আজ ১৫ই এপ্রিল, ১লা বৈশাখ, শুভ নববর্ষ আর এক বার সবাইকে!
অবাক হবার কিছু নেই, সনাতন পঞ্জিকা মতে আজকে দেশের সকল হিন্দু এবং পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতবাসীর মধ্যে সব বাংলা ভাষা-ভাষিরা পালন করবে ১৪২৪ সনের প্রথম দিন, শুভ পহেলা বৈশাখ, শুভ নববর্ষ । কাজেই সবাইকে আজেকেও শুভ নববর্ষ!!
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ কোটি বাঙ্গালী, যদি বাংলাদেশে ১৬ কোটি হয় বাকি অংশ সারা পৃথিবী জুড়ে। এর মধ্যে আবার ধমীয় ভেদে ভাগ রয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি হিন্দু রয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১০ কোটি জনসংখ্যা (সব ধর্ম মিলে) , এদের শুভ নববর্ষের দিন আজকে। অর্থাৎ ১৫ই এপ্রিল। অনেক বছর এটি আবার একই দিনেও হয় !
পহেলা বৈশাখ কী ১৪ না ১৫ এপ্রিল হবে এ নিয়েও যথেষ্ঠ বিতর্ক আছে।
এরশাদের শাসনামলের পূর্বে পঞ্জিকা মতে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গসহ সারাবিশ্বের বাঙালিরা ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করে থাকত। এরশাদ আমল থেকে সরকারিভাবে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। ক্যালেন্ডারের হেরফেরে কখনো ১৪ এপ্রিল বা কখনো ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিন ঠিক হয়। বাংলাদেশের হিন্দুরা পঞ্জিকা মতে পহেলা বৈশাখ পালন করে থাকেন। পাকিস্তান সরকার ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে দিয়ে গ্রেগারিয়ান ক্যালেন্ডারের আদলে বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক দেয়াল তৈরি করার জন্য। কিন্তু পাকিস্তান আমলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলেও এরশাদ সাহেব বাংলা একাডেমির সহায়তায় তা বাস্তবায়ন করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা বিভক্তি রেখা টেনে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এখন একই দেশে দুদিন পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। ১৪ এপ্রিল হয় সাড়ম্বরে, ১৫ এপ্রিল অনাড়ম্বরে
পহেলা বৈশাখের দিন নির্ণয় ব্যবস্থা (বিস্তারিত)ঃ
সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে- বরাহমিহির ৫৫০ খৃৃষ্টাব্দের দিকে পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার পাঁচটি খণ্ডের নাম সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত ও ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত। এই গ্রন্থটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীন ভারতে দিন, মাস, বৎসর গণনার ক্ষেত্রে 'সূর্যসিদ্ধান্ত' একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে সৌর-মাস নির্ধারিত হয় সূর্যের গতিপথের উপর ভিত্তি করে। তারা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন যার একটি ভাগকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন এক একটি রাশি। আর ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছে রাশিচক্র। এই রাশিগুলোর নাম হলো- মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন। সূর্যের বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য পরিক্রমা অনুসারে, সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন তাকে ‘সংক্রান্তি’ বলা হয়। এই বিচারে এক বছরে ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। এক একটি সংক্রান্তিকে এক একটি মাসের শেষ দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সূর্য্য ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে প্রবেশ করে তার পরদিনই ১ বৈশাখ (পহেলা বৈশাখ) হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সংক্রান্তি হয় তার পরদিনই মাসের প্রথম দিন। মূলত একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর সংক্রান্ত পর্যন্ত সময়কে এক সৌর মাস বলা হয়। লক্ষ্য করা যায় সূর্য পরিক্রমণ অনুসারে সূর্য প্রতিটি রাশি অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। এক্ষেত্রে মাসভেদে সূর্যের একেকটি রাশি অতিক্রম করতে সময় লাগতে পারে ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন। সেই কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন মাসের দিনসংখ্যা সমান হয় না। এই সনাতন বর্ষপঞ্জী অনুসারে বছর ঋতুভিত্তিক থাকে না। একেকটি মাস ক্রমশঃ মূল ঋতু থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে। ভারতে প্রচলিত সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে বঙ্গাব্দের সূর্য যখন মেষ রাশিতে অবস্থান করে তথন হয় বৈশাখ মাস, এই মাসের ব্যপ্তি হতে পারে ৩০ বা ৩১। শকাব্দ এবং বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে। বৈশাখ নামটি এসেছে বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে।
সংস্কারকৃত বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুসারে- বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ সালে। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে এ কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো হতে উত্তরণের প্রস্তাবনা প্রদান করেন। বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের। যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেয়া হয়েছে। এ প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ সেকেন্ড। এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি চার বছরের ফেব্র“য়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয় এবং ঐ বর্ষকে অধিবর্ষ বলা হয়। (ব্যতিক্রম হচ্ছে সে শতাব্দীতে যে শতাব্দীকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না বা বিভাজ্য নয়।) জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই পূর্বে অতিরিক্ত দিনকে আত্মীকরণ করা হয়নি। বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতোই বিভিন্ন পরিসরের ছিল। এই সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে কমিটি বাংলা একাডেমীর কাছে কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করে। সে প্রস্তাব অনুযায়ী বর্তমানে---
সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত পাঁচ মাস প্রতিমাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩০ দিন গণ্য করা হয়।
প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে (গ্রেগরি ক্যালেন্ডারের অধিবর্ষে) অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করা হয় এবং তখন ফাল্গুন মাস হয় ৩১ দিনে।
তাছাড়া পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না সূর্যদোয় থেকে থেকে শুরু এটা নিয়ে অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যদোয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দ অর্থাৎ ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু হয়।
বাংলাদেশে বাংলা একাডেমী কর্তৃক সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করা হয় প্রতি বছরের এপ্রিল ১৪ তারিখে। যদিও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তা উদ্যাপন করা হয় পুরাতন সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে তাই ভারতের বাঙালিরা নতুন বছর উদযাপন করে কখনও এপ্রিল ১৪ আবার কখনও এপ্রিল ১৫ তারিখে।
মাস
সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী-র মাসের নামগুলি প্রচলিত ছিল ফারসি ভাষায়, যথা: ফারওয়াদিন, আর্দি, ভিহিসু, খোরদাদ, তির, আমারদাদ, শাহরিযার, আবান, আযুর, দাই, বহম এবং ইসকান্দা মিজ। বঙ্গাব্দতে যা, বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রাহায়ন, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন এবং চৈত্র।
বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হযেছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ "সূর্যসিদ্ধান্ত" থেকে। বাংলা মাসের এই নামগুলি হচ্ছেঃ
• বৈশাখ - বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• জ্যৈষ্ঠ - জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• আষাঢ় - উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• শ্রাবণ - শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• ভাদ্র -উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• আশ্বিন - অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• কার্তিক - কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• অগ্রহায়ণ - মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• পৌষ - পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• মাঘ - মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• ফাল্গুন - উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
• চৈত্র - চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
দিন
বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই সাত দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এ দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারকামন্ডলীর উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে।
• শনিবার হচ্ছে শনি গ্রহের নাম অনুসারে
• রবিবার হচ্ছে রবি বা সূর্য দেবতার নাম অনুসারে •
• সোমবার হচ্ছে সোম বা শিব দেবতার নাম অনুসারে
• মঙ্গলবার হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের নাম অনুসারে
• বুধবার হচ্ছে বুধ গ্রহের নাম অনুসারে
• বৃহস্পতিবার হচ্ছে বৃহস্পতি গ্রহের নাম অনুসারে
• শুক্রবার হচ্ছে শুক্র গ্রহের নাম অনুসারে
ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলা সনে দিনের শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয়ে।
(তথ্যঃ দৈনিক আমাদের সময় এবং বাংলা উইকিপিডিয়া)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ৭:১৩