আমি কানাডায় নিজের মা বাবার সাথে আসি কিশোরি বয়সে। আজকে কেন যেন আপনাদের সাথে প্রথম দিনের স্কুলের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ইচ্ছা করল। আমার জন্ম ঢাকায় হলেও বাবার চাকরির সুবাদে মফস্বল শহরে থাকতাম, বাংলা মিডিয়ামে, দুই বেণী করে, নীল সাদা ইউনিফর্মে স্কুলে যেতাম। ঢাকার কিছু মেয়েরা ব্যাকডেটেড, আনস্মার্ট যাকে বলে একদম তাই ছিলাম। সেই আমাকে এনে ফেলে দেওয়া হলো কানাডার মতো দেশে। যে আমি ঢাকায় ওড়না ছাড়া মেয়ে দেখলে হা হয়ে যেতাম, সেই আমি কিনা মিনি স্কার্ট, বিকিনির দেশে। ভাবা যায়!!
তো প্রথমদিন স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্যে কাউন্সিলরের সাথে দেখা করতে গেলাম মা বাবার সাথে। আরে বাবস স্কুলে কোন ইউনিফর্ম নেই, মেয়েরা প্রায় অর্ধ উলন্গ। আমি তো শেষ, এই জিনিস যদি আমাকে পড়তে হয়? গ্রেড সেভেন থেকে ওড়না ছাড়া ঘর থেকে বের হতাম না, বান্ধবীরা অনেকে এক কদম এগিয়ে বোরখা পরত। তো অতি সহজেই ভর্তি হওয়ার পরে (কোন admission test না দিয়ে, শুধু দেশের সার্টিফিকেট দেখিয়ে) ভর্তি হলাম। মা কাউন্সিলরকে আমার পরে থাকা সালোয়ার কামিজটা দেখিয়ে বলল, এটা পরে স্কুলে আসতে পারব কিনা। সেদিন রোদ থাকায় জ্যাকেটও পরিনি। তখন কাউন্সিলর হাত নেরে বলল "Absolutely, no problem. প্রায় তিরিশটির বেশি দেশের ছাত্রছাত্রী এখানে পড়ে, কোন সমস্যা নেই।" ওনার কথার ভংগিতে সেদিনকার সেই কিশোরি মেয়েটি যে কি আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলো তা বলে বোঝানো যাবে না। হাই স্কুল শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাকে আগলে রেখেছিলেন। পরে সে কথা বলব।
তো তিনি আমাকে কোর্সও ঠিক করে দিলেন। ওখানে দুই সেমিস্টারে চারটা করে মাত্র আটটা কোর্স। বাংলাদেশে যেখানে একসাথে দশ বারোটা কোর্স সেখানে মাত্র চারটা কোর্স। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাশে। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম নিজের ভাষায় বারোটা কোর্সও কিছু না, অন্য ভাষায় অন্য দেশে চারটা কোর্সই কঠিন।
তারপরে কাউন্সিলর আমাকে পুরো স্কুল ঘুরে দেখালেন। ওখানে বিভিন্ন ওয়ালে অন্য ভাষায় স্বাগতম লেখা থাকত। তো ইন্ডিয়ার আকা পতাকার ওপর হিন্দিতে স্বাগতম লেখা, আমার কাউন্সিলার জানতে চাইলেন আমি সেটা পরতে পারি কি না। তিনি ভেবেছিলেন বাংলাদেশ আর ভারতের ভাষাগত মিল থাকতে পারে। আমি না বললাম। আর বললাম আমার ভাষা বাংলা। তিনি আমার অনাগ্রহ দেখে ইন্ডিয়া বিষয়ক আর কোন কথা বললেন না। বাংলাদেশ যে পাকিস্তান অথবা ভারত না (আর কখনও হওয়ার ইচ্ছাও নেই) সেটা আজ পর্যন্ত অনেককে বুঝিয়েছি। বোঝানোর সহজ উপায় হলো আমেরিকা। কানাডিয়ানরা সবসময় বলে আমরা আমেরিকার থেকে আলাদা, বেটার এই সেই। তো ওদেরকে শুধু এটা বললেই হয় আমেরিকা কানাডা যেমন আলাদা, বাংলাদেশ ভারত তেমন আলাদা। তখন ওরা মাথা ঝাকায় আর ব্যাপারটা বোঝে।
তবে একটা কষ্টের ব্যাপার ছিল যেহেতু খুব ছোট শহর ছিল তাই তেমন বাংলাদেশি ছিল না। আর আমার স্কুলে শুধু আমিই একমাত্র বাংলাদেশি ছিলাম। আমার মতো দেখতে, আমার মতো পোশাকের আর কেউ ছিল না। একদম আউটসাইডার মনে হতো নিজেকে। সেটার সাথে কিভাবে এডজাস্ট করে নিলাম সেটা আরেকদিন লিখব যদি ব্লগাররা জানতে চান।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:৫২