রমিজ মিঞা এই শহরে নতুন এসেছে। শহরের হালহকিকতে কেতাদূরস্ত হতে খানিক সময় লাগবে। জীবনের এতগুলো বছর গ্রামে কাটানোর পর হঠাৎ শহুরে হাওয়া কখনো স্বাস্থ্যকর হয়না। তার ক্ষেত্রেও তাই হলো। শহরে আসার আগে বউয়ের শেষ সম্বলটা বিক্রি করে এসেছে। মূলত বাঁধা দেয়ার মত কেউ ছিলনা বলে প্রাচীন সেই গাভীটি বিক্রি করতে পেরেছে। বাঁধা দিবেই বা কে? গত মাসেই তো তার তিন বাচ্চার মা আদরের সোহাগী বেগম ওপাড়ে চলে গেল। গরীবরা পটল তুলে। মহামান্যরা ইহলোক ছেড়ে স্বর্গের পথে পা বাড়ায়। সোহাগী বেগমের ক্ষেত্রে পটল তুললো বলাটাই শ্রেয়তর। যদিও পটল তুলতে গিয়ে মারা যায়নি। অভাব তাদের সংসারের নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। ভিটে মাটির জমিটুকু ছাড়া ফসল ফলানোর মত সামান্য কয়েক শতাংশ জমি ছিল। শীতকাল হলে ভিটের মাটিতেই হরেক শাক সবজী ফলে। অন্য সময় ভিটে মাটির আনাচে কানাচে যৎসামান্য আগাছামত শাক জন্মাতো। তাই দিয়ে তারা প্রতিদিন কাঁকর ভর্তি মোটা চালের ভাত গলায় ঢালতো। এক বেলা অন্ন জুটলে আর এক বেলা গ্রামের নির্মল বায়ুই তাদের খাদ্য হতো। সেই আগাছা টাইপের শুশনি শাক তুলতে গিয়েই এক জাত সাপের কামড়ে সোহাগী বেগম পটল তুলে। নামটা যদিও সোহাগী। স্বামী সোহাগ, প্রকৃতি সোহাগ কখনো পেয়েছে কিনা তার তিন কুলে কেউ বলতে পারবে না। সেই জাত সাপ এমন সোহাগ করলো সোহাগী বেগম ঐ পাড়ে যেন কিছুটা তড়িৎ গতিতে চলে গেল। পোড়া পৃথিবীর হাত থেকে আরও ঝলসানোর আগেই চলে গিয়ে এক প্রকার বেঁচেই গেল। তার চলে যাওয়ায় সংসারে যা অভাব অভিযোগ ছিল তা আরো বেড়ে গেল। গ্রামে এখন কাজ কামে বন্ধ্যা মৌসুম। সন্তানদের নিয়ে দু'বেলা খেয়ে পড়ে বাচা দায়। শহরে গেলে ভাগ্যের উন্নয়ন হবে এই বিশ্বাসে গাভীটি বেচে সে শহর অভিমুখে রওয়ানা হলো।
রমিজ মিঞা শহরে এসে প্রথম কয়েকদিন রফিক মিঞার বাসায় অবস্থান করে। রফিক মিঞা রমিজ মিঞার পাড়াতো ভাই। সে পাঁচ বছর আগে শহরে এসেছে। শহরের এক চৌরাস্তার মোড়ে পান সিগারেটের দোকান করে। দোকান থেকে যা রোজগার হয় তা থেকে কিছু কালা নান্টুকে দেয়। বাকীটা দিয়ে টেনে টুনে সংসার চালায়। কালা নান্টু ঐ জায়গায় দোকান বসিয়ে বলেছিল আজকে থেকে এই জায়গা তোর নামে বরাদ্দ। চাইলেও কোন বান্দির পো কোনদিন তোরে উঠাইতে পারবো না। বিনিময়ে প্রতিদিন একশ কৈরা টেকা দিবি। নাইলে পরের দিন থিকা এই দোকান অন্য কোন দোকানদারের হবে। তখন হারাদিন কাইন্দা কাইট্টা মরলেও জায়গা ফিরায় পাবি না। জে আচ্ছা নান্টু ভাই। আপনে না থাকলে কি আমরা এই শহরে আয় রোজকার কৈরা খাইতে পারতাম, রফিক মিঞা এই বলে সায় দেয়। কালা নান্টু তার কাঁধ চাপড়িয়ে অভয় দান করে চলে যায়। এই দোকান করে রফিক মিঞা বস্তির এক ঝোপড়া ঘরে থাকে। সাথে দুইটা পিঠাপিঠি বাচ্চা আর বউ থাকে।
রমিজ মিঞা সাধ্যের মধ্যে কয়েক দিন কাজের খোঁজ খবর নিলো। গ্রাম্য চাষাকে সেধে কে আর কাজ দিবে। যেটুকু কাজ আছে তাও আবার ইট সিমেন্ট টানাটানি। এই বয়সে এত ভারী কাজ তার শরীরে কুলাবে না। এদিকে কদ্দিন আর কাম কাজ না করে বসে থাকা যায়। তার শরীরটা ম্যাজম্যাজ করতেছে। সেই সাথে কোমড়ে বাত ধরার জোগাড়। রফিক কে বলে কয়ে একটা ভ্যানের ব্যবস্থা করে। সেই ভ্যানে শাক সবজি চাপিয়ে বাসা বাড়িতে ফেরী করা শুরু করে।
আজ ভ্যান নিয়ে কিছুটা ক্লান্ত ভঙ্গীতে শহরের এক বড় রাস্তা ধরে যাচ্ছিল। শহরে আসার পর শরীরটা তার বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। সর্দি জ্বর লেগেই আছে। শরীরের অবস্থা কাহিল। হাঁটতে গেলে পড়ে যাবে এরকম দশা। বের না হলে আর এক মুছিবত। গতরখাটা মানুষের কি আর বসে থাকার সময় আছে। সন্তানদের রেখে এসেছে বাড়ীতে। তাদেরকে দেখাশোনার জন্য কিছুদিনের কথা বলে বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে এসেছে। গরুটা বেচে যা টাকা পেয়েছিল তা দিয়ে কিছু ঋণ শোধ করেছে। বাকীটা থেকে কিছু শাশুড়ীর হাতে গছিয়ে দিয়ে মাস খানেক চলার কথা বলে এসেছে। পরের মাসেই কিছু টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা। প্রায় মাস খানেক হলো এখানে আসার। বাচ্চাদের কথা মনে পড়ে রমিজ মিঞার চোখে জল এসে গেল।
কারওয়ান বাজার থেকে কিছুটা সস্তা দরে শাক সবজী কিনে ভ্যান ভর্তি করেছিল। তাই নিয়ে কোনরকম রাস্তার বাম পাশ দিয়ে হেলে দুলে যাচ্ছিল। রাস্তায় গাড়ীর এমন বহর যে তা ঠেলে সামনে এগোনো যাচ্ছে না। তার উপর নগর উন্নয়নের অংশ হিসেবে রাস্তায় খোড়াখুড়ি চলছে মহাসমারোহে। এজন্য রাস্তা অনেকটা সংকুচিত হয়ে এসেছে। শহরের এই মহা উন্নয়ন কবে সমাপ্ত হবে তা নগরবাসী জানেনা। রমিজ মিঞা তো আরও দূরের কথা। রাস্তায় মরুভূমির মত ধূলা বালির রাজ্য। এই রাজ্যে যাবতীয় রোগবালাই উড়ে বেড়াচ্ছে। বাম দিকের লেন কিছুটা ফাঁকা হওয়ায় একটা বাস পঙ্খীরাজের মত সামনে এগোচ্ছিল। ড্রাইভার ব্রেক করতে করতে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল বাসটা। একটু পরেই এক শোরগোল সৃষ্টি হলো। আশেপাশের লোকজন আতঙ্কিত হলেও একটু পরে অবাক হওয়ার পালা। সেই শোরগোলের মাঝে ভগ্ন ভ্যান ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভ্যানচালক কোথায় হাওয়া হয়ে গেল?
এর মধ্যে দায়িত্বপরায়ন লোকজন ড্রাইভারকে ধরে ফেলেছে। পেটেভাতে বেঁচে থাকা মানুষগুলো উপলক্ষ্য পেলেই হলো। পুলিশ আসার আগেই তারা ড্রাইভারকে দু'চারটা কিল থাপ্পর বসিয়ে দিয়ে বাস চালানোর লাইসেন্স দিয়ে দিলো। একটু পরে কালো সানগ্লাস পড়া পুলিশ এসে গেল। তার হাতে ড্রাইভারকে সোপর্দ করে তারা যেন কিছুটা উদ্ধার পেল। পুলিশ বাস ড্রাইভারের শার্টের কলার ধরে গুঢ় শলাপরামর্শের জন্য এক গলিতে হেচড়াতে হেচড়াতে নিয়ে গেল। এ সমস্ত লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের কারণে রাস্তায় একসিডেন্ট বেড়ে গেছে, এ বিষয়ক আলোচনা প্রসব করতে করতে যে যার কর্ম উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। কিন্তু ভ্যানচালক কোথায় সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভ্রুক্ষেপ নেই বললে হবে না। একজন শুধু ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। তার কথায় বাকীরাও তটস্থ হলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না। তারা লোকটির কোন প্রকার হদিস পেল না। ইতোমধ্যে শহরের উদ্ধারকারী দল এসে গেছে। তারাও অনেক খোঁজাখুজি করে বিফল হয়ে গেল।
বাসের ধাক্কায় রমিজ মিঞা ছিটকে গিয়ে রাস্তার পাশে থাকা স্যুয়ারেজ লাইনের ম্যানহোল গলে ভিতরে ঢুকে যায়। ম্যানহোলের ঢাকনা ছিল না। তাই অস্থিচর্মসার রমিজ অনায়াসে ম্যানহোলে ঢুকে পড়ে। শহরের দামী বাবু হলে মোটা পশ্চাদ পেট আটকা পড়ে যেত। রমিজ পানিতে পড়ে কয়েক ঢোক পানি গিলে ফেলে। এরপর ভুস করে ভেসে উঠে। গ্রামের মানুষ। খালে বিলে সাঁতরিয়ে মানুষ। তাই ভেসে উঠতে সময় লাগেনি। বর্ষাকাল বলে লাইনে পানির গতি বেড়ে গেছে। ম্যানহোলের কাছাকাছি আঁকড়ে ধরার মত তেমন কিছু পায়নি। বাধ্য হয়েই পানির গতিতে চলতে হচ্ছে তাকে। চারিদিকে অন্ধকার রাজ্য। এই অন্ধকার ফুঁড়ে তার বাচ্চাদের কথা মনে পড়ছে। আর এক দিকে তার বউ যেন আকুল হয়ে তাকে ডাকছে। অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে দমবন্ধ করা পুঁতিগন্ধ। ঘন্টাখানেকের মধ্যে তার প্রাণ বায়ু ফুরিয়ে যায়।
পরের দিন কয়েক কিলোমিটার দূরে স্যুয়ারেজ লাইনের এক খোলা জায়গা থেকে রমিজ মিঞার লাশ উদ্ধার হলো। লাশ তোলার সময় লাশের পচ্ছাদ্দেশে একটা ছোট বাঁশের টুকরা আটকে থাকতে দেখা গেল। হয়ত ম্যানহোলে পড়ার সময় লাইন মেরামতের স্থান থেকে ঢুকে গেছে। উদ্ধারকারী দলের প্রধান দম্ভের সাথে স্বগতোক্তি প্রকাশ করলো, আমরা আপ্রাণ চেষ্ঠা করেছি বলে একদিনের ভেতর দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে পেরেছি। তা না হলে লাশ পঁচে গলে যেত। নাড়ী ভুড়িও খুঁজে পাওয়া যেত না।
পরের দিন পেপারে ফলাও করে প্রচার করা হলো। মানিকনগর এলাকায় পূর্ব শক্রতার জের ধরে এক ব্যক্তির পশ্চাদ্দেশে বাঁশ ঢুকিয়ে বলাৎকার করে মেরে ফেলা হয়। সরকারী দল প্রধান দাবী করেন দেশ যখন সমৃদ্ধির জোয়ারে ভাসছে তখন আমাদের এক নিষ্ঠাবান কর্মীকে বাঁশ দিয়ে মেরে স্যুয়ারেজ লাইনে ভাসিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসী বিরোধী দল। এরকম শত বাঁশ বা কঞ্চি দিয়ে আমাদের উন্নয়নের জোয়ার কখনো রুখতে পারবেন না। বিরোধী দল দাবী করলো, এই লাশ তাদের এক মেহনতি কর্মীর। এই মেহনতি কর্মীকে বাঁশ দিয়ে মেরে ফেলে সরকার আবারও প্রমাণ করলো তারা দেশ চালাতে অক্ষম। তারা শুধু জনগণকে বাঁশ দিতে পারেন। তারা এখনই এই সরকারের পদত্যাগ দাবী করছেন। নইলে আগামী সপ্তাহে লাগাতার ধর্মঘট শুরু হবে। অনেক কাদা ছোঁড়াছুড়ির পর সরকারী দলের সহায়তায় রমিজ মিঞার লাশ শহরের এক কবরস্থানে সাড়ে তিন হাত মাটি পেল।
ছবিঃ নিজস্ব এ্যালবাম।