রাত ১২ টা বেজে পঁয়ত্রিশ। চায়ের দোকানদার আমার দিকে বিরক্তচোখে তাকিয়ে আছে। আমি ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। আমার কোন তাড়া নেই। কিন্তু লোকটির ঘুমনোর সময় হয়েছে। কেতলির তলানির শেষ পাতিটুকু ফেলে দেবার আগমূহুর্তে চা চেয়ে বসায় না করতে পারেনি। কিছক্ষণ আগে একশলা বৃষ্টি হয়ে চাঁদের আলো ঝকঝক করছে। ট্রেন থেকে নেমে ষ্টেশনের বাইরে এসে দেখি রাস্তার মুখে এই একটিমাত্র দোকান খোলা। দোকানের সামনে দিয়ে রাস্তা মোঁচড় খেয়ে মফস্বলের ভেতরে ঢুকে গেছে। পিচঢালা টানা রাস্তা। দুপাশে বাড়িঘর। মাঝে মাঝে বাঁশঝাড়, পুকুর ডোবা, তালগাছ। আমি বড় করে দম নেই। এই সেই জায়গা! মুখে মুখে শুনে এতদিন আসবো জানতাম। আজ চলেই এলাম। বেশ অনেকটা সময় থাকতে হবে। ভাবনাটা মাথায় নিয়ে বেঞ্চে বসে বাঁশের গায়ে হেলান দিয়ে চায়ে চুমুক দেই। মাথার মাঝে নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে।
- কোন বাড়ি যাইবেন?
- আমার উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। চোখবন্ধ করে চায়ে চুমুক দেই।
- ভাইজান কোন বাড়ি যাইবেন?
- উত্তর না দিয়ে বলি একটা টোষ্ট বিস্কুট দেন।
লোকটার চোখে বিরক্তি। বড় হাই তুলে বিস্কুটের বৈয়াম এগিয়ে দেয়। একটা বিস্কুট তুলে নেই। ধীরে ধীরে চায়ে ভিজিয়ে খেতে থাকি। লোকটি তাকিয়ে আছে, এবারের দৃষ্টিটা কিছুটা সন্দেহজনক। আমাকে বোঝার চেষ্টা করছে। মানুষ কোনকিছু বোঝার বা খোঁজার চেষ্টা করলে চোখমুখের ভাঁেজ তা ফুটে ওঠে। আমার সামনের লোকটির এই মূহুর্তে নাকটা ফুলে নাকের ফুটো দুটা কিঞ্চিত বড় হয়ে গেছে। আমার মোবাইল বেজে ওঠে। লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরেসুস্থে মোবাইল বের করি। স্ক্রীনে দুটি অর ভেসে আছে। রিসিভ বাটন প্রেস করে কানে ফোন লাগাই..
- তুমি কোথায়?
- চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি।
- দোকানটা কোথায়?
- ষ্টেশনে ঢোকার মুখে।
- বেশ আগেই চলে এসেছো?
- জ্বী, আসলে ট্রেনে জ্যাম লাগারতো সুযোগ নাই তাই..
- তুমি এ অবস্থায় মজা করতে পারছো!! আমার প্রচন্ড টেনসন হচ্ছে!!
- টেনসন করবেন না। যারা ভয় পায় তারা আগে মরে।
- ওফ.. তুমি এখন কোথায়?
- যেখানে থাকার কথা ছিলো।
ওপাস থেকে খুট করে লাইন কেটে যায়। আমি সামনের টেবিলে মোবাইলটা রাখি। দোকানদারের চোখে সন্দেহজনিত ভয় খেলা করে।
- আপনে আর কিছু খাইবেন?
- একটা বেনসন দাও।
- বেনসন নাই গোল্ডলিফ আছে।
- আমি বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকাই। ঠান্ডাস্বরে বলি। দাও গোল্ডলিফই দাও।
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতর অস্বস্তি ক্রমেই বাড়ছে। আমি সেটা দুর করতে নিজের ভেতর লড়াই করছি। মনে হচ্ছে আমারই সত্তার প্রতিকীরুপ এই দোকানদার। যাকে কোনভাবেই এখন দোকান বন্ধ করতে দেয়া যাবেনা। কারন এখানে আমাকে আরো বেশ কিছুটা সময় পার করতে হবে। এসময়টা এখানে একা একা বসে থাকাটা আমার জন্য বিপদজনক। আশেপাশে একটা কুকুর বিড়ালও চোখে পড়ছে না। এমনিতে ষ্টেশনের আশেপাশে সবসময়ই কিছু না কিছু মানুষ থাকার কথা। এখানে নেই। মনে হচ্ছে সরকার আজ রাতে কার্ফু দিয়েছে। বিষয়টা একদিক দিয়ে ভালো অন্যদিকে আমার জন্য খারাপ। এমনিতে মফস্বল তার উপর রাত বিরাতে কোন সেন্টিমেন্টাল ইস্যু তৈরি হয়ে গেলে জামিন নাই। সিগারেট জ্বালিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ি। লোকটি দোকান থেকে বের হয়ে কেতলি পরিস্কার করে।
- এখানকার মানুষরা কি প্রতিদিন এসময়ই ঘুমায়? প্রশ্নটা করেই কেমন বোকা হয়ে গেলাম ।
- লোকটা কিছুন প্রশ্নবোধক চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে। ধীরে ধীরে বলে এই এলাকায় ডিস এন্টেনার লাইন নাই। নদীর ওপারের লোকজন এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না।
- ও, আমি বোকার মত মাথা নাড়ি।
- আপনারে কি আরেক কাপ রঙ চা দিমু তাইলে পানি বসাই।
- আমি বোকার মত মাথা নাড়ি।
যাহ গনেষ এবার উল্টে গেলো। ব্যাটা নিশ্চয়ই আমাকে এবার আটকাতে চাইছে। চা খাওয়ার তালে রেখে লোকজন ডেকে আনবে। এরপর কিল আর মাটিতে পরবে না। আজকাল দেশের মানুষজন বড়ই অস্থির ডাকাত, ভালোমানুষ যাচাই করারও সময় দেয় না। জোস উঠে গেলে লাশ না দেখা পর্যন্ত মার থামায় না। কিন্তু আমি নিরুপায়, অন্য কোথাও অবস্থান নেয়াটা আমার জন্য আরো বেশি বিপদজনক। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মোবাইলটা বেজে উঠে।
- হ্যালো বলুন।
- শোন ঢাকায় যাবার ট্রেনটা তিনটা বিশে এই ষ্টেশনে পাঁচ মিনিটের জন্য থামে, ওই ট্রেনেই..
- একমিনিট, এটাঁতো বাংলাদেশ। ঠিক তিনটা বিশেই ট্রেনটা আসবে কিনা..?
- তুমি যে দোকানটায় বসে আছো সেখান থেকে পেছনে ষ্টেশন প্লাটফর্মের ডানে তাকাও।
- আমি পেছন ঘুরে ডানে তাকালাম। দোকানদারও আমাকে দেখে মাথা ঘুরিয়ে যতটা চোখ যায় তাকালো।
- তাকিয়েছো?
- জ্বী
- লাইন ওদিক দিয়ে বড় একটা মোড় নিয়েছে। ওখান দিয়ে ট্রেন আসার পাঁচমিনিট আগে তুমি ট্রেনের সিগন্যাল দেখতে পাবে।
- জ্বী, এভরিথিং ইজ কিয়ার।
-তুমি কিছু খেয়েছো?
- জ্বী একটা টোস্ট আর এককাপ চা। আর দোকানদার ভাই মায়া করে এককাপ চা.. খুট করে লাইনটা কেটে গেলো।
দোকানদার আমার দিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে । হাতে রঙ চায়ের কাপ। হাত বাড়িয়ে চা দিতে দিতে বলে
- আপনে রাইত তিনটা পর্যন্ত এইখানে থাকবেন?
- তেমনইতো কথা হলো।
- কন কি? এত রাইতে কি কাম??
আমি ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক দেই। দোকানদার নিরুপায়ের মত আমার উত্তরের অপো করে। একপর্যায় হাল ছেড়ে দিযে বলে ভইজান তড়াতাড়ি চা শেষ করেন। আমি দোকান বন্ধ করুম।
আমি দোকানদারের সাইকোলজি ধরার চেষ্টা করি। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। কারন দোকানে এমন কোন মাল নেই যে ডাকাতি হতে পারে। তবে আমার মোবাইলে কথা বলার ধরনে সে শংকিত হতে পারে। আমিও কথা বলার সময় মাথায় রেখেছি যাতে আমার কথা বাইরের কেউ হঠাৎ বুঝতে না পারে। প্রথম থেকেই আমার ব্যাপারে তার কৌতুহল কাজ করছে। লোকটির সন্ধানি চোখ আর আমার কথা বলার সময় বার বার কান আগিয়ে কথা শোনার চেষ্টা তাই প্রমান করে। আমার মত অচেনা মানুষের কারনে ব্যাটা এরাতে ঝামেলায় পড়ার ভয় পাচ্ছে। আমি চা শেষ করে কাপ নামিয়ে সরাসরি লোকটির চোখের দিকে তাকালাম।
- আপনেতো এখন দোকান বন্ধ করতে পারবেন না।
- দোকানদার ঢোক গিলে, মাইনে?
- মানে হলো রাত তিনটায় এখানে একটা ঘটনা ঘটবে, তার সাক্ষী হবেন আপনি।
- লোকটি কিছুন হা করে তাকিয়ে থেকে বলে কী ঘটনা!!
- সেটাতো এখন বলা যাবেনা। ঠান্ডা স্বরে বলি একটা গোল্ডলিফ দাও।
আমার কখনো আপনি কখনো তুমি বলার ধরনে লোকটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভয় মাখানো চোখে গোল্ডলিফ এগিয়ে দেয়।
- ভাইজান কি পুলিশের লোক?
- মনে কর তাই।
লোকটির চোখেমুখে আশার আলো ফূটে । যাক তাইলে তেমন ভয়ের কিছূ নাই।
- ভাইজান.. থুককু স্যার আমি কি যায়ে গ্রামের লোকজন ডাইকে নিয়ে আসবো।
- আমার টেনসনে আত্নারাম খাঁচাছাড়া, বলে কি!! এতো খাল কেটে পিরানহা নিয়ে আসার মতো অবস্থা। আমি বলি কেন!!
- মাইনে আপনার যদি দরকার পড়ে, আপনে একা মানুষ তাই।
- কোন দরকার নাই, আমি এখানে যে কাজটা নিয়ে এসেছি সেটা আমাকে একাই করতে হবে।
- স্যার..
- আমি বিরক্ত চোখে তাকাই
- আমার কি সাক্ষী না দিলে হয়না। গরিব মানুষ এমনিতেই নানান ঝামেলায় থাকি।
- তোমার এত কিছু চিন্তা করতে হবেনা। তোমার কিছু হবে না।
লোকটি যেন একটু স্বস্তি পায়। তার চেয়েও বেশি স্বস্তি পাই আমি। যাক আপাতত সময় কাটানোর একটা ব্যবস্থা হলো। ঘড়িতে দুটা বেজে পঁয়ত্রিশ। সময় এগিয়ে আসছে। আমি আমার চিন্তায় ডুবে যাই। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এরপর কি করবো? এখান থেকে ঢাকায় পৌঁছালে অন্য জীবন। কেমন হবে সে জীবন? নিজেকে প্রশ্ন করি কাজটা কি আমি ঠিক করছি ? পরমূহুর্তে নিজেকে ধিক্কার দেই, শেষ সময়ে এসে এটা কি ধরনের প্রশ্ন? সিদ্ধান্তটা আমি অনেক ভেবেচিন্তে নিয়েছি। এখন আর পিছিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই। আমি জানি আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেইনি। এভাবে নিজের ভেতর বোঝাপড়া চলতে থাকে। দোকানদার বাঁশে হেলান দিয়ে ঘূমায়। কিছুন পরপর চমকে উঠে আমাকে ল্য করে। আমি একটার পর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিজের ফুসফুসটা কালো করি। পূবদিকে চাঁদটা ধীরে ধীরে ঢলে পড়ে ঝাপসা থেকে আরো ঝাপসা হয়। আমি প্রহর গুনি আর স্বপ্ন সাজাই।
এভাবে কতক্ষণ কেটে যায় ঠিক খেয়াল নেই। দোকানদারের হেলান দেয়া বাঁশের সাথে মাথা ঠূকে যাবার শব্দে চমকে উঠি। ব্যাটা মাথায় হাত ঘষে বিড়বিড় করে। মনে হয় আমাকেই কোন অভিশাপ দেয়। বেচারার জন্য মায়াই লাগে। রাতের ঘুমটা হারাম করে দিলাম। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাই। তিনটা পনেরো! সময় চলে এসেছে। আমার ভেতর টেনসন বাড়তে থাকে! সবকিছু ঠিক থাকবেতো। এদিক ওদিক তাকাই। চারিদিক সুনসান। প্রচন্ড পানি পিপাসা পায়। দোকান থেকে জগ, গ্লাস নিয়ে পানি ঢালি। চেয়ে দেখি দোকানদার গুটিসুটি মেরে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। আমি ঢকঢক করে পানি খেয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখি। ঠিক তখনই ষ্টেসন প্লাটফর্মের ডানদিক বরাবর অনেক দুরে ছোট একটা আলোর বিন্দু দেখতে পাই। ট্রেন চলে এসেছে!! আমি স্থীর হয়ে বেঞ্চে বসি। আলোটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়। আমি একবার রাস্তার দিকে একবার আলোর দিকে তাকাই। এর মধ্যেই পকেটে হাত দেই। আমার পকেটে হাত দেয়া দেখে দোকানদার জড়সড় হয়ে দোকানের আরো ভেতরে ঢুকে যেতে চায়। লোকটার দুচোখে প্রচন্ড আতংক। আমি বলি
- ভাই আপনার টাকা রাখেন।
- টাকা..!!
- হ্যা টাকা রাখেন জলদি করেন।
- টাকা লগবো না স্যার। আপনে যে আমার দোকানে মেহেরবানি করে বসছেন, এজন্য শুকর আলহামদুলিল্লাহ।
আমি কড়া ধমক লাগাই। লোকটা জড়সড় হয়ে টাকা নেয়। এই টেনসনের মধ্যেও লোকটির জন্য আমার মায়া লাগে। বেচারা আমার অনেক উপকার করলো। কিন্তু এখনওতো শেষ হয়নি। ট্রেনের আলো জোড়দার হয়। আসেনা কেন? ঘড়ির দিকে তাকাই। তিনটা বেজে আঠারো। ট্রেন ষ্টেসনে ঢুকে পড়ে। আমি ঘন ঘন রাস্তার দিকে তাকাই। প্লাটফর্ম থেকে মানুষের গলার স্বর ভেসে আসে। উত্তেজনায় দোকানের ভেতরে তাকাই, ভদ্রলোক শরীরটাকে কাঁথার মাঝে মুড়ে শুধুমাত্র চোখদুটো খোলা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার হার্টবিট বেড়ে যায়, তবে কি আসবে না। নিজের ভেতর রাগ দুঃখ হতাশা, মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে। প্লাটফর্ম থেকে লোকজন বের হয়ে যে যার মত চলে যেতে থাকে। উত্তেজনায় আমার দুহাত মুঠিবদ্ধ হয়ে আসে। আমি পায়চারি করি। হঠাৎ গুনগুন শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দোকানদার চোখ বুজে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে। আমার ভেতর একধরনের শূন্যতা তৈরি হতে থাকে। আমি সারারাতের কান্ত অবসন্ন চোখ মেলে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকি। নিজেকে মনে হয় সময়, কাল, মুহূর্তের গোলকধাঁধার আবর্তে পথভ্রষ্ঠ পথচারি। আমি স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকি। ট্রেনের শেষ হুইসেল বেজে ওঠে। শব্দটা যেন আমার শিরা উপশিরা, ধমনি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চোখদুটোতে জ্বলুনি হয়। সামনের রাস্তটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। আমি আশার আলোর শেষ বিন্দুটাকে মুছে যেতে দেখে ঘাড় ঘুরাতে যাবো, ঠিক তখনই ওকে দেখতে পাই। নীল শাড়ি পরনে ডান হাতে স্যুটকেস ঝুলিয়ে দেৌড়ে আসছে নিশি। ও এসে আমার হাত ধরে।
- চলো। ঘুরে দোকানদারকে বলে, মামা সকালে একটু কষ্ট করে বাসায় জানিয়ে দিও আমি আমার জামাইয়ের সাথে ঢাকায় চলে গেছি।
আমাদের সাক্ষী দোকানদার বোকার মতো মাথা নাড়ে। আমরা দ্রুত ষ্টেসনে ঢুকে পড়ি। ট্রেনটা দুলতে শুরু করেছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দেই। নিশি আমার হাতটা ধরে চোখের দিকে তাকায়। ওর চোখ ভরা উপচে পড়া ভালোবাসায় ছোট প্লাটফর্মটা ভেসে যেতে থাকে। ঠিক তখনই জীবনের টার্নিং পয়েন্ট থেকে চলতে শুরু করে আমাদের ট্রেন।