান্টিক অভিব্যক্তি খেলে যায়। কিন্তু চোখ মুখ নাক সব অচল হওয়ায় সেটা বুঝা যায় না। তুমি বুঝি ওর প্রেমে পড়ে গেছো? বাবুল কিছু বলে না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস গোল মুখ ফুঁড়ে বের হয়ে আসে। কিন্তু...। না থাক। একটা কথা বলতে গিয়ে ইটুল থেমে যায়। একটু চিন্তা করে কথা অন্য দিকে ঘুরায়। তুমি বরং স্রষ্টার কাছে ফরিয়াদ করো জেনো শীঘ্রই মানুষ হতে পারো। আমি সত্যি মানুষ হতে পারবো তো! বাবুল বিস্ময় প্রকাশ করে। ইটুল কাঁধ চাপড়ে অভয় দান করে। এতে বাবুল অনেক ভরসা পায়। স্রষ্টার কাছে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ করতে থাকে। চারিদিকে দিনের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। তুমি তাহলে প্রার্থনা করো। একদিন ঠিকই মানুষ হতে পারবে। এই বলে ইটুল বাবুলের কাছ থেকে বিদায় নেয়। যাও বন্ধু মানুষ হলে তোমার উপকার করার চেষ্ঠা করবো। দু'হাতে তোমাকে, বিটুলীকে, তোমার ছানাদের শুধুই মাছ আর মাছ খাওয়াবো। ইটুল ফুরুত করে তার গন্তব্যের দিকে উড়ে যায়।

সূর্যের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আকাশে পাখিরা ডানা মেলে খাদ্যের সন্ধানে। মানুষ জেগে উঠে ঘুমের কোল থেকে। বাবুল একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে আর স্রষ্ঠার কাছে ফরিয়াদ করে। হে স্রষ্টা! আমাকে মানুষ করে দাও, আমাকে ঐ কৃষক ঘরের বাবুল করে দাও। আমি বাবুল হয়ে বাবুলের বাবা-মার দুঃখ ঘোঁচাবো। আয়নাকে বিয়ে করে এনে সংসার পাতবো। দু'জনে সংসার পেতে পৃথিবীতে সুখে শান্তিতে দিনাতিপাত করবো। এভাবে দিন যায় মাস যায়। দীর্ঘ এক বছর প্রার্থনা করার পর এক পূর্ণিমা রাতে তার দোয়া কবুল হয়। স্রষ্টা তার উপর বেজায় খুশী হোন। দেবদূত পাঠান। দূত এসে বলেন, স্রষ্টা তোমার উপর বেজায় খুশী হয়েছেন। তুমি এখন যা খুশী হতে পারো। তবে সেটা একবারই। এরপর কিছু হতে পারবে না। হতে চাইলেও চরম খেসারত দিতে হবে। বাবুল খানিক চিন্তা করে। বলে ঠিক আছে দেবদূত তুমি আমাকে বাবুল করে দাও। ঠিক কুঁড়ি বছরের বাবুল। এরপর আমি কিছু হতে চাইবো না। দেবদূত তাকে বাঁশ, হাঁড়ি কাপড়ের পুতুল থেকে জলজ্যান্ত মানুষে পরিণত করে দিয়ে চলে যান।

প্রতিদিনের মত আজ সকালেও কৃষক তার ক্ষেতের দিকে দৃষ্টি মেলে। বাবুল কে দেখতে না পেয়ে দ্রুতলয়ে ক্ষেতের মাঝে ছুটে আসে। এসে দেখতে পায় তার সেই হারানো ছেলে বাবুল। ঘুমের ঘোরে শুয়ে আছে। গায়ে সেই কাকতাড়ুয়াকে পড়ানো শার্টটা ঠিকই আছি। কিন্তু বয়সে একটু বাড়ন্ত। কৃষক চিৎকার করে তার বউকে ডাকে। তার চিৎকারে বউ ছুটে আসে। আস্তে আস্তে গ্রামবাসীও ছুটে আসে। এতদিন পর বাবুলকে ফিরে পেয়ে তারা বেজায় খুশী। লোকজনের চিৎকারে বাবুলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনে হয় এক অনন্ত ঘুমের পর সে জেগে উঠেছে। তার প্রচন্ড পিপাসা ও ক্ষুধা লেগে গেছে। সে মিহিকন্ঠে ভাত খাবো। পানি খাবো বলা শুরু করে। সবাই মিলে ধরে তাকে বাড়ীতে নিয়ে যায়।

বাবুল অবিরাম বলে যাচ্ছে, আমি ভাত খাবো। আমি পানি খাবো। তার বাবা-মা তাকে ভাত ও পানি এনে দেয়। সে গোগ্রাসে গিলে। যেন কত দিন কত রাত সে না খেয়ে কাটিয়েছে। প্রায় এক হাঁড়ি ভাত খাওয়ার পর তার ক্ষুধা কিছুটা নিবৃত্ত হয়। ভালভাবে চোখ মেলে চারিদিকে তাকায়। দেখে সারি সারি লোকের ভীরে সব অচেনা মূখ দাঁড়িয়ে। ভীরের মাঝে দূরে দাওয়ার একটা খুঁটিতে ঠেস দেয়া মুখের দিকে চোখ যায়। এই মুখটা তার অনেক চেনা। তার প্রিয় মূখ আয়না। সে লাজুক চোখে বাবুলের দিকে চেয়ে আছে। আর আনমনে দু'বেনী দোলাচ্ছে। লোকজন বাবুলের ফিরে আসা নিয়ে অনেক মুখরোচক রচনা তৈরী করে। আলোচনা করতে করতে যারযার বাড়ীর দিকে ফিরে যায়। আয়না সেই লাজুক দৃষ্টিতেই বাবুলের দিকে চেয়ে আছে। দেখবেই না বা কেন! কত দিন পর তার শৈশবের খেলার সাথী ফিরে এসেছে। তার সাথে ভেট তুলতে গিয়েই তো পুকুরে ডুবে যায় বাবুল।

তার মা বাবুলকে পেয়ে অনেক উচ্ছ্বসিত। হারানো মানিক খুঁজে পেয়ে আজ দিশেহারা। টেঙড়া, শিং মাছের ঝোল দিয়ে মেখে মেখে সে আস্ত তিন প্লেট ভাত খেতে পারতো। বাবুলের মা লোক পাঠিয়ে বাজার থেকে শিং ও টেঙড়া মাছ আনায়। সেটাই এখন মহা আনন্দে রাঁধছে। রান্না ঘর থেকে মা বাবুল ও বাবুল বলে ডাক দেয়। আয়নাকে জলজ্যান্ত মানুষের দৃষ্টিতে দেখতে পেয়ে বাবুলের চোখ ফিরতেই চায় না। বাবুল ও বাবুল তুই এতদিন কই ছিলি বাবা! মা রান্না ঘর থেকে বের হতে উদ্যত হলে আয়না নিরুপায় হয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।

বাবুল ফিরে আসার কয়েক মাস হয়েছে। কিন্তু হারানো বাবুল আর ফিরে আসা বাবুলের মধ্যে তার বাবা মা বেশ বড় একটা ফারাক বুঝতে পারে। আগের বাবুল বেশ উদ্যোমী ছিল। কাজে কামে বেশ চটপটে ভাব ছিল। যে কোন কাজের কথা বললেই সে মুহূর্তে ছুটে যেত। এখন দেখে বেশ অলস হয়ে গেছে। কোন কাজে আর আগ্রহ নেই। শুধু এক দৃষ্টিতে এক দিকে চেয়ে থাকে। আর খাই খাই করে। দিনে চার পাঁচ বার ভাত খেয়েও তার ক্ষুধা মিটে না। আয়না বাড়ীতে এলেই কিছুটা চঞ্চল হয়ে পড়ে।

বয়স বেড়ে গেছে বলে হয়ত এরকম মতিগতি। তার বাবা-মা ছেলেকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। ছেলের ভাবভঙ্গীমা দেখে বুঝতে পারে আয়নাই হতে পারে ছেলের যোগ্য বউ। আয়নার সাথেই তার বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। তারা আয়নার বাবা-মাকে বলে কয়ে রাজী করায়। একদিন উপযুক্ত দিনক্ষণ দেখে আয়না আর বাবুলের বিয়ে হয়ে যায়।

বিয়ের পর প্রথম প্রথম দু'জনেই বেশ খুশী। সুন্দর করে হেসে খেলে দিন যাচ্ছিল। কিছুদিন পর সংসারে গোলযোগ শুরু হয়। বাবুল শুধু খাবো খাবো করে। কিন্তু কাজকাম আয় রোজগারের কোন বালাই নেই। এভাবে শুয়ে বসে খেয়ে কখনো সংসার হয়না। রাজার ভান্ডারেও কুলাবে না। আয়না কথায় কথায় বাবুলকে বিভিন্ন খোঁটা দেয়া শুরু করে। বাবুলেরও এসব সাংসারিক কাজ কাম ভাল লাগে না। সারাদিন এটা করো। ওটা করো। মাঠে যাও। হালচাষ করো। বাজার করো। খাও দাও নাও। এসব ভেবে সে মন খারাপ করে ঘরের কোনায় বসে থাকে। বউ আর এক দিকে ঘরের খুঁটি ধরে কাঁদতে থাকে। প্রায়ই এই দৃশ্য দেখা যায়। বাবুল বড্ড একঘেয়ে হয়ে যায়। আগের জনমেই তো ভাল ছিল। কোন নাওয়া খাওয়া ছিল না। কোন কাজ কাম ছিল না। সারাদিন শুধু এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকো।

বাবুল একদিন মন খারাপ করে কাজলাপুকুর পাড়ে গিয়ে বসে পড়লো। সেখানে গাছের ডালে ইটুল বসে ছিল। বাবুল কে দেখে উড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তত হলে বাবুল ডাক দেয়। এই ডাকে ইটুল নড়েচড়ে বসলো। সে পিটপিট করে বিস্ময়ে বাবুলের দিকে চেয়ে আছে। নিশ্চয়ই তুমি সেই ক্ষেতের পুতুল বাবুল। হ্যাঁ আমি সেই বাবুল। জানো, আমি এই পথে আসা যাওয়ার সময় তোমাকে অনেক খুঁজেছি। যাক সৃষ্টিকর্তা তোমার প্রার্থনা কবুল করেছেন। তুমি সুন্দর একটা মানুষ হয়েছো। কন্ঠটা কিছুটা পরির্বতন হয়েছে। ছোট্ট ইটুলের কন্ঠে কিছুটা কৌতুক খেলে গেল। হ্যা বন্ধু, আমিই সেই হতভাগা বাবুল। হতভাগা বলছো কেন? না মানে সেই ইতিহাস পরে বলবো। এখন তোমার অবস্থা কি বলো। আমার অবস্থা ভাল। আমাদের সেই ছানা দুটি বড় হয়ে গেছে। তারা আলাদা সংসার পেতেছে। আমরা দুজন বেশ সুখেই আছি বলা যায়। নতুন করে আর একজোড়া সুন্দর মিষ্টি ছানা ফুটেছে। বাহ ইটুল। তোমার সুখের খবর শুনে খুব খুশী হলাম। কিন্তু আমার অবস্থা তো বেহাল বন্ধু। তোমার অবস্থা বেহাল হলে আমি কি করবো। তোমাকে তখনই নিষেধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার মনের অবস্থার কথা শুনে আর বলার ইচ্ছে হয়নি। তুমি তখনই নিষেধ করলে আমার জন্য অনেক উপকার হতো ইটুল। আজ মানব জন্ম নিয়ে এতটা লাঞ্ছনা গঞ্জনা পোহাতে হতো না। এখানে সমাজে টিকতে হলে তোমাদের চাইতে আরও বড় ঝড় মোকাবেলা করতে হয়। প্রতিনিয়ত কাজ করো। আর খাও। এই খাওয়া দাওয়া নাওয়া নিয়েই জীবন পার। সাথে সমাজের সবার খোঁটা। বাবা-মায়ের খোঁটা। বউয়ের কাঁন্না। এখানে বাঁচতে হলে এত যুদ্ধ করতে হয়। আগে জানা ছিল না। সেই জন্যই তো তোমাকে নিষেধ করতে চেয়েছিলাম। বলে, বিজ্ঞের মত মাথা ঝাকায় ইটুল। আমার মাছ দাও। দু'হাত ভরা মাছ দাও বলে সে মসকরা শুরু করে। বাবুলের দুঃখ যেন আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়। সে ভেউভেউ করে আকাশ বাতাস ভারী করে কাঁদতে থাকে। বাবুলের দুঃখে সমব্যথী হয়ে কিছুটা সান্তনা দেয়ার চেষ্ঠা করে ইটুল। এখন কি করবে বলো বাবুল? আমার তো এত কাজ ভাল লাগে না। তার চাইতে ঐ কাকতাড়ুয়া হিসেবেই ভাল ছিলাম। কোন নাওয়া খাওয়া নেই। কাজ কাম ঘুম নেই। মুখ হা করে সামনের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকো। ইটুল তার মনের দুঃখ বুঝতে পারে। হাজার হোক কোন অকর্মণ্য লোক দিয়ে জাগতিক সংসার হয়না। এখানে কাজ না জানলে কোন খাদ্য নেই। কোন পানীয় নেই। জড়ের মত স্থবির হয়ে পড়ে থাকার চেয়ে কাকতাড়ুয়া হয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়েও থাকাও অনেক কাজের। এসব কথা চিন্তা করে ইটুল তাকে আবার কাকতাড়ুয়া হওয়ার পরামর্শ দেয়। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতে বলে বিদায় নেয়।

সেই রাত্রেই বাবুল ক্ষেতের মাঝখানে গিয়ে বসে পড়লো। ক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে থাকলো, হে স্রষ্টা তুমি আমাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নাও। আমার আর মানব জীবন ভাল লাগছে না। এখানে শুধু কাজ আর কাজ। তার চাইতে আমার আগের কাজই ভাল। আমি কাকতাড়ুয়া রুপে ক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে দুনিয়ার সব দৃশ্য দেখবো। আমাকে দেখে পাখিরা দূরে দূরে থাকবে। আমি দূর থেকেই তাদের আকাশে ডানা মেলা দেখবো। একটা জড় বস্তু হিসেবেই কাকতাড়ুয়া হিসেবেই আমি পৃথিবীতে থাকতে চাই। সৃষ্টিকর্তা আগেরবার এক বছরে তার প্রার্থনা কবুল করেছিলেন। এবার এক দিনেই কবুল করে নিলেন। সাথে সাথে দেবদূত পাঠিয়ে দিলেন। অমাবস্যার রাতের মত এক অন্ধকার ধেয়ে আসলো পৃথিবীতে, সাথে ঝড়ো হাওয়া। সেই অন্ধকার আর ঝড়ো হাওয়ার নিচে হাত পা ভেঙ্গে পড়ে থাকলো বাবুল। আজকের কাকতাড়ুয়া।

ছবিঃ এডব ফটোশপে তৈরী।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৪:৪২
৫৮টি মন্তব্য ৫৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×